অপূর্ণতায় পূর্ণতা পর্ব-২

0
3449

#অপূর্ণতায়_পূর্ণতা
#তানজিলা_তিহা (লেখনীতে)
#পর্ব_০২

তার প্রতিটি কথাই আমাকে অবাক করে দিচ্ছে। লোকটা আমার সাথে এভাবে কথা বলছে কেন? তার কথাবার্তায় মনে হচ্ছে সে আমার কত কালের পরিচিত। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি। সে আমাকে শাসিয়ে বললো,
সমস্যা কি তোমার? নিজের অবস্থা এমন করেছো কেন?

আমি কোন উত্তর করলাম না। মা বললেন, সেই আসার পর থেকেই ও এমন। একেবারেই কারো সাথে কথা বলে না মিশে না। মেয়েটা আমার একদম চুপচাপ হয়ে গেছে।

যুবকটি আমার সন্নিকটে এসে বললো, এভাবে নিজেকে কষ্ট দেওয়া কিন্তু কোনভাবেই এর সমাধান না মিস. ইশারা। আপনার জীবনের অনেকটা রাস্তা এখনো সামনে বাকি। শক্ত হন। আপনাকে আরো দূরে এগোতে হবে।

তার কথায় চুপ করে রইলাম। কিছু বলার শক্তি পাচ্ছি না। বলবোই বা কি? নিজেকে বদলানোর তো বহু প্রচেষ্টা করেছি কিন্তু! কিন্তু পারি নি। বার বার সেই কথাগুলোই আমাকে কষ্টের সাগরে ফেলে দিচ্ছে। দুলাভাই আমাকে বললেন, আমি তো জানতাম আমাদের ইশারা অনেক শক্ত একটা মেয়ে। ইশারা তো কোনদিনই নিজেকে দুর্বল ভাবে নি। তবে আজ কেন ইশারা দুর্বল হয়ে পড়লো? সে কি সামনে এগোনোর চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেললো?

সবার কথাগুলো আমার অদ্ভুত লাগছে‌। কোনভাবেই কথাগুলো হজম হচ্ছে না। নিতে পারছি না আমি‌। আমি শক্ত কি করে হবো? সে তো আমাকে লন্ডবন্ড করে দিলো!

মা দুলাভাইকে বললেন, বাবা খেতে এসো অনেক বেলা হলো। ভাইয়া বললেন, আজ ইশারার সাথে খাবো। ও না খেলে আজ আর খাবো না। অরিদ্র চল খাবারের টেবিলে। ইশারা নিশ্চিত আসবে। তারা চলে গেলেন। আমি চুপ করেই থাকলাম।

বড় আপা আমায় কোলে নিয়ে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। আপু বললো, তোর কি হয়েছে রে? এমন করছিস কেন?

আমি চুপ রইলাম। আপু পুনরায় জিজ্ঞেস করলেন, কথা বলিস না কেন? কি হয়েছে? এভাবে আর ক’দিন থাকবি?

আমি চোখের নোনাজল মুছে নিয়ে বললাম, যতদিন থাকা যায়!

আপু বললো, পাগলের মতো কথা বলছিস কেন? তুই না আমার লক্ষী বোন। ওই ঘটনা আর ক’দিন মনে রাখবি? যে তোকে বুঝলো না তার জন্য জীবন শেষ করে দিবি?

আমি তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললাম, আমার আবার জীবন? সেটা তো কবেই শেষ হয়ে গেছে। বাকি যেটা আছে সেটা আমার জন্য মৃত্যুপুরী। জানিস আপা আত্মহত্যা যদি পাপ না হতো তবে কবেই…

আমি আর বলতে পারলাম না। আপু হাত দয়ে আমার মুখ চেপে ধরলো। আমাকে বুকের মাঝে জড়িয়ে বললো, এসব কি বলছিস ইশা? পাগল হয়ে গেলি? এসব মুখে আনবি না খবরদার।

আমি বললাম, যা সত্যি তাই বললাম। আমি শেষ হয়ে গেছি রে আপু। ও আমাকে শেষ করে দিলো। আমি…আমি….

