#মেঘের_পরে_রংধনু
#পর্ব_১৯
লিখা: Sidratul Muntaz
হসপিটালের লম্বা করিডোরের সারিবদ্ধভাবে সাজানো চেয়ারগুলোর একটিতে বসে আছে অরিন।ঠিক পাশেই অরিনের বামহাতটা শক্ত করে আঁকড়ে বসে আছে ইলহান। নিরব করিডোরে ফ্যানের শনশন শব্দটা কানে বাজছে। অরিন মনোযোগী দৃষ্টিতে ইলহানের দিকে তাকালো। তার চোখ দু’টো ফোলা। নাকের ডগা ফেঁপে একদম গোলাপী বর্ণ ধারণ করেছে। তার রক্তলাল ঠোঁট দুটো অবিরত কাঁপছে! ইলহান যখন খুব বেশি হতাশ হয়ে যায় তখন তার চেহারার এই অবস্থা হয়। কিছুদিন আগেও এই চেহারা দেখে অরিনের কিচ্ছু যায়-আসতো না। কিন্তু এখন বার-বার অরিনের হৃদয় কেঁপে উঠছে। এই অবিরুদ্ধ কম্পনের উৎসটা কি?অরিন জানে না। ইলহান হঠাৎ অরিনের দুই হাত মুঠোয় নিয়ে খুব অনুরোধের স্বরে বললো,
” কিচ্ছু ভালো লাগছে না অরিন। প্লিজ তুমি যেও না।”
” আমি যাচ্ছি না তো। আপনার সাথেই আছি।”
ইলহান মুখমন্ডলে মালিশ করতে করতে বললো,
” ভয় লাগছে আমার। খুবই ভয় লাগছে। বাবা বার-বার মৃত্যুর কথা কেনো বলছে বলোতো?”
” ভয় পাবেন না। অসুস্থতার কারণে উনার মনোবল দূর্বল হয়ে গেছে। এখন আপনিও যদি ভেঙে পড়েন তাহলে আঙ্কেল সুস্থ হবে কিভাবে?”
” এর আগেও বাবা অসুস্থ হয়েছেন। এবারের চেয়েও আরও অনেক ভয়ানক পরিস্থিতি সামলাতে হয়েছে আমাদের। কিন্তু কখনও তো এমন হয়নি। বাবা এতো নরম তো হয়ে যাননি আগে। উনি আজকে এমনভাবে কথা বলছিলেন যেনো এক্ষুণি মরে যাবেন।”
অরিন মুখ দিয়ে ‘চ’ এর মতো শব্দ করলো। ইলহানের কাঁধে হাত রেখে বললো,” এমন কথা বলতে হয় না। আর আপনি এতো টেনশন করছেন কেনো? আঙ্কেলের রিপোর্ট তো সব নরমাল। এর চেয়েও অনেক সমস্যা নিয়ে মানুষ বেঁচে থাকে। থাকে না?”
” আমার কি মনে হয় জানো অরিন?”
” কি?”
” বাবা আমাদের কাছে কি যেনো একটা হাইড করেছে। বাবার হয়তো সিরিয়াস কিছু হয়েছে। কিন্তু বাবা সেটা আমাদের জানতে দিচ্ছে না। ডাক্তারও এই বিষয়ে জানে। কিন্তু আমাদের কিছু বলছে না। আমি এখনই ডক্টর নিয়াজের সাথে কথা বলবো।”
” আরে থামুন। এটা আবার হয় নাকি? ডাক্তাররা রোগীর সমস্যা কেনো গোপন করবে? এতে তো ওদের লাভ নেই। তাছাড়া আমি সারাজীবন শুনেছি রোগীর কাছে সমস্যার কথা গোপন রাখা হয়। যেনো সে মনোবল না হারায়, দূর্বল না হয়ে পড়ে। কিন্তু বাড়ির লোকের কাছে গোপন রাখার কথা আমি কখনও শুনিনি। এইটা ডাক্তাররা কেনো করবে?”
