অপেক্ষার প্রহর পর্ব-১৪

0
706

অপেক্ষার প্রহর (পর্ব- ১৪)
প্রয়োজনের সময় দরকারি জিনিষগুলো কেন জানি খুঁজে পাওয়া যায় না। একটা চিঠি লিখতে হবে, কলম খুঁজে পাচ্ছে না শফিক। পাশের বাসার মেয়েটা তো ডাক্তার। ওর হাসপাতালে নিশ্চয়ই মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভরা আসে। ওদের কাছ থেকে নিশ্চয়ই কলম পায়। শফিক কি শিলার কাছে কলম চাইবে?
শফিকের একটি অদ্ভুত অভ্যাস আছে। বড় বড় মানুষদের চিঠি লিখে।এ পর্যন্ত অনেক জনকে চিঠি লিখেছে সে- বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম, সত্যজিৎ রায়, ম্যাক্সিম গোরকি, হুমায়ুন আহমেদ সহ আরও বড় বড় মানুষদের।জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকেও একটা চিঠি লিখেছে। বঙ্গবন্ধুকে লেখা চিঠিটা নিম্নরুপ ছিলঃ
প্রিয় বঙ্গবন্ধু,
কেমন আছেন? আশা করি ভাল আছেন। এই অভাগার সালাম নিবেন। আপনি হয়তো জানেন না আপনার জন্মদিন এখন শিশু দিবস হিসেবে পালন করা হয়ে থাকে। আপনি শিশুদের অনেক পছন্দ করতেন বলেই এই দিনটি শিশু দিবস হিসেবে পালন করা হয়ে থাকে। শিশুদের জন্য নেয়া যেকোনো উদ্যোগই প্রশংসার দাবি রাখে।কিন্তু এই শিশু দিবসটি কোন শিশুদের জন্য? যেসব শিশু শ্রমকে বিক্রি করে বেড়ায় সেইসব শিশুরা কি এই দিনে ছুটি পায়? তারা কি নিজেরদের মত আনন্দ-উৎসবে মেতে থাকতে পারে এই দিনে? আমার তো মনে হয় অনেক শিশু হয়ত জানেই না তাদের এই দিবসের কথা।
শিশুশ্রম বলতে আমরা বুঝি বাস-লেগুনার হেল্পার বা গৃহকর্মী বা কলকারখানায় কাজ করা। কিন্তু এর বাইরেও শিশুশ্রমের অন্য রূপ আছে। এই রূপের পেছনে অবশ্য রয়েছে সমাজে শিক্ষা ও সচেতনতার অভাব। দারিদ্র্যের কষাঘাতে নিষ্পেষিত এক দল দরিদ্র বাবা-মা এই শিক্ষা ও সচেতনতার অভাবে অর্থ উপার্জনের আশায় তাদের শিশুদের তুলে দেন পাচারকারীদের হাতে। মধ্যপ্রাচ্য সহ বিভিন্ন দেশে শিশুরা পাচার হয়ে যাচ্ছে। সেখানে তারা যৌনকর্ম, উটের জকি ইত্যাদি বিভিন্ন ধরনের নিষিদ্ধ কাজে জড়িয়ে পড়ে। এসব পাচারকারীরা আরও ভয়ংকর ব্যবসা করে এসব বাচ্চাদের নিয়ে- শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিক্রি করে দেয়, তাদের মাথার খুলি- কঙ্কাল বিক্রি করে।
শিশুশ্রমিকের সমস্যা আজ পুরো বিশ্ব জুড়ে। শিশুশ্রমের কারণে শিশুদের মধ্যে গড়ে উঠছে না সামাজিক মূল্যবোধ। পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, একে অন্যের প্রতি যে সহমর্মিতা তা যেন হারিয়ে যাচ্ছে এসব শিশুদের মধ্য হতে।এছাড়া অল্প বয়সে ধূমপান সহ বিভিন্ন ধরনের মাদকদ্রব্যে আসক্ত হয়ে পড়ে। তদুপরি অল্প বয়সে বেশি অর্থ উপার্জনের জন্য বিভিন্ন অপরাধকর্মে জড়িয়ে পড়ছে। শিশু শ্রমকে নিরুৎসাহিত করার কথা আসলেই আমরা চিন্তা করি কিভাবে তাদেরকে স্কুলের পড়াশুনার গণ্ডিতে কিভাবে আবদ্ধ রাখব তা নিয়ে। শিশু শ্রমের মূলে যে আর্থিক অভাব- অনটন তা দূর করার কথা চিন্তা করি। কিন্তু সবার অভাব-অনটন কি কখনও স্থায়ীভাবে দূর করা সম্ভব? না, সম্ভব না। তাই শিশুশ্রমও কখনও স্থায়ীভাবে দূর হবে না। কিন্তু আমাদের খেয়াল করতে হবে অভাবের কারণে শিশুদের যাতে কোন বিপদজনক কাজ করতে না হয়। শ্রমের পাশাপাশি তারা যাতে সুস্থ জীবনযাপন করতে পারে, পড়াশুনা- খেলাধুলা ঠিকমতো করতে পারে সেটুকুও নিশ্চিত করতে হবে আমাদের।এর পাশাপাশি শহর এবং গ্রাম অঞ্চলে শিশুশ্রম এবং শিশু পাচারের বিরুদ্ধে মানুষকে সচেতন করে তুলতে হবে।
