অপূর্ণতায় পূর্ণতা সূচনা পর্ব

0
6077

“আপনি আমায় ছেড়ে দিচ্ছেন শুভ্র?” প্রশ্ন করলাম সামনের ব্যক্তিটিকে। সে কোন কথা বললো না। আমার সামনে ডিবোর্সের কাগজটা তুলে ধরলো। আমি বিস্মিত!

আজ আমার বিয়ের প্রথম বিবাহবার্ষিকী। খুশি হয়ে ওনাকে সারপ্রাইজ দিতে গিয়েছিলাম। কিন্তু উনি আমাকে আরো বড় সারপ্রাইজ দিয়ে দিলেন! আমার হাতে ধরিয়ে দিলেন ডিবোর্স পেপার। আমার হাতে থাকা গোলাপের তোড়া সাথে সাথেই হাত থেকে পড়ে গেলো। ছবির ফ্রেমটাও পড়ে গেলো। মাত্রই বাঁধিয়ে এনেছিলাম! আমাদের বিয়ের ছবি বিদ্যমান ছিলো এতে। তাকে সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিলাম। ফ্রেম ভেঙে কাঁচের টুকরো হওয়ার ধ্বনি কানে আসছে! ঝিম ধরে গেছে সারা শরীরে। এর সাথে আমার হৃদয় অঙ্গনও টুকরো হয়ে যাচ্ছে। আমি হা করে তাকিয়ে আছি তার পানে। এতে তার কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করলাম।

আমি আবার বললাম, আমার থেকে দূরে সরতে চান? হয় তো তিনি আমার প্রশ্নেও অসন্তুষ্ট! কারণ আমি মানুষটাই যে তার জন্য এখন অসহ্য। তিনি নিরুত্তর।

আমি আবার বললাম, আমার সাথে কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছে না? তিনি এবার বড্ড রেগে গেলেন। আমার সামনে এসে হাতে ডিবোর্সের কাগজটা ধরিয়ে দিয়ে বললেন, ন্যাকামি ছেড়ে আমার সামনে থেকে দূর হও তো। তোমাকে আমার সহ্য হচ্ছে না।

তার কথায় চোখের নোনাজল গুলো আর বাঁধ মানলো না আপন গতিতে প্রবাহিত হওয়া শুরু করলো তারা। আমি ধীর কণ্ঠে বললাম, আপনার রূপ সমন্ধে পরিচিত হলাম। আপনার এই রূপটা সমন্ধে অজ্ঞ ছিলাম আমি।

পাশ থেকে পায়েল বলে উঠলো, উফফ শুভ্র এই মেয়েকে চলে যেতে বলো। এ যদি এক্ষুনি না যায় তবে আমি কিন্তু আর এক মুহুর্ত ও থাকছি না।

তার কথায় তার দিকে হাবার মতো তাকিয়ে থাকলাম। এই সেই কারণ যার জন্য আমায় ছেড়ে দিচ্ছেন শুভ্র। যার জন্য ভেঙে দিচ্ছেন আমার সাজানো গোছানো সংসার। এই নারীর ছলনে পড়ে আমায় ঘর ছাড়া করছেন উনি!

শুভ্র আমার কাছে এসে বললেন, ইশা তোমার কি কথা কানে ঢুকছে না? বেহায়ার মতো দাঁড়িয়ে আছো কেন? গেট আউট।
আমি তার উদ্দেশ্যে বললাম, ঠিকই বলেছেন শুভ্র। বড্ড বেহায়া আমি যে কারো কথা শুনি নি ছুটে এসেছি আপনার সাথে। বড্ড বেহায়া আমি পাগলের মতো ভালোবাসলাম আপনাকে। বড্ড বেহায়া আমি যে অন্ধের মতো বিশ্বাস করলাম আমার স্বামীকে। বাঁচতে চেয়েছিলাম তাকে ঘিরে।

শুভ্র জোরে চিৎকার দিয়ে আমাকে বললেন, যাবে তুমি? নাকি সিকিউরিটি ডাকবো?

বুকের ভিতরটা একদম ভেঙে চুড়ে যাচ্ছে। এই সেই শুভ্র যাকে ভালোবেসে ঘর ছেড়েছি। যার জন্য সব ইচ্ছে আশা ভরসা জলাঞ্জলি দিয়েছি। এই কি সেই?

আর এক মুহুর্ত ও অপেক্ষা না করে বেড়িয়ে পড়লাম সেই মায়ার বসতি ছেড়ে। বুকের ভিতরটা জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে মায়ায় পড়ে গেছি এই সংসারের কিন্তু কিছু করার নেই! যার মায়ায় আবদ্ধ হতে চাই সেই তো চায় না আমাকে। সেই তো তাড়িয়ে দিলো আমাকে। আমায় নিয়ে খেললো সে! তবে তার জন্য কেন এতো পিছুটান? কেন ছুটে যাবো তার কাছে? আমার ভালোবাসা তো সত্যি ছিলো!

