#দ্বিতীয়_পুরুষ
পর্ব ৭
নীলাভ্র জহির
চিত্রার শরীরে ঘামের গন্ধ। ভ্যাপসা গরমের মধ্যে সন্ধ্যাবেলা চুলার ধারে বসে রান্না করেছে। লাকড়ির ধোঁয়া আর ঘুটে গোবরের মিশ্র গন্ধ তার শরীর থেকে বেরোচ্ছে। রূপকের খুব ভালোলাগে বউয়ের এই গন্ধ।
চিত্রা ভয়ে ভয়ে বলল, আপনারে একটা কথা কইতাম চাই।
কও বউ।
রাগ কইরবেন না তো?
নারে বউ। তুমি তো আমার দোয়েল পাখি। আমার ময়না, টিয়া, আমার কইতর। ময়না পাখির কথায় কি রাগ করা যায়।
– ময়না পাখির সব কথা কি আর ময়না পাখির মত লাগে। ময়না পাখি খারাপ কথা কইলে সেটা শুনতে কাউয়ার মত লাগে।
রূপক গম্ভীর হয়ে বলল, কি কথা কইতে চাও। কও দেখি বউ।
অনেকটা আতঙ্কগ্রস্থ কন্ঠে চিত্রা বলে ফেলল, আপনি কি সাইকেলটার জন্য কয়টা দিন ধৈর্য ধরতে পারবেন? আমার বিয়াতে ভাইদের ম্যালা খরচ হইয়া গেছে। আমার বাপের অবস্থা তো আপনি জানেন। সাইকেল টা দিতে একটু দেরি হইব। আর কয়টা দিন আপনি যদি একটু মারে বুঝ দিতেন।
রূপক চিত্রাকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল, আমার কোনো অসুবিধা নাই। যখন পারব তখনই দিবো। আমি কি সাইকেল ছাড়া দোকানে যাই না? আব্বা যেদিন দোকানে যায় না আমিতো ঐদিন আব্বার সাইকেল নিয়া যাই। সমস্যা নাই। তারা যখন দিতে পারে দিবে। তুমি এগুলো নিয়া মন খারাপ কইরোনা।
চিত্রা অনেক স্বস্তি পেল। মন থেকে সমস্ত শঙ্কা কেটে গেল তার। তার স্বামী অনেক ভালো মানুষ। সাইকেলের জন্য রূপক কোনো জোরাজোরি করবেনা এটা ভেবেই তার শান্তি লাগছে।
রূপক বলল, ও বউ এত দূরে শুইছ কেন। কাছে আসো।
আর কত কাছে আসবো।
আসো তোমারে একটু সোহাগ করি।
রূপক চিত্রার ব্লাউজের ভেতর দিয়ে হাত ঢুকিয়ে দিল। কেঁপে উঠল চিত্রা। তার সুড়সুড়ি কাটতে শুরু করেছে। এই স্পর্শ এখন তার খুবই চেনা। কিন্তু আজ মনের মধ্যে খুব অশান্তি হচ্ছে চিত্রার। রূপক তার সুডৌল বুক দুটো দলাই-মলাই করছিল। চিত্রা হঠাৎ রূপকের হাত ধরে বলল সীমা মাইয়াডা কেমন?
– আমাগো সীমা? কেন কি হইছে
-কন না কেমন মাইয়া।
– ঝগড়াইট্যা। সবার লগে ঝগড়া কইরা বেড়ায়। মানুষের মইধ্যে ঝামলা লাগাইয়া বেড়ায়। একজনের কথা আরেকজনকে কয়।
স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে চিত্রা, আমার লগে ও লাগাইতে আইছিল।
কও কি। কি কইছে তোমারে?
যা কওনের কইছে। থাউক ওসব কথা। আপনি ঘুমায়া যান।
ঘুমাইয়া যাবো? আমার সোহাগী বউডারে একটু সোহাগ করমু না?
– প্রত্যেকদিন সোহাগ করতে হইবো না। আপনার কি শইল্যে একটু ক্লান্তি নাই।
রূপক খিলখিল করে হেসে বললো, নতুন বিয়া করছি। এখন তো একটু এমন করবই। তাছাড়া এই কামে আমার কোনো ক্লান্তি নাই।
আপনে এমন ক্যান?
