নীলকণ্ঠা পর্ব-১১

0
1678

#নীলকণ্ঠা

১১।
একটা ঘন জঙ্গলের ভ্রমণ সমাপ্তি ঘটিয়ে ফের পেছন ফিরে জঙ্গলের দিকে তাকালো ফায়াজ। হৃদস্পন্দন জানান দিচ্ছে যে সে ঠিক কতটা উত্তেজিত তবে সেই উত্তেজনা বাতাসে ভাসমান ধুলিকণা পর্যন্ত টের পাচ্ছে না। ফায়াজ চোখ বন্ধ করে শব্দ করে নিশ্বাস ফেলল। বাড়ির দরজার কাছে আসতেই ট্রাউজারের পকেটে পড়ে থাকা ফোনটা স্বশব্দে বেজে উঠলো। ফায়াজ পকেট থেকে ফোন বের করে সামনে ধরলো। জাফর আহমেদ নামটা ভেসে উঠেছে। ফায়াজ বাড়ির ভেতর না ঢুকে উল্টো হেটে উঠানে যেয়ে দাড়ালো। কল রিসিভ করে কানের কাছে নিল। সালাম দিয়ে সৌজন্য হেসে জিজ্ঞাস করল,
কেমন আছেন?

জাফর সালামের উত্তর দিয়ে ভরাট কন্ঠে বললেন,
ভালো আছি। তা তোমার কি খবর? কাজ কতদূর আগালো?

আমার খবর ভালো। কাজ চলছে।

কতদিন নাগাদ শেষ হবে বলে মনে করছো?

বেশি দিন লাগার কথা না। আমি আমার সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি।

জাফর এবার গম্ভীর কন্ঠে বললেন,
কিন্তু আমার জানা মতে তুমি যে কাজের জন্য গিয়েছো সেটা বাদ দিয়ে কারো পারিবারিক ব্যপারে মাথা ঘামাচ্ছো। আমি কি ভুল বলেছি?

জ্বি। ছোট্ট শব্দে ফায়াজ উত্তর দিল।

জাগর চমকালো। তার শতভাগ নিশ্চিত হওয়া কথাকে ফায়াজ অকপটে ভুল প্রমাণিত করছে। জাফর ভ্রু কুঁচকে বলল,
মানে? কি বলতে যাচ্ছো?

মানে আপনি ভুল বলেছেন। আমি কারো পারিবারিক ব্যপারে মাথা ঘামাচ্ছি না। ফায়াজের নির্বিকার কন্ঠ।

তাহলে কি করছো?

ফায়াজ ট্রাউজারের পকেটে হাত পুরে মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়ালো। বলল,
একজন নির্যাতিত মানসিক ভাবে অসুস্থ রোগীকে সুস্থ্য করে তোলার চেষ্টা।

জাফর ব্যঙ্গ হাসলেন। সেই হাসির ধ্বনি ফায়াজের কান পর্যন্ত পৌঁছালো। জাফর তাচ্ছিল্য কন্ঠে বললেন,
ভালো বলেছো কিন্তু রোগীর বাড়ির লোক আছে রোগীকে দেখভালের জন্য।

তারা দেখভাল নয় বরং শারীরিক এবং মানসিক নির্যাতন করছে আর এসব তো আমি বসে বসে দেখতে পাড়ি না।

জাফর নিশ্বাস ফেললেন। ফায়াজ কানে ফোন রেখেই অদূরে তাকালো। জাফর বেশ শান্ত ভাবে বললেন,
দেখো ফায়াজ। এটা মইনুর ভাইয়ের নিজেদের ব্যপার। তারা তার মেয়েকে কিভাবে রাখবেন এটা তারা বুঝবেন ভালো। তোমার সেখানে না যাওয়াই ভালো। তুমি সেখানে দুদিনের মেহমান। দিন শেষে তোমাকে ফিরে আসতেই হবে। যদি তোমার কাজ শেষ হয়ে থাকে তাহলে তুমি কাল-পরশুর মধ্যেই ঢাকা চলে এসো। আর কাজ না শেষ হলে আমাকে বলো বাংলাদেশে অনেক গ্রাম আছে আমি এর থেকে সুন্দর গ্রামে পাঠাবো তোমাকে।

