অপেক্ষার প্রহর পর্ব-১৬

0
536

অপেক্ষার প্রহর (পর্ব-১৬)
“হাসান, কেমন আছ?” হাসান থমকে দাঁড়াল। কলেজের ইংরেজি শিক্ষক হেলাল উদ্দিন ডাকছেন পেছন থেকে।
“আসসালামু আলাইকুম স্যার। ভালা আছেন?” হাসান পেছনে এসে শিক্ষকের কুশল জিজ্ঞেস করল।
“হুম, ভালা আছি। কই যাইতাছ?”
“একটু মাঠের দিকে যাইতাছি।”
“পরীক্ষার সময় এত আড্ডা দেয়া ঠিক না। আর কয়টা পরীক্ষা আছে?”হেলাল সাহেবের খুব পছন্দের এক স্টুডেন্ট হাসান। ছেলেটার মাথা বেশ পরিষ্কার। কোন কিছু একবারের বেশি দুইবার বোঝানো লাগে না। কিন্তু ছেলে পড়াশুনার প্রতি তেমন মনযোগী না। এটাই সমস্যা। ওর বড় ভাই শফিকের চাইতেও ভাল মাথা ওর পড়াশুনায়। শফিক অনেক সিনসিয়ার স্টুডেন্ট ছিল। এজন্য পরীক্ষায় ফলাফলও ভাল করেছে।মাথা যত ভালই হোক না কেন সিনসিয়ার না হলে কখনও ভাল ফলাফল করা যায়না।
“জি দুইটা। গণিত দুই পার্ট। আর প্র্যাকটিক্যাল বাকি।”
“ভাল। তা কোচিং করতে ঢাকায় যাইবা নাকি?”
“জি।”
“ভাল। ভর্তি পরীক্ষাই হইতাছে আসল পরীক্ষা। ভাল একটা জায়গায় টিকলে দেখবা এক ভাবে না এক ভাবে পাস কইরা বাইর হইবাই। ভালা কোন জায়গায় টিকাটাই হইতাছে কষ্ট। আইজকাল তো কম্পিটিশান অনেক বাইরা গেছে।” হাসান কিছু বলল না। যে দেশের মানুষ দুই বেলা দুই মুঠো ভাত ঠিক মত খেতে পায় না সে দেশের মানুষের এত পড়াশুনা করে কি লাভ? এই কথাটা প্রায়ই মনে হয় হাসানের(এই কথাটা লেখিকারও মাঝে মাঝে মনে হয়)।
“কই থাকবা? বন্ধুগো লগে মেসে?” হাসানের বাবাকে বলতে হবে হাসানকে যাতে ওর বন্ধুদের সাথে মেসে না রাখে। তাহলে ওর পড়াশুনা ঠিকমতো হবে না।
“জি না। ভাইজান বাসা লইছে। মা সহ থাকমু। মার ডাক্তার দেহান লাগব তো।”
“বাসা নেয়ার সিদ্ধান্ত ভালা হইছে। তা তোমার মায়ের শরীর কেমন?”
“এইত আছে মোটামুটি। ঐদিন একটু শরীর খারাপ করছিল। মাথা ঘুরাইয়া পইরা গেছিল।পরে ফার্মেসি থেকে লোক আনাইয়া দেখলাম প্রেসার লো। এখন একটু ভালা।”
“তোমরা ঢাকা যাওয়ার আগে একদিন যামু তোমাগো বাসায়।”
“স্যার আমি গেলাম তাইলে।”
“যাইবা? আইচ্ছা যাও। ভালামত পরীক্ষা দিও। আর বাসায় আইস ঢাকা যাওনের আগে।”
“আইচ্ছা স্যার। আসসালামু আলাইকুম।”
রাজিব- তন্ময় নিশ্চয়ই এতক্ষণে পৌঁছাইয়া গেছে। খেলাও শুরু হয়ে গেছে। স্যারের সাথে কথা বলায় দেরি হয়ে গেছে। তাড়াতাড়ি যাওয়ার জন্য হাসান শর্টকার্ট রাস্তা ধরল। পোড়াবাড়ির পাশ দিয়ে যেতে হয়। এই বাড়ি নিয়ে এলাকায় অনেক কথা চালু আছে। ছোটবেলায় বড়রা ভয় দেখাত ঐ বাড়িতে ভুত আছে বলে। আসলে এসব কিছুই না। বড় হয়ে কত আড্ডা দিয়েছে ঐ জায়গায়। সাপের আড্ডা ছাড়া আর কিছুই মনে হয়না এটা হাসানের কাছে। কিন্তু আজকে সত্যিই ভয় পেয়ে গেল হাসান। বাড়ির পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় একটা মেয়েলী গলায় কান্নার আওয়াজ পায়। ছোট ছেলে-মেয়ে বা মেয়েরা সাধারনত এদিকে আসেনা তেমন। তাদের মত ছেলেপেলেরাই আড্ডা দিতে, নতুন নতুন সিগারেটে টান দিতে আসে এখানে।
আয়াতুল কুরসি পড়ে বুকের মধ্যে ফুঁ দিয়ে হাসান বাড়ির ভিতরে ঢুকে অবাক হয়ে গেল। খুশি কাঁদছে। মনির স্যারের মেয়ে।
“খুশিবু তুমি এইহানে কি কর? আর কাঁদতেছ কেন?”
