সর্বনাশিনী পর্ব-৬

0
2857

#সর্বনাশিনী
#সুরাইয়া সাত্তার ঊর্মি
৬।
দিনটি ছিল শীতকালের শুরু। ধোঁয়া উঠা ভাপা পিঠার স্বাদ আর বাহারি পাখির কিচিরমিচিরে সন্ধ্যার নরম আলোয় এক উৎসব। কুয়াশা ঢাকা শহরটিতে শীতকালীন ফুলের সুবাস ভেসে বেড়ায়। হার কাঁপানো ঠান্ডায় গরম কাপড় গায়েও গরম ভুট্টার স্বাদে ছুটে চলে
কপোত কপোতীরা। এমনি একটি দিনে বাংলার সাজে সজ্জিত হয়ে ছুটে চলছে এক রমণী। হাঁড় কাঁপানো ঠান্ডায় সাদা শাড়িতে জিড়য়ে নিয়েছে নিজেকে। খুব অল্প সাজেই এক ছোট পরি মতো মনে হচ্ছে। গোলাপি ঠোঁটের কোনে আলতো হাসি। থাবেই বা কেনো? আজ স্নেহার মনের মানুষ দেশে ফিরছে। চোখে মুখে আনন্দের ফুলঝুরি। স্নেহা বাতাসের গতিতে এসে দাঁড়ালো বাসার সামনে। ভার্সিটি এক প্রকার দৌড়ে এসেছে, উদ্দেশ্য বাবা-মা বোনের সাথে যাবে এয়ারপোর্টে। স্নেহা হাঁপাতে হাঁপাতে এসে দাঁড়ালো। তালুকদার বাড়ির গাড়িটি ছাড়লো বলেই। স্নেহা কাছে এসে সায়রাকে বলল,

” মা আমাকে নিবে তোমাদের সাথে?”

সায়রা হেসে বলল,

“হ্যাঁ অবশ্যই কেন নিবো না। এয়ারপোর্ট থেকে আমরা একেবারে আমরিন ভিলায় যাবো। পার্টি আছে। ”

স্নেহা হাসলো। দুরুদুরু বুকে গাড়িতে উঠলো। সেহের তখন নাক ছিটকে বলল,

” ছিঃ তুই এসব পড়ে যাবি নাকি পার্টিতে? মান- সম্মান থাকবেতো মা?”

সায়রা ধমকে বললেন,

” বেশি কথা নয়”

সেহের মুখ ভেংচে নিজের ফোনে মন দিলো। এদিকে স্নেহা তার বুকের বাপাশটা চেপে ধরে আছে। দিলশাদকে এক পলক দেখবে ভেবেই হৃদপিণ্ড দ্রুত গতিতে ছুটছে। স্নেহা ভয় পাচ্ছে বুকের এই ধুকপুকানির ওয়াজটা যদি গাড়ির ভিতরে সবাই শুনে ফেলে? আচ্ছা দিলশাদকি তাকে চিনবে? সায়রা যখন স্নেহাকে সেহেরের পুরাতন ফোনটা দিয়েছিলো প্রথমবার ইউস করতে? তখনি সে ফেবু একাউন্ট খুলেছিলো এক বন্ধুর মাধ্যমে। তারপর থেকেই সে সব সময় ঘুরাঘুরি করতো দিলশাদ লিখা আমরিন নামের আইডিটিতে। এক বার দু বার নয় দিনে রাতে অসংখ্যবার। প্রতিটি ছবিতে লাভ রিয়েক্ট ছিলো মাস্ট। তবে দিলশাদ তাকে ফেন্ড লিস্টে কখনো এড করেনি। কিন্তু কেন করেনি? স্নেহার অনেক ইচ্ছে হতো একটি বার “হাই” ” হ্যালো” করতে। ভয় পেতো স্নেহা….! কিন্তু সেহের তালুকদার ঠিকি তার আইডির ফেন্ড লিস্টে জায়গা পেয়েছে। কথা-ও হয়েছে তাদের….! এসব ভেবেই বুকের ভিতরটা ভাড় অনুভব মনে হলো স্নেহার। একটা দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে ঠোঁটের কোনে হাসির রেখে ফুঁটিয়ে আনলো। এত দিন পরে পোড়া মনে একটু ঔষধ লাগবে বোধহয়?

ঘন্টা খানেক পর….

