মেঘের পরে রংধনু পর্ব-২৪

0
966

#মেঘের_পরে_রংধনু
#পর্ব_২৪
লিখা: Sidratul Muntaz

অর্ণভ এখনও শ্যানিনদের বাড়ি থেকে ফিরে আসেনি। এদিকে গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান প্রায় শুরু হয়ে গেছে। অরিন ভারী মেকাপের সাজ আর কাঁচা হলুদরঙা শাড়ি পড়ে আয়নার সামনে বসে আছে। একটু পরেই তাকে হলুদের স্টেজে নেওয়া হবে। অরিনের গায়ে হলুদ নিয়ে তেমন বেশি আগ্রহ নেই। যেখানে বিয়েটাই মিথ্যে সেখানে গায়ে হলুদ তো নিছক পাগলামি। অরিন বাঁকা হাসলো। তার মনটা বার-বার অতীতে ডুবে যেতে চাইছে। সেদিন ইলহান যে গাড়ি থেকে নেমে অরিনের দুল খুঁজতে গেল। তারপর যেনো কি হয়েছিল?
সেদিন ইলহানের জন্য অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেও কোনো লাভ হচ্ছিল না। সে ফিরে আসছিল না। এদিকে ঝড়ের অবস্থাও নিয়ন্ত্রণের বাহিরে! সামনে যে ছেলেদের গাড়ি ছিল সেটিও ফোন করে থামানো হলো। গাড়ি থেকে নেমে শ্যানিনের এক বড়ভাই এসে বললেন মেয়েরা যেনো বাসায় চলে যায়। ভাইয়ারা গাড়ি নিয়ে সিআরবি হিলে যাচ্ছে। ইলহানকে খুঁজে পেলে ওরা সাথে নিয়ে আসবে। বাড়ি ফেরার পর শ্যানিন ঘটনা সবাইকে জানিয়ে দিল। সকলের ক্ষোভ উপচে পড়তে লাগলো অরিনের প্রতি। ইলহানের বড়ফুপু জোহরা আবারও তেড়ে এসে অরিনকে একগাঁদা হুমকি-ধমকি দিলেন।
” তোমার রুপার দুল হারাইসে তো কি হইসে? খুঁজোন যাইতো না? কিনোন যাইতো না?রূপার দাম কি আমগোর পোলারতে বেশি নাকি? পোলাডারে পাঠাইতে গেলা ক্যা? হেরে খুইজ্জা না পাইলে তোমারে আমি আস্তা রাখুম না কইয়া দিলাম। দুল হারাইসো দেইখা তোমার মায় তোমারে জবাই দেওনের আগেই আমি তোমারে জবাই কইরা রাইখা দিমু।”
অরিন বকাগুলো শুধু মাথা নিচু করে নিশ্চুপ শুনে যাচ্ছিল। আর চোখের জল ফেলছিল। সে বুঝলোই না তার এইখানে কি দোষ? সে তো ইলহানকে জোর করে দুল খুঁজতে পাঠায়নি। তারপর মারিয়া আর ইতি অরিনকে টেনে ঘরে নিয়ে এলো। সব বান্ধুবিরা মিলে শ্যানিনকে বকাও দিল। শ্যানিন বার-বার একই বোকামি করে। ভাইয়ের শোকে পাগল হয়ে অরিনকে ফাসিয়ে দেয়। ইলহানকে চড় দেওয়ার বিষয়টাও শ্যানিন বিয়ের অনুষ্ঠানে সবাইকে ঘোষণা করে বলে দিয়েছিল। সেজন্য অরিনের কত অপমান হলো। একটু পর নুসাইবা নিজে এসে অরিনের কাছে ক্ষমা চাইলেন। ছেলের জন্য তিনি যে কম চিন্তিত ছিলেন তা না। কিন্তু এতে অরিনের কোনো দোষ নেই সেটা অন্তত বুঝেছিলেন তিনি। নুসাইবা শ্যানিনকেও বকা দিলেন। অরিনকে বুঝালেন যাতে মনখারাপ না করে। ট্রেনে যে অরিন ইলহানকে চড় মেরেছিল সেজন্য বিয়ের অনুষ্ঠান শেষে সবার সামনে শ্যানিন অরিনের নাম ঘোষণা করার পর ইলহান খুব ক্ষেপে গেছিল। কারণ সে চেয়েছিল অরিনের নাম গোপন রাখতে। কিন্তু বেচারি শ্যানিন ভাইয়ের অপমান একটুও সহ্য করতে পারে না। শ্যানিন এতোই ভাই পাগল যে ছোটবেলায় সবাই