আবারো খিল খিল করে হেসে উঠল রূপক। তারপর গভীর আলিঙ্গনে তার বউকে নিয়ে ডুবে গেল অন্য এক সুখের রাজ্যে।
সকাল বেলা রূপক দোকানে যাওয়ার আগে চিত্রা বলল, আপনের মোবাইলে আজকে একটা ছবি লোড দিয়া দিয়ে আইনেন তো।
– কার ছবি দেখব কও?
– সাকিব খানের ছবি আইনেন।
– আচ্ছা, ঠিক আছে বউ। মারুফের ছবি দেখবা। আমার মারুফের ছবি খুব ভালো লাগে।
– আপনার যা মন চায়।
আজকের দিনটা খুব ভালো গেল চিত্রার। আজ সারাটা দিন কাজের ব্যস্ততায় কেটে গেল। সকালে রূপক দোকানে যাওয়ার পর চিত্রা গোবর দিয়ে ঘুটে বানিয়েছে। শাশুড়ির সঙ্গে গাছের ডাল কেটে লাকড়ি বানিয়েছে, পাতাগুলো দিয়েছে রোদে শুকাতে। দুপুর বেলা রুবিনা ও নাজমার সঙ্গে পুকুর ঘাটে গোসল করতে গিয়ে সাঁতার কেটেছে। আশে পাশের দুই বাড়ি থেকে মেয়েরা এসেছিল তার সঙ্গে গল্প করতে। গল্পের ফাঁকে ফাঁকে টুকিটাকি সংসারের কাজকর্ম করেছে সে। মেয়েরা তার বিছানার নিচে রাখা উপহারের জিনিস গুলো দেখতে চাইলে চিত্রা সব বের করে দেখিয়েছে তাদের কে। তাদের মধ্যে একটা মেয়ে বলে ফেলেছে, বিয়ার জিনিসটা সুকেসে সাজাইয়া রাখতে হয়। আপনার সুকেস নাই। রাখবেন কুনখানে। চকির নিচে মাটিত ফালাইয়া রাখলে তো নষ্ট হইয়া যাইবো।
চিত্রা কোন উত্তর না দিয়ে চুপ করে রইলো। পাশের বাড়ী থেকে আসা এক বউ বলল, আমি তো বাপের বাড়ি থাইকা সব আনছি। বড় গাছ কাইটা আব্বা আমারে খাট শোকেস আলমারি বানাইয়া দিছে। শোকেসে জিনিস নাই। এখন আমার আম্মায় কয় বাপের বাড়ি থাইকা জিনিস আইনা ভরতে। আমি কই, সুকেশ দিছে খাট দিছে আবার জিনিস দিব?
চিত্রা একটা নিঃশ্বাস ফেললো শুধু। এইসবের উত্তরে কোন কিছুই বলা যায় না। তার বাপের বাড়ি থেকে কিছু দেবার সামর্থ্য নেই। কাজেই এসব নিয়ে তার কোনো কথা না বলাই ভালো। অনেকেই তাঁকে খোঁচা মেরে নানান কথা বলবে চিত্রা জানে। সবকিছু তাকে মুখ বন্ধ করে সহ্য করতে হবে।
রূপক রাত্রিবেলা বাড়িতে ফিরে বলল, জব্বর জিনিস আনছি। আসো তাড়াতাড়ি ভাত খাইয়া লই। খাওনের পর শুইয়া শুইয়া ছবি দেখমু।
এ যেন বড়ই সুখের দিন। শ্বশুর-শাশুড়ির সঙ্গে একসাথে বসে ভাত খেলে রূপক চিত্রা। তারপর দরজা বন্ধ করে শুতে এলো। চিত্রা সন্ধ্যাবেলা দিয়ে বিছানা ঝেরে পরিষ্কার করে রেখেছে। বিয়েতে একটা নতুন বিছানার চাদর পেয়েছে চিত্রা। চৌকির উপরে একটা কাথা বিছিয়ে তার উপর চাদর বিছিয়েছে। শক্ত চৌকির উপর তাকে নিয়ে রূপক শুয়ে পড়লো। একই বালিশে মাথা রেখে দুজনে দেখতে শুরু করলো সিনেমা।
রূপক তাকে নির্দিষ্ট কোন ছবি দেখতে দিলো না। কি কি ডাউনলোড দিয়ে নিয়ে এসেছে সেগুলো দেখাতে লাগলো। রূপকের ফোর জিবি মেমোরিতে যে কয়টা ছবি লোড দিয়েছে সবগুলোই অল্প অল্প করে দেখাল সে।
তারপর দাঁত বের করে হাসতে হাসতে বলল, খাড়াও তোমার একখান জিনিস দেখাই।
বেশকিছু হিন্দি গান লোড দিয়েছে রূপক। ছোট ছোট জামা কাপড় পরা হট কিছু গান। বউকে নিয়ে দেখবে বলে খুব শখ করে সেই গানগুলো ডাউনলোড দিয়েছে। একটা গান চালু করতেই চিত্রা লজ্জায় মুখ ঘুরিয়ে বলল, এইসব কি দেখাইতেছেন?
