মেঘের পরে রংধনু পর্ব-২৬

0
846

#মেঘের_পরে_রংধনু
#পর্ব_২৬
লিখা: Sidratul Muntaz

ঘড়িতে রাত এগারোটা বাজে। অরিন আয়নার সামনে বসে স্পঞ্জের সাহায্যে মুখ থেকে মেকাপের প্রলেপ অপসারণ করছিল। ঠিক ওই সময় ফোনটা বেজে উঠলো। ফোনের স্ক্রিনে তাকাতেই মুখ থেকে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসলো অরিনের। ইলহান আবারও ফোন করেছে। আজকে সারাদিন না হলেও পঞ্চাশ থেকে ষাটবার সে অরিনকে ফোন করেছে। প্রত্যেকটা পদক্ষেপেই যেনো তার অরিনের পরামর্শ চাই। একবার ফোন করে জানতে চাইলো সে কি রঙের পাঞ্জাবী পরবে। অরিন বললো,” যেটা ইচ্ছা পরুন।” তখন ইলহান জানতে চাইলো অরিন কি রঙের শাড়ি পরেছে। অরিন বললো বাসন্তী রঙ। ইলহান তখন নিজের হলুদের পাঞ্জাবী বাদ দিয়ে বাসন্তী রঙের পাঞ্জাবী কিনে আনলো! সেই পাঞ্জাবী পরে অরিনকে মেসেঞ্জারে ছবিও পাঠালো। অরিন তখন বলেছিল, আপনাকে লেমন কালার পাঞ্জাবীতে বেশি ভালো লাগবে। যদিও বাসন্তী রঙেও ইলহানকে অন্যরকম সুন্দর লাগছিল। কিন্তু অরিন তো মরে গেলেও ইলহানের প্রশংসা করবে না। অন্যদিকে ইলহান সত্যি সত্যি লেমন কালার পাঞ্জাবী কেনার জন্য হলুদের স্টেজ থেকে উঠে গেল।শায়িখ-নুসাইবা কতবার নিষেধ করলেন। বললেন এইভাবে স্টেজ থেকে উঠে পরা যায় না। মানুষ কি ভাববে? তখন ইলহানের জবাব ছিল,” মানুষের ভাবাভাবিতে আমার কিছু যায় আসে না। আমি শুধু ভাবছি আমার বউ কি ভাববে? যে রঙের পাঞ্জাবী আমার হবু বউয়ের অপছন্দ সেই রঙের পাঞ্জাবী পরে আমি হলুদ মাখবো না। আগে অরিনের পছন্দের রঙের পাঞ্জাবী পরবো। তারপর হলুদ লাগাতে বসবো।” শ্যানিন অরিনকে ফোন করে হাসতে হাসতে এসব কিছু জানিয়েছিল। অরিনের কাছে ইলহানের এই সমস্ত আচরণ নিছক ন্যাকামি মনে হয়েছে। একটা ছেলেমানুষ হয়ে সে এতো ন্যাকামি কিভাবে করতে পারে? যত্তসব! অরিন ফোন রিসিভ করতে করতে নিজের মনে বললো,” না জানি এই ন্যাকুরাম আবার কোন ন্যাকামি দেখাতে ফোন করেছে।”
” হ্যালো।”
ফোনের অপর পাশ থেকে ইলহান বললো,
” অরিন, তোমাদের অনুষ্ঠান কি শেষ হয়েছে?”
” হুম। অলমোস্ট শেষ। ”
” এখন কি করছো?”
” ফ্রেশ হচ্ছি। ঘুমিয়ে যাবো জলদি। টায়ার্ড লাগছে।”
” এতো অল্পতেই টায়ার্ড হয়ে যাও তুমি? বিয়ের রাতেও কি তুমি টায়ার্ড থাকবে? ঘুমিয়ে যাবে? তাহলে কিন্তু..”
অরিন বাকি কথা বলতে দিল না ইলহানকে। ধমক দেওয়ার মতো করে বললো,” এইসব বলতে ফোন করেছেন? জরুরী কিছু বলার থাকলে বলুন নয়তো ফোন রেখে দিবো।”
” আচ্ছা শোনো, আমি একটু গাড়ি নিয়ে বের হয়েছি। তোমাদের এদিকেই আসবো।”
” কেনো আমাদের এদিকে আসবেন?”
” তোমাকে পিক করতে।”
” মানে? আমি কোথায় যাবো আপনার সাথে?”