শান্ত হ ইশা। কিছু হবে না দেখিস। সব আগের মতো হয়ে যাবে। আপার কথায় এবার ঠুকরে কেঁদে ফেললাম।
আপু আমাকে শান্তনা দিতে থাকলেন।

ইশা চল খেতে চল। তোর দুলাভাই কি বলেছে শুনেছিস?

আমি চুপ থাকলাম।

আপু আবার বললো, দেখ তুই এমন করে থাকলে কিন্তু আমি চলে যাবো। তোর দুলাভাইকে তো চিনিসই।

আমি কিছু বললাম না। চুপচাপ উঠে ফ্রেশ হয়ে খাবার টেবিলে চলে গেলাম।

বিকেল হয়ে গেছে। রোজগার মতোই ঘরে বসে আছি। কিছুই ভালো লাগছে না। খাবার টেবিলে সবার সাথে বসে নামে মুখে কয়েক লোকমা গিলে চলে এসেছি‌। জানালার পাশে বসে আছি। অতীতের স্মৃতিতে মগ্ন হয়ে যাচ্ছি বার বার। শুভ্রের সাথে কাটানো প্রতিটি মূহুর্তই মনে হচ্ছে আমার! সাথে সাথেই এক তীব্র যন্ত্রনার সম্মুখীন হচ্ছি।

ইশারা ঘুরতে যাবেন?

কারো শব্দ পেয়ে পিছন ফিরে তাকালাম। সেই যুবক দাঁড়িয়ে আছে। মুখে তার এক চিলতে হাসি। আমি কিছু বললাম না পুনরায় জানালার বাহিরের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। সে আমার পাশে চেয়ার টেনে বসে পড়লো। বললো,

কি হলো ইশারা? কথা বলছেন না যে?

তার কথাগুলো বেশ অসহ্য মনে হচ্ছে। আমি তার সাথে কথা বলতে চাচ্ছি না লোকটা কি বুঝতে পারছে না? তার প্রতি খুব বিরক্ত হচ্ছি। কিন্তু চুপ করে আছি।

কথা বলছেন না? আপনাদের বাড়িতে বেড়াতে আসা অতিথিদের এভাবে অ্যাপায়ন করা হয় বুঝি?

তার কথায় বিস্মিত হলাম। অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলাম। সে জোরে শব্দ করে হেসে ফেললো। বললো,

“এভাবে তাকাবেন না ইশারা। আপনার এই ডেভিল চাহনি সত্যিই আমায় মেরে ফেলবে।”

তার কথায় আশ্চর্য হলাম। আর সহ্য হচ্ছে না তাকে। আমি বললাম, আপনার সমস্যা কি? আমাকে একটু একা থাকতে দিন প্লিজ। আমার ভালো লাগছে না।

সে বললো, আমারও ভালো লাগছে না। চলুন একটু ঘুরে আসি। আপনাদের গ্রামে তো আমি নতুন। চলুন না আপনাদের গ্রামটা ঘুরে দেখান।

আমি বললাম, আপুর সাথে যান। আমার বাহিরে যাওয়ার ইচ্ছে নেই।

সে আর কথা বাড়ালো না চলে গেলো। আমি আমার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। সেই স্মৃতিগুলো মনে হতেই কেঁদে ফেললাম। কিন্তু দরজার আড়াল থেকে এক জোড়া চোখ আমার উপরেই বিদ্যমান তা জানা ছিলো না। অপরপ্রান্তের ব্যক্তিটি দীর্ঘশ্বাস ফেললো বললো, “আ’ম সরি ইশুবতী। আমার জন্য তোমাকে এতোটা কষ্ট পেতে হচ্ছে। প্লিজ ক্ষমা করে দিও আমাকে। তোমাকে একা ছাড়াটা আমার একদমই উচিত হয় নি। আ’ম সরি।”

