মেঘের পরে রংধনু পর্ব-৮

0
1522

#মেঘের_পরে_রংধনু
#পর্ব_৮
লিখা: Sidratul Muntaz

বাড়ি বয়ে এসে হুমকিযুক্ত চিঠি দিয়ে যাওয়া পর্যন্ত ঠিক ছিল। কিন্তু শ্যানিন আরেকটা বাড়াবাড়ি করেছে। ঠিক আধঘণ্টা পরেই গাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে অরিনকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। অরিনদের বাড়ির দাঁড়োয়ান এইমাত্র এসে জানালেন ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছে। অরিনকে যেতে হবে। হালিমা এই কথা শুনে চোখ বড় বড় করে দাঁড়োয়ানের সামনেই জিজ্ঞেস করলেন,
” কোথায় যাবি তুই এতোরাতে? কে তোর জন্য গাড়ি পাঠিয়েছে?”
অরিন মনে মনে শ্যানিনকে গালি দিয়ে গুষ্টি উদ্ধার করলো। মায়ের প্রশ্ন শুনে খানিক ভ্যাবাচেকা খেয়ে উত্তর দিল,
” শ্যানিন পাঠিয়েছে মা।”
” কেনো?”
” আঙ্কেল খুব অসুস্থ। আমাকে দেখতে চাইছেন।”
” অদ্ভুত তো! কেউ অসুস্থ হলে আপনজনকে দেখতে চায়, প্রিয় মানুষদের দেখতে চায়। শ্যানিনের বাপ তোকে কেনো দেখতে চাইবে? তুই উনার কোন জনমের কি?”
” এখন উনি আমাকে কেনো দেখতে চাইছেন সেটা আমি কিভাবে জানবো? গেলেই না জানতে পারবো।”
” তাই বলে এতোরাতে? কি হয়েছে শ্যানিনের বাবার?”
” শ্যানিন শুধু বলেছে প্রেশার বেড়েছে। এর বেশি কিছু জানি না।”
হালিমা বুঝতে পারছেন না কি বলবেন। তাঁকে খুবই বিভ্রান্ত দেখাচ্ছে। শ্যানিন যে একটু আগে বাসায় এসেছিল তখন তো কিছু বলেনি। তখন যদি মেয়েটা বলতো সে অরিনকে নিতে এসেছে তাহলেই তো হালিমা অনুমতি দিয়ে দিতেন। বেস্টফ্রেন্ডের অসুস্থ বাবাকে দেখতে যেতে নিষেধ নেই। কিন্তু রাত বারোটা বাজে ড্রাইভার পাঠিয়ে নিয়ে যাওয়ার বিষয়টা সন্দেহজনক। অরিন ভয়ে ভয়ে বললো,
” আমি কি যাবো মা?”
হালিমা কিছু একটা চিন্তা করে বললেন,
” আচ্ছা, যা। তোর বাবা তো এখন ঘুমায়। তুই বরং অর্ণভকে সাথে নিয়ে যা।”
” না, না, আমি একাই যাই। ভাইয়া সারাদিন অফিসে কাজ করে টায়ার্ড হয়ে বাসায় এসেছে,মা। এখন একটু ঘুমাক। জ্বালানোর দরকার নেই। আমি যেতে পারবো।”
” এখন রাত বারোটা বাজে। তুই গেলে ফিরবি কখন? আজরাতে তাহলে আর ফেরারই দরকার নেই।”
অরিন হতভম্ব হয়ে বললো,
” কেনো মা? ফিরবো না কেনো?”
” এতোরাতে আসার দরকার নেই। ওইখানেই থাকিস। আর শ্যানিনদের বাসার নাম্বার আমাকে লিখে দিয়ে যা। আমি ফোন করবো।”
অরিন বাধ্য হয়ে মায়ের কাছে নাম্বার লিখে দিল। এখন কথা না শুনলে মা যেতে দিবে না। তাই মা যেটা বলছে সেটাই মানা উচিৎ। অরিনের মনে হয় আজকে শ্যানিনদের বাসায় যাওয়াটা তার জন্য অতীব জরুরী।
শ্যানিনদের বাড়ির দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কলিংবেল বাজালো অরিন। সাথে সাথেই দরজা খুললেন শ্যানিনের মা নুসাইবা ইসলাম। উনি খুব আনন্দিত একটা হাসি দিলেন।
” অরিন, এসে গেছো মা? আসো ভেতরে আসো।”
নুসাইবা অরিনকে হাত ধরে ভেতরে নিয়ে যাচ্ছেন। অরিন এতোটাই বিস্মিত হলো যে সালাম পর্যন্ত দিতে ভুলে গেল। এর আগে অরিনকে দেখে এতোবড় হাসি নুসাইবা কখনও দেননি। আজকে কি হলো? ড্রয়িংরুমে শায়িখ সাহেব আর শ্যানিন বসে আছেন। এই বাড়িতে এলেই অরিনের চোখ ধাঁধায় পড়ে যায়। এতোবড় বাড়ি আর এতো লাইটিং অরিন আর কোথাও দেখেনি। প্রত্যেকটি সিমেন্টের কোণাও যেনো খুব যত্নে সাজানো। আগে অরিন এই বাড়িতে এলেই এক্সাইটেড হয়ে যেতো। এখন তো আর আসাই হয় না। সব ওই সাইকোটার জন্য। কে বলেছিল তাকে অস্ট্রেলিয়া থেকে ফিরে আসতে? শায়িখ সাহেব আর শ্যানিনের বসার ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে অরিনের জন্যই অপেক্ষা করছিল তারা। কিন্তু শ্যানিন তো চিঠিতে বলেছিল ওর বাবা অসুস্থ। আর মা কান্নাকাটি করছেন। বাসায় সিডর, ঘূর্ণিঝড় শুরু হয়েছে। কিন্তু এখন তো কাউকে দেখে তেমন কিছু মনেই হচ্ছে না। সব কেমন শান্ত, নিরব! শ্যানিন কি তাহলে মিথ্যে বলেছে? শায়িখ বললেন,
” মা অরিন, এতোরাতে তোমাকে ডেকে পাঠালাম। কিছু মনে করোনি তো মা?”