খুশি ও চমকে উঠল কারও গলার আওয়াজ শুনে। তারপর একটু সামলে নিয়ে বলল, “কাঁদি আমার কপালের দোষে। তুই এহানে কি করস?”
“আমি এইহান দিয়া যাইতেছিলাম। কান্নার আওয়াজ শুইনা ভিতরে ঢুকলাম। কিন্তু তুমি কাঁদতাছ কেন? তাও আবার এইহানে বইসা। তোমার ভয় করেনা এইহানে?”
“এহনও কি ছোড আছি যে ভয় করব পাগল? আমি আর আরমান কতদিন এইহানে আইসা একলগে গল্প করতাম।”
হাসান চুপ করে থাকল। খুশির প্রেম-বিয়ে নিয়ে গ্রামে অনেক রসালো গল্প চালু আছে। হাসান অবশ্য কখনও এসব গল্প নিয়ে মশগুল হয়নি। খুশিকে ও অনেক পছন্দ করে। তাই খুশির জন্য একটা সমবেদনা আছে ওর মনে। খুশির বাচ্চাটা কয়েকদিন আগে নষ্ট হয়ে গেছে।
“তোমার বাচ্চাটার জন্য খুব খারাপ লাগে তাইনা খুশিবু?” হাসান জিজ্ঞেস করল। খুশি হঠাৎ কাঁদা শুরু করল।
“তোমার বাচ্চাটা নষ্ট হইল কেমনে?”
খুশি এবার সত্যি অবাক হল। “তোরে কে বলল আমার বাচ্চা নষ্ট হইয়া গেছে?”
এবার হাসান সত্যি অবাক হল, “কেন? গ্রামের সবাই তো জানে তুমি বাথরুমে পিছলা খাইয়া পড়ছ, তারপর তোমার বাচ্চা নষ্ট হইয়া গেছে।”
খুশি কাঁদতে কাঁদতে বলল, “তাই যদি হইত তাইলে তো ভালাই হইত রে ভাই। এত পাপী মনে হইত না নিজেরে।”
“কি হইছে খুশিবু। খুইলা বল।”
“হাসান আমার বাচ্চাটারে মাইরা ফেলন হইছে।”
“মানে? কি কইতাছ তুমি এইসব?”
“হ। মায়ে ঐদিন কইল খুশি চল আমি আইজকা তোরে ডাক্তারের কাছে লইয়া যামু। আমিও খুশি হইছি মা যাইব শুইনা। ডাক্তার দেহনের পর ডাক্তার মারে ডাইকা কি জানি কইল। মা কইল ডাক্তার আলট্রাসনোগ্রাম করব। এর লাইগা পানি খাইতে হইব। পানি খাইলাম। কিছুক্ষণ পর ঘুমাইয়া গেলাম। ঘুম থেইকা উঠার পর দেখলাম পেটের মধ্যে কেমন জানি ব্যথা লাগতেছে।”
“ব্যথা লাগতাছিল কেন? আর পানি খাইয়া তুমি ঘুমাইয়া গেলা কেন তাইত বুজলাম না।”
খুশি কাঁদতে কাঁদতে বলল, “অইহানে তো আসল কথা রে। ঘুম থেইকা উইঠা দেহি আব্বাও অইহানে আছে। কিছু বুজিনাই তহন। বাড়ি আওনের পর মায় কইল আমার বাচ্চাটা নাকি পেটের মধ্যে মইরা গেছিল। তাই পেট কাইটা বাইচ্চা বাইর করছে।”
“কি কইতাছ এইসব? বাচ্চা পেটের মধ্যে মইরা গেছিল?”
