মেঘের পরে রংধনু পর্ব-৩৯ শেষ পর্ব

0
7670

#মেঘের_পরে_রংধনু
#শেষপর্ব
লিখা: Sidratul Muntaz

সেদিন ভার্সিটি থেকে ফিরে আসার পর প্রচন্ড মেজাজ খারাপ হলো অরিনের। আর কখনও ক্যাম্পাসে মুখ দেখানোর জো নেই। ইলহান সবার সামনে অরিনের পায়ে ধরে ফেলেছিল। তারপর অসহ্য ন্যাকামো শুরু করলো। অরিন একাধারে তিন-চারটা চড় মেরেও ইলহানকে থামাতে পারেনি৷ মানুষজন ছবি তুলছিল, হাসি-তামাশা করছিল। বেশিরভাগ মানুষ অরিনকে অনুরোধ করলো যাতে ইলহানকে ক্ষমা করা হয়। অরিনের বুঝে আসলো না কারো ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে মানুষের এতো মাথাব্যথা কিসের? ইলহানকে সে ক্ষমা করবে কি করবে না এটা তার নিজস্ব বিষয়। এইখানে মানুষ কেনো মাথা ঘামাতে আসবে? কিছুদিন পর ইলহান আরও বড় ঘটনা ঘটালো। সেদিন ছিল তুমুল বৃষ্টি। সন্ধ্যা থেকেই আকাশে গুমোট ভাব। রাত আটটা নাগাদ বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। অরিন সুপার শপ থেকে বাসায় ফিরছিল। একটা রিকশাও পায়নি বলে পায়ে হেঁটেই দ্রুত আসছিল। পুরো শরীর ভিজে জপজপে অবস্থা হলো। ইলহান গাড়ি নিয়ে অরিনের সামনে দাঁড়ালো৷ অরিনকে অনুরোধ করলো যেনো তার গাড়িতে উঠে। কিন্তু অরিন রাজি হলো না। সে ইলহানের গাড়ি পাশ কাটিয়ে চলে যেতে লাগলো। ইলহান বাড়াবাড়ি করতে বাধ্য হলো। রাস্তার মাঝেই অরিনকে জোর জবরদস্তি কোলে নিয়ে গাড়িতে উঠালো৷ অরিন রাগে ইলহানের মুখে থু মেরে দিল। ইলহান সেই থুতু টিস্যু দিয়ে পরিষ্কার করলো। অরিনকে কিছুই বললো না। বরং তার কোমড়ে সিটবেল্ট বেঁধে রাখলো যেনো বের হতে না পারে। অরিন মোচড়ানো শুরু করলো। ইলহান শান্ত কণ্ঠে বললো,
” এই অবস্থায় রাস্তায় কেনো বের হয়েছো? কত বিপদ আসতে পারে। তোমার কি কমন সেন্স নেই অরিন?”
অরিন জবাব দিল না। রাগে ওর সারা শরীর রি রি করছিল। ইলহান বললো,
” তোমার পেছনের ছেলেগুলো খুব বাজে ভাষায় টিটকিরি মারছিল। তুমি কি ওদের কথা শুনতে পাওনি?”
অরিন এইবার মুখ খুললো,” ওরা যেমনই হোক আপনার চেয়ে ভালো। আপনার মতো নকল বিয়ের নাটক সাজিয়ে বিছানায় নিয়ে যায় না।”
ইলহান কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। অরিন একদম দমলো না। সে আরও বললো,
” আপনার মতো মানুষরূপী নরপিশাচ আমি আর একটাও দেখিনি৷ কি ভেবেছেন এসব করলেই আমি গলে যাবো? আবার আপনার কাছে ফিরে আসবো? ভুল করেও এই স্বপ্ন দেখবেন না। অরিনকে আপনি হারিয়ে ফেলেছেন। শত চেষ্টা করলেও অরিনকে আপনি পাবেন না। না, না, না!”
ইলহান মুখ চেপে ধরলো অরিনের।
” চুপ, একদম চুপ। আর একটা কথাও না।”
এইটুকু বলেই ইলহান গাড়িতে প্রবেশ করে অরিনের পাশে বসলো। ওর গায়ে যে টি-শার্ট ছিল সেটা খুলে জোর করে অরিনকে পরিয়ে দিল। আর নিজে খালি গায়ে রইল। অরিন ইলহানের গায়ের দিকে তাকাতে পারছিল না। পুনরায় তার মাথা চক্কর দিতে লাগলো। ইলহানের সৌন্দর্য্য তাকে বেহুশ বানিয়ে ফেলেছে। অরিন একটা নিষিদ্ধ কাজ করতে বাধ্য হলো। ইলহানকে জড়িয়ে ধরে তার গলায়, গালে, বুকে চুমু দিতে শুরু করলো। ইলহান ড্রাইভ করা থামিয়ে দিল।দু’হাতে অরিনকে জড়িয়ে ধরে বললো,
” প্লিজ অরিন, চলো আমরা বিয়ে করি।”
অরিন কিছুক্ষণ কেঁদে ভাসালো। তারপর ইলহানের বাহু থেকে নিজেকে মুক্ত করে বললো,” আপনি আর কখনও আমার সামনে আসবেন না প্লিজ। যদি আসেন তাহলে আমি বিষ খাবো। সত্যি বলছি। আপনার দিব্যি।”
অরিন প্রথম সিটবেল্ট খুললো। গাড়ির দরজা খুলে কাঁদতে কাঁদতেই বের হয়ে গেল। ইলহান অরিনের ফোনে ম্যাসেজ করলো,
” যতক্ষণ না তুমি রাজি হচ্ছো ততক্ষণ আমি এভাবেই রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকবো৷ বৃষ্টি,ঝড়, তুফান এমনকি ভূমিকম্প আসলেও আমাকে তাড়াতে পারবে না।”
অরিন ম্যাসেজ দেখেও কোনো জবাব দিল না। সে বাসায় ঢুকে গেল। জামাকাপড় বদলে বারান্দায় এসে দেখলো ইলহান গাড়িতে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ওর ফরসা আর বিশালদেহী শরীর বৃষ্টির পানিতে ভিজে একাকার হচ্ছে। অরিন বারান্দার দরজা আটকে দিল। ইলহানকে ক্ষমা করার ইচ্ছে থাকলেও সে ক্ষমা করতে পারছে না। কোথায় যেনো একটা বাঁধা। ভয়ংকর বাঁধা অরিনকে দমিয়ে রেখেছে। সেই বাঁধার উৎস কোথায় অরিন নিজেও জানে না। বিছানায় শুয়ে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে গেল অরিন। ভোর হলো। বাহিরে অনেক চেঁচামেচি শুনে অরিন যখন বের হলো, দেখলো ইলহান রাস্তার মাঝে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। মানুষজন ভীড় জমিয়ে ওকে দেখছে। ওর শরীরটা বরফের মতো ঠান্ডা। চোখেমুখে রক্তিম আভা। অরিনের গা শিউরে উঠলো। সে কাঁদতে কাঁদতে ইলহানকে বাসায় আনার ব্যবস্থা করলো। অরিনের রুমে শুইয়ে রাখা হলো ইলহানকে। হালিমা আর ফয়সাল সাহেব অস্থির হয়ে গেলেন। ছেলেটার কিছু হয়ে গেলে তারা কি করবেন?ফয়সাল সাহেব ডাক্তার আনতে গেলেন৷ হালিমা ইউটিউব খুঁজে জ্বর ছাড়ানোর আয়ুর্বেদিক টোটকা বের করতে লাগলেন। ইলহানের গায়ে তখন আগুনের উত্তাপের মতো জ্বর। অরিন ইলহানের পাশে বসে অবিরত কাঁদতে লাগলো। ইলহানের কপালে একটা, দুইটা করে অনেকগুলো চুমু দিল। আর বললো,
” তুমি এমন পাগলামি কেনো করো ইলহান? তুমি এমন কেনো?”