ইলহান কোনো জবাব দিল না। গভীর মনোযোগে কিছু একটা চিন্তা করতে লাগলো। তারপর হঠাৎ মাথা খামচে ধরে বললো,
” উফফ! আমার সবকিছু অসহ্য লাগছে।”
অরিন অস্থির হয়ে উঠলো ইলহানের আচরণে। তাকে ধরে বললো,” মাথা ঠান্ডা করুন। একদম চাপ নিবেন না। আমার এখন মনে হচ্ছে আপনি নিজেও বাবার মতো স্ট্রোক করে এই হসপিটালেই ভর্তি হবেন।”
” আচ্ছা অরিন, তোমার কি মনে হয় না বাবা আমাদের বিয়েটা নিয়ে খুব বেশি তাড়াহুড়ো করছে? বার-বার খালি বলছে মরার আগে তার শেষ ইচ্ছা বিয়ে দেখা। তোমার কি এরপরেও মনে হচ্ছে না এর মধ্যে কিছু একটা অস্বাভাবিকতা আছে? বাবা কিভাবে নিশ্চিত হলেন তিনি এ সপ্তাহেই মরে যাবেন? ”
অরিন চুপ করে রইল। কি বলবে সে? তার কাছে অবশ্যই ব্যাপারটা অস্বাভাবিক লাগছে। কিন্তু এই কথা স্বীকার করে ইলহানের হতাশা আর বাড়াতে চাইছে না অরিন। শায়িখ সাহেব ঘণ্টা দুয়েক আগে ইলহান আর অরিনকে তার কেবিনে ডেকে বলেছেন, এক সপ্তাহের মধ্যেই তিনি বিয়ের কাজ সম্পন্ন করতে চান। এর আগে অবশ্য তিনি অরিনকে আলাদা ডেকে অরিনের মতামত জেনে নিয়েছিলেন। অরিন তখন একপ্রকার বাধ্য হয়েই রাজি হয়েছিল। কারণ অসুস্থ মানুষের মুখের হাসি কেড়ে নিতে ইচ্ছে করেনি তার। কিন্তু এখন শায়িখ সাহেব বলছেন বিয়ে নাকি এক সপ্তাহের মধ্যেই হতে হবে! তিনি আগামীকালই নুসাইবা আর শ্যানিনকে অরিনদের বাড়ি প্রস্তাব নিয়ে যেতে বলেছেন। শ্যানিন প্রথমে রাজি হয়নি। তাকে খুব বুঝিয়ে- শুনিয়ে রাজি করিয়েছেন নুসাইবা। অরিন ভাবতেও পারেনি এতো জলদি সবকিছু ঘটে যাবে। কাল যদি সত্যিই নুসাইবা আন্টি আর শ্যানিন তাদের বাড়িতে প্রস্তাব নিয়ে যায় তাহলে মা-বাবা কি ভাববেন? যে বাড়ির কর্তা হসপিটালে মৃত্যু শয্যায় সে বাড়ির মানুষ হৈ হৈ করে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছে! বিষয়টা নিশ্চয়ই অস্বাভাবিক। তবে অরিন এইটুকু নিশ্চিত যে তার মা-বাবা বিয়ের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিবেন না। কারণ অরিনের বিয়ে নিয়ে তো তাদের দুশ্চিন্তার অন্ত ছিল না। কালো মেয়েকে কে বিয়ে করবে? এমন কথা তো উঠতে বসতে দিনে তিন-চারবার করে শুনতে হতো অরিনকে। এখন থেকে আর শুনতে হবে না। অরিন ভেবে রেখেছে বিয়ের দিন তার মাকে জড়িয়ে ধরে কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলবে,” দেখো মা, তোমার কালো মেয়েটাকে বিয়ে করতে কেমন রাজপুত্র এসেছে দেখো! রাজপুত্র চাঁদের মতো সুন্দর! আমি কিন্তু তোমার সেই মেয়ে,যার চেহারার দিকে তাকালে তোমার দুনিয়া অন্ধকার হয়ে যেতো। এখন তারই হবু স্বামীর রূপের আলো কি তোমার দুনিয়া আলোকিত করতে পেরেছে মা? দেখো, তার আলোয় পুরো বিয়ে বাড়িটা ঝলমল করছে। সুন্দর লাগছে না? যাকে জন্ম দেওয়ার পর কোলে নিতেও মুখ কুচকেছিলে এখন তাকেই হাসিমুখে চাঁদের মতো সুন্দর এই রাজপুত্রের হাতে তুলে দিতে তোমার আপত্তি নেই তো? সে যদি চাঁদ হয়, আমি তার কলঙ্ক। এই কলঙ্ক ছাড়া কি চাঁদকে চিহ্নিত করা যায় মা বলো? আমাকে নিয়ে আর দুশ্চিন্তা করতে হবে না তোমার। বেঁচে গেলে অনেক বড় দায় থেকে। এখন থেকে এই কলঙ্কের দায়িত্ব শুধুই চাঁদের। তুমি খুশি হওনি মা?”
