নীলকণ্ঠা পর্ব-২০

0
1265

#নীলকণ্ঠা

২০।
আকাশে মেঘের ভেলা। মাথার ওপর মস্ত বড় সূর্যটা মেঘের আড়ালে গা লুকিয়েছে। তার তীব্রতা শুষে নিয়েছে হাজারো মেঘপুঞ্জ। সাঁইসাঁই বাতাস আর গুড়গুড় মেঘের আওয়াজ হচ্ছে। মিঠা সুবাসে ভরপুর চারিদিক। বৃষ্টির আগে বাতাসে মিষ্টি সুবাস মেখে থাকে। কাঠের বড় জানালাটার ভারী দুপাল্লা বার বার বাড়ি খাচ্ছে জানালায়। সেই শব্দে যেন বিশাল বাড়িটাও কেপে উঠছে। ফায়াজ বিছানা ছেড়ে উঠে পাল্লা টেনে ছিটকিনি লাগিয়ে দিলো। আমেনা পরীর ব্যাগ গুছিয়ে দিচ্ছেন। পরী নতুন জামা পড়ে বিছানায় আসন করে বসে আছে। আমেনার কাজ দেখছে। ব্যাগ গোছানো হলে ফায়াজ বলল,

খালা, আপনি আতর চাচাকে ডেকে দিন। ব্যাগের দিকে ইশারা করে বলল,

এগুলো বসার ঘরে রাখতে হবে। গাড়ি আসবে এখনই।

আমেনা নিরবে মাথা হেলিয়ে সম্মতি দিয়ে উঠে ঘর থেকে বেড়িয়ে গেলো। ফায়াজ হাটু ভাজ করে ব্যাগের কাছে বসলো। ব্যাগ নাড়িয়ে জামা কাপড় বসিয়ে ব্যাগের চেন লাগিয়ে উঠে দাঁড়ালো। তাকালো পরীর দিকে। পরীর চুল বাধা হয় নি। এলোমেলো চুলে ওড়না কোলে নিয়ে আলুথালু বসে আছে। ফায়াজ নিজ মনে হেসে ফেললো। এই অগোছালো পরীটাকেও বড্ড সুন্দর লাগছে। ছোট্ট শব্দে পরীকে ডেকে বলল,

পরী, এদিকে এসো তো। চুল বেধে দেই।

পরী অবুঝ চোখে তাকালো। ফায়াজ আবার ডাকলো,

এসো।

পরী বসা থেকে উঠে হাটুতে ভর করে দাঁড়ালো। ওড়না মুড়িয়ে বলের মতো করে দুহাতে জড়িয়ে নিয়ে হাটুতে ভর দিয়ে দিয়ে বিছানার কিনারায় ফায়াজের সামনে গেল। ফায়াজ পরীর হাত থেকে মুড়ানো ওড়না নিয়ে খুলতে খুলতে বলল,

এমন করে না পরী, ভাজ নষ্ট হয়ে যাবে তো।

ফায়াজ মুড়ানো ওড়নাটা খুলে পরীর সামনে দুহাতে মেলে ধরে বলল,

সুন্দর না?

পরী ওড়নাটার দিকে তাকালো। গভীর মনোযোগে তাকালো। ওড়না জুড়ে রঙ তুলির কাজ। একটা মেয়ে তার দীঘল কালো চুল ছেড়ে দিঘীর পাড়ে বসে আছে। হাতে দুটো পদ্মফুল। ফায়াজ এই জামাটা পরীর জন্য অর্ডার দিয়ে বানিয়েছে। পরীর অবুঝ মস্তিষ্ক বুঝদার হতে শুরু করেছে। পরী ওড়নায় থাকা মেয়েটার জায়গায় নিজেকে দেখতে পাচ্ছে। ফায়াজ একদিন পুকুর জলে ঝাপ দিয়ে দুটো পদ্মফুল এনে দিয়েছিল সেটা মনে পড়ে গেল। ওড়না থেকে চোখ সরিয়ে তাকালো ফায়াজের দিকে। ফায়াজ জিজ্ঞাসু ভ্রু নাচালো। পরী সম্মতিতে মাথা নাড়লো। কোমল ঠোঁট নেড়ে বলল,

সু-সুন্দর।

ফায়াজ প্রশস্ত হাসলো। পরীর ওড়নাটা লম্বায় ভাজ করতে করতে মনে পড়লো পরীর সাথে প্রথম দেখার কথা। পরী আবল তাবল বিরবির করতো। হাত পা নাড়তো। ফায়াজের মাথায় ইটের টুকরা ছুড়ে মেরেছিল। আর সেই পরী এখন পাচঁ দশটা মেয়ের মতো স্বাভাবিক থাকে। যে কেউ দেখলেই বলবে পরী তো একদম সুস্থ্য।

