মেঘের পরে রংধনু পর্ব-১৬

0
1406

#মেঘের_পরে_রংধনু
#পর্ব_১৬
লিখা: Sidratul Muntaz

হসপিটালে আসার পর থেকেই অর্ণভের মাথা খারাপ হয়ে গেছে। সে লম্বা করিডোরের এ মাথা থেকে ওই মাথা শুধু পায়চারী করছে। কোথাও স্থির হয়ে বসতে পারছে না কিংবা বসার মতো স্বস্তি পাচ্ছে না। প্রথমে যখন সে আর অরিন হসপিটালে ঢুকলো, দেখলো শ্যানিন আর ইলহান শায়িখ সাহেবের কেবিনের সামনে দাঁড়িয়ে একে-অপরকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদছে। ভাই-বোনের সে কি কান্না! তখন তো অর্ণভ ধরেই নিয়েছিল শায়িখ সাহেব দুনিয়া ছেড়ে পগারপার। এই কথা যখন সে অরিনকে বললো, অরিন এতো ক্ষেপে গেল যে চিৎকার করে নার্স, ডাক্তার সবাইকে ডেকে আনলো। শায়িখ সাহেব সুস্থ হবেন কি-না এইটুকু জানার জন্য অস্থির হয়ে উঠলো। ওর আচরণে অর্ণভ মাথায় হাত দিয়ে বসে রইল। তার ছোট্ট, মিষ্টি বোনটা শেষমেষ পঞ্চাশোর্ধ বয়সী এক বুইড়ার প্রেমে পড়ে পাগলের মতো আচরণ করছে? অরিন কাঁদতে কাঁদতে একটা কথা অর্ণভকে বার-বার বলছিল,
” ভাইয়া, শায়িখ আঙ্কেলের কিছু হলে আমি শেষ হয়ে যাবো। তাঁর কিছু হলে আমি আমাকে ক্ষমা করতে পারবো না। ভাইয়া, হেমারেজ স্ট্রোকে কি মানুষ মারা যায়? তিনি মারা গেলে আমার কি হবে?”
অর্ণভ এইসব শুনে আরও হতাশ হয়ে গেল। ইলহানও বার-বার এক কথা বলছিল,” অরিনের জন্য আমি বাবাকে অনেক কষ্ট দিয়ে ফেলেছি। স্যরি বাবা। প্লিজ ফরগিভ মি।”
অর্ণভ তো তখন পুরোপুরি নিশ্চিত হয়ে গেল, অরিনকে নিয়ে বাপ-ছেলের যুদ্ধ ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গেছে। সেজন্যই হয়তো শায়িখ সাহেব স্ট্রোক করেছেন। আর ইলহান বাড়ি ছেড়েছে। কি সর্বনাশা কান্ড! ভাবতেই অর্ণভের গাঁয়ে কাঁটা দিয়ে উঠছে। ঘটনা শুধু এখানেই থেমে নেই। শায়িখ সাহেবের আত্মীয়-স্বজনের ঠেলাঠেলিতে হসপিটাল ভরে গেছে। সকালে নাকি আরও মানুষ ছিল। সন্ধ্যায় জনসংখ্যা অনেকটাই কমেছে। তাও অর্ণভের দম বন্ধ হয়ে আসছে। ইলহানের এক বড়ফুপু, নাম জোহরা খাতুন। সেইরকম দজ্জাল মহিলা। চেহারা দেখলেই ভয়ে আত্মা কাঁপে। তিনিও কিছুক্ষণ আগে অরিনকে শাসিয়ে গেলেন৷ জোহরা খাতুন জহুরি দৃষ্টিতে অরিনকে দেখতে দেখতে বলেছেন, “তোমার জন্য আমার ভাইয়ের এই অবস্থা। আমার ভাইপো তোমার জন্য ঘর ছেড়েছে। তুমিই সমস্ত অশান্তির মূল হোতা। তোমার জন্য তো আমাদের পরিবারে আগুন লাগবে দেখছি।”
অর্ণভ তখন মনে মনে ভেবেছে শুধু আগুন নয়, যুদ্ধ লাগবে। বিরাট যুদ্ধ। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন বিরল যুদ্ধ আগে কেউ কখনও দেখেনি। অরিন তো ইতিহাস রচনা করতে যাচ্ছে। পৃথিবীতে মনে হয় অরিনই একমাত্র মেয়ে যার জন্য বাবা-ছেলে একসাথে যুদ্ধে নামবে। যুদ্ধে যদি শায়িখ সাহেব বিজয়ী হয় তাহলে অর্ণভ কি পারবে ওই বুড়ো লোকটার সাথে তার আদরের বোনকে বিয়ে দিতে? কিন্তু অরিন যেভাবে কাঁদে, তার মুখের দিকে তাকিয়ে তো অর্ণভ নিষেধও করতে পারবে না। কি মুশকিল! এজন্যই ছোট থেকে বোনদের কড়া শাসনে রাখা উচিৎ। ছেলে বন্ধুর সাথে সাথে মেয়ে বন্ধুও নিষিদ্ধ করা উচিৎ। শ্যানিন যদি অরিনের বান্ধুবি না হতো তাহলে এসব কিছুই হতো না। অর্ণভ সিদ্ধান্ত নিল সে মিহরীমাকে কখনও কোনো বন্ধুর সাথে মিশতে দিবে না। ছেলে বন্ধু তো অবশ্যই নিষিদ্ধ। মেয়ে বন্ধু আরও নিষিদ্ধ। আর যদি বন্ধু পাতানো একান্তই জরুরী হয় তখন অর্ণভ আগে নিজে খোঁজ নিয়ে দেখবে সেই মেয়ে বন্ধুটির ঘরে বাপ-ভাই আছে কি-না৷ বাপ-ভাইওয়ালা মেয়ে বন্ধুর সাথে কিছুতেই বন্ধুত্ব পাতানো যাবে না। এমন মেয়ের সাথে বন্ধুত্ব পাতাতে হবে যার পরিবারের প্রত্যেকটি সদস্য মেয়ে। অর্ণভ তার বান্ধুবি বিথীকে একবার ফোন করলো। এই সমস্যা সমাধানে বিথীর সাহায্য জরুরী।
” হ্যালো বিথি, অর্ণভ বলছি। চিনতে পেরেছিস?”
” চিনবো না কেনো? তোর নাম্বার তো আমার ফোনে সেভ করাই আছে। তাছাড়া আমি কি তোর মতো যে প্রয়োজন ফুরালেই সবাইকে ভুলে যাবো?”
” তুই কি আমাকে সেলফিশ বলছিস? আসলে চাকরির জন্য আজ-কাল খুব ব্যস্ত থাকতে হয়। ভার্সিটির কারো সাথেই আমার তেমন যোগাযোগ নেই।”
” আরে, আমি এতোকিছু মিন করে বলিনি। এমনিই কথার কথা বললাম। তুই বল, কেমন আছিস?”
” আছি তো ভালোই। কিন্তু একটা ঝামেলাতে পড়ে তোকে ফোন করেছি।”
” কি ঝামেলা?”
” আচ্ছা, তোর হাসব্যান্ড জানি তোর থেকে কয়বছরের বড়?”
” উনিশ বছর পাঁচমাস।”
” তোদের মধ্যে এডজাস্টমেন্ট কেমন?”
” এডজাস্টমেন্ট তো ভালোই। আমি যা বলি তাই শোনে, আমাকে অনেক গুরুত্ব দেয় আর সবসময় আমাকে খুশি রাখার চেষ্টা করে। আর কি লাগে? হঠাৎ এসব কথা জিজ্ঞেস করছিস কেনো?”
” না, মানে আমি আসলে জানতে চাইছি একটা বৃদ্ধ পুরুষ বিয়ের পাত্র হিসেবে কেমন হয়?”
” তুই কাকে বৃদ্ধ পুরুষের কাছে বিয়ে দিবি?”
” অরিনকে।”
” কি? অরিনকে তুই বুড়ার কাছে বিয়ে দিবি কেনো? এতো কিউট একটা মেয়ে। ওর জন্য তো আমার কাছেই হাজার হাজার ভালো পাত্র আছে। তুই শুধু একবার বলে দ্যাখ, আমি রাজপুত্র এনে হাজির করবো।”
” কিন্তু আমার বোন তো রাজপুত্র বিয়ে করবে না। তার বৃদ্ধ রাজাই পছন্দ হয়েছে। ওই বুইড়ার প্রেমে পড়ে সে একদম আউট অফ মাইন্ড হয়ে গেছে। আমাদের কারো কথা শুনবে বলে মনে হয় না।”
” কি বলছিস এসব? তাহলে আমার মনে হয়, বিয়েটা দিয়ে দেওয়া উচিৎ। যেহেতু ভালোবাসার ব্যাপার। আর ভালোবাসায় বয়সের কোনো বিধি-নিষেধ নেই। মনের টানই আসল। আমাদের মহানবী(সাঃ) যখন মারা যান, তাঁর বয়স ছিল তেষট্টি। আর বিবি আয়েশার (রাঃ) বয়স তখন মাত্র তেইশ। বয়সের এতো ব্যবধান থাকা সত্ত্বেও তাঁদের মধ্যে কি মিল-মহাব্বতের কোনো অভাব ছিল? বয়স্ক পুরুষ বিয়ে করা তো হারাম না। তাহলে অসুবিধা কোথায়?”