হ, দেখ না।
চিত্রা মোবাইলের স্ক্রিনের দিকে তাকাতে পারল না। তার খুব লজ্জা লাগে। ছোট একটা জামা কাপড় পরা মেয়ে বুকের উপরের অংশ বের করে নাচছে। আর একটা ছেলে মেয়েটার গলায় ও নাভিতে বারবার চুমু খাচ্ছে। লজ্জায় চিত্রা মাথা ঢেকে ফেলল।
রূপক বলল, আরে দেখ না কেমনে করতাছে?
আমার শরম করে।
শরমের কি আছে? স্বামী স্ত্রী একসঙ্গে দেখবো তাই না।
আমার লজ্জা লাগতেছে। আপনি সরেন। এখন ছবি দেন।
খাড়াও। আগে দুইটা গান দেইখা লই। আসো আমার বুকের মধ্যে আসো।
চিত্রাকে বুকের মধ্যে ঠেসে চেপে ধরে রূপক গান চালু করল। গানের তালে তালে নাচছে একটা মেয়ে। তাদের রোমাঞ্চকর কিছু দৃশ্য দেখে চিত্রা ওর রূপক নিজেদেরকে ধরে রাখতে পারল না।। সেই চূড়ান্ত সুখের মুহূর্তে তারা নিজেদেরকে পৌঁছে দিয়ে ক্লান্ত হয়ে শুয়ে পড়লো। অতঃপর একটা সিনেমা চালু করল রূপক। সেই সিনেমাটা দেখতে লাগল অর্ধেক রাত অবধি। সিনেমা শেষ করে কখন ঘুমিয়ে পড়েছে টেরও পায়নি চিত্রা।
সকালে চিত্রার ঘুম ভাঙতে একটু দেরি হল। শাশুড়ির চেচামেচিতে যখন সে ঘুম থেকে উঠলো তখন অনেক বেলা হয়ে গেছে। এত দেরিতে উঠে গোসল করতে গেলে খুবই লজ্জার বিষয় হয়ে যাবে। গতরাতে অনেক দেরিতে ঘুমানোর কারণে আজকে ভোরবেলা তার ঘুম ভাঙেনি।
সে তাড়াহুড়া করে পুকুরপাড়ের দিকে ছুটল। দ্রুত সময়ের মধ্যে গোসল সেরে উঠে আসতেই শাশুড়ি মা বললেন, এগুলা কোন কথা?
