মেঘের পরে রংধনু পর্ব-৩১

0
915

#মেঘের_পরে_রংধনু
#পর্ব_৩১
লিখা: Sidratul Muntaz

হসপিটালের ক্যান্টিনে কফি মগ হাতে নিয়ে পাশাপাশি বসে আছে অরিন আর অ্যাংকার। অ্যাংকারই প্রথমে কথা শুরু করলো,
” তোমাকে খুব উজ্জ্বল লাগছে অরিন।”
অরিন স্মিত হাসি দিয়ে বললো,” কালো মানুষের আবার উজ্জ্বলতাও থাকে?”
” ওহ অরিন, তুমি হয়তো জানো না। কালোই তোমার রূপের ঝলক। যদি তুমি ফরসা হতে তাহলেও তোমার এই কালো রূপের কাছে সেই ফরসা রঙ ফিকে পড়ে যেতো। তুমি একদম অন্যরকম একটা সুন্দর। সবার চেয়ে আলাদা। বিশেষ করে তোমার চেহারা, লম্বা চুলের বাহার, চোখ, চোখের ঘন পাপড়ি। এতো বড় চোখের পাপড়ি আমি খুব কম মানুষের দেখেছি৷ আর তোমার মতো খুব সুন্দরী কালো মেয়েও আমি অনেক কম দেখেছি। রেয়ার বলা যায়। তাই দয়া করে আর কখনও গায়ের রঙ নিয়ে নিজেকে শেমিং করো না। এই রঙ নিয়েও তুমি সর্বসুন্দরী। অন্তত আমার চোখে।”
” আমি আমার সৌন্দর্য্য নিয়ে অসন্তুষ্ট না অ্যাংকার।বরং আমি অনেক খুশি যে আমার গায়ের রঙ কালো। এই কালো রঙের মাধ্যমেই আমি মানুষ চিনতে পেরেছি।”
” কিরকম?”
” আমার ছোটবেলার কাহিনী তো জানোই। বড় হওয়ার পরেও মানুষের কাছে গায়ের রঙের জন্য অনেক কটু কথা শুনতে হয়েছে, অপমান সইতে হয়েছে। এখনও আমাদের সমাজটা সুন্দরের পূজারী। তারা মানুষের গাঁয়ের রঙকে এতো বেশি প্রাধান্য দেয় যে শুধু অসুন্দর হওয়াটাকেই অপরাধ মনে করে। একমাত্র অসুন্দর হওয়ার অপরাধে একজনকে মানসিকভাবে কত টর্চার সহ্য করতে হয় তা নিজচোখে দেখেছি, অনুভব করেছি। যেখানে ফ্যামিলির মানুষ পর্যন্ত অপমান করতে বাদ রাখে না সেখানে বাহিরের মানুষের কথা আর কি বলবো? তবে একটা কথা জানো অ্যাংকার? ইলহানকে দেখার পর আমার এই ধারণা একদম বদলে গেছে। ও আমাকে কি বলে জানো? আমার গাঁয়ের এই কালো রঙটাই ওর সবচেয়ে পছন্দ। আমাকে দেখার পরই ও জানতে পেরেছে কালো’তে কত মায়া। এজন্যই আমাকে মায়াপরী বলে ডাকে। এরচেয়ে বড় কমপ্লিমেন্ট আমার কাছে আর কি হতে পারে?”
অ্যাংকার হাতের ঘড়িতে সময় দেখে নিয়ে বললো,” অরিন, আমার আর পাঁচমিনিট পর অনলাইনে একটা মিটিং এটেন্ড করতে হবে। এখন আমি যাই। পরে কথা বলবো।”
” কফিটা শেষ করে যাও?”
” চিনি বেশি হয়েছে। এতো স্যুগার আমি খাই না।”
” ও, আচ্ছা তাহলে আরেকটা দিতে বলি? স্যুগারটা ঠিক রেখে?”
অ্যাংকার হেসে বললো,” বললাম তো পরে আসবো আবার।”
অ্যাংকার উঠে দাঁড়ালো। অরিন ওর কাছে গিয়ে বললো,
” একটা কথা বলি?”
” বলো।”
” কাউকে অবিশ্বাস করে পস্তানোর চেয়ে বিশ্বাস করে ঠকে যাওয়াই ভালো নয় কি? একবার ঠকলে সেটা জীবনের সুন্দর শিক্ষা হয়ে দাঁড়াবে। কিন্তু যদি পস্তাতে হয়? সেই পস্তানোর আক্ষেপটা কোনোদিন মিটবে না!”
” তাই বলে কি তুমি জেনে-বুঝে ঠকতে চাইবে?”
