নীলকণ্ঠা পর্ব-৯

0
1953

#নীলকণ্ঠা

৯।
সাহেব আসবো?

ফায়জ দরজায় তাকালো। আমেনা ভাতের প্লেট আর একগ্লাস পানি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ফায়াজ ক্ষুদ্র শব্দে সম্মতি জানিয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। তখনই ওষুধের কথা মনে পড়লো। এদিক সেদিক তাকিয়ে ওষুধের বাক্স দেখতে না পেয়ে আমেনার দিয়ে ঘুড়ে তাকালো। আমেনা পরীর বিছানায় বসেছে মাত্র। গ্লাস রেখেছে বিছানার পাশের ছোট টেবিলে।
ওষুধের বক্স কোথায়?

ফায়াজের প্রশ্নে আমানা মুখ তুলে তাকালো। এরপর উঠতে নিলেই ফায়াজ বাধা দিল।
উঠতে হবে না। আপনি বলুন আমি খুঁজে নিচ্ছি।

আমেনা ফের বিছানায় বসলো। ঘাড় ঘুড়িয়ে দরজার পাশের টেবিল দেখিয়ে বলল,
টেবিলের উপরের ড্রয়ারে।

ফায়াজ বড় বড় পা ফেলল টেবিলের দিকে। ড্রয়ার টেনে খুলতেই লাল ঢাকনা ওয়ালা সাদা বক্স নজরে এলো। ফায়াজ বক্স বের করে ড্রয়ার বন্ধ করলো। টেবিলের উপর বক্স রেখে ঢাকনা খুলে ওষুধ নড়াচড়া করলো। প্যারাসিটামল, বার্নক্রিম, এন্টিসেপ্টিক, তুলা, গজ, স্যাভলন ইত্যাদি থাকলেও পরীর তিনবেলার ওষুধ নেই। ফায়াজ ভ্রু কুঁচকে বক্স উল্টে সব কিছু টেবিলে ঢাললো। আরো দুবার হাত চালিয়ে ভালো ভাবে খুজলো। কিন্তু পরীর ওষুধ বাদে সব কিছুই সেখানে আছে। ফায়াজ ঘুড়ে দাঁড়ালো। আমেনা পরীর মুখে খাবার তুলে দিচ্ছে।

পরীর ঘরে আজ কে কে এসেছিল?

আমেনা পরীর মুখে খাবার তুলে দিয়ে মনে করার চেষ্টা করে বলল, আমি আসছিলাম সাহেব।

রেনুকা এসেছিল?

আমেনা মাথা দুলিয়ে বলল, হ্যা সাহেব।

দুই শব্দে ফায়াজের চোয়াল শক্ত হয়ে এলো। দাঁতে দাঁত চেপে দু হাত মুঠো করলো। বড় বড় শ্বাস নিচ্ছে নাকের পাটা ফুলে উঠেছে। ফায়াজের প্রচন্ড পরিমান রাগ লাগছে। মনে হচ্ছে রেনুকাকে মেরে ফেললে শান্তি লাগবে। ফায়াজ হাতের মুঠো কোমল করে আমেনাকে বলল,
আপনি ওকে খাইয়ে ওর সাথে থাকুন। আমি আসছি।

আমেনা মাথা নাড়ালো। ফায়াজ আমেনাকে বুঝতে না দিলেও এই মুহুর্ত্বে নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ সে। বার বার তার কাজে বাধা হয়ে মাঝে দাঁড়াচ্ছে রেনুকা। নিজের কাজে বাধা ফায়াজের সব থেকে বেশি অপছন্দ। ফায়াজ ঠান্ডা মাথার মানুষ হলেও তার অপছন্দের কাজ বার বার সে সহ্য করে না। ফায়াজ এক প্রকার দৌড়ে গেল রেনুকার ঘরে। করাঘাত না করেই সরাসরি দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলো। রেনুকা ঘরে নেই। ফায়াজ চারপাশে চোখ বুলালো। এরপর বিছানার বালিশ থেকে শুরু করে টেবিল, ড্রয়ার সব এক এক করে খুলে দেখলো। কোথাও পরীর ওষুধ পেল না। ফায়াজ কোমরে হাত রেখে বড় বড় দুটো নিশ্বাস ফেলে দরজার দিকে এগিয়ে যেতেই ফের থামলো। দু কদম পিছিয়ে হাটু ভেঙ্গে বসে খাটের নিচে তাকাতেই একটা পলিথিন ব্যাগ দেখতে পেল। ফায়াজ হাত বাড়িয়ে পলিথিনের ব্যাগ খাটের নিচ থেকে বাহিরে নিয়ে এলো। ব্যাগ খুলে দেখলো তাতে বেশ কয়েকটা ওষুধের পাতা। দু একটা পাতা বের করে দেখতেই ফায়াজের আন্দাজ ঠিক হলো এগুলো সব পরীর ওষুধ এবং রেনুকাই নিয়েছে।