” তুইও এই কথা বলছিস?”
” হ্যাঁ বলছি। কারণ আমার মনে হয় বৃদ্ধ পুরুষ জামাই হিসেবে বেস্ট। ওরা স্ত্রীদের অনেক আদর- যত্নে রাখে।”
” তুইও কি আদর-যত্নে আছিস?”
” অবশ্যই। এজন্যই তো বলছি, যদি সম্ভব হয় তোরা রাজি হয়ে যা। তাছাড়া অরিন যেই জিদ্দি মেয়ে। পরে উল্টা-পাল্টা কিছু করে বসলে সামলাবি কিভাবে?”
” আমিও এটার ভয় পাচ্ছি।কিন্তু আরেকটা সমস্যা আছে। যেই বৃদ্ধের সাথে অরিন প্রেম করছে সে কিন্তু অরিনের বেস্টফ্রেন্ডের বাবা। বিষয়টা কেমন দৃষ্টিকটু দেখায় না?”
” তাতে কি হয়েছে? তুই জানিস, হুমায়ূন আহমেদের দ্বিতীয় বউ শাওন কিন্তু তার কন্যা শীলা আহমেদের বেস্টফ্রেন্ড ছিল। সেইদিক থেকে চিন্তা করলে শাওনের হাসব্যান্ডও তার বেস্টফ্রেন্ডের বাপ। তাদের যদি বিয়ে হতে পারে তাহলে অরিনের বিয়ে হতে পারবে না কেনো?”
” এই হুমায়ূন আহমেদটা যেনো কে?”
” আরে, রাইটার হুমায়ূন আহমেদ।”
” ও আচ্ছা।”
অর্ণভ ফোন রেখে চিন্তা করতে লাগলো, হুমায়ূন আহমেদের মতো গুণী মানুষও যদি এইরকম একটা কাজ করতে পারে তাহলে অরিন কেনো পারবে না? বিথীর কথায় যুক্তি আছে।

শ্যানিন অরিনকে জড়িয়ে ধরে বললো,” থ্যাঙ্কিউ সো মাচ ভাইয়াকে নিয়ে আসার জন্য। বাবা এখন আগের চেয়ে অনেক ভালো আছে। আমাদের সবার সাথে হেসে কথা বলেছে। ফিজিওথেরাপির পর বাবা একদম সুস্থ হয়ে গেছে। শুধু হাত-পা নড়াচড়ায় একটু সমস্যা হচ্ছে। এটাও কয়েকদিনের মধ্যে ঠিক হয়ে যাবে।”
অরিন আনন্দিত গলায় বললো,” আমি কি আঙ্কেলের সাথে একবার দেখা করতে পারি?”