একটু চুপ থেকে খুশি বলল, “না হাসান, বাচ্চা পেটের মধ্যে মরে নাই। বাচ্চারে মাইরা ফালাইছে। আব্বা আর মায়ে মিলা আমার বাচ্চাটারে মাইরা ফালাইছে হাসান।”
হাসান অবাক হয়ে খুশির দিকে তাকিয়ে রইল। কি বলবে বুজতে পারছে না। খুশি বলতেই লাগলো, “আমার বাচ্চাটারে আমি বাঁচাইতে পারলাম না। ওরা কেমনে পারল আমার বাচ্চাটারে মাইরা ফেলতে? এই অধিকার ওগোরে কে দিছে?”
হাসান ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল, “খুশিবু তোমারে নিয়া গেরামে অনেকে অনেক কিছু কইতাছে।”
“জানি, কেউ কইতাছে বাইচ্চার বাপ শামীম (খুশির আগের স্বামী), কেউ কইতাছে আরমান। সবাই কথার ডালপালা ছরাইতাছে, কেউ আমারে একবার জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন ও আসলে বাচ্চার বাপ কে? হাসান একটা মাইয়ার বাচ্চার বাপ কে ঐটা ঐ মাইয়া ছাড়া আর কে জানব কইতে পারস?”
“বাচ্চাটার বাপ কে খুশিবু?”
“আরমান। যহন ফুর্তি করনের সময় হইছিল তহন ফুর্তি করছে। আর বাচ্চা পেটে আওনের পর শয়তানটা আমারে ছাইড়া দিল। নিজে দায়িত্ব লইবার পারে না আর আমারে সন্দেহ করে। শালা বেঈমান।”আরমান যে ছেলে ভাল না এটা গ্রামের সবাই জানে। আরমানের বাবা মেম্বার। ওদের একটা দল আছে। গ্রামের মেয়েদের উত্যক্ত করাসহ বিভিন্ন ধরনের আজে বাজে কাজ করে বেড়ায়।খুশি যে কি করে এরকম একটা ছেলের প্রেমে পড়ল বুজতে পারেনি হাসান। কিন্তু খুশিকে এই ব্যপারে সাবধানও করতে পারেনি। পাছে খুশি তাকে ভুল বোঝে।
“আরমান যে ভালা পোলা না এইডা তো তুমি আগে থেইকা জানতা খুশিবু।”
“শয়তানডা আমারে জাদু করছিল হাসান। বুজবার পারিনাই। বিয়ার পর শামীমরে যহন আরমানের কথা কইলাম সেও আমারে ব্যবহার করল। প্রতিটা দিন আমার উপর নির্যাতন চালাইত। একটা রাতও লোকটা আমারে শান্তিমত ঘুমাইতে দিলনা। আরমান যহন আমার লগে আবার যোগাযোগ করল ভাবলাম মানুষটা হয়তো আমারে শান্তিতে রাখব। সেই আশায় আরমানের হাত ধইরা পালাইলাম। সেইখানেও তো শান্তি পাইলাম না দেখলি তো।” হাসান চুপ করে রইল।
খুশিও কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, “জানস হাসান, আইজকা আরমানের বিয়া।”
হাসান শুনেছে আরমানের জন্য মেয়ে দেখা হয়েছে, আজকে মেয়েকে আংটি পড়াবে। মেম্বার চাচ্ছেন আজকেই ছেলের বিয়ে দিয়ে দিতে। কিন্তু এত ঘটনার পর খুশি এখনও কেন আরমানের কথা কেন এত ভাবে তাই চিন্তা করে পেল না।বিরক্ত লাগছে হাসানের।
“তুমি যদি আরমান ভাইরে এতই অপছন্দ কর তাইলে তারে ভুলতে পারতেছ না কেন? খুশিবু সবাই নিজের নিজের জীবন সাজাইয়া লইতেছে। তাইলে তোমার এত পিছুটান কেন? তুমি কেন পারতাছ না নতুন কইরা সব কিছু শুরু করতে?”