আমি ইন্দ্রিয়া মুসকান ইশারা। আর যার সাথে কথা বলছিলাম সে আমার স্বামী সায়মন সাবিদ শুভ্র। স্বামী বলছি কাকে? সে তো আমার প্রাক্তন স্বামী। আমাকে তো ডিবোর্সই দিয়ে দিলেন। ছিনিয়ে নিলেন সেই অধিকার। ধুর ধুর করে তাড়িয়ে দিলেন। দীর্ঘ দুই বছর সময় চুটিয়ে প্রেম শেষে গত বছর এই দিনেই আমাদের বিয়ে হয়েছিলো। বাড়ি থেকে পালিয়ে বিয়ে করেছি তাকে। বাবা মায়ের অসম্মতিতে বিয়ে করেছি তাকে। বাবা মা কারো কথা ভাবি নি সেই মূহূর্তে। তার কথায় পড়াশোনাটাও ছেড়ে দিয়েছি। অন্ধের মতো মেনে চলেছি তার প্রতিটি আদেশ। পাগল ছিলাম তার জন্য। আর আজ! আজ আমায় ছেড়ে অন্য কাউকে নিয়ে মেতে উঠলেন তিনি? আমার ভালোবাসার মূল্য রইলো না তার কাছে?

এলোমেলো পায়ে রাস্তার পাশ দিয়ে হেঁটে চলেছি। মাথায় একটা জিনিসই ঘুরপাক হচ্ছে। কি হলো এটা? আমার সাথেই কেন এমন হওয়ার ছিলো। এখন কোথায় যাবো আমি? মা বাবাকেও তো পর করে দিয়েছি এই মানুষটার জন্য।

চিরপরিচিত পল্লি ছাড়া তো কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই তাই সেখানেই চলে গেলাম। চলে গেলাম মা বাবার কাছে। আমায় দেখে বাবা রাগে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেন। বললেন আমাকে তিনি তার চোখের সামনে দেখতে চান না। আর বলবেনই না কেন? তার মান সম্মান সব ধূলোয় মিশিয়ে বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছি। আজ কোন মুখে তার সামনে আসি? গ্রামে তার কোন সম্মান রইলো না। গায়ের চেয়ারম্যানের মেয়ের এই কাজ নিশ্চয় কেউ ভালো চোখে দেখবে না। এখন যদি শোনে আমার ডিবোর্স হয়েছে তাহলে তো বিদ্রুপের অভাব থাকবে না! মাও রেগে আছেন আমার প্রতি। মা তো মাই যত রেগেই থাকুক সন্তানের প্রতি তার মায়ার বাঁধন বেশ শক্ত। ঘরের ভিতর আসতেই মা বললেন, কোথা থেকে এলি? এতো দিন পর মনে হলো তোর মা বাবা আছে? আমি কোন কথা না বলে মাকে জরিয়ে ঠুকরে কেঁদে ফেললাম। মা বললেন, আরে আরে কাঁদছিস কেন? আমার সোনা মেয়েটা। সেও কেঁদে ফেললো। মা বললেন, জামাই বাবাজি কোথায়? আসে নি? তার কথায় আমার কান্নার গতি আরো তীব্র হলো। মা বললেন, কি হয়েছে বল তো ইশা। আমি বললাম, আমায় ছেড়ে দিয়েছে সে। মা ধপ করে বসে পড়লেন‌। আমি অনবরত কেঁদেই চলেছি।
মাও আমার সাথে কেঁদে দিলেন। বললেন, আমাদের কথা তো তখন শুলনি না। এখন দেখ তো? আমি কান্নার কথা বলতে পারছি না। মা আমায় শান্ত হতে বললেন।
আমি বললাম, আমাকে ধোঁকা দিয়েছে মা। ও আমার সাথে প্রতারণা করেছে। মা চুপ করে রইলেন।

আমার ফিরে আসা আর ডিবোর্সের কথা চারপাশে বেশ দ্রুত ছড়িয়ে পড়লো। বাঙালির তো স্বভাবেরই এরকম। এ পাড়া ও পাড়া থেকে মানুষজনের ভীড় লেগে গেছে। সবাই আমাকে দেখতে আসছে আর কটু সব কথাই বলছে। একে পালিয়ে গেছি আবার ডিবোর্স নিয়ে সেই বাপের বাড়িই এসেছি। নিরবে সব সয়ে যাচ্ছি। কিছু বলছি না। বলারই বা কি আছে লোকজন তো ঠিকই বলছে।

শুভ্র কেনো এমন করলো? কেন প্রতরণার জালে আমায় ফাঁসালো? মনে মনে এবার এক কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম। আমি আবার সামনে এগোবো। আমি আবার পথ চলবো। দেখিয়ে দিবো আমিও কম নই! তাকে ছাড়াও চলতে পারি আমি।