ফায়াজ পরীর ওড়নায় দুই ভাজ দিয়ে বিছানার উপর রাখলো। পরীকে ধরে বিছানায় বসিয়ে চিরুনি দিয়ে চুল আচরে বেনুনী বেধে দিতে শুরু করলো। বেনুনী বাধার মাঝেই আতর আলি এলো।

সাহেব।

ফায়াজ পেছনে ফিরে তাকালো। হলুদ ফতুয়া আর চেক লুঙ্গি পড়ে গলার ঝুলানো লাল গামছার দুপাশ ধরে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে। ফায়াজ সামনে তাকিয়ে পরীর বেনুনী বাধতে বাধতে বলল,

ব্যাগ গুলো বসার ঘরে রাখতে হবে চাচা।

আতর আলি গামছা ছেড়ে বললেন,

জ্বি আইচ্ছা সাহেব।

ফায়াজের ব্যাগও পরীর ঘরে ছিল। আতর আলি একে একে ব্যাগ দুটো বসার ঘরে নিয়ে গেলেন। ফায়াজ পরীর চুল বেধে খুব যত্ন নিয়ে ওড়নায় পিন মেরে দিল। নিজের শার্ট ঠিক করে চুলে হাত চালান দিয়ে পরীর হাত মুঠোয় নিল। সুমিষ্ট হেসে বলল,

চলো।

ঘর থেকে বের হতেই বাহির থেকে ভ্যানের শব্দ এলো। জঙ্গলের মাঝে সরু রাস্তা হওয়ায় গাড়ি ভেতরে আসতে পাড়ে না। তার জঙ্গল পাড় হওয়ার জন্য ফায়াজ ভ্যান ভাড়া করেছে। সে করেছে বললে ভুল হবে গ্রামের একজন করে দিয়েছে। গ্রামের যতজন মানুষ ফায়াজের সাথে কথা বলেছে বা দেখা হয়েছে তারা সবাই ফায়াজের বিশাল ভক্ত হয়ে গিয়েছে। মূলত তারা ভাবে নি মইনুর শেখের বাড়িতে এমন একজন আসবে যে সবার সাথে মিশবে।

_______
বসার ঘরে সবাই উপস্থিত থাকলেও অনুপস্থিত একমাত্র শ্রাবণ। মইনুর শেখ মাঝের সোফায় বসে খবরের কাগজ পড়ছেন। তার পাশের সোফায় বসে আছে রেনুকা। আড় চোখে তাকিয়ে আশপাশ পর্যবেক্ষণ করছে। থেমে থেমে তাকাচ্ছে পরীর হাত মুঠোয় রাখা ফায়াজের হাতের দিকে। আমেনা খাবার ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে আর আতর আলী দাঁড়িয়ে আছে বাহিরের দরজার সামনে।

ভ্যানওয়ালা বাড়ির দরজায় এসে ফায়াজ কে সালাম দিল।

আসসালামু আলাইকুম স্যার।

ফায়াজ সৌজন্য হেসে সালামের উত্তর দিল।

ওয়া আলাইকুমুস সালাম। এসেছেন? আপনার নাম যেন কি?

স্যার, আমার নাম মফিজ উদ্দিন।

জ্বি মফিজ, আমাদের এই দুটো ব্যাগ। আপনি এগুলো ভ্যানে নিয়ে রাখুন আমরা আসছি।

মফিজ ঘাড় কাত করে সম্মতি দিয়ে ঘরে ঢুকলো। মইনুর শেখকে সোফায় বসে থাকতে দেখে হাত তুলে সালাম দিলো।

আসসালামু আলাইকুম সাহেব। ভালো আছেন?

মইনুর শেখ উত্তর দিলেন না। তিনি তার গুরুগম্ভীর ভঙ্গিতে খবরের কাগজ পড়ে গেলেন। মাথা তুলে তাকালেন না পর্যন্ত। এতে মফিজের যে মন খারাপ হলো তা নয়। সে আগে থেকে জানে মইনুর শেখ কেমন মানুষ আর কেমন তার স্বভাব, আচার-আচরণ। মফিজ আর কোন কথা না বলে ব্যাগ দুটো হাতে তুলে নিয়ে বেরিয়ে গেল। ভ্যানের নিচ থেকে মোটা দড়ি বের করে ব্যাগ দুটোকে ভ্যানের সাথে বেধে দিল যাতে উঁচু নিচু রাস্তায় ভ্যানের দোলানিতে ব্যাগ পড়ে না যায়।

_______
ফায়াজ আশেপাশে তাকিয়ে শ্রাবণকে দেখতে পেল না। বসার ঘরের বড় দেয়াল ঘড়িটায় তাকালো। আটটা বাজতে পাচঁ মিনিট বাকি। আটটা বিশে গাড়ি জঙ্গলের ওপারে বড় রাস্তায় থাকবে। ফায়াজ বিরক্তিসূচক মৃদু শব্দ তুললো। এরপর গলা পরিষ্কার করে বলল,

আমাদের দেড়ি হচ্ছে। মিস্টার শ্রাবণ কোথায়?