তাকে ‘ভাইয়ের চাকর’ নামে ডাকতো। শ্যানিন ভাইয়ের জন্য কি কি কান্ড করতো তার একটা উদাহরণ হলো, ইলহানের ছোটবেলায় ভিডিও গেইমসের প্রতি খুব নেশা ছিল। নুসাইবা প্রায়ই ভিডিও গেইমস এর সেট লুকিয়ে রাখতেন। যেনো ইলহান একটু পড়ায় মন দেয়। শ্যানিনের তখন মাত্র দুই- আড়াইবছর। ঠিক করে হাঁটতেও পারে না। আধো আধো স্বরে কথা বলে। ওই বয়সেই সে মায়ের গোপন জায়গা থেকে ভিডিও গেইম নিয়ে ভাইকে দিয়ে দিতো। আবার ইলহানের বেডরুমের দরজাও আটকে বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে পাহাড়া দিতো যাতে কেউ আসতে না পারে। কেউ এলে শ্যানিন চিৎকার করতো। তখন ইলহান সেটা বুঝতে পেরে গেইমসের সেট রেখে পড়তে বসতো। নুসাইবা এসে দেখতেন ছেলে পড়ছে। এভাবে ছোট ভাই-বোন মিলে মা-বাবাকে বোকা বানানোর জন্য কূটনীতি করতো। ইলহান দুষ্টুমির জন্য ছোটবোন শ্যানিনকে ধারালো অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতো। তার যখন যেটা প্রয়োজন হতো শ্যানিনকে বোকা বানিয়ে আদায় করে নিতো। এখনও নেয়। আর শ্যানিন তো সর্বক্ষণ ভাই-ভাই করে জান ছেড়ে দেয়। ইলহানের সমস্ত দোষ, সিকরেট নিজের থেকেও সাবধানে লুকিয়ে রাখে। নুসাইবা ঠাট্টা করে মাঝে মাঝে বলেন,” ভাই যদি তোকে বলে গু খেতে, খাবি?” শ্যানিন এই কথা শুনলেই রেগে যায়। অভিমানী মুখ করে বলে,” ভাইয়া আমাকে এটা কখনও বলবেই না! কিন্তু ছোটবেলায় মনে হয় সে ‘গু’ এর আসল অর্থ বুঝতে পারতো না। তখন তার উত্তর হতো,” অ্যা কাবো।”
এইটুকু শুনে সবাই হেসে ফেললো। শ্যানিনও অভিমানী মুখ নিয়ে সামান্য হেসে ফেললো। নুসাইবা অনেকক্ষণ মেয়েদের সাথে শ্যানিন আর ইলহানের ছোটবেলার গল্প করলেন। তারপর চলে যাওয়ার সময় সান্ত্বনা দেওয়ার মতো বললেন,” তোমরা ঘুমিয়ে যাও। ইলহান ফিরলে আমি খবর পাঠিয়ে দিবো। তুমিও ঘুমিয়ে যাও অরিন, টেনশন করো না। ঠিকাছে?”
অরিন খুব ভালো করে খেয়াল করেছিল নুসাইবা তাকে ভীষণ আদর করছেন। তখন থেকেই তার সন্দেহ হয়। ইলহানের জঘন্য খেলায় শুধু সে একা নয়, তার পরিবারও হয়তো জড়িত।
ইলহান সিআরবি থেকে ফিরে এসেছিল গভীর রাতে। অরিনদের মধ্যে কেউ ঘুম থেকে জাগেনি তখন। যদিও কেউ আয়োজন করে ঘুমায়নি। যে যেভাবে পেরেছে চেয়ারে, মেঝেতে, টেবিলে, সোফায় মাথা রেখে শুয়ে পড়েছে। অরিন তো শাড়িও খুলেনি। ওই সাজ নিয়েই ঘুমিয়ে গেছিল। শ্যানিন শুধু ঘুম থেকে জেগে উঠে দেখেছিল ইলহান রক্তাক্ত অবস্থায় বাড়ি ফিরেছে। ঝড়ের প্রকোপে একটা বড় গাছের ডাল ভেঙে ইলহানের মাথায় পড়ে মাথার একপাশ কেটে গেছে। শ্যানিন যত্ন নিয়ে সেই জায়গায় ব্যান্ডেজ লাগিয়ে দিল। সবাই ইলহানকে খুব বকা-ঝকা করলো এতোবড় পাগলামির করার অপরাধে। সামান্য একটা রূপার দুলের দাম কি তার জীবনের থেকেও বেশি হয়ে গেছিল? কেনো সে এতোবড় ঝুঁকি নিতে গেল!