অরিনের চোখ ভিজে যাচ্ছে। সে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে চোখের জল মুছতে নিয়ে দেখলো কিছুটা দূরে পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে কয়েকটা মেয়ে খুব উৎসুক দৃষ্টিতে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। চিড়িয়াখানায় বিরল কোনো প্রাণী এলে মানুষ যেভাবে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে, মেয়েগুলোর চাহনিও তেমন। অরিন এদের আগেও দেখেছে। সারাক্ষণ ইলহানের আশে-পাশে ঘুরঘুর করেছে মেয়েগুলো। তারা প্রথমে হয়তো ইলহান-অরিনের সম্পর্কটা বুঝতে পারেনি। এখন বুঝতে পেরেই অবাক হয়ে গেছে। তাই কি ওভাবে চেয়ে আছে?অরিন তাকানোর কিছু সেকেন্ড পরই মেয়েগুলো অস্বস্তি নিয়ে জায়গা থেকে সরে গেল। অরিন দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। আজকে যদি সেও ইলহানের মতো চোখ ধাধানো সুন্দর হতো তখন হয়তো কেউ এমন অবাক চোখে তাদের দিকে তাকাতো না। হুট করে তাদের সম্পর্ক বুঝতে পেরে চমকে যেতো না। বরং মুগ্ধ হয়ে মনে মনে বলতো,” মাশাল্লাহ, বেস্ট কাপল, বেস্ট পেয়ার।”
অরিন নিজের মনেই হাসলো। কালো-সাদার মিশ্রণ কি কখনও বেস্ট পেয়ার হতে পারে? ইলহান এখনও অরিনের হাতটা চেপে ধরে আছে। ফরসা, গোলাপী আভাময় বলিষ্ঠ হাতের মুঠোয় অরিনের চিকন, অন্ধকারাচ্ছন্ন কালো হাতটা বড্ড বেশিই বেমানান। অরিন হাত ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলো। কিন্তু ইলহান ছাড়ছে না। সে ভ্রু কুচকে বললো,
” কি হয়েছে? যাবে কোথাও?”
” যাচ্ছি না তো। হাত ধরে রেখেছেন কেনো? হাত ছাড়ুন।”
” কেনো? হাতটা ধরে থাকতে আমার ভালো লাগছে। কিন্তু তোমার অস্বস্তি লাগলে ছেড়ে দিবো।”
” না থাক, ধরে থাকুন।”
ইলহান অরিনের হাতটা মুখের কাছে নিয়ে একটা গভীর চুমু দিল। অরিনের শরীরের লোম দাঁড়িয়ে গেল। ইলহান বললো,
” বিয়েতে রাজি হওয়ার জন্য থ্যাংকস। কিন্তু তুমি কি খুশি?”