এ তো গেল শিশু শ্রমিকদের কথা। যাদেরকে জীবনের প্রথম ভাগে আর্থিক জটিলতার মাধ্যমে যেতে হয়না তারাও যে খুব ভাল আছে তা নয় কিন্তু। তাদেরকে পোহাতে হয় অন্য রকমের ঝামেলা। প্রতিটি মানুষের কিছু স্বপ্ন থাকে। কিছু স্বপ্ন পুরণ হয় কিছু হয় না। বাবা- মারা তাদের অপূর্ণ স্বপ্নগুলোকে চাপিয়ে দেয় কোমলমতি শিশুদের উপর। ছোটবেলা থেকে এসব শিশুদেরকে বাবা-মায়ের স্বপ্নের বোঝা বয়ে বেড়াতে হয়। শুধু লেখাপড়ায় ভাল হলে হবে না, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে পারদর্শী হতে হবে। শুরু হয় সেরা হবার ইঁদুর দৌড়। নিজের পছন্দ-অপছন্দ প্রকাশের নেই কোন স্বাধীনতা। বাড়তে থাকে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে দূরত্ব যা একসময় এই নিষ্পাপ শিশুগুলোকে নিয়ে যায় সামাজিক অপরাধের দিকে।
আমি খুব ক্ষুদ্র একজন মানুষ। যতটুকু বুঝি তাই লিখার চেষ্টা করেছি। কোন সমাধান দেবার যোগ্যতা আমার নেই। যদি ভুল কিছু বলে থাকি তবে ক্ষমা করবেন প্লিজ। ভাল থাকবেন।
ইতি
মিজানুর রহমান শফিক

আজকে চিঠি লিখবে শহীদ জননী জাহানারা ইমামকে। চিঠিতে কি লিখবে তা ঠিক করে রেখেছে। চিঠিটি নিম্নরুপ হবেঃ
শ্রদ্ধাস্পেষু,
কেমন আছেন? মাত্র আপনার একটি বই পড়লাম “জীবন- মৃত্যু”। মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন ঘটনা নিয়ে লেখা অসম্ভব সুন্দর একটি বই। এই বইয়ের আরেকটা জিনিষ ভাল লেগেছে। একটি ঘটনা আছে মুক্তিযুদ্ধে মেয়েদের অবদান নিয়ে। যখনি মুক্তিযুদ্ধের কথা উঠে আসে তখনি আমরা বলি আমরা বলি মুক্তিযুদ্ধে ত্রিশ লক্ষ মানুষ শহীদ হয়েছে, দুই লক্ষ মা- বোন নির্যাতিত হয়েছে। কিন্তু তাদের নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের কোন গল্প তৈরি হয়নি, সিনেমা তৈরি হয়নি। পুরুষকেন্দ্রিক সমাজটি মুক্তিযুদ্ধকে পুরুষের আয়ত্তে নিয়ে গেছে। কিন্তু আমরা জানি যে মুক্তিযুদ্ধে পুরুষের চেয়ে নারীর অবদানকে খাটো করে দেখার কোন অবকাশ নেই।
গ্রামবাংলার মায়েরা নিজের ছেলেদের যুদ্ধে যেতে উদ্দীপনা জুগিয়েছেন, আগ্রহ দেখিয়েছেন, খাদ্য দিয়েছেন। মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিয়েছেন এবং স্থানীয় পাকিস্তানী সেনা ও রাজাকার বাহিনীর খবর সংগ্রহ করে দিয়েছেন। ভিখারী, বিক্রেতা নানারকম সাজে নারীরা শত্রুর অবস্থানের কাছে গিয়ে তাদের সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করে মুক্তিযোদ্ধাদের অবগত করতেন। এ ছাড়াও মুক্তিযোদ্ধকালে নারী মুক্তিযোদ্ধাগণ সংগঠন ও পরামর্শক, সাংস্কৃতিক প্রেরণাদাত্রী, কূটনৈতিক চরিত্র এবং প্রশিক্ষকের ভূমিকায় অবদান রেখেছেন। যুদ্ধের পর এই বীরনারীরা তাঁদের প্রাপ্য স্বীকৃতি ও মর্যাদা এখনো পাননি বরং তাদের করা হয়েছে সমাজচ্যূত। যেন ধর্ষিত আর নির্যাতিত হওয়াটা তাদেরই ‘অপরাধ’ ছিল। মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করার জন্য ভাগীরথীকে নির্মম নির্যাতনের মাধ্যমে হত্যা করেছিল পাকিস্তানী সৈন্যরা। অথচ শহীদ ভাগরথী স্বাধীন দেশে পাননি তাঁর প্রাপ্য স্বীকৃতি। প্রয়াত ড. নীলিমা ইব্রাহিমের ‘আমি বীরাঙ্গনা বলছি’ বইয়ের পাতায় রয়েছে এই বীরনারীদের সংগ্রামের ইতিবৃত্ত।