” জেনে-বুঝে নয় অ্যাংকার।ইলহানের প্রতি এখন আমরা শুধু শুধু সন্দেহ করছি। ও যে কতটা বদলে গেছে এটা না তুমি বুঝতে চাইছো আর না আমাকে বুঝতে দিচ্ছো। আচ্ছা তুমিই বলো, জোভান ভাই আর মুক্তি ভাবীর বিয়েতে কি সুন্দরী মেয়ের অভাব ছিল? সবাইকে ছেড়ে ইলহান কেনো আমাকেই.. ”
অ্যাংকার অরিনের ঠোঁটে আঙুল ঠেকিয়ে ওর কথা বলা বন্ধ করলো। এরপর নিজে বললো,
” তুমি হয়তো নিজেই জানো না অরিন, তুমি আসলে সবচেয়ে সুন্দর!”
” অ্যাংকার, তুমি কি আমার উপর রাগ করেছো? ভাবছো আমি তোমার কথার গুরুত্ব দিচ্ছি না? এমনটা নয় অ্যাংকার। আমি মানছি ইলহান খারাপ ছিল। কিন্তু সে এখন বদলে গেছে। এটা তোমাকেও মানতে হবে। নয়জন খারাপ মানুষের জন্য আমরা একজন ভালো মানুষকে যেমন অবিশ্বাস করতে পারি না তেমন একজন মানুষের নয়টি খারাপ কাজের জন্য তার একটি ভালো কাজকে কেনো অসম্মান করবো বলো? সে যদি ভালো হওয়ার চেষ্টা করে তাহলে আমাদের কি উচিৎ না তাকে সাপোর্ট করা? তার পাশে দাঁড়ানো?”
অ্যাংকার দীর্ঘশ্বাস ফেলতে ফেলতে বললো,” যেমন তোমার ইচ্ছা।”
অরিন আলতো করে অ্যাংকারের গালে একটা চুমু দিল। তারপর বললো,”তুমি আর ইলহান দুজনই আমার জন্য ইম্পোর্ট্যান্ট। তোমাদের আমি খুব ভালোবাসি৷”
অ্যাংকার হালকা করে হাসলো। অরিন অ্যাংকারের হাত চেপে ধরে বাধিত স্বরে বললো,
” তুমি যেমন খুব ভালো একজন বেস্টফ্রেন্ড তেমনি একজন ভালো মানুষ।”
অ্যাংকার ঠোঁটে হাসি আনার চেষ্টা করলো এবং বললো,
” তুমিও।”
অ্যাংকার চলে যেতেই অর্ণভ চোখ-মুখ কুচকে ক্যান্টিনের ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বললো,” তোদের মেয়ে মানুষের রুচি এতো খারাপ কেনো? এই স্যাম্পলটার গালে কি করে চুমু খাস তোরা? লজ্জা করে না?”
অরিন কফিতে চুমুক দিতে দিতে দায়সারাভাবে বললো,” লজ্জার কি আছে?”
” একটু আগে দেখলাম শ্যানিনও এইটাকে ধরে চুমু খাচ্ছে। এখন দেখি তুইও শুরু করেছিস। আমার তো দেখলেই বমি আসে। ইয়াক!”
” শ্যানিন ওকে চুমু খেয়েছে বলে কি তোমার হিংসা লাগছে ভাইয়া?”
” আমার কেনো হিংসা লাগবে? শ্যানিন এই গরুকে চুমু খাক কি রামছাগলকে চুমু খাক তাতে আমার কি? কিন্তু আমার সমস্যা হচ্ছে অন্য জায়গায়।”
” কোন জায়গায়?”
” এই বেটার কানে দুল, নাকে ফুল, গলায় মালা, চুলে ব্যান্ড৷ এই অবস্থা কেনো জঙলিদের মতো? জিনিসটা ছেলে না মেয়ে আমি কিন্তু সাতদিনেও বুঝতে পারলাম না।”
” ভাইয়া, প্রথমত অ্যাংকার নাকে ফুল পড়েনি। আর গলায় মালাও নেই। শুধু চুলে ব্যান্ড আর এককানে একটা দুল পড়েছে। তাতে কি এমন ক্ষতি হয়েছে?”
” কথা হলো সে মেয়েদের জিনিস পড়বে কেনো? ছ্যাচড় জানি কোথাকার!”
” ভাইয়া, ও তো আমাদের মতো না। দেখে নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছো ও থার্ড জেন্ডার। এভাবে বলছো কেনো? হি ইজ ভেরি ট্যালেন্টেড। তুমি জানো, ও অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন ইউনিভার্সিটিতে সাইকোলজি নিয়ে লেখাপড়া করছে। একই সাথে ও একজন গ্রেট মিউজিশিয়ান। আর খুব ভালো স্কেচও পারে। দেখেছো, একজন অসম্পূর্ণ মানুষকে আল্লাহ ট্যালেন্ট দিয়ে কেমন স্বয়ংসম্পূর্ণ করে দিয়েছে? আল্লাহ সবাইকেই কোনো না কোনোদিক দিয়ে ঠিকই পরিপূর্ণতা দান করে। এটাই হলো তার প্রমাণ।”
অর্ণভ কিছু একটা ভেবে বললো,” ছেলেটার বিহেভিয়ার আমার কাছে ভালোই লেগেছে। যখন তুই অসুস্থ ছিলি তোর অনেক খেয়াল রেখেছে। ইলহানের মা-বাবাকেও সামলে রেখেছে। মাঝখানে শায়িখ আঙ্কেল অনেক অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। তাঁকেও হসপিটালে ভর্তি করতে হয়েছে। অ্যাংকারের সেবায় তিনিও এখন মোটামুটি সুস্থ। আমার মনে হয়, সাইকোলোজি বাদ দিয়ে নার্সিংএ এই বেটা বেশি ভালো করতো।”
” ভাইয়া, তুমি কি ওকে নিয়ে মজা করছো?”