ফায়াজ উঠে দাঁড়ালো। রুষ্ট মেজাজে ঘর থেকে বের হলো রেনুকার খোঁজে। ফায়াজকে বেশি কষ্ট করতে হলো না রেনুকার দেখা মেললো বসার ঘরে। মইনুর শেখ সোফায় বসে আছেন আর রেনুকা তার পাশে দাঁড়িয়ে নিচু স্বরে কিছু বলে চলছে। ফায়াজ দ্রুত হেটে সেন্টার টেবিলের উপর ওষুধের পাতা ভর্তি পলিথিনের ব্যাগ ছুড়ে মেরে নিরস কন্ঠে জিজ্ঞাস করলো,
এগুলো কি?

রেনুকা ও মইনুর শেখ দুজনই তাকালেন ব্যাগের দিকে। রেনুকার কুঞ্চিত ভ্রু ক্ষানিকের মাঝেই প্রসারিত হলো। চোখ-মুখে ফুটে উঠলো আতঙ্কের ছাপ তবে এ সকল ব্যপারে মইনুর শেখ পুরোপুরি অজ্ঞ। তিনি গম্ভীর দৃষ্টিতে কিছুক্ষন পলিথিন ব্যাগের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালেন ফায়াজের দিকে। প্রশ্ন করলেন,
কি এটা?

ফায়াজ রেনুকাকে দেখিয়ে চোয়াল শক্ত করে গলা খাদে নামিয়ে কঠোর কন্ঠে বললো,
ওনাকে জিজ্ঞাস করুন।

মইনুর শেখ ঘাড় ঘুড়ালেন।
এটা কি রেনু?

রেনুকা তখন মেঝের দিকে তাকিয়ে ছিল। মইনুর শেখের প্রশ্নে মাথা তুলে তাকালো। শুকনো ঢোক গিলে বলল, আমি জানি না।
রেনুকার কন্ঠ কাঁপছে।

আপনি জানেন না? ফায়াজ সরাসরি জিজ্ঞাস করলো।

রেনুকার এবার কথাগুলো ওলট পালট হচ্ছে। কথা বলতে যেয়ে বার বার কন্ঠ নালি কাঁপছে। কোন মতে বলল,
না। জানি না।

ফায়াজ বেশ উচ্চ স্বরে বলল,
আপনি যদি না-ই জানেন এটা কি তাহলে এটা আপনার খাটের নিচে কি করে এলো? এটার নিশ্চই কোন পা নেই।

ফায়াজের উচ্চ স্বরে রেনুকা ক্ষানিকটা কেপে উঠলো। তাও চুপ রইলো। ফায়াজ আগের মতোই রেনুকাকে ধমক দিয়ে বলল,
কি হলো বলুন।

রেনুকা কথা বলার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। অগোছালো কথা গুলো এক সুতোয় গাথার আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছিল। মইনুর শেখ কিছু না বুঝলেও এটা ঠিক বুঝতে পেরেছেন রেনুকা তাকে জিজ্ঞাস না করে কিছু করেছে এবং ফায়াজের কাছে ধরা পরেছে। মইনুর শেখ ছোট একটা নিশ্বাস ফেলে গলা খেঁকারি দিয়ে বললেন,
শান্ত হও ফায়াজ। বসো। এরপর শান্ত ভাবে বলো কি হয়েছে।

আপনারা আমাকে শান্ত থাকতে দিচ্ছেন না। আমার কাজে যে বাধা দেয় তাকে আমি ছাড়ি না। আপনার এই রেনুর মাথায় কথাটা ঢুকিয়ে দিবেন। আমি এক কথা বার বার বলি না। আমি প্রচন্ড খারাপ মানুষ। আপনাদের সাথে ভালো আছি বলে আমাকে ভালো ভেবে বসবেন না যেন। একসাথে কথা গুলো বলে থামলো ফায়াজ। এরপর ওষুধের পাতা ভর্তি ব্যাগ নিয়ে পরীর ঘরে চলে গেল।

মইনুর শেখ নিঃশব্দে ফায়াজের যাওয়ার দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে রেনুকার দিকে তাকালেন। গম্ভীরকন্ঠে জিজ্ঞাস করলেন,
কি হয়েছে রেনু? কি করেছো তুমি?

রেনুকা আমতা আমতা করতেই মইনুর শেখ কঠোর ভাবে বললেন,
সব সত্যি বলবে, ইনিয়ে-বিনিয়ে না।

রেনুকা মইনুর শেখের দিকে তাকালো তবে তার চোখের দিকে নয়। তার নাকের দিকে। দু হাত কচলাতে কচলাতে বলল,
ইয়ে মানে স্যার। ফায়াজ পরীর জন্য ওষুধ এনেছে।

ওষুধ? কিসের ওষুধ?

