নীলকণ্ঠা পর্ব-২৭

0
1756

#নীলকণ্ঠা

২৭|
হারিকেনের শিখায় ঘর অর্ধভাগ কমলা হলুদাভ রঙে রাঙান্বিত। হারিকেল ঘরের দরজার পাশে জলচৌকিতে রাখা। পুরো অন্ধকার ঘরে হারিকেনের মৃদু আলো কেমন একটা রোমাঞ্চকর পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। ফায়াজ এমন পরিবেশের সান্নিধ্যে আসে নি বহুদিন। দীর্ঘ বাতাসে ঝিঝিপোকার গানের সুর ভেসে আসছে। বাহিরে পাতিল, চামচের টুকটাক শব্দ হচ্ছে। নুরু মিয়া রান্না করছে। মাটির দুই চালার এক চুলায় ভাত বসিয়েছে অন্যচুলায় তরকারি। পরী দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বিছানায় বসে আছে। দুহাটুতে ফ্রেম ঠেকিয়ে তাকিয়ে আছে ফ্রেমে আবব্ধ তার পিতা মাতার ছবিতে। দুহাতে আকরে ধরে আছে ফটো ফ্রেমটা।

ছোট বাচ্চাদের যখন নতুন খেলনা দেয়া হয় তখন সে সারাক্ষন সেটা নিয়েই বসে থাকে। খেতে বসলে সেটা নিয়ে যায়, ঘুমাতে গেলেও সেটা নিয়ে ঘুমায়। পরীর হয়েছে সেই দশা। সে তার বাবা মায়ের ফটো ফ্রেম এমন ভাবে আঁকড়ে ধরে আছে যেন ছেড়ে দিলেই কেউ নিয়ে দৌড়ে পালাবে। ফায়াজ ঘরের একপাশে একটা কাঠের টুলে বসে পরীকে পর্যবেক্ষণ করছে। পরী একদৃষ্টিতে ফটো ফ্রেমের দিকে তাকিয়ে আছে। ফায়াজ পকেট থেকে ফোন বের করে সময় দেখলো। আটটা বাজতে কিছু মিনিট বাকি। পরীর আজকের প্রতিক্রিয়া রাফসানকে বলা হয় নি মনে পরতেই রাফসানকে কল দিল।

ফায়াজ কথা বলার আগেই ফোনের ওপাশ থেকে রাফসানের রাগত কণ্ঠস্বর কানে এলো।
কি রে ব্যাটা। এখন সময় হলো তোর কল করার?

ফায়াজ নিঃশব্দে হাসলো। হাসি শেষে বলল,

সরি রে, ভুলে গিয়েছিলাম।

রাফসানের রাগত কন্ঠ আরো উচ্চ শোনা গেল। সে ব্যঙ্গ করে বলল,

হ্যা হ্যা, ভুলে তো যাবাই। কাজ শেষ হলে আর কে মনে রাখবে?

ফায়াজ ফের হাসলো। এবার ক্ষানিকটা শব্দ হলো। বলল,

কি ইয়ার, তুই বাচ্চাদের মতো রাগ করছিস?

আচ্ছা বাদ দে সেসব। ওখানের খবর বল। সব ঠিক ঠাক?

হ্যা। ঠিক ঠাক বলা যায়।

ঠিক ঠাক বলা যায় মানে? ঠিক ঠাক নাই? ঘটনা খুলে বল। পরীর রিয়েকশন কেমন ছিল? পজেটিভ ওর নেগেটিভ?

ফায়াজ রাফসানকে পুরো ঘটনা বলার পর বলল,

কিন্তু পরী তো বাবা মায়ের কাছে যেতে চাচ্ছে না। সে দেখি ছবিতেই সন্তুষ্ট।

রাফসান ফায়াজের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনলো। এরপর কিছুক্ষন ভেবে বলল,

আমি এটার কারন ঠিক বলতে পারছি না। তবে আমার যতটুকু মনে হয় ওর বাবা মা যে ওর কাছে নেই অর্থাৎ চাইলেও তাদের পাওয়া যাবে না। এটা সে বুঝে গেছে। আচ্ছা, ও কি ওর বাবা মাকে চিনতে পেরেছে?

ফায়াজ এক নজর পরীকে দেখে নিল। পরী আগের মতোই বসে আছে। ফায়াজ বলল,

হ্যা। চিনতে পেরেছে। ছবি হাতে পাওয়ার পর থেকে এখনও হাতছাড়া করে নি। কিছুক্ষন জড়িয়ে ধরে রেখেছিল আর এখন তাকিয়ে আছে।

আচ্ছা, বুঝলাম। আর ওষুধ কন্টিনিউ করছিস তো?