“এত সহজ না হাসান। বলতে পারস আমি কেমনে ভুলমু আমার বাচ্চাটারে মাইরা ফেলন হইছে? একটা বাচ্চারে দুনিয়াতে সবচেয়ে নিরাপদ রাখে বাচ্চার বাপ-মা। বাচ্চার বাপে বাচ্চারে অস্বীকার করছে আর আমি বাচ্চার মা হইয়া বাচ্চারে বাঁচাইয়া রাখতে পারিনাই। আমার বাচ্চাটারে আমি মাইরা ফালাইছি হাসান। ”
“কেন এমনে চিন্তা করতাছ খুশিবু।তোমার তো কোন দোষ নাই। তুমি তো জানতা না যে স্যার আর চাচী মিইলা তোমার বাচ্চাটারে মাইরা ফেলব। যে দোষ তোমার না তার জন্য তুমি কষ্ট পাইও না।”
একটু চুপ থেকে খুশি বলল, “অনেক চেষ্টা করছি হাসান, পারিনাই। সারাক্ষণ নিজেরে অপরাধী মনে হয়। আমার লাইগা আমার বাপ-মায় গেরামে মুখ দেখাইতে পারেনা। একটা নিষ্পাপ বাচ্চা মইরা গেল। আমি দায়ী সবকিছুর লাইগা।ঠিক করছি নিজেরে শেষ কইরা ফালামু। ” হাসান অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। খুশি বলতে থাকল, “এই দেখ বিষ লইয়া আইছি। এইহানেই নিজেরে শেষ কইরা দিমু। আইজকা আরমানের বিয়া। আইজকা ঠিক সময় হইব মরণের লাইগা। আরমানের জীবনের প্রতি বছর বিবাহবার্ষিকী হইব তার প্রথম স্ত্রীর মৃত্যুবার্ষিকী।”
হাসান ভয় পেয়ে খুশির সামনে এসে বলে, “এসব তুমি কি কইতাছ খুশিবু। না না তুমি এইসব কিছু করবা না। দাও আমার কাছে শিশিটা দাও।” তারপর খুশির হাত থেকে জোর করে বিষের বোতল নিয়ে ভেঙ্গে ফেলল। খুশি কাঁদতে শুরু করল।
“খুশিবু বুজতে পারতেছি তোমার সাথে অনেক বড় অন্যায় হইছে। কিন্তু তোমারও কিছু ভুল আছিল। যে ক্ষতি তোমার জীবনে হইছে পৃথিবীর কোন কিছু দিয়া সেই ভুলের সমাধান হয়না। ধইরা নাও না এটা তোমার জন্য একটা শিক্ষা ছিল জীবনে। ধর এইখান থেইকা তোমার জীবন আবার নতুন কইরা শুরু হইল।” খুশি একনাগাড়ে কাঁদতেই থাকে। হাসান খুশির হাত ধরে বলে, “তুমি কথা দাও আমারে তুমি এই কাম আর করবা না। সবসময় ভালা ভালা চিন্তা করবা এহন থেইকা।কখনও নিজেরে ছোট মনে করবা না, একা মনে করবা না। পৃথিবীটা অনেক বড় খুশিবু, অনেক সুন্দর। আত্মহত্যা কইরা এই সুন্দর পৃথিবীটা ছাইড়া যাইও না। ” খুশি অবাক হয়ে গেল। হাসান এত কিছু জানল কিভাবে জীবন সম্পর্কে, পৃথিবী সম্পর্কে এত ছোট বয়সে। খুশি তখন কিছু বলেনি।
বিষের বোতলটা ভাঙ্গার পর হাসান ভেবেছিল খুশি হয়ত তার কথাগুলো মেনে জীবনে সামনে এগিয়ে যাবে। কিন্তু হাসানের অনুমান মিথ্যা প্রমানিত হয়।জামিলুর সাহেব রাতে এশার নামাজ পড়ে এসে ফরিদাকে বলেন, “মাষ্টারের মেয়ে খুশি বিষ খাইয়া আত্মহত্যা করছে। মাষ্টার পুলিশে খবর দিছে। পুলিশ আরমানরে ধইরা লইয়া গেছে।” হাসান তখন পড়ছিল। হাসানের চোখের সামনে বিকালের ঘটনাটা ফুটে উঠল।(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here