অরিন সকালে ঘুম থেকে উঠে এতো বেশি চমকে গেল যে প্রায় পাঁচমিনিটের মতো শুধু চিৎকার করলো। মুক্তি ভাবীদের বাড়ির মাঠের প্রান্তরে যে বিশাল উঁচু একটা পর্বত আছে সেই পর্বতের চূড়ায় বালিশ-চাদর বিছিয়ে অরিনকে শুয়িয়ে রাখা হয়েছে। অরিন কিছুই বুঝতে পারছে না সে এই জায়গায় কিভাবে আসলো? রাতে তো সে সবার সাথে ঘরেই ঘুমিয়েছিল। অরিন ঘুমালে তার একদম হুশ থাকে না। কিন্তু তাই বলে তাকে এতোবড় পাহাড়ে নিয়ে আসা হলো আর সে একটুও টের পেল না? এটা কিভাবে সম্ভব? তাছাড়া অরিনের মনের সবচেয়ে বড় প্রশ্নটি হলো, তাকে এই পাহাড়ে কে তুলে এনেছে? অরিন উঠে দাঁড়িয়ে জোরে জোরে চিৎকার করতে লাগলো। ইলহান পেছন থেকে অরিনের হাত আর মুখ শক্ত করে চেপে ধরে বললো,
” বলেছিলাম না, ভাইয়া ডাকলে জোর করে কিস করবো? সেটা কিন্তু তুমি ঘুমিয়ে থাকা অবস্থায় অসংখ্যবার করে ফেলেছি। এখন বেশি চিৎকার আর নড়াচড়া করলেই ধাক্কা মেরে পাহাড় থেকে ফেলে দিবো। আমি যেটা বলি সেটা যেকোনো মূল্যে করেই ছাড়ি। এইটা তোমার এতোক্ষণে বুঝে যাওয়ার কথা চকলেটি!”
অরিন জোর করে ইলহানের হাত মুখ থেকে সরিয়ে বললো,” চকলেটি মানে? কে আপনার চকলেটি?”
” তুমি আমার চকলেটি। তোমার নাম মিষ্টি না? তাই মিষ্টি থেকে চকলেটি, শন পাপড়ি, রসগোল্লা, সন্দেশ, জিলাপি..”
” আপনি কি মিষ্টি বিশেষজ্ঞ? নাকি গুণ্ডা? নাকি খুনী? নাকি কিডন্যাপার? আপনার মধ্যে তো সবকিছুর প্রতিফলন একসাথে দেখা যাচ্ছে।”
অরিনের কণ্ঠে ত্রাস। ইলহান হেসে পকেটে হাত গুজে উত্তর বললো,
” আরও একটা জিনিসের প্রতিফলন আছে। সেটা সবচেয়ে স্পেশাল। দেখাবো?”
” আগে আমাকে এই পাহাড় থেকে নামতে দিন। বলা তো যায় না, কখন সত্যি-সত্যি ধাক্কা মেরে ফেলে দিবেন। নয়তো আমিই উল্টে পড়ে যাবো।”
” আমি থাকতে তোমার কিচ্ছু হতে দিবো না। আর আমি তোমাকে ফেলবো না। প্রমিস করছি, ফেলবো না। একটু শান্ত হয়ে দাঁড়াও প্লিজ। তোমাকে আমার আরেকটা রূপের প্রতিফলন দেখানো এখনও বাকি।”
অরিন চোখ বন্ধ করে ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে রইল। ইলহান এখন তার কাছে শুধুই একটা সাইকো ছাড়া অন্যকিছু না। এতো অদ্ভুত কান্ড যে করতে পারে সে না জানি আরও কি কি করতে পারে? ঘুমন্ত অবস্থায় অরিনকে একদম পাহাড়ের চূড়ায় নিয়ে চলে এলো? ও মাই গড!