ইলহান অরিনের হাতের তিনটি আঙুল চেপে ধরে বললো,
” যদি বলো ভালোবাসি, সাজাবো তারার মেলা, খুঁজবো স্বপ্নের ভুবন, যদি কথা দাও তুমি। থাকবো পাশে আজীবন।”
অরিন কাঁদতে কাঁদতে বললো,” আই লভ ইউ।”

এই ঘটনার এক মাস পেরিয়ে যায়। অবশেষে স্থির হয় সেই প্রতীক্ষীত দিন। আজ অরিন-ইলহানের বিয়ে। মাসব্যাপী বিপুল আয়োজনের মাধ্যমে সবার সম্মতিতে সারা এলাকা সাজিয়ে বিয়ের আয়োজন করা হয়েছে। অরিনের সবসময় ইচ্ছে ছিল তার বিয়েটা হবে খুব ঘরোয়াভাবে, আয়োজন হবে একদম সাদামাটা। বিয়ের দিন সে পড়বে খুব সাধারণ একটা শাড়ি। হালকা গয়না আর একটু সাজগোজ। তার হবু স্বামী শুধু একটা সাদা পাঞ্জাবী পড়বে৷ কাজী আসবে, কবুল বলবে, সবাই দোয়া-দরুদ পড়বে। ব্যস, বিয়ের আয়োজন শেষ। কিন্তু সেই স্বপ্নের গুড়ে বালি। অরিনকে ভোর পাঁচটা বাজে পার্লারে নেওয়া হয়েছিল। অথচ বিয়ে হবে সন্ধ্যায়। অরিন হিসেব করে দেখেছে বিয়ের দিন পুরো বারো ঘণ্টা সময় সে পার্লারে নষ্ট করেছে। কি বিছরি ব্যাপার! অরিন একাই যে শুধু পার্লারে ছিল তা না, তার সাথে নিশিতা, নৌশিন, সুমনাও ছিল। সুমনা আগের চেয়ে অনেক সুন্দরী হয়ে গেছে। এখন ওকে দেখলেই ভাবী বলে ডাকতে ইচ্ছে করে। আগে দেখলে মনে হতো বাচ্চা একটা মেয়ে। আর এখন মনে হয় সুন্দরী ভাবী। বিয়ের পরে কি সব মেয়েদের চেহারাতে এমন ম্যাচিউরিটি চলে আসে? অরিন বাবাকে শর্ত দিয়েছিল তার বিয়ের সকল আয়োজন অর্ণভ করবে। তাই অর্ণভকে বাড়ি ফিরিয়ে আনতে হবে। ফয়সাল সাহেব কিছুতেই রাজি হলেন না। পরে অনেক অনুরোধের মাধ্যমে তিনি আরেকটি শর্ত দিয়ে তবেই রাজি হলেন। শর্ত হলো যতদিন অরিনের বিয়ে চলবে ততদিন অর্ণভ বাড়ি থাকতে পারবে। তারপর তাকে আবার চলে যেতে হবে। বিয়ের স্টেজ সাজানো হয়েছিল অরিনদের এলাকার একটি মাঠে। বড় বড় আর্টিফিসিয়াল গাছ এনে, লাইটিং করে চমৎকার অবস্থা। অরিনের শাড়ির রঙ ছিল অফ হোয়াইট। সেই শাড়ির সাথে ম্যাচিং করে ইলহানও অফ হোয়াইট শেরয়ানি পরেছে। ওকে সেই শেরয়ানিতে এতো সুন্দর দেখাচ্ছে যে অরিনের মনে হলো তার এখনি জ্বর চলে আসবে। সত্যি সত্যি শরীর খারাপ করতে লাগলো। অর্ণভের বান্ধুবি বিথিও এসেছিল বিয়েতে। অর্ণভ যখন বিথিকে ইলহানের সাথে পরিচয় করাতে আনলো তখন বিথি ফোঁড়ন কেটে বললো,
” এই বুঝি তোর পঞ্চাশোর্ধ বয়সের আধদামড়া বুড়ো?”
অর্ণভ লজ্জা পেয়ে গেল। ইলহান এই কথা বুঝতে না পেরে হাসার চেষ্টা করলো। ভ্রু কুচকে জানতে চাইলো,
” মানে?”
বিথি মানে বুঝানোর আগেই অর্ণভ প্রসঙ্গ পাল্টে অন্যকথা শুরু করলো। বাসন্তী ও ইউসুফ সাহেবকে বিয়েতে আসার জন্য অরিন নিজে গিয়ে দাওয়াত করে এসেছিল। বাসন্তী খালাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে অরিন বলেছে,” তোমরা আমার বিয়েতে না এলে কিন্তু আমি শ্বশুরবাড়ি যাবো না। প্লিজ এসো। নয়তো অরিন খুব কষ্ট পাবে।”
এভাবে অনুরোধ করলে নিষেধ করা যায় না। দুই ফ্যামিলির দ্বন্দ্ব-বিরোধ থামলো। সবাই বিয়েতে এলেন। ইউসুফ সাহেব অর্ণভকে দেখে মনে মনে চিন্তা করলেন, এই ছেলেটিকে তিনি কখনও সুখে থাকতে দিবেন না। অনেক বড় প্রতারণা করেছে সে। প্রতারকের শাস্তি ভয়াবহতম। তিনি নিজের মেয়ের জামাইকে হাসিমুখে মেনে নিয়েছেন। তার নামে প্রয়োজনে বাড়ি, ফ্ল্যাট সব লিখে দিবেন। আর এইসব দেখে অর্ণভ আফসোস করবে। তিনি অর্ণভকে পৃথিবীর কোনো প্রান্তে শান্তিতে টিকতে দিবেন না। তাঁর মেয়েকে ঠকিয়ে তাঁদেরই বাড়ির কাজের মেয়েকে বিয়ে করে অর্ণভ কতবড় অপরাধ করেছে সেটা তাঁকে হারে হারে টের পেতে হবে। বাসন্তী চেয়ারে বসেই নাসিরকে হুকুম দিলেন,
” এই ছেলে, আমার জন্য দোকান থেকে হাফ লিটারের কোল্ড্রিংক নিয়ে আসো যাও। ঠান্ডা হয় যেনো।”
নাসির হাসি মুখে বললো,” এখনি যাচ্ছি মা।”
” তোমাকে না বলেছি আমাকে মা ডাকবে না?”