সারি সারি লোকজন বের হচ্ছে। বড় বড় সাইনবোর্ড, ব্যানার টানিয়ে এনেছে আপনজনেরা তাদের দেশ ফিরত আপনজনদের জন্য। তালুকদার পরিবার আর আমরিন পরিবার নিজেরাও সেখানে দাঁড়িয়ে… অধির আগ্রহে বড় বড় চোখ করে এদিক সেদিক তাকাচ্ছে উৎকন্ঠা স্নেহা। ওর ভয় লাগছে। ভয়টি-ও মিষ্টি মনে হচ্ছে। হাত-পা ঘেমে যাচ্ছে। ঘন বড় বেনি করা চুল গুলো ঘুছিয়ে নিচ্ছে। এয়ারপোর্টের বাহিরে থাকা একটি আয়নায় নিজেকে একবার দেখে নিলো স্নেহা। শাড়িটি ঠিক আছে তো? কঁপালের টিপ টা? আর হাতের চুরি? রিনিঝিনি নূপুর? নাহ্ সব ঠিক। যেমনটি দিলশাদ একবার পোষ্ট করেছিলো তার বাঙ্গালি নারী খুব পছন্দ। লিখে ছিলো,

” সারাদিনের অক্লান্ত পরিশ্রমের পর মাথার ঘাম টুকু মুছে দেয়ার জন্য একজন রমণীর শাড়ির আঁচলটা প্রয়োজন”

এই পোষ্টের নিচে তখন হাজারো কমেন্টের ভীড়। দিলশাদ ইউএস থাকাকালীন প্রায় পাঁচ বছর মডেলিং হিসেবে কাজ করেছে তার সাথে খুব সুন্দর গিটারিস্ট সে। গিটারের সুরের সাথে নিজ কয়েকটা গান-ও কমোজ করেছে সে। যার জন্য ফ্যান ফোলোয়িং কমনেই তার। দিলশাদের পোষ্টের নিজে তখন একজন কমেন্ট করেছে,

” আমাদের স্বপ্নের রাজকুমারের বুঝি বাঙ্গালী মেয়ে পছন্দ?”

তার নিচে আরেকজন লিখেছে,

” আমাকে বিয়ে করবে দিল? আমি তোমাকে এত এত ভালোবাসি! ”

তার নিচে বিন্দু লিখেছে,

” বুঝেছি, ছেলের বিয়ের বয়স হয়েগেছে? এবার দেশে আসলেই মিঙ্গেল করে দিবো!”

বিন্দুর কমেন্টের একজন মেয়ে সঙ্গে সঙ্গে তখন রিপ্লাই করলো,

” আন্টি আমি কি আপনার ছেলের বউ হতে পারি?”

বিন্দু রিপ্লাই করলো,

“ওয়েল, তোমাদের দিলশাদ তো ওল রেডি নিজের মানুষ খুঁজে রেখেছে!”

এমন রিপ্লাইতে আরো আরো কমেন্ট মুহুর্তেই ভরে গেলো। সব কমেন্ট গুলো পরে স্নেহা লাল-নীল হতো।দিলশাদ তো তাকেই বলে গেছিলো, অপেক্ষা করতে? তাহলে বুঝি সে সত্যি তার কাছে ফিরছে?

স্নেহার ভাবনার মাঝেই একটি ঝংকার তোলা পুরুষালীর স্পষ্ট কন্ঠ ভেসে এলো। কন্ঠের স্বর শোনেই কেঁপে উঠলো স্নেহা। মাটির থেকে নজর উপরে উঠতেই হাজার টা টুকরো হয়ে গেলো স্নেহার স্বপ্নে। চোখের কোনের জলে ফুরোঙ্গী টুপ করে ঝড়ে গেলো। স্নেহা একদম পিছিয়ে গেলো। সে কি ভুল দেখছে?

দিলশাদ, তার দিলশাত, তার প্রাণ প্রিয় দিলশাদ। সেহেরকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আছে। স্নেহার পেটে মোচড় দিয়ে উঠলো। ভুল কিছু ভাবছে না তো স্নেহা?

স্নেহা সামনে গেলো না৷ দিলশাদ বলেছিলো,

” তোমাকে আমি ঠিক খুঁজে নিবো।”

তাহলে হয়তো, সত্যি খুঁজে নিবে সে…! স্নেহা আবার মাথা নুয়ে রাখলো। বিন্দু তখন স্নেহার কাছে টেনে নিয়ে দিলশাদকে বলল,

” দিলশাদ, ওকে চিনেছো? ও স্নেহা!”