আমরা অনেক দেরী করে ফেলেছি এই সব সাহসী আর মহান নারীদের সন্মানিত করতে। আমাদের প্রিয় লাল সবুজ পতাকার পুরুষের রক্তের পাশাপাশি মিশে আছে নারীর রক্ত, নারীর আত্মততত্যাগ।সকল নারীদের এই মহান আত্মত্যাগের যথাযথ সন্মান জানাতে হবে। ৭১ এর সকল বীর নারীকে জানাই সশ্রদ্ধ অভিবাদন। অভিবাদন জানাই শহীদ সেলিনা পারভীন, শহীদ মেহেরুন্নেসা, শহীদ ভাগীরথী সহ অসংখ্য শহীদ নারীকে ,অসংখ্য নির্যাতিত নারীকে, অসংখ্য যোদ্ধানারীকে। বাংলার মায়েরা মেয়েরা সকলেই বীর, সকলেই মুক্তিযোদ্ধা।
মুক্তিযোদ্ধাদের উৎসাহিত করার পেছনে সাংস্কৃতিক দলগুলোর ভুমিকা ছিল অতুলনীয়। এই দলগুলোতে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নারী ছিল।মুক্তি সংগ্রামী শিল্পী সংস্থা নামে একটি সংস্থা ছিল, যার সদস্যরা (যার উল্লেখজনক সদস্য ছিল নারী) বাংলাদেশের মুক্তাঞ্চলগুলো ঘুরে বেড়িয়েছিলেন মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্বুদ্ধ করতে। এ গ্রুপটির কর্মকাণ্ড নিয়ে পরবর্তীকালে মুক্তির গান চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করেন প্রয়াত পরিচালক তারেক মাসুদ ।
মুক্তিযুদ্ধের সময় সেক্টর -২ –এ বাংলাদেশ সরকারের একটি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠিত হয়। সেখানে অসংখ্য নারী সেবিকা আহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা প্রদান করে থাকেন। তাদের মধ্যে একজন ছিলেন সুলতানা কামাল(লিলি আপা) যার উল্লেখ পাওয়া যায় আপনার লেখা গ্রন্থ “একাত্তরের দিনগুলি” বইটিতে আপনার ছেলে শহীদ রুমির কথায়।
আপনি হয়ত জানেন না যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি নিয়ে যে আন্দোলন আপনি শুরু করেছিলেন তা আজ সফল হয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হচ্ছে এবং সে অনুযায়ী তাদের সাজা হচ্ছে। যারা যুদ্ধাপরাধী তারা দেশের শত্রু। তারা আমাদের দেশের অনেক বড় ক্ষতি করেছে। আজ তাদের সেই বিশ্বাসঘাতকতার বিচার হচ্ছে এবং তারা শাস্তি পাচ্ছে। আমার কথা হচ্ছে আমাদের দেশে বর্তমানে অনেক মানুষ রয়েছে যারা এসব রাজাকারদের মত দেশের ক্ষতি করে বেড়াচ্ছে। টাকা পাচার, মানুষ পাচার সহ বিভিন্ন অনৈতনিক কার্যকলাপের মাধ্যমে তারা দেশের ক্ষতি করছে, দেশের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করছে। এরা তো ঐসব রাজাকারদের তুলনায় কম বিপদজনক নয়। তাহলে এদের কি বিচার হবে না? এদের সাজা হবেনা?
আমি খুব কম বুঝি। কিন্তু এই ব্যপারগুলো যখন চোখে পড়ে তখন খুব খারাপ লাগে, কষ্ট হয়।তাই আপনার সাথে শেয়ার করলাম। আপনার কাছ থেকে আমাদের অনেক কিছু শেখার আছে। একজন স্বামী- সন্তান হারা নারী কি করে শুধু মনের জোরে সমাজের ভয়ঙ্কর মানুষগুলোর বিরুদ্ধে লড়েছেন তা সত্যি আমাদের জন্য শিক্ষণীয়। অনেক সালাম রইল আপনার জন্য। ভাল থাকবেন।
ইতি
শফিক

শিলা এবার সত্যিই অবাক হয়ে গেল। মানুষ প্রতিবেশীর কাছে কলমও চায়? এটাও সম্ভব? (চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here