অরিন জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করে বললো,
” হুম। খুশি।”
ইলহান কতক্ষণ একদৃষ্টিতে অরিনের চোখের দিকে তাকিয়ে রইল। কি দেখলো কে জানে? তারপর হঠাৎ অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বললো,
” ঝোঁকের মাথায় এতোবড় সিদ্ধান্ত নিয়ে পরে আফসোস করবে না তো?”
” না তো! আমি ঝোঁকের মাথায় সিদ্ধান্ত নিয়েছি আপনার কেনো মনে হচ্ছে?”
” জানি না। অরিন একটা কথা বলি, যদি আমাকে সত্যিই ভালোবাসা সম্ভব না হয় তাহলে বলে দাও। আমি অস্ট্রেলিয়া চলে যাবো। আর কখনও তোমার সামনে আসবো না। কিন্তু প্লিজ, আমার জীবনের সাথে নিজেকে জড়িয়ে আমার সবকিছু তছনছ করে চলে যেও না। এইবার কিন্তু আমি আর বাঁচবো না।”
অরিনের কান্না পেয়ে গেল। সে মুখে হাত দিয়ে ফুপিয়ে উঠলো। ইলহান বললো,
” আরে, আরে, কি হলো?”
” আমি তো কালো, অন্ধকার জগতের কালো। আপনার আলোকিত জীবনের সাথে আমাকে কেনো জড়িয়ে ফেললেন? কেনো?”
ইলহান মৃদু হেসে অরিনের গালে হাত রেখে বললো,” আমার সাদামাটা জীবনের সবচেয়ে অপূর্ব রংটা হচ্ছো তুমি। সেটা কি জানো? অন্ধকার ছাড়া আলোর কোনো অর্থই হয় না। অন্ধকার আছে বলেই মানুষ আলোর গুরুত্ব বোঝে। আবার এই অন্ধকার ছাড়া আলো যেমন অর্থহীন, অরিন ছাড়াও ইলহান অর্থহীন।তাই হাজারও রঙের ভীড়ে ইলহান শুধু এই অপরূপ কালো রংটাকেই খুঁজবে। তার অরিনের কালো রঙ। যেটা তার কাছে সবচেয়ে দামী, সবচেয়ে সুন্দর। গ্লেমারাস।”
অরিনের ইচ্ছে হলো কথাগুলো রেকর্ড করে নিয়ে অর্ণভকে শুনাতে। আর উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলতে,
” দেখো ভাইয়া, তোমার কল্পনার সাথে মিলেছে কি-না দেখো? তোমার কল্পনায় আমার ফিউচার হাসব্যান্ড তো এমনি হওয়ার কথা ছিল তাই না? তুমি তো এটাই চাইতে, এমন কেউ আমার জীবনে আসবে যার কাছে আমিই হবো সেরা প্রায়োরিটি।”
” কি ভাবছো?”
অরিন ইতস্তত হয়ে বললো,” কিছু না। আমি একটু শ্যানিন আর আন্টিকে দেখে আসি।”
ইলহান হাত ছাড়লো না। শক্ত করে ধরেই রাখলো। অরিন প্রশ্ন করলো,
” যাবো না?”
” ওরা এখন ঘুমাচ্ছে। তুমি গেলে ডিস্টার্ব হবে। আমার সাথেই থাকো না!”
” কিন্তু আমারও ঘুম আসছে।”
” তাহলে কি ঘুমিয়ে যাবে?”
” হুম। কিন্তু কিভাবে ঘুমাবো? কেবিনেও জায়গা নেই। আন্টি আর শ্যানিন কোনোমতে শুয়েছে। আমি কোথায় শুবো?”
” উমম.. এক কাজ করি চলো। তুমি-আমি গাড়িতে গিয়ে শুয়ে থাকি।”
” কি?গাড়িতে শোয়া যাবে?”
” যাবে না কেনো? আমি ব্যবস্থা করবো, চলো।”
” একই গাড়িতে?”