অর্ণভ হাসলো। অরিন বললো,” আচ্ছা, লাঞ্চ করতে এসেছো না? আমিও সারাদিন কিছু খাইনি। চলো কিছু অর্ডার করি।”
” হুম, দেখ তুই কি নিবি?”
” তুমি কোনটা নিবে?”
” তুই যা বলবি তাই।”
” শিউর?”
” হুম।”
” ওকে তাহলে কাচ্চি।”
” এতোকিছু থাকতে এটাই কেনো? খালি পেটে এতো ভারী খাবার খেতে হয় না। মাইল্ড কিছু অর্ডার কর। কাচ্চি পরে।”
” তুমি সবসময় এমনই করো।”

অরিন ইলহানের কেবিনে প্রবেশ করতেই ইলহান সোজা হয়ে বসতে বসতে বললো,
” এদিকে আসো তো অরিন।”
অরিন কাছে গিয়ে বসলো ইলহানের। ইলহান বললো,
” সামনে ঘুরে বসো।”
” কেনো?”
” বসতে বলেছি।”
অরিন ইলহানকে পিঠ দেখিয়ে সামনে ঘুরে বসলো। ইলহান একটানে অরিনের ঝুঁটি খুলে ফেললো। অরিন বললো,” আরে কি করছো?”
” চুল আঁচড়ে দিচ্ছি।”
” আমি নিজেই আঁচড়াতে পারি।”
” একদম চুপ। কত আঁচড়াতে পারো সেটা তো দেখতেই পাচ্ছি। এতো সুন্দর চুলের কি অবস্থা করেছো বলো তো? জট লেগে পাখির বাসা হয়ে আছে। আন্টি আমাকে সব বলেছে অরিন। গত সাতটি দিন ধরে তুমি হয়তো বাঁচতেও ভুলে গেছিলে। কেনো অরিন? যদি আমাকে এতোই ভালোবেসে থাকো তাহলে কেনো আগে এতো কষ্ট দিতে?”
অরিন গম্ভীর স্বরে বললো,” কারণটা তুমি জানো ইলহান।”
” জানি। কিন্তু বিশ্বাস করি না। অতীতে আমার এক্স গার্লফ্রেন্ডস ছিল বলে তুমি আমাকে ভালোবাসা সত্ত্বেও এইভাবে শাস্তি দিয়েছো? এটা তো কোনো কারণ হতে পারে না। তোমাকে পাওয়ার পর আমি তো কখনও অন্যকারো প্রতি আসক্ত হইনি। তুমি আমার সেই ভালোবাসা,যাকে একবার ভালোবাসতে শুরু করলে অন্যকাউকে ভালোবাসার ইচ্ছেটাই মরে যায়।”
অরিন কান্নামিশ্রিত কণ্ঠে বললো,” স্যরি, আমি তোমাকে অবিশ্বাস করেছি।”
” এই অবিশ্বাসের কারণটা জানতে পারি? কি-না করেছি আমি তোমার জন্য? আমার পাগলামি তো তুমি নিজচোখে দেখেছো। তবুও কেনো এতো অবিশ্বাস?”
অরিন অ্যাংকারের কথাটা বলতে নিয়েও থেমে গেল। সে চাইছে না তার জন্য দুই বেস্টফ্রেন্ডের সম্পর্ক নষ্ট হোক। অ্যাংকারের জীবনটা এমনিতেই নিঃসঙ্গতায় ঘেরা। ইলহানকে হারিয়ে সে আরও নিঃসঙ্গ হয়ে যাক এটা অরিন চায় না। অরিন ইলহানের দিকে ঘুরে বসে বললো,
” এখন থেকে আর কখনও অবিশ্বাস করবো না। কথা দিচ্ছি।”
ইলহান অরিনের দুইহাত মুঠোয় নিয়ে চুমু দিল। তারপর বললো,” কখনও হারিয়ে যেও না প্লিজ। অরিনকে ছাড়া ইলহান একদম বাঁচবে না।”
অরিনও একইভাবে ইলহানের দুইহাত নিয়ে চুমু দিয়ে বললো,” ইলহানকে ছাড়াও অরিন একদম বাঁচবে না।”
ইলহান অনতিবিলম্বে অরিনকে বুকে জড়িয়ে ধরলো।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here