ইলহান অরিনের সামনে হাঁটু গেড়ে বসলো। অরিনের ডানহাতটা নিয়ে সেই হাতে কিছু একটা গুঁজে দিল। অরিন চোখ খুলেই দেখতে পেল মায়ের সেই রূপালী দুল! অরিনের মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। খুশি হয়ে ইলহানকে ধন্যবাদ দিতে যাবে তার আগেই ইলহান বললো,
” মানুষ প্রপোজ করে আংটি দিয়ে, টেডি দিয়ে অথবা ফুল দিয়ে। আর আমি হলাম এক গাঁধারাম। প্রপোজ করছি দুল দিয়ে! তবে এইটা কিন্তু যেনো তেনো দুল নয়। বলতে পারো এর জন্য আমাকে জীবন বাজি রাখতে হয়েছে। তাই এই দুল আমার কাছে নিজের জীবনের মতো দামী। এইযে মাথার সাদা ব্যান্ডেজটা দেখতে পাচ্ছো, এজন্যও কিন্তু তোমার এই দুল দায়ী।”
ইলহান হঠাৎ অরিনের বামহাতটা নিয়ে নিজের কপালে ঠেকিয়ে বললো,
” দেখো তো আমার শরীরে জ্বর আছে না-কি? এখন মনে হয় চলে গেছে। কিন্তু গতরাতে অনেক জ্বর এসেছিল। তোমাকে কতবার খুঁজেছি জানো? তুমি একবারও আসলে না। তাই এবার নিজেই তুলে আনলাম। ঠিক করেছি না?”
অরিন উত্তর না দিয়ে বোকার মতো তাকিয়ে রইল। ইলহানের কথাগুলো সব তার মাথার এপাশ-ওপাশ দিয়ে যাচ্ছে। কিছুই মাথার ভেতরে ঢুকছে না। অথবা অরিন নিজেই এসব কথা মাথায় ঢোকাতে চাইছে না। ইলহান হঠাৎ উঠে খুব জোরে টান মেরে গায়ের নেভি ব্লু জ্যাকেট খুলে ফেললো। অরিন কিঞ্চিৎ কেঁপে উঠলো আতঙ্কে। এরপর তাকিয়ে দেখলো ইলহানের জ্যাকেট থেকে ঝরঝর করে বেলী ফুল এসে অরিনের গায়ে লেপ্টে যাচ্ছে। অরিন হতবাক হয়ে গেল। প্রথমে সে ভেবেছিল পোকা। তাই ভয়ে সরে গিয়ে চেঁচাতে নিচ্ছিল। তারপর ভালোভাবে খেয়াল করে দেখলো ফুল। একরাশ বিস্ময় নিয়ে ইলহানের দিকে তাকালো সে। ইলহান একটা বেলী ফুল মাটি থেকে কুড়িয়ে গন্ধ শুঁকে বললো,
” খুব সুন্দর সুভাষ তাই না? মানুষ বলে বেলী ফুলের সুভাষ নাকি খুব মিষ্টি, মোহনীয়! বেশিরভাগ মানুষের কাছেই এই সুভাষ অত্যন্ত প্রিয়। কিন্তু জানো অরিন? এই বেলীফুলের সুভাষ আমার কাছে শুধু ততক্ষণ প্রিয় যতক্ষণ তোমার চুলের সুভাষ এর সাথে মিশে থাকে।”
ইলহান অরিনের চুলে বেলীফুলটা গুঁজে খুব আসক্তের মতো চুলের ঘ্রাণ নিল। অরিন কিছুটা দূরে সরতে চাইল। কিন্তু পা ফসকে নিচে পড়ে যাচ্ছিল। এর আগেই ইলহান একহাতে শক্ত করে ধরলো অরিনকে। অরিন চমকে তাকালো ইলহানের মুখের দিকে। ইলহান হেসে বললো,
” এমন একটা জায়গায় আমরা দাঁড়িয়ে আছি যেখান থেকে ইচ্ছে করলেই আলাদা হওয়া যায় না। আমার থেকে দূরে যেতে চাইলেই তোমাকে জীবন দিতে হবে। পা ফসকে যেকোনো মুহুর্তে একদম নিচে। একবার পড়লে আর রেহাই নেই। তাই ইচ্ছে না থাকলেও এভাবেই দাঁড়িয়ে থাকতে হবে তোমাকে। ঠিক আমার চোখের সামনে। আমার সব কথা আজকে শুনতে হবে। নাহলে সত্যি-সত্যি পাহাড় থেকে ফেলে দিবো বুঝেছো?”