” আমি তোমাকে নিয়ে লং ড্রাইভে যাবো। তাছাড়া আজকে আমাদের হলুদ ছিল। অথচ আমরা কেউই কাউকে হলুদ লাগাইনি। তোমার কি ইচ্ছে করছে না নিজের হাতে আমার গালে একটু হলুদ লাগাতে?”
” একদমই ইচ্ছে করছে না। এমন অদ্ভুত ইচ্ছে আমার কেনো করবে?”
” তোমার কাছে এটা অদ্ভুত কেনো মনে হলো অরিন?”
” অবশ্যই অদ্ভুত। দেখুন এসব আজে-বাজে চিন্তা বাদ দিয়ে ঘুমান। বিয়ের দিন ছাড়া আমাদের আর একবারও দেখা হচ্ছে না।”
অরিন ফোন রেখে দিতে চাইল। ইলহান বললো,
” অরিন, আমি এখন গাড়িতে আছি। তোমাদের ওইদিকে আসতে সর্বোচ্চ চল্লিশ মিনিট লাগবে। তাই রেডি হওয়ার জন্য তোমার হাতে চল্লিশ মিনিটই আছে। এর মধ্যে নিচে না আসলে আমিই উপরে চলে আসবো৷ আন্টিকে বলবো, তুমি ফোন করে আমাকে আসতে বলেছো।”
” হোয়াট? আমি রাত বারোটা বাজে আপনাকে বাসায় আসতে বলবো কেনো? মা কি ভাববে?আপনার কি লজ্জা-শরম নেই?”
” আমার নেই। কিন্তু তোমার তো আছে। তুমি যদি মা-বাবার সামনে লজ্জা পেতে চাও, তাহলে এসো না! থাক, আমিই আসছি।”
” ঠিকাছে আমিই আসবো। কিন্তু আপনি এসব উল্টা-পাল্টা কাজ করবেন না প্লিজ!”
” আই লভ ইউ অরিন।”
অরিন ফোন কেটে দিল। আর মনে মনে হতাশ গলায় বললো,” ব্লেকমেইলার একটা!”
অর্ণভ দরজায় টোকা দিল।
” আসতে পারি?”
” আমার ঘরে আসতে কি অনুমতিপত্র লাগবে? আসো ভাইয়া।”
অর্ণভ অরিনের বিছানায় এসে বসলো। অরিন ভালো করে অর্ণভের দিকে ঘুরে তাকিয়ে আয়েশ করে বললো,
” সারাদিন তো কথা বলার সুযোগই পেলাম না। এখন বলো, সুমনা কিছু বলেছিল পরে?”
অর্ণভ কয়েক মুহুর্ত চুপ থেকে বললো,” তোকে মিস করছিল সে। এজন্য দেখতে চেয়েছে। এছাড়া তেমন জরুরী কিছু না।”
” সত্যি?”
” মিথ্যে বলবো কেনো?”
অরিন মনে মনে দুশ্চিন্তায় পরে গেল। ভাইয়া কি আসলেই কিছু জানতে পারেনি? সুমনা অর্ণভ ভাইয়াকে কিছু বলেনি কেনো? নাকি সুমনা নিজেই ইলহানকে দেখে চিনতে পারেনি? অরিন তো ভেবেছিল ইলহানকে দেখেই মনে হয় সুমনা অস্থির হয়ে গেছে। কারণ ইলহান যে তার নিশিতা আপুর বয়ফ্রেন্ড! হ্যাঁ, নিশিতার সাথে যে ইলহানের ফোনে কথা হয় এই বিষয়টা অরিন জানে। নিশিতা নিজেই অরিনকে বলেছিল একবার। অরিন তখন একটুও অবাক হয়নি। কারণ সে ইলহানের কলুষিত চরিত্র সম্পর্কে আগে থেকেই অবগত। তাছাড়া নিশিতার সেই ডেলিভারিবয় যে ইলহান মাহদী ছাড়া অন্য কেউ নয় সেটাও অরিন নিশ্চিত হয়েছে অ্যাংকারের মাধ্যমে। অ্যাংকার খুব ভালো স্কেচ করে। মানুষের কাছে বিবৃতি শুনেই সে যেকোনো মুখাবয়ব এঁকে ফেলে। নিশিতা যখন তার ডেলিভারি বয়কে খুঁজতে মরিয়া হয়ে যাচ্ছিল তখন অরিন নিজেই বুদ্ধি করে অ্যাংকারের সাথে নিশিতার ভিডিওকলে কথা বলিয়ে দিয়েছিল। নিশিতা ইলহানের চেহারার বর্ণনা দিয়েছিল আর অ্যাংকার পোট্রের্ট এঁকেছিল। তারপর দেখা গেল অরিন যা ভাবছে তাই সত্যি! সেই পোট্রের্টের মানুষটিই অরিনের অতি সুপরিচিত ইলহান মাহদী। অরিন তখন একটু অবাক হয়েছিল। অবাক হয়েছিল এই ভেবে যে ইলহান এতোকিছু থাকতে ডেলিভারি বয়ের চাকরি কেনো করে? তার তো টাকার অভাব থাকার কথা নয়। তাহলে কি ডেলিভারি বয়ের চাকরিটা ইলহান নিশিতা, নৌশিনের মতো সুন্দরী মেয়েদের ফাঁসানোর জন্য করে? অর্ণভ হঠাৎ বললো,
” আমার একটা প্রশ্নের উত্তর দিবি অরিন?”