মইনুর শেখ খবরের কাগজ থেকে মাথা তুলে তাকালেন। ফায়াজের সাথে দৃষ্টি বিনিময় হলো। তিনি কিছু বললেন এমন সময় শ্রাবণের আওয়াজ এলো।

আমি আসছি। তোমরা রওনা দাও।

ফায়াজ পেছনে তাকালো। ফায়াজের সাথে মইনুর শেখও তাকালেন। শ্রাবণের উক্তিতে ফায়াজ কিছু না বললেও মইনুর শেখ বললেন,

কেন? ওদের সাথে যাবে না কেন কি সমস্যা?

শ্রাবণ মাথা চুলকে বলল,

আমার কিছু কাজ আছে।

কি কা…মইনুর শেখের কথার মাঝেই ফায়াজ বিরক্তি সুরে বলল,

কাজ যদি থাকে তাহলে সেটা আগে বলা উচিত ছিল আপনার।

শ্রাবণ ফায়াজের দিকে তাকালো। মইনুর শেখ দ্রুত উঠে শ্রাবণের কাছে গেলেন। শ্রাবণের বাহু টেনে নিয়ে গেলেন আড়ালে। রুষ্ট গম্ভীর কন্ঠে বললেন,

কি সমস্যা তোমার? হেয়ালি করছো আমার সাথে? তোমাকে ওদের সাথে পাঠাতে চাচ্ছি কেন বুঝতে পারছো না?

শ্রাবণ মইনুর শেখের থাবা থেকে নিজের বাহু ছাড়িয়ে বলল,

এই কাজ থেকে আমার কাজ বেশি ইম্পরট্যান্ট।

মইনুর শেখ রেগে গেলেন। চোয়াজ শক্ত করে চাপা স্বরে বললেন,

ফাজলামো করছো আমার সাথে? তোমাকে এখানে এনেছি কি কারনে ভুলে গেছো?

কিচ্ছু ভুলি না স্যার। তবে আপনি যেটাকে শুধু কেটে ফেলতে চাচ্ছেন আমি তাকে মূল থেকে উপড়ে ফেলার চেষ্টায় আছি।

মইনুর শেখ কপাল ভাজ করে উদ্দেশক দৃষ্টিতে তাকালেন। প্রশ্ন করলেন,

মানে? কি বলতে চাচ্ছো?

শ্রাবণ মইনুর শেখকে আশ্বাস দিয়ে বলল,

চিন্তা করবেন না। আমি যা করছি আপনার ভালোর জন্যই করছি এবং বিশ্বাস করুন এর থেকে আপনার জন্য ভালো আর কিছুই না।

কিন্তু তোমার কাজটা কি?

আমি কিছু ইনফরমেশন কালেক্ট করতে যাচ্ছি।

কিসের ইনফরমেশন?

ফায়াজের সম্পর্কে।

_______
ভ্যান থামলো ঘন জঙ্গল পেরিয়ে পিচঢালা রাস্তায়। ফায়াজ পরীকে নিয়ে পেছনে বসেছিল। ভ্যান থেকে নেমে ফায়াজ একশত টাকার নোট দিয়ে বলল,

রাখুন।

মফিজ দ্রুত সত্ত্বর হাত সরিয়ে ভ্যান থেকে নেমে দাঁড়ালো। বলল,

না না স্যার। কি বলেন। ভাড়া লাগবো না।

কেন লাগবে না? এটা আপনার পারিশ্রমিক। নিন ধরুন।

না স্যার। হারুন ভাই জানলে রাগ হইবো। টাকা নিতে পারুম না।

আরে কেউ রাগ হবে না। আপনি নিন।

না স্যার। এইটুকুন রাস্তায় ভাড়া বিশ টাকা।

ফায়াজ মফিজের শার্টের পকেটে টাকা গুজে বলল,

বাকি টাকা আমি খুশি হয়ে দিয়েছি। আপনি আমাদের জন্য এত কষ্ট করে গেলেন আবার আমাদের নিয়ে এলেন। এতে আমি খুশি হয়েছি।

মফিজ পরম আনন্দে গদগদ হয়ে বলল,

স্যার, গ্রামের লোকের মুখে আপনার কথা শুনছি। তারা কয় আপনে অনেক ভালো একজন মানুষ। আজ দেইখা লইলাম।

ফায়াজ মৃদু লজ্জা মিশ্রিত হাসলো। তার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে পরী। সে আশেপাশে দেখছে, ফায়াজের মুঠোয় বন্দি তার হাত রেখে। তীব্র বাতাসে উড়ছে পরীর ওড়নার শেষ প্রান্ত।

চলবে…
®উম্মে কুমকুম

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here