হ্যা। অকপটে ছোট্ট শব্দে মিথ্যা বলল ফায়াজ।

তাহলে সুবিধাজনক ফল পাওয়ায়ার সম্ভাবনা আছে।

_______
অর্ধনির্ঘুমে রাত কাটালেন মইনুর শেখ। শরীরটা কেমন দুর্বল লাগছে। রেনুকাকে বলেছিলেন আদা চা দিতে। মইনুর শেখের নাস্তা শেষ হলে রেনুকা চায়ের কাপ এগিয়ে দিল। মইনুর শেখ গম্ভীর মুখে চায়ের কাপে চুমুক দিলেন। রেনুকা ক্ষানিক দূরে দাঁড়িয়ে হাসফাস করছে। মইনুর শেখের গাম্ভীর্যপূর্ণ মুখভঙ্গি দেখে সে কিছু বলার সাহস পাচ্ছে না।

মইনুর শেখ চায়ের কাপে দ্বিতীয় চুমুক দিলেন। অদ্ভুত স্বগম্ভীর কন্ঠে বললেন,

কিছু বলতে চাচ্ছো?

হঠাৎ রেনুকা চমকে উঠলো।

না মানে পরীর খবর পাওয়া গেছে কোন? রেনুকার কন্ঠ কাঁপছে। মইনুর শেখ নিঃশব্দে চায়ের কাপে তৃতীয় চুমুক দিলেন। চায়ের কাপ টেবিলে রেখে ধীরে সুস্থে বললেন,

এখনও না। পুলিশ দেখছে।

ওহ। রেনুকা ক্ষীণ শব্দ করে জবাব দিল। মইনুর শেখ চা শেষ করে উঠতেই ফোন বেজে উঠলো। মাহবুবুর রহমান কল করেছেন।

হ্যালো অফিসার।

মইনুর সাহেব?

জ্বি।

আপনাদের গ্রামের পরের গ্রাম কলাবাগানে বড় রাস্তার পাশে একজন যুবকের লা/স পাওয়া গেছে। আপনার দেয়া কি/ড/ন্যাপারের বর্ণনার সাথে লা/সের বর্নানার মিল পাওয়া যাচ্ছে। লা/স দেখে মনে হচ্ছে খু/ন করা হয়েছে। আপনি এখানে আসতে পারবেন?

মইনুর শেখের শরীর শিরশির করে উঠলো। তিনি কম্পিত কন্ঠে বললেন,

আমা-আমার আমার মেয়ে? মেয়ের খবর পে-পেয়েছেন?

না। আপনার মেয়েকে এখনও খুঁজে পাওয়া যায় নি। আমরা তদন্ত করছি। আপনার দেয়া গত কালকের নাম্বার ট্রেস করা হচ্ছে। আশা করছি ঘন্টা দুইয়ের মধ্যে ট্রেস সম্পন্ন হবে। আপনি কষ্ট করে কলাবাগান গ্রামে আসুন লা/সকে আইডেন্টিফাই করার জন্য।

জ্বি। আমি এখনই বের হচ্ছি।

মইনুর শেখ ফোন রাখলেন। তার বুক দুরুদুরু কাঁপছে। পুলিশের এক অন্যতম ক্ষমতা আছে। যে কোন পরিস্থিতিতে তারা খুব শান্ত ভাবে কথা বলতে পারে। এই যেমন একজন খু/ন হয়েছে। তার লা/স পাওয়া গিয়েছে কথাটা কত শান্ত ভাবে বললেন মনে হলো যেন দুধভাত কিন্তু এই কথাটা শুনে মইনুর শেখের শরীরের কম্পন যেন থামছেই না। তার মনে হাজারো প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। লা/সটা কি ফায়াজের? কে খু/ন করলো তাকে? তাও পাশের গ্রামে। তাহলে পরী কোথায়?

মইনুর শেখ ফোন রাখতেই রেনুকা জিজ্ঞাস করলো,

পরীর খোঁজ পেয়েছে?

না। একটা লা/স পাওয়া গেছে।

রেনুকা আঁৎকে উঠলো। মুখ ফসকে বলে ফেললো,

কি! পরীর লা/স পাওয়া গেছে?

রেনুকার কথাটা বলতে দেড়ি কিন্তু মইনুর শেখের অগ্নিশর্মা হয়ে তাকাতে দেড়ি নেই। মইনুর শেখের রাগত চোখে তাকাতেই রেনুকা ভয়ে জড়সড় হয়ে গেল। চোয়াল শক্ত করে রেনুকার দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে উচ্চস্বরে আতর আলিকে ডাকলেন। মইনুর শেখের উচ্চস্বরে রেনুকা মৃদু কেপে উঠলো। আতর আলি বাহিরে ছিল। মইনুর শেখের ডাকে এক প্রকার দৌড়ে ঘরে এলো। আতর আলি আসতেই মইনুর শেখ গম্ভীর কন্ঠে বললেন,

ভ্যান ডাকো। কলাবাগান গ্রামে যাবো।

আইচ্ছা। বলে আতর আলি আবার প্রায় দৌড়ে বেড়িয়ে গেল। আতর আলি যেতেই মইনুর শেখ নিজের ঘরে চলে গেলেন।

_______
রাস্তার ধারে মানুষের ভীড়। পুলিশ, সাংবাদিক আর এলাকার মানুষের ভীড়। গ্রামের মানুষ কৌতুহল নিয়ে লা/স দেখতে এসেছে। মইনুর শেখ ভ্যান থেকে নেমে দাঁড়ালেন। কিছুদূরে মাহবুবুর রহমান সাংবাদিকদের সাথে কথা বলছেন। মইনুর শেখ সেদিকে এগিয়ে গেলেন।