” বলো ভাইয়া।”
” তুই কি এই বিয়েটায় খুশি?”
” হ্যাঁ। খুশি হবো না কেনো? সবাই যেখানে খুশি সেখানে আমি খুশি না হয়ে থাকতে পারি?”
” আচ্ছা, তোর বিয়ের পাত্র যদি ইলহান না হয়ে অন্যকেউ হতো তাহলেও কি তুই এতোটাই খুশি থাকতি?”
” উমম.. সেটাও ডিপেন্ড করে তোমাদের উপর। তখনও যদি তোমরা সবাই এভাবেই খুশি থাকতে তাহলে আমিও খুশি থাকতাম।”
” তার মানে তুই আমাদের সবাইকে খুশি রাখার জন্য এই বিয়েটা করছিস?”
” না। আমি নিজেও খুশি এই বিয়ে নিয়ে। কিন্তু এসব জিজ্ঞেস করছো কেনো? তোমার কি মনে হয় আমি খুশি না?”
অর্ণভ কৃত্রিম হাসি দিয়ে বললো,” কি জানি?”
তারপর সে একটু নড়েচড়ে বসলো। কিছু একটা চিন্তা করে আবার বললো,” আচ্ছা অরিন, মনে কর তুই বিয়ের পরে জানতে পারলি তোর হাসব্যান্ড সুবিধাজনক নয়। মানে সে মানুষ হিসেবে ততটা ভালো নয় যতটা তুই ডিজার্ভ করিস। তখন তুই কি করবি?”
” ভালো নয় বলতে?”
” মানে হচ্ছে.. আচ্ছা ফ্রীলি বলি, ধর তুই হঠাৎ একদিন জানতে পারলি ইলহান পরকিয়ায় আসক্ত। যদি বিয়ের পর এটা জানতে পারিস তখন তুই কি স্টেপ নিবি?”
অরিন প্রথমে ভ্রু কুচকালো। তারপর নিচের ঠোঁট উল্টে কাঁধ নাড়িয়ে বললো,
” ডিভোর্স দিয়ে তোমাদের কাছে চলে আসবো!”
” সত্যিই কি ডিভোর্স দিবি?”
” হ্যাঁ অবশ্যই। যে এতোবড় প্রতারণা করবে তাকে ডিভোর্স দিবো না?”
” সে যদি ক্ষমা চায়?”
” কিছু কিছু অপরাধের ক্ষমা হয় না ভাইয়া। শুধু শাস্তি হয়। আর আমার দৃষ্টিতে পরকিয়ার মতো জঘন্য অপরাধের শাস্তি দুই রকম হওয়া উচিৎ। হয় ঝেড়ে ফেলো নয় মেরে ফেলো।”
অর্ণভের চোখগুলো হঠাৎ জ্বলে উঠলো। সে ভরাট গলায় বললো,
” সাবাশ!”
অরিন হেসে বললো,” তোমার কি হয়েছে ভাইয়া? হঠাৎ এগুলো জিজ্ঞেস করছো কেনো?”
অর্ণভ উত্তর দিল না। কিছুক্ষণ হাসি হাসি মুখে তাকিয়ে থেকে বললো,
” এমনি। আচ্ছা এখন আমি যাচ্ছি। তুই রেস্ট নে।”
অর্ণভ উঠে দরজা পর্যন্ত যেতেই অরিন বললো,” ভাইয়া, আমাকে এখন একবার বের হতে হবে।”
” কই যাবি?”
