অপূর্ণতায় পূর্ণতা পর্ব-৩

0
2502

#অপূর্ণতায়_পূর্ণতা
#তানজিলা_তিহা (লেখনীতে)
#পর্ব_০৩

আপন গতিতে চলছে চার পায়ার জীপটা। কিছুক্ষণ পর পর রাস্তার উঁচু নিচু খাদে পরে হালকা ঝাঁকুনির সৃষ্টি করছে। আমি আর আপু পাশাপাশি সিটে বসে আছি। সামনের সিটে দুলাভাই আর ড্রাইভিং সিটে সেই অপরিচিত। জানালা দিয়ে বাহিরে মুখ গুঁজে আছি আমি। আম্মু আর আপুর জোরাজুরিতে আপুর বাসায় যাওয়ার জন্য রাজি হয়েছি। আবার সেই শহরে যাচ্ছি যেটা আমার কাছ থেকে আমার সব কেড়ে নিয়েছিল। আবার সেই গন্তব্যে পাড়ি জমাচ্ছি! আবার সেই মায়ালোকের সম্মুখীন হতে হবে আমাকে? আবারও কি সেই জঘন্য ব্যক্তির সম্মুখীন হবো? হয়তো না হয়তো বা হ্যাঁ! গাড়ির তীব্র হর্নে আমার ধ্যান ভেঙে গেলো। সেই অপরিচিত আমায় বললো,

এই যে মিস. ইশারা বাহিরে মুখ বের করেছেন কেন? এতো বড় বুড়ি হয়ে এভাবে বাচ্চামোর মানে হয়?

তার কথায় তাজ্জব বনে গেলাম। মাত্র কি বললো সে? আমি বুড়ি হয়ে গেছি? মুখ ফুলিয়ে বসে থাকলাম। লুকিং গ্লাসে দেখতে পেলাম সে হাসছে। ইচ্ছে হচ্ছে তার দাঁত গুলো ভেঙে ফেলি। হঠাৎ তার দৃষ্টি প্রতীয়মান হতেই চোখ সরিয়ে নিলাম।

গাড়ির গতি বৃদ্ধিতে সো সো করে হাজারো মাইল রাস্তা পেড়িয়ে যাচ্ছি। রাস্তার পাশের ছোট বড় গাছপালা গুলো এক পলকে হারিয়ে যাচ্ছে। অস্পষ্ট প্রকৃতি পেড়িয়ে যাচ্ছি বার বার। বেশ ভালো লাগছে সময়টা গোধূলি বিকেল বলে কথা। এখনো পৌঁছাতে পারি নি গন্তব্যে। আঁকাবাঁকা পথ ধরে চলছে চার পায়ার জীপ। গোধূলি আলোড়নে চারপাশটা বেশ সুন্দর লাগছে। আকাশে উড়ে বেড়াচ্ছে এক ঝাঁক পাখি। পাখিগুলোকে চিনতে পারছি না। কিন্তু তাদের একসাথে উড়ার দৃশ্যটা বেশ ভালো লাগছে। আমিও যদি একসাথে চলতে পারতাম! জীবনটা যদি তার কাটিয়ে দিতে পারতাম! মনে হতেই কান্না দলাপাকা দিলো। কিন্তু পরোক্ষণেই নিজেকে শান্ত করে নিলাম। পরোক্ষণেই মনের মধ্যে ঘৃণার সঞ্চার হলো। সে তো আমায় ধোঁকা দিয়েছে আমাকে তছনছ করে দিয়েছে। তবে কেন আমি তাকে নিয়ে বার বার ভাবছি? কেন তার দূরত্ব আমাকে কাঁদায়? হয়তো ভালোবাসি বলে!

আমার ভাবনার মাঝেই জীপটা তার চাকা থামিয়ে দিলো। হঠাৎ এহেন পরিস্থিতিতে আমি হকচকিয়ে গেলাম। কিন্তু পরোক্ষণেই নিজেকে ধাতস্থ করে নিলাম। আপু বললো,

ইশা আমরা চলে এসেছি এবার নাম।

আমি মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বললাম। কিন্তু পাশ থেকে আওয়াজ পেলাম। সে বললো,

না তাকে গাড়িতে বসেই ভাবনার সাগরে হাবুডুবু খেতে দাও। তার চিন্তা ভাবনা শেষ হোক এরপর না হয় বাড়িতে যাবে। কি বলেন ইশারা? আমি ঠিক বলি নি?