আমরা দ্রুত এর তদন্ত করবো। লা/স কার, কে বা কারা খু/ন করেছে দ্রুত সত্ত্বর বের করার চেষ্টা করবো। ধন্যবাদ।

মাহবুবুর রহমানের শেষের কথা গুলো মইনুর শেখের কানে এলো। মইনুর শেখ আরো দু কদম এগিয়ে যেতেই মাহবুবুর রহমানের সাথে দেখা হলো। মাহবুবুর রহমান বললেন,

মইনুর সাহেব এসেছেন? চলুন লা/স দেখবেন।

মইনুর শেখের হৃদস্পন্দন আবার বেড়ে গেলো। তিনি মাহবুবুর রহমানের দিকে তাকিয়ে কোন মতে সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়লেন। মাহবুবুর রহমান সামনে এগিয়ে চলছে। মইনুর শেখ যাচ্ছেন তার পেছন পেছন। কিছু দূর যেতেই মাহবুবুর রহমান হঠাৎ থেমে গেলেন। মইনুর শেখ প্রশ্ন করার আগেই মাহবুবুর রহমান বললেন,

ওহ, একটা কথা বলতে ভুলে গিয়েছিলাম। গতদিন আপনার বাড়ি থেকে কি/ড/ন্যাপারের ঘর থেকে যে ওষুধের পাতা পেয়েছি সেটার খোঁজ খবর নিয়েছি।

মইনুর শেখ জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালেন। মাহবুবুর রহমান বললেন,

ওটা মূলত মানসিক রোগীদের জন্য। আমি সন্দেহ করছি কি/ড/ন্যাপার মানসিক ভাবে অসুস্থ্য এবং সে এর জন্য এই ওষুধ নিত।

মইনুর শেখ নিরবে কথা শুনলেন। তিনি ইচ্ছে করেই পরীর মানসিক রোগের কথা মাহবুবুর রহমানের কাছে চেপে গেলেন। মাহবুবুর রহমানের কথায় শুধু সম্মতিসূচক মাথা নাড়লেন।

মাহবুবুর রহমান বললেন,

আপনি কি কি/ড/ন্যাপারের অস্বাভাবিক কিছু লক্ষ করেছেন?

মইনুর শেখ ক্ষীণ স্বরে বলল,

জ্বি না।

আচ্ছা। আর ওই ছবিটার ব্যপারে এখনও জানা যায় নি। তবে আশা করছি খুব শীগ্রই জেনে যাবো।

মইনুর শেখ ঢোক গিয়ে গলা ভিজালেন। মাথা নাড়িয়ে বললেন,

জ্বি।

মাহবুবুর রহমান বললেন,

তো, চলুন। লা/স দেখে বলুন।

মাহবুবুর রহমান মইনুর শেখকে লা/সের কাছে নিয়ে গেলেন। মাহবুবুর রহমান দুজন পুলিশের সাথে কিছু নিয়ে কথা বললেন। মইনুর শেখ সেগুলো শুনলেন না। মাহবুবুর রহমানের কথায় লা/সের উপর থেকে প্লাস্টিকে পলি সরিয়ে দেয়া হলো। মাহবুবুর রহমান সামনের দিকে হাত বাড়িয়ে বললেন,

মইনুর সাহেব দেখুন।

মইনুর শেখ লা/সের দিকে তাকালেন। লা/সের দিকে তাকাতেই মইনুর শেখের মাথা ঘুড়ে গেল। এত নি/শং/স ভাবে কেউ কাউকে খু/ন করতে পারে সেটা লা/স না দেখলে বুঝতেই পারতেন না। এক চোখ উ/প/ড়ে ফেলেছে। ঠোঁট কে/টে ফেলেছে। দু পাটি দাতঁ বেড়িয়ে আছে। গালে অসংখ্য কা/টা দাগ। কপালের চামড়া কে/টে ফেলা। শরীরে শুধু একটা কালো প্যান্ট। শরীরের উপরিভাগেও অসংখ্য কা/টা-ছ্যা/ড়া।

মইনুর শেখ আরো মনোযোগ দিয়ে লা/সের মুখের দিকে তাকাতেই স্তব্ধ হয়ে গেলেন। পুরো শরীর কেঁপে উঠেছে। বুক কাঁপছে প্রচন্ড। সূর্যের মিঠা আলো তীব্র অনুভূত হচ্ছে। ঘাম দিচ্ছে। মাহবুবুর রহমান মইনুর শেখের দিকে তাকালেন। মইনুর শেখের মুখভঙ্গি দেখে বুঝাই যাচ্ছে লা/সটা তার পূর্বপরিচিত। মাহবুবুর রহমান ভাবলেন তাহলে এই সেই কিডন্যাপার। সে কি/ড/ন্যাপ করে নিজেই এখন খু/ন হয়েছে।

চলবে…
®উম্মে কুমকুম

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here