অরিন মাথা নিচু করে বললো,” কাজ আছে।”
” এতোরাতে আবার কাজ কিসের? কোথাও যেতে হবে না। ঘুমা।”
অর্ণভ বেরিয়ে যাওয়ার সময় অরিন কিছুটা জোরে শব্দ করে বললো,” ইলহান আমাকে নিতে আসবে ভাইয়া।”
অর্ণভ থেমে গেল কথাটা শুনে। অরিনের এই কথা ড্রয়িংরুম থেকে হালিমাও শুনতে পেলেন। তিনি দরজার সামনে এসে বললেন,
” জামাই নিতে আসছে মানে? কই যাবি তোরা?”
অরিন অস্বস্তি নিয়ে বললো,” সে গাড়ি নিয়ে বাসার নিচে আসবে। আমাকে বলেছে বের হতে। কোথায় যাবো জানি না।”
হালিমা আর অর্ণভ একবার চোখাচোখি করলো। অর্ণভ বললো,
” বিয়ের আগে এতো মেলা-মেশার দরকার কি? আর এক দিন পরেই তো বিয়ে। এখন কেনো রাতের বেলা বাহিরে গিয়ে তোদের দেখা করতে হবে?”
অরিন মাথা নত করে বললো,” থাক, তোমরা নিষেধ করলে যাবো না।”
হালিমা সঙ্গে সঙ্গে বললেন,” ওমা যাবি না কেনো? ছেলেটা এতো কষ্ট করে আসবে! অবশ্যই যাবি। না গেলে যদি মাইন্ড করে?”
অরিন মায়ের কথা শুনে বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে গেল। অর্ণভও চমকে উঠলো। মনে মনে আফসোসও করলো। যে জামাইকে নিয়ে মায়ের এতো আনন্দ,বিশ্বাস,গর্ব তার আসল রূপ জানার পর মা সহ্য করতে পারবেন তো? অরিন মনে মনে চিন্তা করলো, বিয়েটা ভেঙে গেলে মায়ের এই হাসি, আনন্দ,উচ্ছ্বাস সব হারিয়ে যাবে৷ এতোবড় ধাক্কা মা কি সামলাতে পারবেন? হালিমা ভ্রু কুচকে বললেন,
” ওমা, তোরা ভাই-বোন মিলে আমার দিকে এইভাবে তাকিয়ে কি দেখছিস? আমি কি ভুল কিছু বলেছি? যে ছেলের সাথে দুইদিন পর বিয়ে তার সঙ্গে দেখা করতে অসুবিধা কোথায়? অরিন, যা তুই। আমি অনুমতি দিলাম। ”
অর্ণভ বললো,” তাহলে আমিও যাবো।”
এইবার হালিমা আর অরিন অর্ণভের দিকে চমকে তাকালো। হালিমা বললেন,
” তুই ওদের মাঝখানে গিয়ে কি করবি?”
” মানে আমি অরিনকে নিচে পর্যন্ত দিয়ে আসবো।”
” আজব! ও কি মিহরীমা যে হেঁটে হেঁটে সিঁড়ি পার হতে পারবে না? তোর নিয়ে দিয়ে আসতে হবে কেনো?”
” ধূর, এতোকিছু বুঝি না। আমিই ওকে নিয়ে যাবো ব্যস! অরিন, তুই তৈরী হো। আমিও তোর সাথে বের হচ্ছি।”
অর্ণভ ঘাড়ত্যাড়ার মতো এই কথা বলে তার রুমে চলে গেল। হালিমা ফিসফিস করে বললেন,” অর্ণভের মাথা খারাপ হয়ে গেছে মনে হয়। তুই চুপিচুপি বের হয়ে যা তো! ও যেনো টের না পায়।”
অরিনের হাসি পেল মায়ের কথা শুনে। জামা বদলানোর জন্য অরিন দরজা আটকে মোবাইলের কাছে আসতেই দেখলো ইলহানের ম্যাসেজ।
” সাদা রঙের জামা পরে এসো, প্লিজ।”
অরিন দীর্ঘশ্বাস ফেলতে ফেলতে বললো,
” এই মানুষটার শখের শেষ নেই।”
আলমারি থেকে সাদা একটা সেলোয়ার-কামিজ বের করলো অরিন। চুল ছেড়ে ভালোমতো আঁচড়ে নিল। কানে রূপার দুল পড়লো। তারপর ড্রয়ার থেকে মাইক্রোফোন আর সিকরেট ক্যামেরা বের করলো। ডানকানে মাইক্রোফোন লাগিয়ে নিল। আর সিকরেট ক্যামেরাটা নিজের হাতব্যাগে আটকালো। ইলহানের সাথে অরিন যতবার দেখা করে ততবার এই দুইটি জিনিস সাথে নেয়। সিকরেট ক্যামেরা দিয়ে অ্যাংকার ওদের উপর নজর রাখে। আর মাইক্রোফোন দিয়ে অ্যাংকার অরিনের সাথে কথা বলতে থাকে। অরিন বললো,
” শুনতে পাচ্ছো অ্যাংকার? আমি বের হচ্ছি এখন।”
” এতোরাতে কোথায় বের হচ্ছো?”