অরিন ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। এতোবড় হুমকি? এইভাবেও কেউ কাউকে প্রপোজ করতে পারে? আস্তো সাইকো না হলে এই কাজ কারো দ্বারা সম্ভব না। অরিন ঢোক গিললো যথেষ্ট কষ্ট নিয়ে। ইলহান আবার গলার স্বর নরম করে বলতে লাগলো,
” তুমি আমাকে কতটা বদলে দিয়েছো জানো?কিছুদিন আগেও আমার প্রিয় ছিল রঙধনুর সাতরঙ। কিন্তু তোমাকে দেখার পর থেকে আমি মনে হয় কালার ব্লাইন্ড হয়ে গেছি অরিন। সবকিছুতে শুধু কালো আর কালোই দেখতে পাচ্ছি। আমার প্রিয় রঙ হয়ে গেছে শুধু কালো! এখন মাঝে মাঝে মনে হয় আকাশে রঙধনুর জায়গায় যদি সাতটি ঝকঝকে কালো রঙ থাকতো তাহলে রঙধনু আরও বেশি আকর্ষণীয় হতো। কিন্তু সাতটি কালো রঙ কি হয়? কালো রঙ তো একটাই। আর আমার কাছে কালো রঙ মানেই অরিন রঙ। গতকাল যখন তোমাকে এই শাড়িতে দেখলাম তখন আমার কি মনে হয়েছিল জানো? পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্য কালো-সাদার মিশ্রণ। আমার কালারফুল জীবন এক নিমেষে সাদা-কালো হয়ে গেল কি করে বলো তো? আমি নিজেই তো পুরোপুরি তুমিময় হয়ে গেছি। অরিনময় হয়ে গেছি। অরিন ছাড়া আমার একটা মুহুর্তও চলছে না। এতো সুন্দর তুমি কেনো হলে অরিন? আমার এই চোখ এখন সারাক্ষণ তোমার ঠোঁটের নেশালো হাসি, চোখের ভয় পাওয়া চাহনী, এলোমেলো চুলের অবাধ্যতা, কোমড়ের ভাজ, সেই অদ্ভুত সুন্দর কালো সমুদ্র…সব ম্যাজিক্যাল দৃশ্য খুঁজে বেড়াচ্ছে। কোনোভাবেই নিজেকে আটকে রাখা যাচ্ছে না।”
অরিন সাথে সাথে পেটে হাত দিয়ে দেখলো তার শাড়িটা ঠিক জায়গায় আছে কি-না। হ্যাঁ ঠিক জায়গাতেই আছে। তবুও অরিন আরও ভালো করে শাড়ি ঠিক করে নিল। ইলহান কথা বলে গেলো।
” আমি হেরে গেছি অরিন। আমার মন হার মেনেছে তোমার সৌন্দর্য্যের কাছে, সত্যি! এইবার তো এই যন্ত্রণা থেকে আমাকে মুক্তি দাও। নয়তো মৃত্যু নিশ্চিত। বুকের বামপাশের এই অসহ্য ব্যথা নিয়ে আমি আর বাঁচতে পারছি না।”
ইলহান আবারও হাঁটু গেড়ে বসে পড়লো অরিনের সামনে। কাতর দৃষ্টিতে চোখ মেলে বললো,
” আমি তোমার কাছে শুধু তোমাকেই চাইছি। খুব, খুব, খুব করে চাইছি। দিবে তোমাকে?”
অরিন নিজেকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করলো। কঠিন মুখভঙ্গিতে বললো,” অসম্ভব। এটা কখনও হয় না। আপনি তো জানেন আমার প্রেমিক জীবিত আছে। তারপরেও কিভাবে এই দুঃসাহস দেখালেন?”
ইলহান ভ্রু কুচকে খুব আহত কণ্ঠে বললো,” তোমার প্রেমিক!”
” শ্যানিন আপনাকে এখনও বলেনি? যার শোকে কাতর হয়ে ট্রেনে আপনাকে চড় মেরেছিলাম! রায়হানের থেকে কষ্ট পাওয়ার পর আমি সুইসাইড করতে গিয়েছিলাম। কিন্তু আপনি আমাকে বাঁচিয়ে দিলেন। কেনো বাঁচিয়েছিলেন আমাকে? যদি না বাঁচাতেন তাহলে আজকের এই অসহ্য দিনটা আমার জীবনে আসতো না। আপনি আমাকে মেরে ফেলার হুমকি দিচ্ছেন তো? আরে যেখানে আমি নিজেই একটা জ্যান্ত লাশ সেখানে আপনি আমাকে কিভাবে মারবেন? বরং আমি নিজেই নিজেকে হত্যা করতে চাই৷ এই যন্ত্রণাদায়ক জীবন থেকে নিজেকে মুক্তি দিতে চাই!”