ওর এই রোগের। ওনার কোন পরিচিত ডাক্তারের সাথে কথা বলে এই ওষুধ এনেছে এবং ওষুধ গুলো নিয়মিত খাওয়াচ্ছে। পরী এখন শান্ত থাকে।আমার মনে হয়েছে ওষুধের জন্য পরীর স্বাস্থ্যগত উন্নতি হচ্ছে তাই আমি আজ ওষুধ গুলো নিয়ে এসেছিলাম। কোথায় ফেলবো ভেবে না পেয়ে খাটের নিচে রেখেছিলাম পরে ফেলব ভেবে কিন্তু ফেলার আগেই

ফায়াজের হাতে লেগে গেল তাই তো?

রেনুকা বিনা শব্দে মাথা নাড়লো। মইনুর শেখ শব্দ করে নিশ্বাস ফেললেন।
পরবর্তীতে কিছু করার আগে আমাকে বলে করবে।
রেনুকা কোন শব্দ উচ্চারণ করলো না। কেবল মলিন মুখে মাথা নাড়িয়ে স্বায় দিল।

_______
শার্টর বাহুর অংশ বার বার টান পড়ায় ফায়াজের ঘুম ভাঙ্গলো। মাথার দু পাশ সহ আপাদমস্তক ব্যথায় জর্জরিত হয়ে বিছানার সাথে পিঠ লাগিয়ে রাখা ফায়াজের। গত রাতের অনিচ্ছাকৃত বর্ষনস্নান বেশ ভারী পড়েছে ফায়াজের উপর। রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে প্যারাসিটামল খেলেও তার ফল পাওয়া নি। ভোরের দিকে প্রচন্ড কাঁপুনিসহকারে জ্বর এসেছিল। কোন মতে দূর্বল শরীরে মাথায় পানি দিয়ে আবার বিছানায় শরীর লাগিয়েছিল ফায়াজ। এরপরে আর কিছু মনে নেই।

চোখের ভারী পাতা তুলে তাকাতেই পরীর স্নিগ্ধ মুখশ্রী ভেসে উঠলো। চোখ বন্ধ রাখলে বেশি শান্তি পাওয়া যেত তবুও ফায়াজ চোখ মেলে পরীর দিকে তাকিয়ে রইলো। পরী তার ডান হাতের অনামিকা, কনিষ্ঠা এবং বৃদ্ধাঙ্গুল দিয়ে ফায়াজের শার্ট খামচে ধরে টানছে। তার দৃষ্টি এলোমেলো।

ফায়াজ দুর্বলতাজনিত কোমল কন্ঠে পরীকে ডাকলো।
পরী।

পরী শার্ট টানাটানি থামালো না। ফায়াজ মাথা তুলে পুরো ঘরে চোখ বুলালো। ঘরে আর কেউ নেই। পরী একা তার বিছানার পাশে বসে তার শার্ট টানছে। ফায়াজ স্মিত হেসে বলল,
কিছু বলবে পরী?

পরী ফায়াজের দিকে তাকালো। কিছু বলবে হয়ত কিন্তু বলতে পাড়ছে না। ফায়াজ এক হাতে ভর দিয়ে উঠে হেলান দিয়ে বসলো। আবার জিজ্ঞাস করল,
হ্যা বলো। কিছু বলতে চাচ্ছো?

পু- পু

সাহেব, আপনি কি অসুস্থ? পরীর কথা সম্পূর্ণ হওয়ার আগেই আমেনা বলল। ফায়াজ আমেনার দিকে তাকালো। বলল, একটু।
এরপর পরীকে উদ্দেশ্য করে জিজ্ঞাস করল,
ওকে আপনি নিয়ে এসেছেন এখানে?

ফায়াজের কথায় আমেনা হয়ত ভয় পেল। চোখ নামিয়ে বলল,
না সাহেব। পরী মা একা আসছে। আমি না করছিলাম শুনে নাই।

ফায়াজ পরীর দিকে তাকালো। পরী বিরবির করছে। ফায়াজ মৃদু ভ্রু কুঁচকে পরীর দিকে এগিয়ে যেতেই শুনলো অস্পর্শ এবং অসম্পূর্ণ পুর ঘাট, পুর ঘাট, পুর ঘাট।

ফায়াজ সোজা হয়ে বসে পরীকে জিজ্ঞাস করল,
পরী, পুকুর ঘাটে যাবে?

পরী তৎক্ষণাৎ বিরবির থামিয়ে দিলো। স্থির দৃষ্টি রাখলো ফায়াজের দিকে। তার চোখ যেন বলছে আমার অসম্পূর্ণ কথা বুঝে যাওয়ার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ।

চলবে…
®উম্মে কুমকুম

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here