” ঠিকাছে মা, আর ডাকবো না।”
বাসন্তী অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন। নাসির হাসিমুখে চেয়ে রইল। কারণ সে জানে শাশুড়ী মায়ের এই রাগ কৃত্রিম। ভেতরে ভেতরে ‘মা’ ডাক শুনে তিনি অনেক খুশি হোন। সবচেয়ে বেশি খুশি হোন যখন হাজারবার নিষেধ করার পরেও নাসির একাধারে মা ডেকে যায়৷ অর্ণভ যদি বাসন্তীর মেয়ে-জামাই হতো তাহলে এমন সুবিধা হয়তো তিনি পেতেন না। একবার অর্ণভকে মা ডাকতে নিষেধ করলে সে ডাকতো খালা। তখন মুশকিল হয়ে যেতো। নাসির তো আর সেটা পারবে না। একদিক দিয়ে লাভই হয়েছে। ছেলেটা ভীষণ বিনয়ী। আজকালকের যুগে গুরুজনদের খুব সম্মান করে এমন ছেলে বিরল। অর্ণভ ভীড়ের মাঝে সুমনার হাতে একটা চিরকুট গুঁজে দিয়ে চোরের মতো পালিয়ে গেল। চিরকুটে লেখা ,
“এতো সুন্দর কেনো তুই? এতো সুন্দর হওয়া অন্যায়। ঘোরতর অন্যায়।” সুমনা হাসতে হাসতে ভাবলো, বিয়ের এতোদিন পেরিয়ে গেছে কিন্তু মানুষটার পাগলামি একটুও বদলায়নি। অরিনের বিয়েতে সবচেয়ে মনখারাপ ছিল অ্যাংকারের। সে কেনো এতো দুঃখী দুঃখী চেহারা নিয়ে বসে ছিল অরিন জানে না। এক ফাঁকে সে নিঃসঙ্গ অ্যাংকারের পাশে গিয়ে বসলো। ওর হাতে হাত রেখে বললো,
” তোমার কি হয়েছে অ্যাংকার?”
অ্যাংকার বানোয়াট হাসি দিয়ে বললো,” কিছু না। ইঞ্জয় করছি।”
” মিথ্যে কথা। তুমি মোটেও ইঞ্জয় করছো না। আমার কেনো মনে হচ্ছে যে তুমি এই বিয়েতে খুশি নও? তুমি কি এখনও ইলহানকে বিশ্বাস করতে পারোনি?”
অ্যাংকার জবাব না দিয়ে চশমা ঠিক করলো। ওর চোখেমুখে অপ্রকাশিত এক ভীতি৷ অরিন বললো,
” ইলহান আমাকে ভালোবাসে এটা নিয়ে এখনও তুমি সন্দেহ করছো? ও যদি আমাকে ভালো না বাসতো তাহলে বিয়ে কেনো করছে বলো তো?”
অ্যাংকার মলিন হাসি দিয়ে কিছু বলতে যাচ্ছিল তখনি ইলহান ডাকলো,” অরিন, এদিকে এসো। একটা জিনিস দেখে যাও।”
অরিন ছুটে গেল ইলহানের কাছে। ইলহান অরিনকে দু’জন মানুষের সাথে পরিচয় করানোর জন্য ডেকেছে। তাদের দেখে অরিন হতভম্ব হয়ে গেল। তার চোখের কোটরে পানি জমে উঠলো। নিজেকে সামলাতে গিয়ে হিমশিম খেতে হলো অরিন। কারণ তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে রায়হান আর রায়হানের বউ। ইলহান হেসে বললো,
” এইটা হৃদয় ভাই আর তার বউ জেসমিন আপু। হৃদয় ভাই আমার দুঃসম্পর্কের এক খালার ছেলে।”
অরিন হাসার চেষ্টা করে সালাম দিল। কুশল বিনিময় পর্ব শেষ হওয়ার পর তারা যখন চলে গেল তখন অরিন ইলহানের শেরয়ানি খামচে ধরে বললো,
” ইলহান আমার মাথা ঘুরছে।”
” এখন মাথা আরও ঘুরবে। যখন একটা সিকরেট জানতে পারবে।”
” সিকরেট মানে? কিসের সিকরেট?”
” তুমি রায়হান নামের যে ছেলেটির সাথে আগে কথা বলতে সে আমি।”
” হোয়াট? না, না, এটা হতে পারে না।”
” কেনো? আরে, সত্যি বলছি বিশ্বাস করো। আমার ফেইক আইডি ছিল৷ হৃদয় ভাইয়ের ছবি দিয়ে খুলেছিলাম আইডিটা। এজন্যই তোমার সাথে দেখা করালাম তাকে। তুমি রায়হানকে অনেক ভালোবাসো তাই না?”
অরিন চোখ তুলে তাকাতেই ইলহান বললো,” মানে আমাকে অনেক ভালোবাসো।”
অরিন অস্ফুট স্বরে বললো,” ওই কণ্ঠ তোমার ছিল না।”
” আমার কণ্ঠই ছিল। তোমার মনে নেই অরিন? আমি তোমাকে কত জায়গায় দেখা করার কথা বলেছিলাম। কিন্তু কখনও দেখা করতে আসিনি। তুমি ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে কিন্তু আমি আসতাম না। এই সবকিছুর প্রতিশোধ নিয়েছো এতোদিন?”
অরিন অবিশ্বাসী চোখে তাকিয়ে রইল। ইলহান ফোন বের করে তার সেই ফেইক আইডিতে লগইন করলো যে আইডি থেকে আগে তাদের কথা হতো। অরিন স্বচক্ষে প্রমাণ দেখে খুশিতে হাসতে লাগলো। হাসতে হাসতেই বললো,
” তুমি কেনো এতোদিন বলোনি?”