অরিন পাহাড় থেকে লাফ দিতে নিল। ইলহান দুইহাতে শক্ত করে অরিনের কোমড় আঁকড়ে ধরলো। তাকে সাবধানে একটা নিরাপদ জায়গায় এনে দাঁড় করিয়ে বললো,
” এইরকম করো না অরিন। এইটা কি ধরণের পাগলামি? যে তোমার জীবন শেষ করে দিয়েছে তাকে শাস্তি দেওয়ার কথা চিন্তা না করে তুমি নিজেকে শাস্তি দিচ্ছো? আমাকেও শাস্তি দিচ্ছো? এইটা কি ঠিক? ওই একটা খারাপ মানুষের জন্য আমরা দুইজন নির্দোষ মানুষ কেনো কষ্ট পাবো বলো? তার চেয়ে এটাই ভালো নয় কি যে আমরাই একে-অপরের পরিপূরক হয়ে যাই? তুমি ভুলে যাও না সেই কলুষিত অতীতকে। কষ্টের দিন ভুলে যেতে হয়। দেখো, তোমার বর্তমানটা কত সুন্দর। তাহলে বর্তমানকে মেনে নিতে কি সমস্যা অরিন? প্লিজ অরিন,আমাকে ফিরিয়ে দিও না প্লিজ!”
অরিন দুইহাতে মাথা চেপে ধরে পাগলের মতো বললো,” পারবো না, পারবো না, পারবো না!”
” পারবে, তুমি অবশ্যই পারবে। আমি তোমাকে হেল্প করবো। যতদিন না তুমি রায়হানকে ভুলে আমাকে গ্রহণ করতে পারবে ততদিন আমি তোমার পিছু ছাড়বো না অরিন।”
” এইটা কোনোদিনও সম্ভব না। দয়া করে এসব মাথাতেও আনবেন না। আমাকে ভুলে যান। এটাই আপনার জন্য উত্তম।”
” তোমাকে ভোলার চেয়ে মৃত্যু উত্তম।”
” তাহলে মরে যান!”
অরিন সজোরে ধাক্কা মারলো ইলহানকে। উচ্চকণ্ঠে বললো,
” মরে যান প্লিজ।”
অরিন কথাটুকু বলেই থমকে গেল অদ্ভুত শব্দে।পেছনে তাকাতেই দেখলো ইলহান ততক্ষণে মুখ থুবড়ে পড়ে গেছে নিচে। রক্তগঙ্গা বয়ে যাচ্ছে সবুজ ঘাসে! অরিন জ্ঞান হারিয়ে ফেললো। সেদিন ইলহান আর অরিনের মাঝে কি হয়েছিল কেউ জানে না। সবাই এই ঘটনা এক্সিডেন্ট বলেই ধরে নিয়েছিল। কিন্তু অরিন নিজে জানতো, ইলহানের ওই ভয়ংকর অবস্থার জন্য সে দায়ী। এ কারণে অরিন তীব্র অপরাধবোধে সর্বক্ষণ নিজের সাথে লড়াই করে যাচ্ছিল।হসপিটালে ইলহানকে প্রায় একমাসের মতো থাকতে হয়েছিল। এই একমাস ধরেই সে পাগলের মতো শুধু একটা নাম জপ করেছে, অরিন, অরিন আর অরিন। এমনকি ডাক্তার বাধ্য হয়ে নিজেই বলেছেন অরিন নামের মেয়েটিকে হসপিটালে আনার ব্যবস্থা করতে। নয়তো ইলহানকে স্বাভাবিক করা অসম্ভব।শুধু একবার অরিনের মুখ দেখার জন্য ইলহানের যে কত আকুলতা, কত আক্ষেপ! কিন্তু অরিন ইলহানকে হসপিটালে একদিনও দেখতে যায়নি। কারণ অ্যাংকারের কড়া নিষেধ ছিল। ওহ, এতো বড় অতীত স্মৃতিপটে বিশ্লেষণ করতে গিয়ে অরিন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষটাকেই বাদ রেখে দিয়েছে। এখন তার কথা বলা জরুরী। সেই মানুষটি হচ্ছে মার্টিন অ্যাংকার। সবাই জানে অ্যাংকার ইলহানের সবচেয়ে ভালো বন্ধু। কিন্তু শুধু অরিন জানে, অ্যাংকার ইলহানের কত বড় শত্রু!

চলবে

( শুধু এইটুকু বলবো, ধৈর্য্য ধারণ করুন। অবশ্যই ভালো কিছু অপেক্ষা করছে। আর আমার দৃঢ় বিশ্বাস, সেই ভালোটা সবার ভালো লাগবে।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here