______________________

সময় কারো জন্য অপেক্ষা করে না। দেখতে দেখতে কেটে গেলো একটি মাসে। পাথর হতে চেয়েছিলাম কিন্তু পাগলের মতো হয়ে গেছি। বার বার তার স্মৃতিগুলোই আমায় ঠুকরে খাচ্ছে। কোন দোষের কারণে আমাকে ছেড়ে দিলেন তিনি? কি কারণে আমায় নিয়ে খেললেন? এই তার ভালোবাসা? নিজেকে ঘর বন্দি করে নিয়েছি আমি। কারো সাথে সহজে কথা বলি না। ইচ্ছে হয় না বলতে। তার কথাই মনে পড়ে, আমার সংসার! একদম চুপচাপ হয়ে গেছি। বাবা আমার সাথে একটি বারের জন্যও কথা বলেন নি। এতে কষ্টটা বেরে গেছে। একদম ভেঙে পড়েছি। আমার সব আশা ভরসা টুকরো করে দিয়েছে ওই লোকটা!

আজকে সকাল থেকেই ঘর বদ্ধ আমি। মা এসে অনেক বার ডাক দিয়েছেন কিন্তু কোন কথাই বলি নি আমি। একটু পর পর এসেই তিনি আমায় ডেকে যাচ্ছেন। মা তো আমার! আমার সাড়াশব্দ না পেয়ে তিনি নিরাশ হয়ে চলে গেছেন।

দুপুর গড়িয়ে গেছে! সকাল থেকে কান্না করছি। এ পর্যন্ত মুখে কিছু দেই নি। বেশ ক্লান্ত লাগছে এখন। ঘরের এক কোণে বসেই ঘুমিয়ে পড়লাম।

কিছুক্ষণ ঘর কারো দরজা ধাক্কানোর শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেলো। খুব জোরে জোরে দরজা ঠকঠক করছে। জানি মায়েরই কাজ এটা। বললাম, দরজা ধাক্কাধাক্কি করো না মা? আমার ভালো লাগছে না!

কিন্তু ওপাশ থেকে পুরুষালি কণ্ঠস্বর শুনতে পেয়ে থমকে গেলাম। সে কাঠ কণ্ঠে বললো, ইশু! লিসেন দরজা খোলো নাহলে কিন্তু খুব খারাপ হবে!

আমি অবাক! আমাকে ধমকে কথা বলছে! কে সে? তার রাগান্বিত কণ্ঠস্বর আমার মাঝে ভয় নামক জিনিসটাকে তীব্র করে দিচ্ছে। খুব জোরে রাগান্বিত কণ্ঠে সে বারবার দরজা খুলতে বলছে। আস্তে আস্তে যেয়ে দরজাটা খুলে দিলাম। সে ঝড়ের গতিতে ভিতরে প্রবেশ করলো। ভিতরে এসেই বললো, তোমার সাহস তো কম না নিজেকে ঘর বদ্ধ করেছো কেন?

তাকে দেখে চমকে গেলাম। একে তো আগে কখনো দেখি নি। কে হতে পারে এই যুবক? আমাকে ধমকেই বা কথা কেন বলছে সে? দরজার সামনে উঁকি দিতেই খেয়াল হলো মা আর সিহা আপু দাড়িয়ে আছে। তারাও ভিতরে আসলো। আপু আমাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দিলো। আমার কপালে চুমু খেয়ে বললো, কি হয়েছে আমার বোনটার? এমন করছিস কেন? পাগল হয়ে গেছিস?

আমি কিছু বলতে পারলাম না এর আগেই সামনে দাঁড়ানো যুবকটি বলে উঠলো, ভূতে ধরেছে স্টুপিডটাকে। এর ঘাড় থেকে ভূত নামাতে হবে।

আমি বেশ আশ্চর্য হচ্ছি! কে উনি আর আমার সাথে এভাবেই বা কথা বলছেন কেন? আমার উপর জোর খাটিয়ে কথা বলছে সে। আমার উপর অধিকার দেখাচ্ছে মনে হচ্ছে আমি তার বহু বছরের চেনা পরিচিত।

যুবকটি বললো, এই মেয়ে নিজের ক্ষতি নিজে করো কেন? স্টুপিড গার্ল!

আপু বলে উঠলো, অরিদ্র রেগে যেয়ো না ও একটু এমনই।

সে আরো তীব্র কণ্ঠে বললো, রেগে যাবো না মানে? এভাবে নিজেকে কেন ঘর বন্দি করবে সে?

চলবে,,,,,

#অপূর্ণতায়_পূর্ণতা
#তানজিলা_তিহা (লেখনীতে)
#সূচনা_পর্ব

(আসসালামু আলাইকুম। নতুন গল্প নিয়ে আসলাম। আমার কাঁচা হাতের লেখা! ভালো লিখতে পারি না। অনুগ্রহ করে ভুলত্রুটি গুলো ক্ষমা করবেন। কেমন হয়েছে জানাবেন। আপনাদের ভালো লাগলে সামনে এগোবো। রেসপন্স অনুযায়ী দ্বিতীয় পর্ব দেওয়া হবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here