অরিন একটা অপ্রস্তুত হাসি দিয়ে সোফায় বসলো। তার সবকিছু সন্দেহজনক লাগছে। সে বললো,
” আমি কি জানতে পারি? আমাকে কেনো ডেকে আনা হয়েছে?”
শায়িখ বললেন,” অবশ্যই জানতে পারো। সব জানবে। তার আগে বলো, তোমার বাসার সবাই ভালো আছে?”
” আলহামদুলিল্লাহ, আপনাদের দোয়ায় সবাই ভালো আছে।”
” তোমার একটা পিচ্চি বোন আছে না? সে কেমন আছে?”
” জ্বী, ভালো আছে।”
অরিন কথাগুলো বলতে বলতে শ্যানিনের দিকে তাকালো। শ্যানিনের মুখে দুশ্চিন্তার ছাপ। পরীক্ষার রেজাল্ট বের হওয়ার পাঁচমিনিট আগে পরীক্ষার্থীর মুখের অবস্থা যেমন দেখায় শ্যানিনকেও তেমন দেখাচ্ছে। শায়িখ সাহেব যে সোফাটায় বসে আছেন শ্যানিন সেই একই সোফার হাতলের উপর বসে আছে।
” তোমার বোনের বয়স যেনো কত?”
” তিনবছর আঙ্কেল।”
” এখনও অনেক ছোট তাই না? ”
” জ্বী।”
” এই নুসাইবা, ওকে চা-কফি কিছু দাও। মেয়েটা এতো কষ্ট করে এসেছে।”
নুসাইবা বললেন,
” অরিন কি খাবে? চা না কফি?”
এখন অরিনের সত্যিই বিরক্ত লাগছে। এরা আসল কথা না বলে এতো ত্যানা পেচাচ্ছে কেনো? টেনশনে অরিনের হৃৎপিন্ডের সংকোচন-প্রসারণ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। অরিন বললো,
” এক গ্লাস পানি দিন আন্টি।’
” আচ্ছা, পানির সাথে আর কি দিবো? চা নাকি কফি?”
আবার একই প্রশ্ন। অরিন হেসে বললো,” শুধু পানি দিন।”
শায়িখ হেসে বললেন,
” আচ্ছা, থাক। ও চা-কফি খেতে চাইছে না। ওকে শুধু পানিই দাও।”
নুসাইবা পানি আনতে যাওয়ার আগে শায়িখ সাহেবকে ইশারায় কিছু একটা বলে গেলেন। অরিন বুঝলো না সেটা। শায়িখ সাহেব এবার গলা ঝাড়লেন। কিছুটা প্রস্তুতি নিয়ে বসলেন। অরিন বুঝতে পারলো এখন উনি মেইন টপিকে আসবেন। শ্যানিনও আগ্রহী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে বাবা কি বলবে সেটা সে জানে। শায়িখ বললেন,
” দেখো মা, তোমাকে কথাগুলো বলতে আমার খুবই লজ্জা লাগছে। কিন্তু কি করবো? বাবা হয়ে ঠেকে গেছি।”
শায়িখ হাসলেন। হাসিটা দেখে অরিনের মায়া লাগলো। কেনো যেনো খুব বেশিই মায়া লাগলো। শায়িখ বললেন,
” আমার ছেলেটার কথা বলি, ইলহান। খুবই একরোখা,জেদী আর ইন্ট্রোভার্ট। ওকে বাহিরে থেকে দেখে ততটা বুঝা যায় না। ও কিন্তু ভেতরে একদম অন্যরকম। আমি বাবা হিসেবে মনে করি, আমার ছেলে পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো ছেলে। কিন্তু ওর একটা রোগ আছে। সেই রোগের নাম রাগ। রেগে গেলে ও পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ ছেলে। যেটা একবার বলবে সেটা করবে মানে করবেই। এইতো চার-পাঁচবছর আগের কথা। ও এইচএসসি দিয়েই জেদ ধরলো অস্ট্রেলিয়া চলে যাবে। সেখানকার ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হবে। আমাদের কারো ইচ্ছা নেই ছেলেকে বিদেশ পাঠানোর। সত্যি কথা বলতে, ছোটবেলা থেকে ওকে আমি এইখানে রেখে মানুষ করেছি।”