” ইচ্ছে করেই বলিনি। তোমাকে সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিলাম। দেখতে চেয়েছিলাম একটা অচেনা, অজানা মানুষের জন্য তুমি কতদিন পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর ছেলেটিকে অবহেলা করতে পারো। তোমার ভালোবাসার জোর কত পরীক্ষা করেছি।”
” ও, তার মানে তুমি নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর ছেলে মনে করো?”
ইলহান হো হো করে হেসে অরিনকে জড়িয়ে ধরলো। অরিনের মনে হচ্ছে সে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর স্বপ্নটি দেখছে আজ। হঠাৎ করে তার জীবনটা এতো চমৎকার কিভাবে হয়ে গেল? অরিন অ্যাংকারের কাছে গিয়ে খুব আনন্দিত হয়ে বললো,
” জানো অ্যাংকার, ইলহানই আমার রায়হান। বলেছিলাম না? ইলহান আমাকে সত্যি ভালোবাসে! এইবার প্রমাণ পেয়েছো?”
অ্যাংকার কোনো জবাব দিল না। ধরে আসা গলায় বললো,” তোমরা অনেক অনেক ভালো থেকো।”
এরপর অরিনের সাথে অ্যাংকারের আর একবারও দেখা হয়নি। অরিনকে ফুল দিয়ে সাজানো বাসর ঘরে নিয়ে আসা হলো। কত সুন্দরভাবে ঘরটা সাজানো হয়েছে! অরিনের মনে হলো সে ফুলের বাগানেই চলে এসেছে। চারদিকে অনেক লাইটিং। আলো নিভিয়ে দেওয়ার পরেও রুম অন্ধকার হবে না। শ্যানিন বলেছে এই আইডিয়াটা ইলহানের। অরিনের অন্ধকারভীতি আছে তাই ইলহান আলোকিত বাসর ঘর সাজাতে বলেছে। অরিনের খুব হাসি পেল। সে কখনও কল্পনা করেনি তার জীবনটা এতো সুন্দর হয়ে যাবে। একটু পরেই ইলহান ঘরে প্রবেশ করলো। অরিন তখন ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে নিজেকে আয়নায় দেখছিল। ইলহানের প্রতিবিম্ব সে আয়নাতেই দেখতে পেল। ইলহান শেরয়ানির বোতাম খুলতে খুলতে বললো,
” আমার খুব ক্লান্ত লাগছে অরিন।”
অরিন উঠে এসে বললো,” আরে আরে, আপনি শেরয়ানি খুলে ফেলছেন কেনো? আমরা ছবি তুলবো না?”
” আর কত ছবি তুলতে চাও? আজকে সারাদিন তো শুধু ছবিই তুললাম।”
” সেগুলো তো বিয়ের ছবি। এখন তুলবো বাসর রাতের ছবি। ”
অরিন ফোন হাতে নিল ছবি তোলার জন্য। ইলহান অরিনের হাত থেকে মোবাইল কেড়ে নিয়ে সাইলেন্ট করে ড্রয়ারে তালাবদ্ধ করলো। অরিন বললো,
” এইটা কি হচ্ছে?”
” নো ডিস্টার্বেন্স। আজকে শুধু তুমি আর আমি। আমাদের মাঝখানে কোনো মোবাইল থাকবে না।”
” ইলহান, এইটা কিন্তু বেশি বাড়াবাড়ি। ”
” বাড়াবাড়ি এখনও শুরুই করিনি।”
অরিনকে বিছানায় ফেলে একটার পর একটা জুয়েলারি খুলতে লাগলো ইলহান। অরিন বললো,
” তোমার এতো তাড়াহুড়ো কেনো? আমি কি কোথাও পালিয়ে যাচ্ছি?”
” বলা তো যায় না, যদি সত্যিই পালিয়ে যাও!”

ঘড়িতে ভোর চারটা বাজে। বাহিরে প্রচন্ড বৃষ্টি। মাথার উপরে শব্দহীন একটা ফ্যান ঘুরছে। এই ফ্যানের বাতাস গায়ে লাগানোর জন্য নয়। শুধুই সৌন্দর্য্যের জন্য লাগানো হয়েছে। ফ্যানের রংটা সোনালী রঙের। ডিজাইন অন্যরকম। যখন ফ্যানটা ঘুরে, তখন দেখতে সুন্দর লাগে। অরিন মাত্র ঘুমিয়েছে। ইলহান বিছানা থেকে নেমে আয়নার সামনে দাঁড়ালো। শরীর চাঙ্গা করে তোলার মতো একটা হাসি দিয়ে ভাবলো,অবশেষে বিজয়টা তারই হয়েছে।দেড়বছর আগের সেই দৃঢ় শর্ত নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই পূরণ করেছে সে।আজকের এই দিন উল্লাসের!তৃপ্তির! দেড় বছর শেষ হতে এখনও তিনদিন বাকি। ঠিক এই সময়টাতেই ইলহান অরিনকে প্রথমবার দেখেছিল রেলওয়ে স্টেশনের প্লাটফর্মে। ঘন কালো লম্বা চুলের, ছিপছিপে দেহের অধিকারী এক অন্যরকম সুন্দরী মানবী। যার সাদা চোখের কালো তারায় আছে ঘোর, ঘন পাপড়িতে আছে উত্তেজনা, ঠোঁটে আছে নেশা, পুরো শরীরের গঠন জুড়ে আছে তীব্র এক আকর্ষণ। ইলহান মোহে বন্দী হয় প্রথম দেখাতেই। বড় বড় চোখের ডাগরিণীকে দেখে তার মাথা ঘুরে যায়। সে জানতো অরিন অ্যাংকারের প্রেমিকা। দুইবছর ধরে অ্যাংকার একটা মেয়ের সাথে ফেসবুকে রিলেশন করার পর যখন বুঝতে পারে মেয়েটি তাকে সত্যি ভালোবাসছে এমনকি সে নিজেও মেয়েটির মায়ায় আটকে যাচ্ছে তখনি সরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে। কারণ সাধারণ মানুষের মতো প্রেম-ভালোবাসা অথবা বিয়ের ক্ষমতা করুণাময় অ্যাংকারকে দেননি। অ্যাংকার জানতো তাদের সম্পর্কের কোনো ভবিষ্যৎ নেই। তাই অরিনের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। অরিনও অ্যাংকারের কোনো হদিশ পায় না। কারণ অ্যাংকার যেই আইডি থেকে অরিনের সাথে কথা বলতো সেটা ছিল ইলহানের ফেইক আইডি। ইলহান তার শতাধিক গার্লফ্রেন্ড একসাথে ম্যানেজ করার জন্য বিভিন্ন সময় ফেইক আইডির সাহায্য নিতো। যে আইডি থেকে সে অরিনকে পেয়েছিল সে আইডিতে ইলহানের নিজস্ব কোনো ছবি ছিল না। নামটাও ছিল ভুল। আর আইডির মালিকের ছবিটাও ছিল ধার করা। অরিন তার জীবনের হতাশাজনক একটা ঘটনা লিখে কোনো এক নামকরা গ্রুপে পোস্ট করেছিল। দীর্ঘদিন ধরে কেউ মানসিক সমস্যায় ভুগলে যেমন হাল হয়, অরিনের অবস্থাটাও ঠিক তেমন। সে কোনো বিজ্ঞ ব্যক্তির পরামর্শ চেয়েছিল।