” গাড়ি তো একটাই আছে। আমি কি গাড়ি সাথে নিয়ে এসেছি? বাবাকে যে গাড়িতে আনা হয়েছে সেটাই তো।”
অরিনের কেনো জানি এই মুহুর্তে পিকে মুভির ড্যান্সিং কারের কথা মনে পড়ছে। সে উশখুশ করতে করতে বললো,” থাক,থাক। গাড়িতে যেতে হবে না। এখানে বসেই আমরা সারারাত গল্প করি। এটাই ভালো।”
” কেনো?”
” এমনি।”
” তুমি কি আমাকে বিশ্বাস করো না অরিন?”
” আমি নিজেকেই বিশ্বাস করতে পারছি না।”
” উহুম, কথা প্যাঁচানোর চেষ্টা করবে না। স্বীকার করো যে আমাকে ভয় পাচ্ছো, অবিশ্বাস করছো।”
” উফফ, সেজন্য না। আমার এখন আর ঘুম আসছে না।”
” ঠিকাছে। তাহলে চলো নিচে থেকে অন্তত কফি খেয়ে আসি?”
” এতোরাতে ক্যান্টিন কি খোলা থাকবে?”
” সেটাও কথা। তাও চলো দেখে আসি। ক্যান্টিন বন্ধ থাকলেও বাগানের আশেপাশে হেঁটে চলে আসবো। মাঝরাতে হাঁটতে ভালোই লাগবে।”
” ঠিকাছে।”
দু’জনই লিফটে ঢুকলো। কিন্তু অরিনের খুব ঘুম পাচ্ছে। ইচ্ছে করছে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘোড়ার মতোই ঘুমিয়ে যেতে। ঘুমের অত্যাচার সহ্য করা এতো কঠিন? অরিন হাত চুলকাতে চুলকাতে বললো,” চলুন গাড়িতেই যাই। আমার খুবই ঘুম পাচ্ছে।”
” শিউর?”
” হ্যাঁ। কিন্তু আপনি সামনে থাকবেন আর আমি পেছনে। একসাথে না কিন্তু।”
ইলহান হেসে বললো,
” আচ্ছা।”
” আর আমরা যে সারারাত গাড়িতে থাকবো এটা কিন্তু কেউ জানবে না প্লিজ।”
” কেনো? আমরা তো আর একসাথে থাকবো না। আমি সামনে তুমি পেছনে। তাহলে সমস্যা কি?”
” সেটা তো আপনি আর আমি জানি। অন্যকেউ কি জানে? কেউ বিশ্বাস করবে?”
ইলহান কিছু বলার আগেই দুম করে লিফটের লাইট নিভে গেল। সম্পূর্ণ জায়গা ঘন অন্ধকারে ঢেকে গেল। অরিন আঁতকে উঠে বললো,
” কি হলো এটা?”
” কারেন্ট চলে গেছে মনে হয়। লিফটে কি জেনারেটরও নেই নাকি?”
” উফফ, কি অন্ধকার! কিচ্ছু দেখা যাচ্ছে না। আচ্ছা আপনি কি আমাকে দেখতে পাচ্ছেন?”