তার কথায় গা জ্বলে যাচ্ছে। মুখ ফুলিয়ে গাড়ি থেকে নামলাম। আপু হাসছে। এই মুহূর্তে আপুর হাসিতে আরো ফুঁসে উঠলাম। আপু বললো,

হয়েছে অরিদ্র আমার বোনটাকে আর রাগিয়ো না তো। ও যদি একবার রেগে যায় তাহলে কিন্তু ভয়ংকর কান্ড বাঁধিয়ে ফেলবে।

সে হাসলো কোন উত্তর দিলো না। আমার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় কানে ফিসফিসিয়ে বললো, রাগ করলে কিন্তু আপনাকে একদম পাকা টমেটো মনে হয় ইশারা।

আমি অবাক হয়ে গেলাম। চুপ করে সেখানেই দাঁড়িয়ে পড়লাম। একটা জিনিস খুব ভালো ভাবেই বুঝতে পেরেছি লোকটা আমাকে জ্বালিয়ে খাবে।

আপু বললো, চল ভিতরে চল।

আপুর শ্বশুর বাড়িতে আগে কখনো আসা হয় নি। আজই প্রথম এসেছি। আসবোই বা কি করে? সেসময়ই তো সেই মায়ালোকে আবদ্ধ হয়েছিলাম। তাকে ছাড়া কিছুই বুঝতাম না। তার সাথে কথা বলতে পারবো না ভেবে বাড়ি থেকে কোথাও যেতাম না। নিজেকে তার মাঝে বিলিয়ে দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু!!

প্রকান্ড দরজা পেড়িয়ে বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করলাম। মধ্য বয়সী এক মহিলা আমাদের দিকে এগিয়ে এলেন। আপু বললো,

মা এই হচ্ছে আমার বোন ইশারা।

বুঝতে পারলাম এটা আপুর শাশুড়ি। আমি তাকে সালাম দিলাম। ভদ্রমহিলা বেশ হাস্যরসিক। আমার সাথে খুব সুন্দর করেই কথা বললো। একটা দুটো কথা বলছে আমি তার হ্যা না উত্তর দিচ্ছি। বাড়ির লোকজন গুলো সকলেই এমন। সবার মধ্যেই কুশল বিনিময়ে আন্তরিকতার ছোঁয়া বিরাজমান। বেশ ভালো লাগছে তাদের এই আচরণে!

সন্ধ্যা নেমে এসেছে ধরত্রীর বুকে। চারদিকে ফুটে উঠেছে আবছায়ার আলো। মিটিমিটি আলোতে ছেয়ে গেছে শহরের বুকটা। বেলকনিতে দাঁড়িয়ে অন্ধকার শহরটাকে পর্যবেক্ষণ করে যাচ্ছি আমি। আকাশের বুকে অন্ধকারের ছোঁয়ায় চারপাশটাও অন্ধকার। ঠিক তেমনই তো তার ছোঁয়ায় আমার জীবনটায় অন্ধকার নেমে এসেছে। চোখের বারিধারাকে আর বাঁধা দিতে পারলাম না। লুকিয়ে রাখা কষ্ট গুলোকে নিয়ে ঝরে পড়ছে তারা। এই শহরটা বিষাক্ত লাগছে। মনে হচ্ছে এক্ষুনি এই শহর থেকে ছুটে পালাই। কিন্তু কি করে?

“কি করছেন ইশারা?” কথাটা শুনে বুঝতে আর বাকি রইলো না কে হতে পারে। হালকা হাতে চোখের পানি মুছে সামনের দিকে তাকালাম। দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন সেই অপরিচিত। সে বললো,

কি করছিলেন ইশারা?

আমি বললাম, কিছু না। দাঁড়িয়ে আছি।

সে বললো, তাহলে আপনার চোখ মুখ লাল কেন? সত্যিটা বলবেন নাকি আমি?

এই লোককে আমার একদমই সহ্য হয় না। যেহেতু বুঝতেই পেরেছে আমি কি করছিলাম তাহলে জিজ্ঞেস করার কি প্রয়োজন? একেবারেই বিরক্তিকর লোক একটা। আমি বললাম,

কান্না করেছিলাম এবার হয়েছে?

সে বললো, হ্যাঁ হয়েছে। কিন্তু কান্না করেছিলেন কেন?