আর অ্যাংকার ছিল সাইকোলজির স্টুডেন্ট। ইলহান ওই পোস্ট অ্যাংকারকে দেখিয়ে বলেছিল বেচারীকে কিছু পরামর্শ দিতে। সেখান থেকেই অ্যাংকারের সাথে অরিনের পরিচয়। অরিন অ্যাংকারের জেন্ডার বিষয়ক সমস্যাটার কথা জানতো না। সেই ফেইক আইডির প্রোফাইল পিকচারে হৃদয়ের ছবি ছিল। অরিন হয়তো তাকেই অ্যাংকার ভেবে নিয়েছিল। অ্যাংকার নিজের সমস্ত পরিচয় গোপন রেখে অরিনের সাথে কথা বলতো। ছদ্মনাম হিসেবে সে ‘রায়হান’ নামটি ব্যবহার করেছিল। এমনকি নিজের জন্মতারিখ পর্যন্ত মিথ্যে বলেছিল। অ্যাংকারের মা বাঙালি ছিলেন। ভারতের অধিবাসী। তাই সে বাংলা কথা ভালো জানতো। অরিন-অ্যাংকারের সম্পর্কে সত্যির ছিঁটেফোঁটাও ছিল না। তবে অনলাইন ভিত্তিক প্রেমটা তাদের ভালোই চলছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে অরিনের পাগলামি বাড়তে থাকে। আর অ্যাংকারের মনে ভীতি জন্মাতে শুরু করে। ধরা পড়ে লজ্জিত হওয়ার ভীতি। একটা সময় এমন হলো,
অ্যাংকার ভয়ংকর দুঃস্বপ্ন দেখতো। দেখতো অরিন তার সব সত্যি জেনে গেছে। তাকে ধিক্কার জানাচ্ছে। এমন স্বপ্ন দেখে অ্যাংকার হুড়মুড়িয়ে ঘুম থেকে উঠে যেতো। ক্রমান্বয়ে সম্পর্কটা তার কাছে বোঝা মনে হতে লাগলো। ইলহান এই সম্পর্কে না জড়াতে বার-বার সাবধান করেছিল অ্যাংকারকে। যে সম্পর্কের কোনো ভবিষ্যৎ নেই, সেই সম্পর্ক বাঁচিয়ে রেখে লাভ কি? কিন্তু অ্যাংকার নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। অ্যাংকারের কণ্ঠস্বর কিছুটা অন্যরকম। ওর সাথে ফোনে কথা বললে ছেলের গলা নাকি মেয়ের গলা সেটা বোঝা মুশকিল। তাই অরিনের সাথে কথা বলার সময় সে ভয়েস চেঞ্জার অ্যাপ ব্যবহার করতো। ইলহান এইসব দেখে ভীষণ হাসতো। অ্যাংকারকে কটাক্ষ করে কথা শোনাতো, পঁচাতো, উপহাস করতো। দিনে বিশ থেকে পঁচিশটা মেয়ের সাথে ডেটিং করা প্রত্যেকটি মেয়ের হার্টথ্রব ইলহান অ্যাংকারের দুঃখ কিভাবে বুঝবে? তার জীবনটা তো স্বর্গের মতো। আর অ্যাংকার ছিল
মানসিক যন্ত্রণায় জর্জরিত। অ্যাংকার কখনও ইলহানকে মনের কথা বুঝাতে যায়নি। কিন্তু দিন দিন তার মনে হতে লাগলো সে অরিনকে মারাত্মকভাবে ঠকাচ্ছে। অরিন যখন তার সম্পর্কে আসল সত্যিটা জানবে তখন কি মেনে নিতে পারবে? তাকে এতোবড় আঘাত দেওয়ার চেয়ে এটাই ভালো অ্যাংকার আগে-ভাগেই অরিনের জীবন থেকে সরে যাক। অ্যাংকার তাই করেছিল। ধীরে ধীরে অরিনের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিল। কিন্তু দিনে কয়েকহাজার বার সে অরিনের কাজলরাঙা চেহারা দেখে আফসোস করতো৷ অদ্ভুত সুন্দর এই কৃষ্ণবতীকে পাওয়ার লোভে প্রকৃতির নিয়ম বদলানোর জন্য হাপিত্যেশ করতো। অরিনের তখন পাগল প্রায় অবস্থা। সে সোশ্যাল মিডিয়ায় তন্ন তন্ন করে অ্যাংকারকে খুঁজতে লাগলো। অ্যাংকারের ছবি দিয়ে বিভিন্ন জায়গায় পোস্ট করতে লাগলো,’যে এই ছবির মালিককে খুঁজে দিতে পারবে তাকে পাঁচহাজার টাকা পুরষ্কার দেওয়া হবে।’ যদিও ছবিটা অ্যাংকারের ছিল না, ইলহানের পরিচিত হৃদয় ভাইয়ের ছবি ছিল। অ্যাংকার অন্য ফেইক আইডি থেকে অরিনকে সবসময় ফলো করতো। সেখানেই ওর এসব কার্যকলাপ দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলতো। এতো নির্মম পরিণতি অন্যকোনো সম্পর্কের হয়েছিল কি-না জানা নেই। ইলহান যখন তার কাজিনের বিয়েতে বাংলাদেশ যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল তখন অ্যাংকারও তার সাথে যাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করলো। কারণ সে অরিনের সাথে জীবনে অন্তত একবার দেখা করতে চেয়েছিল। নিজের পরিচয় জানাবে না কিন্তু অরিনের সামনে গিয়ে দাঁড়াবে৷ তাকে স্বচক্ষে দেখবে। অ্যাংকারের বাংলাদেশে আসার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল অরিনকে খুঁজে বের করা। কিন্তু কাকতালীয়ভাবে ট্রেনেই তাদের দেখা হয়ে যায়। অ্যাংকার কল্পনাও করতে পারেনি যে ইলহানের বোন শ্যানিনের বেস্টফ্রেন্ডই হবে অরিন। সেদিন প্লাটফর্মে অরিনকে দেখে অ্যাংকারের মারাত্মক রকম হাঁটু কাঁপুনি দিচ্ছিল। সে ফিরে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু ইলহান জোর করে তাকে আটকে রেখেছিল। তার ইচ্ছা ছিল অ্যাংকারের সাথে অরিনের সরাসরি দেখা করানোর। অরিনের সত্যি কথা জানার অধিকার আছে। অ্যাংকারের আসল সত্যিটা জানার পর অরিন যেই সিদ্ধান্ত নিবে সেটাই হবে। কিন্তু যখন ইলহান নিজে অরিনকে দেখলো, তার মনের উদ্দেশ্য বদলে গেল। সে নিজেই অরিনকে পাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠলো।অ্যাংকারকে বললো,
” দোস্ত, এইটা কি জিনিস পটিয়েছিস তুই? আমার তো মাথায় আগুন ধরে যাচ্ছে। দ্যাখ, ওকে তো তোর কোনো প্রয়োজন নেই। আমাকে দিয়ে দে।”
ইলহানের নিঃসংকোচ আবদার শুনে অ্যাংকার অবাক না হয়ে পারলো না। চড়া গলায় ভ্রু কুচকে বললো,” মাথা ঠিকাছে? কি বলিস এইসব?”