চিত্রা লজ্জায় মাথা নিচু করে রাখল। জ্যোৎস্না আর কিছু বললেন না। কিন্তু উনার মুখে অনেক রাগ। গতকালকে কাটা লাকড়ি গুলো সে আজকে আবার রোদে দিচ্ছেন। চিত্রা ভেজা কাপড় ধুতে না দিয়ে তরিঘড়ি করে কাজ করতে লেগে গেল।
জোসনা বললেন, যাও তরকারি দেখো গিয়া। চুলা থাইকা নামাও।
মাথায় লম্বা ঘোমটা টেনে দিয়ে ছুটে রান্নাঘরে গেল চিত্রা। চুলার উপরে তরকারিতে বলগ এসেছে। তার মানে আজকে সে অনেক দেরি করে ঘুম থেকে উঠেছে। কি লজ্জার বিষয়! আর কোনদিনও এত রাত জেগে সিনেমা দেখবে না ঠিক করল চিত্রা। শাশুড়ি মা কখন রেগে কিছু বলবেন সেই ভয়ে তটস্থ হয়ে রইলো সে।
সকালের খাবার খেয়ে রূপক দোকানে চলে গেল। রূপক বের হওয়ার পরপরই শোনা গেল জোসনার গলা, আমাগো সময় বিয়া হইছে। এখনকার মত এত বেশরম মানুষ দেখি নাই। আমরা গোসল করতাম ভোর রাইত্তে। বাড়ির মানুষ একটাও টের পাইত না। আর এরা গোসল করে বেলা হইয়া যাওয়ার পর। পুরা গেরামের মানুষরে দেখায় যে আমি গোসল করতেসি। শরমে মানুষরে কেমনে মুখ দেখাব। আজকালকার পোলা মাইয়া লাজ নাই শরম নাই।
চিত্রা চুপ করে রইলো। মিনিটখানেক জিরিয়ে নিয়ে তার শাশুড়ি আবারো বলতে শুরু করলেন, সারারাইত খালি হাসির শব্দ। রূপকের বাপের কি রাগ। পোলা,পোলার বউয়েরে তো কিছু কইতে পারেনা। আমার লগে রাগ দেখায়। আমারে কয় এগুলার কি একটু লাজ শরম নাই। এত রাইতে কি শুরু করছে। অত জোরে হাইসা হাইসা গেরামবাসিরে শুনাইতে হইবো রঙ্গ তামাশা করতাছে।
চিত্রার চোখ ফেটে জল আসতে চাইল। নিজের দোষ ত্রুটি অন্য কারো মুখ থেকে শুনলে কষ্ট হওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তার শাশুড়ি খুবই কর্কশ ভাষায় জোরে জোরে কথাগুলো বলছে। চিত্রার হাসির শব্দ হয়তো আশে পাশের বাড়ির কেউই শুনতে পায়নি। তার সকালবেলা গোসলের খবরও হয়তো কেউ জানে না। কিন্তু তার শ্বাশুড়ীর এতো চেচিয়ে কথাগুলো বলার কারণে আশেপাশের দশটা বাড়ি পর্যন্ত কথাগুলো পৌঁছে যাবে। লজ্জায় অপমানে চিত্রার মাটির নিচে ঢুকে পড়তে ইচ্ছে করছে। তবে আজকে তার একটা শিক্ষা হলো। এখন থেকে খুব মেপে মেপে প্রত্যেকটা কাজ করবে চিত্রা।
সারাদিন আজ খুব মন খারাপ রইল। কারো সঙ্গে খুব একটা কথা বলল না সে। সন্ধ্যা বেলা ভাত চুলায় দিয়ে জ্বাল দিচ্ছিল বসে বসে। এমন সময় জোসনা এসে বললেন, তোমার বাপে কোনো সংবাদ দিছে?
চিত্রা বলল, না।
-এতদিন হইয়া গেল এখনো কোনো খবর নাই। সাইকেলটা কবে দিবে? আমরা পোলাডা অনেক কষ্ট করে মা গো মা।
– ভাইয়ের লগে কথা হইছে। কইছে দুয়েকের মধ্যেই দিবে।
– তাইলে তো ভালোই। শুনো তোমারে একখান কথা কই। ছেলে আমার প্রচুর খাটনি করে। তারে ভালো কইরা বুঝাইবা। ট্যাকা-পয়সা হিসাব কইরা খরচ করতে কইবা। আর কইবা প্রতিদিন বাড়ি আইসা হাতে ট্যাকা থাকলে তোমার হাতে দিতে। জমাইয়া রাখবা ট্যাকা। ভবিষ্যত আছে বুঝছ?
– জি আইচ্ছা।
রাতে ঘুমাতে যাওয়ার সময় গতদিনের মতোই মোবাইলে সিনেমা চালু করল রূপক। চিত্রা বলল,, আপনে দেখেন। আমি ঘুম যাই।
চিত্রার চোখে ঘুম নেমে এসেছে। এমন সময় মোবাইলে রিং বেজে উঠল। রূপক মোবাইল নিয়ে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। চিন্তাগ্রস্ত হয়ে উঠে পড়ল চিত্রা। কার সঙ্গে এত রাতে কথা বলতে গেল রূপক?
চলবে..