” ইলহান আমাকে লং ড্রাইভে নিয়ে যাচ্ছে।”
অ্যাংকারের কণ্ঠ চড়া হয়ে গেল।
” এতোরাতে লংড্রাইভ কিসের? ফাজলামি পেয়েছে নাকি ও?”
” আমারও বিরক্ত লাগছে।”
” তোমাকে বলেছিলাম না? বিয়ের আগে ও তিরিং বিরিং করবেই। অরিন প্লিজ, খুব সাবধানে থাকবে। ইলহানের থেকে দূরে দূরে থাকবে।”
” নিশ্চয়ই। এটা তুমি না বললেও আমি করি। ওর থেকে সবসময় একহাত দূরত্ব বজায় রাখি।”
” গুড! কিন্তু আমার টেনশন হচ্ছে। একেক সময় ওর একেক কাহিনী। কাল সারারাত তোমার বারান্দায় থাকলো। এখন আবার লংড্রাইভে। তুমিও ওর প্রস্তাবে রাজি হয়ে যাচ্ছো কেনো?”
” এমনভাবে ব্লেকমেইল করে যে রাজি না হয়ে উপায় থাকে না। কিন্তু এবার তুমি টেনশন করো না। ভাইয়াও আমাদের সাথে যাচ্ছে।”
” কেনো?”
” জানিনা। আমার মনে হয় ভাইয়া ইলহানকে সন্দেহ করছে।”
” দ্যাটস গুড! তার মানে সুমনা বোম্ব ব্লাস্ট করে দিয়েছে।”
” হতে পারে। কিন্তু আমি এখনও নিশ্চিত নই। শোনো
অ্যাংকার, তুমি এই দেশে কবে আসবে?”
” কালকেই ফ্লাইটে উঠবো।”
” এতো দেরি কেনো? তুমি আসার আগেই আমার বিয়ে না হয়ে যায়। ”
” ইম্পসিবল! আমি থাকতে তোমার সাথে ইলহানের বিয়ে কখনও হতে দিবো না অরিন। টেনশন ফ্রী থাকো।”
” আমি জানি, কিন্তু তুমি আরও তাড়াতাড়ি এলে আমি সাহস পেতাম। আমার ভীষণ ভয় হচ্ছে ইলহানকে।”
” ভয়ের কিছু নেই। শুধু আমার কথা মনোযোগ দিয়ে শোনো আর মানো তাহলেই হবে।”
” ইলহান যদি আমার সাথে কোনো রকম জোর জবরদস্তির চেষ্টা করে আমি কিন্তু ওকে খুন করবো অ্যাংকার। সত্যিই খুন করবো।”
” প্লিজ অরিন, এই রিস্ক নিও না। ওকে তুমি কেনো মারবে? তুমি এতো নিষ্পাপ একটা মেয়ে হয়ে ওর মতো জানোয়ারকে মেরে কেনো নিজের হাত নোংরা করতে চাও? আমাকে আগে আসতে দাও আমি সব ঠিক করে দিবো।”
” ইলহান তো তোমার বেস্টফ্রেন্ড। তোমার কি ওর জন্য মায়া লাগে অ্যাংকার? সত্যি কথা বলো?”
” মায়া তো একটু লাগবেই। কিন্তু সেই মায়াকে আমি প্রশ্রয় দেই না। অন্যায়ের শাস্তি তো অন্যায়কারীকে দিতেই হবে তাই না?”