” আমার আসলেই মাথা খারাপ হয়ে গেছে। এতো জোস জিনিস তো আমি অস্ট্রেলিয়ার কোথাও পাবো না। সাদা চামড়ার প্রতি বিতৃষ্ণা চলে এসেছে। নাউ আই শুড ট্রাই সামথিং নিউ।”
অ্যাংকার হো হো করে হেসে বললো,” তুই এই কথা বলছিস? আচ্ছা, মেয়েদের হিপনোটাইজ করার ম্যাজিশিয়ান না তুই? পারলে অরিনকে পটিয়ে দেখা তো। যদি পটাতে পারিস, তাহলে অরিন তোর।”
” পটাতে পারলে তো অবশ্যই আমার। কিন্তু তুই পরে ঝামেলা করবি না তো?”
” আগে তুই পটিয়ে দেখা। ”
” তোর কি মনে হচ্ছে আমি ওকে পটাতে পারবো না?”
” ও তোর সাদা চামড়ার গার্লফ্রেন্ডদের মতো সস্তা না। বাংলাদেশের নাম্বার ওয়ান ইউনিক পিস। আমার বিশ্বাস আছে, ও এতো ইজিলি পটবে না।”
” বাজি?
” ঠিকাছে বাজি। কয়টাকার?”
” টাকা না। বাজি হচ্ছে, যদি আমি জিতি তাহলে অরিন আমার। তুই জীবনে কখনও ওর সামনে আসতে পারবি না। আর যদি তুই জিতিস তাহলে.. তাহলে আমি মেয়েবাজী ছেঁড়ে দিবো।”
অ্যাংকার এই কথা শুনে ভীষণ অবাক হলো। উৎফুল্ল উত্তেজনা নিয়ে বললো,
” শিউর? তুই সত্যি ছেঁড়ে দিবি?”
” হ্যাঁ। ”
অরিনকে নিয়ে বাজি ধরার ইচ্ছে অ্যাংকারের ছিল না। কিন্তু ইলহানের এই কথা শুনে সে বাজি না ধরেও থাকতে পারলো না৷ কারণ সবসময় অ্যাংকার চাইতো ইলহান তার এই মেয়েজনিত বদভ্যাস ত্যাগ করুক। একটা বাজির মাধ্যমে যদি সেটা সম্ভব হয় তাহলে ক্ষতি কি? তবে অ্যাংকার মনে মনে এটাও ভেবে রেখেছিল, অরিনকে সে কিছুতেই ইলহানের পাল্লায় পড়তে দিবে না। সেজন্য যতরকম চেষ্টা করতে হয়, সে করবে। অ্যাংকার বললো,
” ঠিকাছে তাহলে ডান। তোর হাতে একবছর সময়। এর মধ্যে যদি অরিনকে পটাতে পারিস তাহলে আমি সত্যি আর কখনও অরিনের সামনে যাবো না।”
” ওয়েট, এক বছর কেনো? ওকে পটাতে আমার যাস্ট দুইমিনিট লাগবে।”
” বললাম তো দোস্ত, অরিন এতো ইজি না। ওকে দেখতে যেমন অন্যরকম, ওর আচরণও অন্যরকম। সাধেই কি আমি এতোবড় বাজি ধরেছি?”
” আর তুই আমার কনফিডেন্স লেভেলের কথা চিন্তা কর। আমি কতটা কনফিডেন্ট হলে আমার সবচেয়ে শখের জিনিস নিয়ে বাজি ধরতে পারি?”
” ঠিকাছে, যদি আসলেই দুইমিনিটে পটাতে পারিস তাহলে ভালো। কিন্তু তবুও আমি তোকে একবছরের টাইম দিচ্ছি। তুই ট্রাই করতে থাক।”
ইলহান প্রথম পদক্ষেপে অরিনকে ধাক্কা মেরে তার হাতের ব্যাগ ফেলে দিল। তারপর স্যরি, স্যরি বলে সেই ব্যাগটা অরিনের হাতে তুলে দিল। এই কাজটা সে করেছিল ট্রেনে উঠার আগে, প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে। অরিন তখন মোবাইল নিয়ে এতোটাই ব্যস্ত ছিল যে ইলহানের চেহারার দিকেও একবার তাকায়নি। ইলহান হাত বাড়িয়ে বলেছিল,
” হায়, আমি ইলহান মাহদী।”
অরিন সেটাও খেয়াল করেনি৷ দায়সারাভাবে ফোন টিপতে টিপতে ব্যাগ নিয়ে চলে গেল। ইলহানের চেহারায় তীব্র বিস্ময় প্রকাশ পেল। জীবনের প্রথমবার কোনো মেয়ের থেকে এতো বড় অবহেলা ইলহানের জেদ বাড়িয়ে দিল। সে অ্যাংকারকে অভিযোগ করলো এই বলে যে অরিন এখনও রায়হানের মধ্যে আটকে আছে। এভাবে চললে সে অরিনকে পটাবে কিভাবে? আগে এমনকিছু করা উচিৎ যাতে অরিন রায়হানের আশা ছেঁড়ে দেয়। এক আশা ভাঙলেই মানুষ নতুন আশার স্বপ্ন দেখে। তাই অ্যাংকার সেদিন ট্রেনে বসেই অরিনকে হৃদয়ের বিয়ের ছবি পাঁঠিয়ে পারমানেন্টলি ব্রেকাপ করেছিল। অ্যাংকার এই কাজ করেছিল ইলহানের পথ সুগম করার জন্য নয়। বরং যখন আসলেই অরিনের থেকে ইলহান পাত্তা পাবে না তখন সে অ্যাংকারকে যাতে কোনোভাবেই দোষারোপ করতে না পারে সেইজন্য। ট্রেনে উঠার পর ইলহান অরিনের হাতে পর পর দুইবার চড় খেয়ে ফেললো। এই অবস্থা দেখে অ্যাংকারের হাসি থামলো না। সে ইলহানকে আরও তাতিয়ে দিয়ে বললো,” আগেই বলেছিলাম, আমার অরিন এতো সস্তা না। তুই কি হার মেনে নিলি? হার মানিস না। তোকে আরও ছয়মাস সময় দেওয়া হলো। মোট দেড় বছর। চেষ্টা করতে থাক।”
অরিনের অ্যাটিটিউড নিয়ে অ্যাংকারের যেনো আরও বেশি অহংকার। ইলহান এবার বিষয়টাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিল। পৃথিবী উল্টে যাক, দুনিয়া ভেসে যাক, অরিনকে সে নিজের করে ছাড়বেই। ইলহান মাহদী এতো সহজে হার মানতে রাজি না। সে