ফায়াজ শব্দহীন হাসলো। বলল,
জাফর সাহেব, বাংলাদেশে গ্রাম তো অনেক আছে কিন্তু পরী শুধু আদুরীগাঁওয়েই আছে। আমি জানি আমার কোন কাজটা করা উচিত আর আমি সেই কাজটাই করছি।

জাফর বুঝলেন ফায়াজ তার সিদ্ধান্তে অটল। তবুও শেষ চেষ্টা করে বললেন,
তাহলে কি তুমি আসবে না?

জ্বি অবশ্যই আসবো। হয় পরীকে নিয়ে আসব নয় পরীকে সুস্থ করে আসবো।

আমি একটা কথা বুঝতে পাড়ছি না তুমি এত ব্যস্ত একজন মানুষ হয়েও ওখানে শুধু একজন মানসিক অসুস্থ মেয়ের পেছনে পড়ে আছো কেন?

সব প্রশ্নের উত্তর হয় না। কিছু প্রশ্নের উত্তর নিজে থেকে বানিয়ে নিতে হয়।

জাফর কিছু বললেন না। তার ঝুলিতে কথা ফুরিয়ে গেছে। তিনি জানেন ফায়াজ প্রচন্ত জেদি কিন্তু আজ সেটার সম্মুখীনও হয়ে গেলেন। তিনি ফায়াজের সাথে আর কথা বাড়ালেন না। নিঃশব্দে কল কেটে দিলেন। কান থেকে ফোন সরিয়ে ফায়াজ বুক ভরে শ্বাস নিয়ে নিশ্বাস ছাড়লো। দুহাতে চুল পেছনে ঠেলে বাড়ির দিকে এগিয়ে গেল। দরজা দিয়ে ঢুকতেই মইনুর শেখের সাথে দেখা। তিনি বসার ঘরে সোফায় বসে পানি পান করছিলেন। ফায়াজ মইনুর শেখের সামনে যেয়ে দু হাত তুলে বুকের উপর হাত বেধে দাঁড়ালো। মইনুর শেখ গ্লাস টি-টেবিলে রেখে সোজা হয়ে বসলেন।
কিছু বলবে?

ফায়াজ নির্বিকার কন্ঠে বলল,
আমি এখানে এসেছি আমার কাজে আর নিজের কাজ শেষ না হওয়া অব্দি এখান থেকে যাবো না। আপনি সর্বোচ্চ চেষ্টা করে দেখতে পাড়েন।

মইনুর শেখ সোফায় পিঠ ঠেকিয়ে দুই হাতলে হাত রেখে আয়েশি ভঙ্গিতে বসে বসলেন,
চ্যালেঞ্জ করছো আমাকে?

একশত ভাগ।

মইনুর শেখের সাদা দাড়ির মাঝে অবস্থিত অধরে হাসি ফুটলো। চোখে তার আত্মবিশ্বাস ভরপুর। হার জিতের প্রতিযোগিতায় সে সবসময় বিজয়ী। পূর্বের হাসি বজায় রেখে বললেন,
তুমি দুদিনের ছেলে। দুনিয়ার দেখেছোই বা কতটুকু আর জানোই বা কতটুকু? তুমি আমাকে চানো না। আমাকে চ্যালেঞ্জ করার মতো বয়স বা ক্ষমতা কোনটা তোমার নেই।

আপনার থেকে অভিজ্ঞতা আমার বেশি।

মইনুর শেখ কপালে ভাজ ফেললেন। কোন বিষয়ে?