স্নেহা আবারো আশা ভড়া চোখে দিলশাদের চোখে তাকালো। কাজল কালো চোখ জোড়া এক ফোঁটা আশার ঝলক। কিন্তু হায়…. দিলশাদ এক পলক তাকিয়ে মুখ ফিরিয়ে চলে গেছে, সেহেরের হাত ধরে। স্নেহা নিস্তব্ধ হয়ে ঠাই দাঁড়িয়ে রইলো। দিলশাদ আজ ক্যাজুয়াল ড্রেসে ছিলো, পড়নে হোয়াইট টিশার্টের উপর ব্ল্যাক জেকেট আর ব্ল্যাক পেন্টে এক যেন রাজপুত্র লাগছিলো। স্নেহা চেয়েছিলো, দিলশাদের চওড়া বুকে মুখ লুকিয়ে শান্তির শ্বাস নিবে। কিন্তু কি হলো? একে একে স্নেহাকে ফেলেই সবাই চলে গেলো। দিলশাদ তার স্পোর্টস কারে সেহেরকে সঙ্গী করে বেড়িয়ে গেলো। বেড়িয়ে গেলে একে আরো দুটি গাড়ি। শুধু পিছনে ফেলে গেলো পরগাছা এক অবয়বকে, একটা ছায়াকে। স্নেহার চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করলো। নিজেকে আজ তুচ্ছ মানুষ হিসেবে মনে হচ্ছে। একটা ইউসল্যাস পার্সন। যার কারো জীবনেই প্রয়োজন নেই। দিলশাদের জীবনেও না….উমহুম একদম না….!একটু-ও না….!

এয়ারপোর্টের চৌকাঠে হাজারো লোকের আনাগোনা সকলের-ই গন্তব্য কোথা-ও না কোথায়-ও। কিন্তু স্নেহার গন্তব্য কই?স্নেহা রাতের আঁধারে কনকনে ঠান্ডায় একাই বেড়িয়ে পড়লো। তার আর জায়গা নেই না তালুকদার বাড়িতে.. আর না আমরিন ভিলা। স্নেহা তুচ্ছো হাসলো। রাতের আঁধারে নিজের ছায়াকে সাথী করে রওনা করলো ভার্সিটির হলে। স্নেহা জানে, তাকে কেউ খুঁজবে না। কেউ না। তাকে কেউ ভালোবাসবে না, কেউ না। তবে সে নিজেকে নিজে ভালোবাসবে, খুব ভালোবাসবে। যদি দিলশাদ তার ভালোবাসার মানুষটিকে না চায়..তবুও সে খুশি হবে, খুব খুশি।

ঠান্ডার কাঁপতে কাঁপতে স্নেহা তার ভার্সিটির হলে উপস্থিত হলো। ঠান্ডায় হাত যেন জমে গেছে তার। তবু-ও কোনো অনুভূতি নেই। নিজের ঘরে, নিজের বিছানায় গা এলিয়ে দিলো। ঠিক তখনি এক প্রকার চিৎকার করে স্নেহার বেস্ট ফ্রেন্ড বন্যা অন্য রুম থেকে দৌড়ে এলো। হাতের ফোনটি বাড়িয়ে দিয়ে বলল,

” দোস্ত.. তোর দিলশাদতো এঙ্গেজমেন্ট করতেছে!”

স্নেহার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো। হতভম্ব হয়ে ফোন হাতে নিলো। নিস্প্রভ দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে দেখলো দিলশাদকে। ব্ল্যাক অফহোয়াইট কালার সুটে দাম্ভিক মুখখানায় খুশির ঝিলিক। তার পাশেই চমৎকার এক সুন্দরী মেচিং অফ হোয়াইট কালার গাউন পরে দাঁড়িয়ে আছে। খিল খিল করে আসচ্ছে। বড় বড় হেডলাইনে ভেসে ভেসে যাচ্ছে স্ক্রীণে,

” আমরিন এমপ্যায়ারের এক মাত্র অংশীদার দিলশাদ আমরিনের সাথে তালুকদার গ্রুপের ছোট বড় মেয়ে সেহের সাথে হতে চলছে একই বন্ধনে আবদ্ধ। এই বিষয়ে দিলশাদ আমরিনের বক্তব্য, ‘ ছোট বেলার ভালোবাসা এবার পূর্ণতা পেতে চলেছে’ ”