অ্যাংকারকে চ্যালেঞ্জ করলো, দেড়বছরের মধ্যেই অরিনকে পটাবে। শুধু তাই নয়, অন্যান্য মেয়েদের বেলায় ইলহান যা করে অরিনের বেলাতেও সবকিছু করবে। আর সেটা অবশ্যই অরিনের সম্মতিতে। অরিন নিজেই নিজেকে ইলহানের কাছে সমর্পণ করবে। ইলহান তার পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করতে থাকলো। পুকুরের সামনে দাঁড়িয়ে অরিনকে চুমু দেওয়া, সিআরবি’তে ঘুরতে যাওয়ার পরিকল্পিত প্ল্যান, অরিনকে আড়ালে এনে ভয় দেখানো, ভাইয়া ডাকলে কিস করার হুমকি দেওয়া তারপর অরিনের কানের দুল চুরি করা। সেই দুল খোঁজার জন্য কত নাটক! পাহাড়ে অরিনকে নিয়ে অদ্ভুত সুন্দরভাবে প্রপোজ করা। কোনোকিছুতেই অরিনকে গলানো যাচ্ছিল না। সে একফোঁটাও প্রভাবিত হয়নি ইলহানের আচরণে কিংবা তার সৌন্দর্য্যে। বরং প্রপোজ করার পরপরই পাহাড় থেকে ধাক্কা মেরে ইলহানকে ফেলে দিয়েছিল অরিন। এতো নিষ্ঠুর প্রত্যাখ্যান ইলহানের মনের আগুনে ঘি ঢালার কাজে দিল। সে আরও বহুগুণ জেদী হয়ে উঠলো। এই চ্যালেঞ্জ পূরণ করতে গিয়ে যদি নিজের জীবন বাজি রাখতে হয়, ইলহান তাও রাখবে৷ তবুও অরিনের অহংকার সে ধুলোয় মিশিয়ে ছাড়বে। নিজের কাছেই নিজে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলো৷ অরিনকে পাওয়ার তীক্ষ্ণ জেদ ইলহানের মনে মহামারী আকার ধারণ করলো। সে এই কাজে মূল অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে থামলো না বাবা-মা এবং ছোটবোনের ভালোবাসাকেও। অরিনকে যখন সে কোনোভাবেই আয়ত্তে আনতে পারছিল না তখন ইমোশোনালি ব্লেকমেইলের চেষ্টা শুরু করলো। তার আগে বাবার কাছে নিজের ভালোবাসা প্রকাশ করার জন্য বিভিন্ন কলাকৌশল প্রয়োগ করলো। যেমন অরিনকে বিয়ে করার উদ্দেশ্যে টিউশনি করা, ডেলিভারম্যানের চাকরি করা, বাসে যাতায়াতের অভ্যাস করা, নিজের পায়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করা। বাবা ধরে নিলেন, তাঁর ছেলে সত্যি প্রেমে পড়েছে। তিনি অরিনের কাছে বিয়ের প্রস্তাব দিলেন। কিন্তু তখন অরিন আরও বড় নাটক শুরু করলো। সে ভাঙবে তবু মচকাবে না। অরিনকে বাগে আনতে ইলহান আঙুল বাঁকা করলো। বাবার সাথে অহেতুক ঝগড়াঝাঁটি করে বাড়ি ছাড়লো। তারপর শায়িখ সাহেব স্ট্রোক করলেন৷ এতে ইলহানের তেমন কিছুই যায়-আসলো না। তার একমাত্র লক্ষ্য শুধু চ্যালেঞ্জে বিজয়ী হওয়া। এজন্য সে নিজের জীবন নিয়ে যেমন বাজি ধরতে পারে, তেমনি প্রিয় মানুষগুলোকে বিপদে ঠেলে দিতেও দু’বার চিন্তা করে না। শায়িখ সাহেবের বড় কোনো অসুখ ছিল না। কিন্তু ইলহান নার্সের মাধ্যমে শায়িখ সাহেবের কানে ভুল খবর প্রচার করে। শায়িখ সাহেবকে বলা হয়, তাঁর আয়ু অতি সংকীর্ণ। ইলহান এই জঘন্য কাজটি করেছিল যাতে অরিনের সাথে তার বিয়ের কার্যক্রম দ্রুততম হয়। ইলহানের পরিকল্পনা সফল হয়েছিল। অতঃপর অরিন একটা দায়বদ্ধতা থেকেই ইলহানের সাথে বিয়েতে রাজি হয়েছিল। কিন্তু অ্যাংকার তখন বিরোধিতা করলো। অরিনের নিজের কোনো সম্মতি ছিল না বিয়েতে। সে তখনও ইলহানকে সন্দেহ করতো। আর বিয়েটা না করার জন্য সে নিজেই অ্যাংকারের কাছে সাহায্য চাইছিল। তাই ইলহান সেদিন লংড্রাইভে যাওয়ার নাম করে অন্য একটা পরিকল্পিত ছক সাজালো। রাস্তার সেই গাড়িভর্তি ছেলেগুলো ইলহানের ভাড়াকৃত ছিল। তারা অরিনকে ডিস্টার্ব করবে আর ইলহান প্রতিশোধ নিতে গিয়ে এক্সিডেন্ট করবে। এটাই ছিল প্ল্যান। আর সেই প্ল্যান একশো পারসেন্ট সফল হলো। অরিন রাতারাতি ইলহানের প্রেমে পড়ে গেল। কিন্তু ইলহান মাঝখানে একটু বেশিই অধৈর্য্য হয়ে পড়েছিল। তাই অরিনকে নিয়ে নকল বিয়ের নাটক সাজালো। ভেবেছিল এতে শর্তও পূরণ হবে আর অরিনকে সত্যি সত্যি বিয়েও করতে হবে না। কিন্তু ইলহান অরিনের কাছে ধরা খেয়ে গেল৷ তারপর আবার আরও কয়েকদিন বাড়তি পরিশ্রম করতে হলো। একগাঁদা ন্যাকামি,ঢং, অভিনয় আরও কূটনীতিক কর্মকান্ডের মাধ্যমে অরিনকে অবশেষে ইলহান জিতেই