ইলহান অরিনের কাছে এসে বললো,” এইতো, ধরতেও পারছি।”
ইলহান আলতো করে অরিনের কোমর চেপে ধরলো। অরিন বললো,
” ধরে থাকুন। লাইট না আসা পর্যন্ত প্লিজ ধরে থাকুন।”
ইলহান মনোযোগ দিয়ে খেয়াল করলো, অরিনের ভয় পাওয়া কণ্ঠটা অনেক দারুণ! তার মাথায় দুষ্ট চিন্তা চলে আসলো। সে আচমকাই অরিনকে লিফটের দেয়ালে চেপে ধরে নাকে,গলায়, মুখে চুমু দিতে শুরু করলো। প্রচন্ড গরমে, অন্ধকারাচ্ছন্ন, দমবন্ধকর এই অবস্থায় ইলহানের অদ্ভুত আচরণে অরিন এতো ভয় পেল যে কয়েক মুহুর্তেই অচেতন হয়ে গেল। ইলহান ভাবলো হয়তো অরিন ক্লান্ত হয়ে বসে পড়েছে। তাই সেও একইভাবে বসে অরিনকে আদর করতেই থাকলো। কিছুক্ষণ পর অরিনের সম্পূর্ণ শরীর অন্যরকমভাবে কাঁপতে লাগলো। সেই কম্পন অনুভব করে ইলহান চমকে উঠলো। পকেট থেকে ফোন বের করে ফ্ল্যাশ লাইট জ্বালিয়ে দেখলো অরিনের চোখ উল্টে মুখ থেকে সাদা ফেণা বের হচ্ছে। এক কথায় খিচুনি উঠে গেছে। ইলহান ভয় পেয়ে চিৎকার শুরু করলো।
ইমারজেন্সি ওয়ার্ড থেকে সরিয়ে কেবিনে স্থানান্তর করা হয়েছে অরিনকে। অরিনের আবছা আবছা মনে আছে, ইলহান তাকে কোলে নিয়ে দ্রুত ইমারজেন্সী কেবিনে ঢুকলো। পাগলের মতো এদিক-সেদিক ছুটোছুটি করছিল। ঔষধ আনতে বার-বার বের হচ্ছিল। নার্স অরিনকে একটা ইঞ্জেকশন পুশ করলো, তারপর অরিন ঘুমিয়ে গেল। এইমাত্র তার ঘুম ভেঙেছে। শ্যানিনের গলার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে।
” তোর নিক্টোফোবিয়া আছে অরিন। তাই লিফটের কারেন্ট চলে যাওয়ায় ভয়ে খিচুনি উঠে গেছিল। সামান্য জ্বর এসেছিল। আর ঘুম হয়নি দেখে শরীর দূর্বল ছিল। এখন তোকে আমি ব্রেকফাস্টের আগে একটা ও ব্রেকফাস্টের পরে দুইটা ট্যাবলেট খাওয়াবো৷ তোর শরীর একেবারে চাঙ্গা হয়ে যাবে।”
শ্যানিন সাইড টেবিল থেকে প্লেটে পরোটা আর ভাজি নিতে নিতে কথাগুলো বলছিল। অরিন বললো,
” আঙ্কেল কেমন আছে?”
” বাবা ভালোই আছে।”
” আমার বাসা থেকে কেউ ফোন করেনি?”
” আন্টি ফোন করেছিল। তোর অবস্থা শুনে এখন আসবে বলেছে।”
” সত্যি আসছে?”
” হুম। তুই তাড়াতাড়ি ব্রেকফাস্ট করে ঔষধ খেয়ে ফেল। জ্বর আছে নাকি দেখি তো।”
শ্যানিন অরিনের কপালে হাত দিয়ে তাপমাত্রা যাচাই করে বললো,
” জ্বর নেই। তাহলে এই ঔষধটা খেতে হবে না।”
” তোরা সবাই খেয়েছিস?”
” হ্যাঁ, আমরা সবাই ডান। কিন্তু ভাইয়া এখনও কিছু খায়নি।”
” কেনো?”
” তুই ঘুম থেকে উঠলে নাকি সে খাবে।”
” ডাক উনাকে।”
” ডাকছি।”
শ্যানিন বেরিয়ে যাওয়ার একটু পরেই ইলহান অরিনের কেবিনে ঢুকলো মুখটা শুকনো আর মাথা নিচু করে। অরিন বাঁকা দৃষ্টিতে ইলহানের দিকে তাকিয়ে রইল। ইলহান ওর সামনে এসে বললো,
” আই এম স্যরি অরিন।”
অরিন মুখ ফিরিয়ে বললো,” হুহ! আর স্যরি দিয়ে কি হবে? যেই ভয় দেখিয়েছেন আমাকে। ভাগ্যিস গাড়িতে যাওয়া হয়নি। লিফটের মধ্যেই যা শুরু করেছিলেন গাড়িতে গেলে তো আমি লাশ হয়ে যেতাম। যা হয় ভালোর জন্যই হয়।”
” অরিন, আমার কোনো খারাপ ইনটেনশন ছিল না। আর তুমি বাধা দিচ্ছিলে না দেখেই তো আমি থামিনি। নাহলে অনেক আগেই থেমে যেতাম। ট্রাস্ট মি।”
” বাধা দেওয়ার সুযোগটা পেলাম কই? আপনি যেইভাবে চেপে ধরলেন আমি তো শ্বাস পর্যন্ত নিতে পারছিলাম না। দৈত্য একটা!”