” এখন ভাইয়া আর মা গিয়েছে। তুই একটু পরে যা। ডাক্তার বেশি ভীড় জমাতে নিষেধ করেছে।”
” ঠিকাছে।”
অরিন আর শ্যানিন একসাথে হাত ধরে বসলো। অরিনের এখন খুব ভালো লাগছে। মনে হচ্ছে বুক থেকে বিশাল ভারী পাহাড়ের বোঝা নেমে গেছে।
ইলহান বাবার হাতে একটা চুমু দিল। তারপর কপালেও একটা চুমু দিল। ভেজা গলায় বললো,
” আই এম স্যরি বাবা। আর কখনও এমন করবো না। তোমাকে ছেড়ে আর কোত্থাও যাবো না।”
নুসাইবা বললেন,” শুধু স্যরি বললে তো হবে না। পায়ে ধর। তারপর শপথ কর, আর কখনও বাবা-মাকে কষ্ট দিবি না। তুই জানিস এই মানুষটা তোকে কত ভালোবাসে? না জানলে আমার কাছে শোন। তোকে এতিমখানা থেকে তুলে এনেই তোর বাবা দশটা খাসি একসাথে জবাই করে তোর নাম রেখেছিল। শহরের সব ফকির-মিসকিন খাইয়েছিল। তোর যাতে কোনো অযত্ন না হয় তাই আমরা সুযোগ থাকা সত্ত্বেও দ্বিতীয় কোনো সন্তান নেইনি। এই সিদ্ধান্তটাও তোর বাবার ছিল। নিজের সন্তান হলে নাকি আমি তোকে ভুলে যাবো। আদর কম করবো। এই ভয়ে তোর বাবা আমাকে কোনো সন্তান নিতে দেয়নি। তারপর তোর যখন ছয়বছর বয়স, তুই একদিন কোন হিন্দি সিনেমা দেখে হঠাৎ বায়না করলি ছোট ভাই-বোন লাগবে। তখন শ্যানিন আমাদের পরিবারে এলো। তুই না চাইলে শ্যানিনও কখনও আসতো না। এবার বুঝতে পেরেছিস? এই মানুষটা তোকে কত ভালোবাসে?”
ইলহান চুপ করে বাবার হাত চেপে ধরে বসে রইল। শ্যানিন দরজায় টোকা দিয়ে বললো,
” মা, অরিন একটু ভেতরে আসতে চাইছে। বাবার সাথে দেখা করবে তাই।”
নুসাইবা বললেন,” ডাক্তার তো দুইজনের বেশি এলাউ করবে না। ইলহান তুই বরং চলে যা। আবার পরে আসিস।”
ইলহান বেরিয়ে যেতেই অরিন ঢুকলো। নতমাথায় ভীষণ অনুতপ্ত কণ্ঠে বললো,
” এখন কেমন আছেন আঙ্কেল?”
শায়িখ সাহেব মাথা নেড়ে জবাব দিলেন,” ভালো।”
তাঁর মুখের হাসি ভাবটা দেখে মনে হচ্ছে অরিন যেনো কিছুই করেনি। অন্যকেউ হলে এতো সহজে কখনও কথা বলতো না। শায়িখ আঙ্কেল আসলেই খুব ভালো মানুষ। অরিনের কেনো যেনো কান্না পেয়ে গেল। সে বললো,
” আঙ্কেল আমি আমার ভুলের জন্য স্যরি। সেদিন আপনার সাথে আমার ওইভাবে কথা বলা একদম উচিৎ হয়নি। প্লিজ আমাকে ক্ষমা করে দিন।”
শায়িখ সাহেব হাতের ইশারায় অরিনকে কাছে ডাকলেন। অরিন তার পাশে গিয়ে বসতেই তিনি অরিনের মাথায় হাত রাখতে চাইলেন। কিন্তু উনি হাত উঠাতে পারছেন না। অরিনের আরও কষ্ট লাগলো। সুস্থ-সবল মানুষটার এহেন অবস্থার জন্য তো সে নিজেই দায়ী। অরিন নিজেই শায়িখ সাহেবের কাঁধে মাথা রাখলো যাতে তিনি অরিনকে ছুঁতে পারেন। এইবার শায়িখ আলতো করে অরিনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। নুসাইবা হাসি মুখে দাঁড়িয়ে রইলেন তাদের পাশে। অর্ণভ বাহিরে থেকে এই দৃশ্য দেখে দেয়ালে কপাল চাপড়ে বললো,
” ছি, ছি, ছি! এ তুই কি করলি অরিন? শেষমেষ এইরকম একটা বুইড়াকে মনে ধরলো তোর? এই বুইড়ার তো বউও আছে।”
ওইসময় নুসাইবা বাহিরে থেকে অর্ণভকে দেখতে পেয়ে এগিয়ে আসলেন। সৌহার্দ্যপূর্ণ গলায় বললেন,
” তোমার বোন খুব ভালো একটা মেয়ে। আমি কিন্তু ওকে খুব শীঘ্রই আমার সংসারে নিয়ে আসতে চাই।”
অর্ণভের মনে হলো তার কানের মধ্যে কেউ পোকা ঢেলে দিচ্ছে। সে অবাক হওয়া দৃষ্টিতে নুসাইবার দিকে তাকিয়ে রইল। ভদ্রমহিলার নিজের সংসারে আগুন লাগানোর এতো শখ?

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here