নিল। ইলহান মাহদী কখনও হারতে শিখেনি৷ অ্যাংকার নিশ্চয়ই এবার প্রমাণ পেয়েছে। শর্ত অনুযায়ী সে আর কখনও অরিনের জীবনে আসবে না। তবে এখন অরিনকে ইলহানের তেমন কোনো প্রয়োজন নেই। যেহেতু শর্ত পূরণ হয়ে গেছে আর ইলহানও বিজয়ী হয়েছে তাহলে অরিনের কি দরকার? দরকার অবশ্যই আছে। এতোদিনের যত অপমান, অবহেলা, অপেক্ষা এবং তৃষ্ণা সবকিছুর হিসাব সুদে-আসলে মিটিয়ে নিতে হবে অরিনের থেকে। তবেই না আসল শান্তি! অরিনের ঘুমন্ত মুখে হাত বুলাতে বুলাতে ইলহান ঠোঁটে মৃদু হাসির রেশ ফুটিয়ে চিন্তা করছিল, ঘুমন্ত চেহারার আশ্চর্য সুন্দর এই মানবীটি তার নেশা, ভালোবাসা নয়। যখন সাময়িক এই নেশা কেটে যাবে তখন ইলহান অরিনের সাথে কি করবে? ইলহান সিদ্ধান্ত নিল, বিয়ে যখন করেই ফেলেছে সে সারাজীবন অরিনকে নিজের বউ হিসেবেই রাখবে। কিন্তু যদি কখনও অরিন ইলহানের ব্যক্তিগত জীবনের অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায় তাহলে তাকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিতে দু’বার ভাববে না। ইলহান এই কথা চিন্তা করেই অদ্ভুত এক বিদঘুটে হাসিতে মত্ত হলো। তার পৈশাচিক আনন্দ লাগছে আজ। অরিনের ঘুম ভেঙে গেল। সে চোখ খুলে তাকিয়ে বললো,
” কি হয়েছে তোমার?”
ইলহান অরিনের কপালে চুমু দিয়ে দিল। হালকা গলায় বললো,” কিছু না, তোমাকে দেখছি। তুমি ঘুমন্ত অবস্থায় অনেক সুন্দর। ”
অরিনের গাল দুটো লাল হলো৷ সে আহ্লাদী স্বরে বললো,” বাহিরে কি বৃষ্টি হচ্ছে?”
” হুম। অনেক বৃষ্টি।”
” তাহলে প্লিজ আমাকে বাহিরে নিয়ে যাও। আমি বৃষ্টি দেখবো।”
” কোলে করে নিয়ে যাবো?”
” হুম অবশ্যই। আমার ওজন কি খুব বেশি?”
ইলহান হেসে অরিনকে কোলে তুললো। বারান্দার ছাঁটে পানি জমেছে। সেই পানি চুইয়ে চুইয়ে পুরো বারান্দা ভেসে যাচ্ছে। আকাশে ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে। সবকিছু ঝাপসা দেখাচ্ছে। শরীরে শিহরণ জাগানো শীত। অরিনকে একটা চেয়ারে বসিয়ে তার সামনে হাঁটু গেড়ে বসলো ইলহান। অরিন ইলহানের চুলে হাত বুলিয়ে বললো,
” আজকে আমার খুব খুশি লাগছে।”
ইলহান অরিনের হাত মুখের কাছে এনে চুমু দিয়ে বললো,” আমারও। ”
অরিন জানালায় চোখ রাখলো। তার চোখেমুখে আনন্দের ঝিলিক। এই আনন্দময় চেহারায় ইলহান শুধুই তৃষ্ণা খুঁজে পায়। যে তৃষ্ণায় ভালোবাসার স্পর্শটুকুও নেই। কামনাই মোক্ষম। প্রতি মুহুর্তে তার কামনা জেগে উঠে অরিনকে দেখে। অরিন সেই চাহনীকে ভালোবাসা ভেবে ভুল করে, ধোঁকা খায়। সে জানেও না ইলহানের কাছে তার মূল্য কতটা নগন্য। নিজের স্বামীর কাছে সে অর্ধাঙ্গিনী নয় শুধুই মনবাসনা পূরণের খোরাকমাত্র। অরিন শরীর ঝাঁকিয়ে কেঁপে উঠলো। খিলখিল করে হেসে বললো,
” উহুহু, শীত লাগছে!”
ইলহান কাছে এসে অরিনকে জড়িয়ে ধরলো শক্তভাবে। অরিনের গলায়, ঠোঁটে, বিশেষ অঙ্গে ভালোবাসার পরশের নামে বিষাক্ত স্পর্শ ঢেলে দিতে লাগলো। অরিন আরাম পেল না, উপভোগ করতে পারলো না, শুধুই কষ্ট হলো তার। একটু পর বৃষ্টি থেমে, আকাশের মেঘ কেটে দেখা দিল রঙধনু। অরিন অবাক হয়ে বললো,
” ওয়াও, দেখো কি সুন্দর রংধনু! ঠিক তোমার মতো।”
ইলহান ভ্রু কুচকে বললো,” আমার মতো মানে?”
অরিন ইলহানের চোখের দিকে তাকিয়ে স্থির দৃষ্টিতে বললো,
” বৃষ্টির পরে কালো মেঘ কেটে রংধনুর আবির্ভাব হলে ঠিক যতটা খুশি লাগে তুমিও আমার জীবনের ঠিক ততটাই খুশি৷ তাই আজ থেকে তুমি আমার কাছে মেঘের পরে রংধনু।”
ইলহান হাসলো। পেছনে থেকে অরিনকে জড়িয়ে ধরে চুলে মুখ ডুবিয়ে বললো,” তুমি হয়তো জানো না অরিন, রংধনুর রঙ কালোও হতে পারে…”

______________সমাপ্ত______________

( বিঃদ্রঃ ইলহান-অরিনের বিবাহিত জীবন নিয়ে আরেকটি গল্প লেখার ইচ্ছা আছে। সেই গল্পের নাম হবে, ‘ রংধনুর রঙ কালো।’ কবে লিখবো সে বিষয়ে নিশ্চিত না। এই গল্পটি সম্পর্কে মতামত জানাবেন। পারলে ছোট্ট করে রিভিউ দিবেন। সবাই ভালো থাকবেন। এতোদিন পাশে থাকার জন্য অনেক, অনেক ধন্যবাদ।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here