ইলহান অপরাধী গলায় আবার বললো,” স্যরি।”
” স্যরি, স্যরি না করে এদিকে আসুন। হা করুন।”
ইলহান বিস্মিত হয়ে বললো,” তুমি আমাকে খাইয়ে দিবে নাকি?”
” হ্যাঁ। কেনো? আমার কালো হাতে খেতে অসুবিধা আছে?”
” আরেহ না! যে হাতে সারাদিন চুমু খেতে ইচ্ছে করে সেই হাতে খাওয়ার সৌভাগ্য মিস করি কিভাবে?”
” ইশশ, ঢং। এবার হা করুন।”
ইলহান আর অরিনের খাওয়া-দাওয়ার দৃশ্যেই অর্ণভ আর হালিমা ঢুকে পড়লেন। অর্ণভ কোমরে হাত দিয়ে বললো,
” বাহ, খাওয়া-দাওয়া চলছে? ভালোই তো।”
অরিন-ইলহান দু’জনেই অপ্রস্তুত হয়ে গেল। ইলহান দাঁড়িয়ে হালিমাকে সালাম দিল। অর্ণভকেও সালাম দিল। অর্ণভ বললো,
” ফ্যামিলি মিটিং হবে। তুমি এখান থেকে যাও।”
অর্ণভের বলার ধরণ দেখে ইলহান আর কথা বাড়ালো না। হালিমার থেকে অনুমতি নিয়ে চলে গেল। হালিমা বিরবির করে অর্ণভকে বললেন,
” ছেলেটা সুন্দর না?”
অর্ণভ বললো,” হুম। সবকিছু ঠিক থাকলে এই ছেলে তোমার নাতি হবে।”
” আস্তাগফিরুল্লাহ। ”
হালিমা কেশে গলা পরিষ্কার করলেন। কি সর্বনাশা কথাবার্তা! অরিনকে ভালো করে বুঝাতে হবে। তিনি অরিনের কাছে বসতে বসতে নরম গলায় বললেন,
” অসুস্থ মানুষ দেখতে এসে নিজেই অসুস্থ হয়ে গেলি? কেমন লাগে বলতো? আমাদেরও কি অসুস্থ বানিয়ে ছাড়বি?”
অর্ণভ বললো,” আমি বলি কি হয়েছে। সারারাত বুড়োর সেবা-যত্ন করতে করতে বেচারি টায়ার্ড হয়ে গেছিল বোধ হয়। তারপর মাথা ঘুরে পড়ে গেছে।”
অরিন ভ্রু কুচকে বললো,” মানে? আমি কার সেবা-যত্ন করেছি?”
” এতো মানে মানে করিস না। মা সব জানে। আমি মাকে সব জানিয়েই নিয়ে এসেছি।”
অরিন মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো,
” নুসাইবা আন্টি তোমাকে বিয়ের বিষয়ে কিছু বলেছে মা?”
” এখনও বলেনি। খালি বলতে আসুক একবার। আমি মুখের উপর না করে দিবো। ”
” মা, তুমি আমাকে ভুল বুঝো না। আমি বলি আসলে কি হয়েছে?”
হালিমা শক্ত করে অরিনের হাত চেপে ধরে বললেন,
” তার আগে তুই বল, তুই কি নিশ্চিত? এই লোককেই বিয়ে করবি?”