সন্ধ্যাতিথিতে ধরত্রী আরেক রঙে সেজে উঠেছে। সারাপাশে জ্বলজ্বল করছে সাজের বাতি। কি করে যে এতো বেলা চলে গেলো বুঝতেই পারলাম না। ফ্রেশ হয়ে ঘর থেকে বের হলাম। ড্রইং রুমে বাবা, দুলাভাই আর সেই অপরিচিত ব্যক্তি বসে আছে। বাবা সম্ভবত খবর দেখছিলেন। আমাকে দেখার সাথে সাথেই তিনি প্রস্থান করলেন। বুকের ভেতরটা ফেটে যাচ্ছে আমার। বাবা কি আমার সাথে একটুও কথা বলতে পারে না? আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। চোখের নোনাজল গুলোকে আটকে মায়ের কাছে গেলাম। মা আর আপু রান্নাঘরে টুকিটাকি কাজ করছেন আর কথা বলছেন। আমি গিয়ে তাদের পাশে দাঁড়ালাম। আপু বললেন, কিছু লাগবে ইশা? আমি মাথা নাড়িয়ে বললাম না। আপু হাসলো। আমিও সৌজন্য মূলক হাসি দিলাম। আপু বললেন, আজকে ইশার মন ভালো নাকি? আমি কিছু বললাম না। আপু বিভিন্ন কথা বলতে থাকলেন। আমি পাশে বসে চুপচাপ শুনতে লাগলাম।

কিছুক্ষণ পর রুমে চলে গেলাম। বেলকনিতে গিয়ে বাহিরে চোখ বুলালাম।

কি করছেন ইশারা?

আবার সেই লোক! একদম অসহ্য একটা লোক। আমি বিরক্তি নিয়ে বললাম, এই আপনি কে? আমার পিছনে লেগে আছেন কেন বলুন তো? কি ক্ষতি করেছি আপনার?

সে হাসলো! আমি নিস্তব্ধ। তাকে দেখলে বারবারই মনে হয় সে আমার শত কালের পরিচিত। তার কথাবার্তা গুলোও তেমনই। সে আমাকে বললো,

এতো প্রশ্ন? আচ্ছা উত্তর দিচ্ছি। প্রথমত আমি হচ্ছি আদ্রিন আনাফ অরিদ্র।দ্বিতীয়ত আমি আপনার পিছনে লেগে নেই আমি একজন সাইকাইট্রিস। তৃতীয়ত আপনি আমার কোন ক্ষতি করেন নি।

আমি বললাম, তাহলে আমার কাছে কি কাজ আপনার?

সে ঠোঁটে হাসির রেখা বজায় রেখেই বললো, আমার কোন কাজ নেই আবার আছেও।

বড্ড অদ্ভুত লোক তো উনি! এভাবে কেউ কথা বলে?

তিনি আমাকে বললেন, ইশারা নিজেকে সামলান। সামনে যদি আরো কাঠখড় পোড়াতে হয় তখন?

তার কথা আমার বোধগম্য হলো না। আমি অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকলাম। সে মুচকি হাসলো আর কিছু না বলেই চলে গেলো।
________________________

এই দুটো দিন বেশ ভালোই গেলো। আপু আসার পর থেকে অনেকটাই ভালো লাগছে। মন মেজাজ ধীরে ধীরে ফুরফুরে হয়ে যাচ্ছে। ভরসার একজন মানুষ হচ্ছে আপু। আজ সকাল থেকেই মন খারাপ। আপু আজ চলে যাবে। দুলাভাইকে অনেক বলেছি কিন্তু না সে আর থাকবে না। সে আজই চলে যাবে।আমি চুপ করে দাঁড়িয়ে তাদের যাওয়ার পানে চেয়ে আছি। আপু হয়তো আমার অবস্থা টের পেলো।

আপু আমাকে বললো, “আমাদের সাথে যাবি ইশা? চল না কয়েকটা দিন থেকে আসবি।”

আমি কি বলবো ভেবে পাচ্ছি না। দুলাভাই বললেন, ঠিক বলেছো তো। কয়েকদিন গিয়ে আমাদের সাথে ঘুরে আসলে ওর ভালো লাগবে।

আপু বললো, একদম ঠিক বলেছো। দু বোন একসাথে থাকলে আমার ইশামণির একদম মন খারাপ হবে না। আমার ইশা মণি আগের মতো হয়ে যাবে।
মাও একই কথা বললেন। আমি আর কিছু বললাম না। চুপ করে তাদের কথা শুনতে থাকলাম।

হঠাৎ আমার কানের কাছে কেউ বিড়বিড় করে বললো, আপনি সাথে চললে কিন্তু মন্দ হতো না ইশারা!

চলবে………

(অনুগ্রহ করে ভুলত্রুটি গুলো ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here