” একদম তাই। ও আমার জীবনটা শেষ করে দিচ্ছে।গত এক বছর ধরে প্রত্যেকটা মুহুর্ত আমাকে আতঙ্কে কাটাতে হচ্ছে শুধু মাত্র ওর জন্য। সারাক্ষণ একটাই ভয়, এই বুঝি শেষ হলো সব! ধ্বংস হলাম আমি! আমার কি মনে হয় জানো অ্যাংকার? ইলহান হয়তো বুঝে গেছে যে আমি ওকে খুন করতে চাই। তাই এতোবার সুযোগ পাওয়া সত্ত্বেও ও আজ অবধি আমার কোনো ক্ষতি করেনি। নাহলে ওর কাছে কত সুযোগ ছিল বলো? যেদিন ও আমাকে কিডন্যাপ করলো সেদিন তো ও চাইলেই কোনো অঘটন ঘটাতে পারতো। কিন্তু ও কিচ্ছু করেনি। জাস্ট একটু জড়িয়ে ধরলো তারপর ছেড়ে দিল? তাছাড়া যেদিন আমি রাতে ওর বাড়িতে গেছিলাম আর ও গাড়ি করে আমাকে বাসায় পৌঁছে দিতে আসলো সেদিনও ওর হাতে সুবর্ণ সুযোগ ছিল। ও চাইলেই কি পারতো না আমাকে ভুল কোথাও নিয়ে যেতে? তারপর সারাজীবনের মতো আমার বাড়ি ফেরা বন্ধ করে দিতে? শায়িখ আঙ্কেল যখন হসপিটালে ছিলেন আমি ভাইয়াকে নিয়ে ওর ফ্রেন্ডের ফ্ল্যাটেও গিয়েছিলাম। সে তখনও কোনো ভুল করেনি। শুধু হসপিটালের লিফটে.. আমার অন্ধকার ভীতি না থাকলে আমি ওইসময় ওকে সত্যি খুন করে ফেলতাম। তোমার কথাও শুনতাম না। কিন্তু ওর ভাগ্য ভালো যে আমি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম। নয়তো ও আজকে এই পৃথিবীতে বুক ভরে শ্বাস নেওয়ার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলতো। আমি ঠিকই ওকে শেষ করে ফেলতাম অ্যাংকার! কাল তো ও সারারাত আমার বারান্দাতেই ছিল। অথচ কাল ও একবারের জন্যেও অসদাচরণের চেষ্টা করেনি আমার সাথে। তার মানে কি আমার মতো সেও সাবধানে থাকছে? নয়তো ওর কাছে যে পরিমাণ সুযোগ ছিল তাতে ও অনায়াসে আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে নিজের উদ্দেশ্য আদায় করে নিতে পারতো। এই বিয়ের নাটক করার কোনো প্রয়োজনই হতো না। কিন্তু ও কেনো খেলাটা কে এতো জটিল বানাচ্ছে। ও কি তাহলে আমাদের পরবর্তী চাল ধরতে পেরে গেছে? ও হয়তো জানে, কাছে আসার চেষ্টা করলেই আমি ধারালো ছুরি দিয়ে ওর শরীর থেকে কলিজা আলাদা করে ফেলবো।”
অরিনের কণ্ঠের ঝাঁঝ দেখে অ্যাংকারের সত্যিই অবাক লাগছে। সে মৃদু হেসে বললো,
” আচ্ছা অরিন, তোমাদের দেশের সব মেয়েই কি তোমার মতো? ”
” আমার মতো মানে?”
” মানে তোমার মতোই সাহসী? প্রতিবাদী? ”
” জানি না, কিন্তু আমি শুধু আমার মতোই।”
” সবসময় এমনই থেকো। এজন্যই বাংলাদেশী মেয়ে আমার এতো পছন্দ। ”
অরিন একটু হেসে বললো,” তোমাকে অনেক ধন্যবাদ অ্যাংকার। তুমি যদি এই ভয়ংকর সময়গুলোতে এইভাবে আমার পাশে থেকে সাজেশন না দিতে তাহলে আমি কখনও এতো সাহস পেতাম না। কবেই অন্যান্য মেয়েদের মতো ইলহানের উচ্ছিষ্ট হয়ে যেতাম। কিন্তু তুমি সাথে আছো বলেই অরিন এখন পর্যন্ত সুরক্ষিত আছে। তোমার প্রতি আমার.. ”
অরিন আর কিছু বলতে পারলো না। অর্ণভ রুম থেকে বের হচ্ছে। অরিন ইতিমধ্যে দরজা খুলে জুতো পড়ে নিয়েছে। অর্ণভ বললো,
” রেডি তুই?”
” হ্যাঁ ভাইয়া, এইতো বের হচ্ছি।”
” চল।”
অরিন ফিসফিস করে বললো,” লাইনে থেকো অ্যাংকার। তোমার শ্বাস নেওয়ার শব্দ শুনলেও আমার আত্মবিশ্বাস বাড়ে!”
” ডোন্ট ওরি। আই এম অলওয়েজ উইথ ইউ।”

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here