প্রিয়জন হারানোর বিষয়ে।

মইনুর শেখের কপালের ভাজ মিলিয়ে গেল। সরু চোখে তাকালেন ফায়াজের দিকে। প্রিয়জন হারানো মানে? কি বলতে চাচ্ছে ফায়াজ? ওর প্রিয়জন হারানোর সাথে এসবের কি সম্পর্ক? আপাতত সব কিছু একপাশে রেখে বললেন,
তুমি এখানে টিকতে পাড়বে না।

আমি টিকতে আসি নি কিন্তু যার জন্য এসেছি সেটা করেই যাবো। ফায়াজ আর দাঁড়ালো না। বুকের উপর বাধা হাত ছেড়ে নিজের ঘরে চলে গেল। দরজা আটকে দিল ভেতর থেকে। পরীকে সুস্থ্য করতেই হবে যত দ্রুত সম্ভব। ফায়াজ রাফসানকে কল করে পরী সম্পর্কিত সকল প্রয়োজনীয় কথা সেরে নিল।

_______
মইনুর শেখ ঘরের মধ্যে পাইচারী করছেন। ফায়াজের এসব কথা বলার কারন বুঝতে পারছেন না। জাফরের সাথে কিছুক্ষন আগে তার কথা হয়েছে। জাফর তাকে জানিয়েছেন সকালে ফায়াজের সাথে যা যা কথা হয়েছে। মইনুর শেখ ভেবেছিলেন ফায়াজ পরীর কর্মকান্ডে অতিষ্ঠ এবং বিরক্ত হবে কিন্তু ফায়াজ তাকে এভাবে শান্ত করে রাখবে কখনও ভাবতেই পাড়েন নি। এখন তার চিন্তা হচ্ছে। পরী তার হাতছাড়া হয়ে গেলে এর থেকে খারাপ আর কিছু হবে না।

_______
পর পর দুদিন পরীকে খাইয়ে দিচ্ছে ফায়াজ। পরী ফায়াজের হাত ছাড়া খেতে নারাজ। মুখে থাকা রুটির শেষ টুকরো চিবিয়ে গিললো পরী। ফায়াজ পানি ভর্তি গ্লাস এগিয়ে দিয়ে পরীর মুখের কাছে ধরলো। বাটিতে ডান হাতের চার আঙ্গুল ভিজিয়ে পরীর মুখ ধুইয়ে দিল। তোয়ালে নিয়ে পরীর মুখ মুছতে যাবে এর আগের পরী আকস্মিক ফায়াজের কাঁধের টিশার্টে ঠোঁট মুছলো। ফায়াজ স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে। পরী কি করলো এটা! তার এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না। ফায়াজ পরীর দিকে তাকালো। অবিশ্বাসের সুরে বলল,
পরী কি করলে এটা?

পরী মাথা এদিক সেদিক নাড়াচ্ছে। ফায়াজ খেয়াল করে নি আমেনা কখন এসে টেবিলের কাছে দাঁড়িয়েছেন। পরী কাজে সে হতবাক হলেও এখন ঠোঁট টিপে হাসছে। ফায়াজ মনে মনে খুশি হচ্ছে। পরী তার সাথে মজা করেছে মানে ওষুধে কাজ হচ্ছে। ভালো কিছুর আভাস পাচ্ছে। পরীকে নাস্তা করিয়ে দিয়ে নিজে নাস্তা করতে বসলো। নাস্তা সেরে চেয়ার ছেড়ে উঠতেই আতর আলি হুড়মুড় করে ফায়াজের কাছে এসে দাঁড়ালো। ফায়াজ তোয়ালে হাতে তুলে নিল। জিজ্ঞাস করল,
কিছু বললেন?

সাহেব, আপনের সাথে একজন দেখা করতে আইছে।

কে?

আব্দুল্লাহ। কাঁধের পাশে হাল্কা আঙ্গুল তুলে বলল, ওই বড় রাস্তায় ওর চায়ের দোকান।

নাম শুনতেই ফায়াজ চিনে ফেললো। তোয়ালেতে হাত মুছে জিজ্ঞাস করলো,
কোথায় তিনি?

উঠানে।

আচ্ছা। বলে ফায়াজ বাড়ির উঠানের দিকে গেল। হাফ হাতা চেক শার্ট আর প্যান্ট করে দাঁড়িয়ে আছে আব্দুল্লাহ। বাড়ির আশপাশ দেখছে। চুলে তেল দিয়ে বাকা সিথী করা। ফায়াজকে দেখে হাসলো। ফায়াজও সৌজন্য হেসে জিজ্ঞাস করল,
কেমন আছেন?

আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। আপনে কেমন আছেন স্যার?

এইতো ভালো। তা এই সকাল সকাল? কোন বিশেষ তলব?

আব্দুল্লাহ হেসে ফেলল। উচ্ছ্বাসিত কন্ঠে বলল,
স্যার, গ্রামে মেলা বইছে। অনেক পুরাতন মেলা। আপনারে দাওয়াত দিতে আইছি। আজ রাতে গান বাজনা হইবো।

ফায়াজ আগ্রহ নিয়ে বলল,
তাই নাকি বলেন কি?

জ্বি সাহেব। আপনে আইবেন তো?

অবশ্যই যাবো। তবে আমি কি একা দাওয়াতি নাকি সাথে কাউকে নিতে পাড়বো।

অনেক আশা নিয়ে এসেছিল আব্দুল্লাহ। ফায়াজ রাজি হওয়ায় সে বেশ আনন্দিত। গ্রামে প্রতিবছর মেলা বসলেও এ বাড়ির কেউ ভুল করেও মেলায় পা রাখে না আর মইনুর শেখকে গ্রামের অধিকাংশ মানুষ দেখতে পাড়ে না। মইনুর শেখের মতো উচ্চবিত্ত মানুষই কেমন মাঝে মধ্যে মইনুর শেখের বাড়িতে মেহমান হয়ে আসে। আব্দুল্লাহ খুশিতে গদগদ হয়ে বলল,

নিতে পারবেন স্যার। যতজন ইচ্ছা নিয়া আইসেন।

ফায়াজ মুচকি হাসলো। দুদিনের দেখায় ফায়াজের সাথে অনেক মিশে গিয়েছে আব্দুল্লাহ। গ্রামের মানুষ খুব সহজ সরল হয়। তাই তো মেলার খবর দিতে এসেছে। ফায়াজের সাথে গ্রামের আরো কিছুজনের পরিচয় হয়েছে তবে তাদের মধ্যে মধ্যবিত্ত এবং বেশির ভাগ নিম্নবিত্ত।

অনেক ধন্যবাদ। আমি বিকেলে অবশ্যই যাবো।

_______
ফায়াজ আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছিল পরীকে নিয়ে মেলায় যাবে এবং এও আশংকা করেছিল মইনুর শেখ তাকে বাধা দিবেনই। তাই মইনুর শেখের থেকে অনুমতি নেয়ার নেয়ার প্রয়োজন বোধ করলো না ফায়াজ। ঝামেলা যখন বাধাবেই আগে ভাগে কি দরকার? ফায়াজ আমেনাকে নিয়ে পরীর ঘরে এলো, উদ্দেশ্য পরী কোন জামা পড়ে যাবে সেটা বাছাই করা। আমেনা এসে পরীর আলমারি খুলে জামা গুলো বের করে বিছানার উপর রাখছে। পরী বিছানায়ই বসে ছিল। বিছানার উপর নিজের জামা গুলোর দিকে ঢেবঢেব করে তাকিয়ে আছে। তার মস্তিষ্ক বলছে এসব কি চলছে? ফায়াজ পরীর সব জামা গুলো নেড়েচেড়ে দেখলো। এরপর একটা বাছাই করলো। সাদা জামাটায় পুরো এম্বোডায়েরি করা। এই জামাটার সাথে ওড়নাও আছে। ফায়জ আমেনাকে বলল,
বাকি গুলো গুছিয়ে রাখুন।

এরপর পরীর পাশে যেয়ে বসলো। পরম স্নেহে পরীর মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
পরী ঘুড়তে যাবে মেলায়?

পরী ফায়াজের দিকে তাকালো। তার ঠোঁট নড়ছে হয়ত কিছু বলতে চাচ্ছে। ফায়াজ ধীরে বলল,
মে-লা। মেলায় যাবো।

পরীও ভেঙ্গে ভেঙ্গে উচ্চারণ করল, মেলা।

চলবে…
®উম্মে কুমকুম

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here