” হুম। যদি তোমরা অনুমতি দাও। ”
” তোকে এতো জলদি কেনো বিয়ে দিবো? মাত্র আঠারোতে পড়েছিস। আরও কয়েক বছর যাক। তারপর দেখা যাবে।”
” কিন্তু শায়িখ আঙ্কেল খুব অসুস্থ মা। তাঁর কথা চিন্তা করেই বিয়ের জন্য এতো তাড়াহুড়ো করতে হচ্ছে। নাহলে সব আস্তে-ধীরেই হতো।”
অর্ণভ বললো,” সর্বনাশ! দেখেছো মা, তার মানে তোমার মেয়ে খুব ভালো মতো জানে বুড়োটা মরবে। এজন্য আগে-ভাগেই বিয়ে করে নিতে চাইছে।”
অরিন রেগে-মেগে বললো,” আশ্চর্য! বুড়োটা মরবে মানে? তুমি এসব কি ধরণের কথা বলছো ভাইয়া? কেউ শুনে ফেললে কি ভাববে?”
” কে শুনবে শুনুক। যা ইচ্ছা ভাবুক। বুড়ো বয়সে ভীমরতি ধরে, মেয়ের বয়সী মেয়ে বিয়ে করে। আরে এইসব মানুষকে তো পুলিশে দেওয়া দরকার। মা তুমি বড়মামার ফোন নাম্বারটা দাও তো। আমি ব্যবস্থা নিচ্ছি।”
অরিন তাজ্জব হয়ে তাকিয়ে থেকে বললো,” কে মেয়ের বয়সী মেয়ে বিয়ে করেছে?”
” তোর বুড়ো।”
” ভাইয়া খবরদার আরেকবার বুড়ো বলবে না।”
হালিমা বললেন,” আচ্ছা তোরা ঝগড়া বন্ধ কর। শোন মা, আমি বলি। তুই কি কোনোদিক দিয়ে পঁচে গেছিস? তোকে দেখতে কি এতোই খারাপ? শুধু গায়ের রংটা কালো। কিন্তু এ যুগে এসব কোনো ব্যাপার না। কালো হলেও তোকে দেখতে কত্ত সুন্দর লাগে। আমি আমার এতো মিষ্টি একটা মেয়েকে ওমন দামড়া বেটার কাছে কিভাবে বিয়ে দেই? ছি! রুচি এখনও এতো নিচে নেমে যায়নি আমাদের। তুই যদি আর কখনও এই বিয়ের কথা উচ্চারণ করিস তাহলে আমি মিহরীমাকে নিয়ে ট্রেনের নিচে মাথা দিবো। একদম কসম বলে রাখলাম।”
অর্ণভ হাতে তূরি বাজিয়ে বললো,” পারফেক্ট!”
অরিন হতভম্ব হয়ে গেল। মায়ের কি ইলহানকে এতোই অপছন্দ হয়েছে? শুধু দেখতে লম্বা আর একটু ওয়েট ভালো বলে দামড়া বেটা বলছে? অদ্ভুত! কিন্তু এতে অরিনের একদমই মনখারাপ হয়নি। বরং ভালোই লাগছে। শায়িখ আঙ্কেলের অসুস্থতার জন্য অরিন নিজে দায়ী। সেই অপরাধবোধ থেকেই সে বিয়ের জন্য রাজি হয়েছিল। তাছাড়া রায়হান যদি অরিনকে ভুলে নতুন জীবন শুরু করতে পারে তাহলে অরিন কেনো পারবে না? এইসব চিন্তা করে অরিন বিয়েতে মত দিয়ে ফেলেছে। কিন্তু মা-বাবার অসম্মতিতে বিয়ে করার প্রশ্নই আসে না। তাছাড়া মা জীবনে প্রথমবার বললেন,” আমার এতো মিষ্টি মেয়েটা!” অরিনের এতেই অপরিসীম আনন্দ হচ্ছে। বিয়ে ভেঙে যাক, চুলোয় যাক। তার কিচ্ছু যায়-আসে না।
চলবে