শায়িখ সাহেব নিজের বুকের বামপাশে হাত দিলেন। হাত দিয়ে দেখালেন,
” এইভাবে ঘুম পাড়াতাম। ও কাঁদলে ওর মায়ের আগে আমার ঘুম ভেঙে যেতো। যেদিন বাসায় থাকতাম, সারাক্ষণ ইলহান আমার কোলে থাকতো। ওকে কোলে নিয়ে যে অদ্ভুত শান্তি আমি অনুভব করতাম তা পৃথিবীর কোনো বাবা কখনও করতে পেরেছে কি-না আমার জানা নেই।”
শ্যানিন বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে হাসছে। কিন্তু ওর চোখ টলমল। অরিন বুঝতে পারছে না কি হচ্ছে? এসব কথা তাকে কেনো বলা হচ্ছে? শায়িখ সাহেব চোখেরজল মুছে বললেন,
” এক মুহুর্ত যে ছেলেকে চোখের আড়াল হতে দেইনি সে হঠাৎ বিদেশ চলে যাবে এই কথা শুনে আমার কি অবস্থা হতে পারে একবার ভেবে দেখো? কিন্তু ছোটবেলা থেকে এই পর্যন্ত আমার ছেলের কোনো আবদার আমি অপূর্ণ রাখিনি। খুব শখের ছেলে তো। তাই বিদেশ যাওয়ার অনুমতিটাও দিলাম। সেখানে গিয়ে ইলহান বদলে গেল।। ছুটিতেও দেশে আসতে চাইতো না। আমরা কত বকতাম, দেশে আসার জন্য চাপ দিতাম৷ কিন্তু ওর কোনো আগ্রহই নেই। সকালে আর রাতে মাত্র একবার ভিডিও কলে কথা হতো। এছাড়া সারাদিন ওর আর কোনো খোঁজ থাকতো না। আমরা তো ভেবেছিলাম ইলহানকে আর ফিরিয়ে আনা সম্ভব না। এইবার আমাদেরও স্যুটকেস গুছিয়ে অস্ট্রেলিয়া রওনা দিতে হবে। কিন্তু হঠাৎ একদিন আমার ছোট ভাইয়ের ছেলের বিয়েতে ইলহান জানালো ও আসবে। আমাদের বাসায় তখন বিয়ের চেয়েও ইলহানের ফিরে আসার উৎসব নিয়ে বেশি মাতামাতি শুরু হলো। সবাই মহাখুশি আমি তো আরও খুশি। কতদিন পর ছেলেটা বাড়ি আসছে।কিন্তু ফিরে আসার পর ইলহান জানালো সে আর অস্ট্রেলিয়া ফিরে যেতে চায় না। বাংলাদেশেই নাকি থাকবে। বিষয়টা আমাদের জন্য অবশ্যই সুসংবাদ। কিন্তু ইলহানের তো ক্যারিয়ার আছে, ভবিষ্যৎ আছে। ও এতোদূর এসে যদি গ্র্যাজুয়েশন শেষ না করে তাহলে কি বিষয়টা ভালো দেখায় তুমিই বলো?”
অরিন মাথা নেড়ে বললো,” না।”
নুসাইবা এতোক্ষণে পানি এনে টেবিলে রেখেছেন। শায়িখ বললেন,
” পানিটা খাও মা।”
অরিন পানির গ্লাস হাতে নিল। শায়িখ কথা বলা চালিয়ে গেলেন।
” ওকে আমরা হাজার বুঝিয়েও অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার জন্য রাজি করাতে পারিনি। এখন তোমাকে বলি, বাংলাদেশে ও কেনো থাকতে চাইছে? কি পেয়েছে? ও আসলে তোমাকে পেয়েছে। তোমার জন্য ও দিনের পর দিন শুধু পাগলামি করেই চলেছে। প্রথম প্রথম বিষয়টা সাধারণ মনে হলেও এখন কিন্তু আর বিষয়টা আমাদের কারো কাছেই সাধারণ লাগছে না। তাই আমরা একটা বড় সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তোমার অনুমতি ছাড়াই সিদ্ধান্তটা নিতে হয়েছে সেজন্য আমি দুঃখিত। আমরা ঠিক করেছি আজকেই ইলহান আর তোমার বিয়ে দিবো।”
শেষ কথাটা শুনে অরিন এতো জোরে কাশতে লাগলো যে ওর নাকে-মুখে পানি উঠে গেল।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here