স্নেহার জোরে জোরে কান্না করে দিলো। হাউমাউ করে কান্না শুরু করে চলছে। বন্যা সামলাতে চাইছে খুব করে কিন্তু পারছে না…। এদিকে স্নেহার বুক ফাঁটা আর্তনাদ কারো সাথে ভাগ করার নেই। স্নেহার কান্নায় বন্যার চোখেও জলের বন্যা। বান্ধবীকে বুকের সাথে চেপে আছে। যতটা শান্তনা দিয়া যায় আর কি! কিন্তু তাতে কি আর লাভ হবে? নাহ্ হবে না….! আর যাই হোক.. কেউ কারো কষ্টের ভার নিতে পারে না…! কিন্তু কষ্টের বোঝা বাড়িয়ে দিতে জানে। জানে কাঁটা গায়ে নুনের ছিটা দিতে….। স্নেহা কাঁদতে কাঁদতে নিস্তেজ হয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লো। মাথার উপর পুরোনা দিনের সিলিংটার দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বলল,

” আপনি আপনার ভালোবাসা খুঁজে নিতে ব্যর্থ দিলশাদ, ব্যর্থ। ”

————-
” আপনি আপনার ভালোবাসা খুঁজে নিতে ব্যর্থ দিলশাদ, ব্যর্থ। ”

আমরিন এ্যামপায়ারের ১৪ তলা দিলশাদের কেবিনের সামনে দাঁড়িয়ে আছে স্নেহা উরফ আকৃতি। স্বচ্ছ কাচের এই কেবিনটিতে একটি সুদর্শন যুবক বসে মনোযোগ দিয়ে কাজ করছে। প্রতিবারের মতো ফিট এন্ড ফাইন, অফিস সুটে একজন সুপুরুষ। ক্লিন সেভ মুখ-মন্ডলে সিরিয়াসন্যাস। এই যুবকটিকে দেখে এখনো স্নেহা বুক কাঁপে, তৃষ্ণা পায়। বড্ড ছুয়ে দিতে মন চায়… বুকের মাঝে লুকিয়ে ফেলতে ইচ্ছে করে। পরম যত্নে ঠোঁটে ঠোঁট ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে করে…! স্নেহা শুকানো ঢুক গিললো। হাই হিল আর অফিস ড্রেস কোর্ডে, মুখের মাঝে কনফিডেন্স নিয়ে দরজায় নক করলো। ভিতর থেকে ভেসে এলো ঝংকার তোলা কন্ঠ,

” কামিং!”

স্নেহা নিজের শত্রু পক্ষের কেবিনে পা রাখলো। বলল,

” হাই মিস্টার আমরিন আ’ম আকৃতা শেখ!”

দিলশাদের কলম থেমে গেলো। মাথা তুলে নিস্প্রভ দৃষ্টি মেলে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। এক পলক তাকাতেই মনে হলো যেন, ” স্নেহা”

কিন্তু কোনো রিয়াকশন নেই। কিন্তু স্নেহা মনে সনে হাসলো,

” শত্রুর দিকে এক ধাপ এগিয়ে দিলাম!”

দিলশাদ এবার মুখ খুললো,

” তরুন আমাকে বলেছে আপনার কথা মিস আকৃতা…! আপনি এখানে আমার পি এ হিসেবে কাজ করবেন!”

স্নেহা মাথা নারলো। দিলশাদ বসতে ইশারা করলো। এবং কাউকে আসতে কল দিলো। কিছু মুহূর্তেই একটি ছেলে এসে হাজির।

” সাফাদ মিস আকৃতা শেখকে কাজ বুঝিয়ে দাও!”

সাফাদ মাথা নাড়িয়ে আকৃতাকে নিয়ে বেড়িয়ে গেলো।পিছনে আবারো আগের মতো ভাবলেশহীন ভাবে কাজে ডুবে পড়লো দিলশাদ আমরিন। স্নেহা একবার চাইলো তার দিকে। বলল,

” আপনার এই এ্যামপ্যারেকে খুব ভালোবাসেন না আপনি? আর এই এ্যামপ্যায়ার যদি না থাকে?”

বাঁকা হাসলো স্নেহা। প্রতিশোদের নেশায় সহজ সরল স্নেহা এখন সর্বনাশিনী……

চলবে,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here