আমি বললাম, কান্না আসলে আমার কি কিছু করার আছে? কান্না এসেছিলো তাই কেঁদেছি।

সে বললো, ওহ্ তাই? আচ্ছা বলুন তো কান্না জিনিসটা আসলে কি?

প্রচণ্ড বিরক্তি নিয়ে বললাম, আপনি তো বড্ড যন্ত্রনাদায়ক। আমি কি কান্না নিয়ে গবেষণা করেছি নাকি?

সে বললো, অবশ্যই করেছেন না করলেও করেছেন আপনি। বিগত দিনগুলোতে তো কম কাঁদেন নি। তাহলে তা নিয়ে আপনার অনেক অভিজ্ঞতা আছে। এবার বলে ফেলুন তো কান্না জিনিসটা আসলে কি?

আমি কাকুতি সুরে বললাম, প্লিজ আমাকে একটু একা থাকতে দিন ভালো লাগছে না আমার। আমি একা থাকতে চাই একটু!

সে বললো, একা তো অনেক থেকেছেন এবার সবার সাথে থাকুন। সবার সাথে হাসুন খেলুন আপনি আবার আগের ইশারায় ফিরে চলুন। সেই দুরন্ত ইশুবতীতে ফিরে চলুন।

ইশুবতী নামটা শুনে ভ্রু কুঁচকে তার দিকে তাকালাম। কি বললো সে? আমি বললাম, আমি আগের মতোই আছি।

সে কিছু বললো না ধীর পায়ে প্রস্থান করলো। আমি আবার আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলাম।

_________________________

মেয়েটার উপর এখনো রেগে থাকবেন আপনি? ইমতিয়াজ আহমেদকে প্রশ্ন করলেন আশেয়া বেগম।

চোখের চশমাটা খুলে জমে থাকা অশ্রুকণা মুছে ইমতিয়াজ আহমেদ বললেন, আমি কারো উপর রেগে নেই। যার যা ভালো মনে হয়েছে সে তাই করেছে। কারো উপর তো জোর করি নি আমি। তাহলে আমার উপর কেন জোর করছো আয়েশা?

ইশা ছোট মানুষ। ভুল একটা করেই ফেলেছে। আমি জানি ও অনেক বড় ভুল করেছে কিন্তু আপনি তো বাবা। ওকে…

আয়েশা ঠিকই বলেছো আমি ওর বাবা। আমি বাবা হয়ে কি আমার সন্তানের অমঙ্গল কামনা করবো বলো? আমি ওকে কতবার বারণ করেছিলাম বলো তো? ও কি করে এটা পারলো? আমি জানতাম ভবিষ্যতে এমন কিছু একটা হবে। প্রতিশোধের নেশা মানুষকে কি বানাতে পারে তা আমার চেয়ে ভালো কেউ জানে? তুমিই বলো আয়েশা ও কি জানতো না?

সব তো জানি। কিন্তু তারপরেও মেয়েটার কি অবস্থা হয়েছে দেখেছেন?

দেখেছি দেখেছি। ওর ভুলের শাস্তি ও পাচ্ছে। তাতে কার কি?

আপনার কিছু না?

ইমতিয়াজ আহমেদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, না।

আয়েশা বেগম আর কথা বাড়ালেন না।

________________________

প্রভাতের আলো ফুটতেই ঘুম ভেঙে গেলো। ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে নিলাম। নিচে নামতেই আপুকে খেয়াল হলো। আপু নাস্তা সাজাচ্ছে। আজকে যে আমার উঠতে দেরি হয়েছে বুঝতে পারলাম। গত রাতে ঘুম হয় নি। সারাটা রাত বিষন্নতায় কাটিয়ে দিয়েছি। ফজরের নামাজের পর একটু শুয়েছি। কখন যে ঘুম আসলো টেরই পেলাম না। আমি ড্রইং রুমে আসতেই আপু বললো, বস ইশা। আমি কোন কথা না বলে বসে পড়লাম। আপু বললো, ঘুম হয়েছে? আমি মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিলাম।

দুলাভাই বললেন, কি ইশা মণি কেমন লাগছে এখানে?

আমার উত্তরের আগেই অপরপক্ষ বলে বসলো, “কেমন লাগছে সেটা পরে জিজ্ঞেস করো। গতরাতটা তো কান্না করেই কাটিয়ে দিয়েছে। আমি বলি কি তাকে আবার গ্রামেই পাঠিয়ে দাও। সেখানেই ভ্যা ভ্যা করে থাকুক তাই ভালো হবে।”

তার কথায় হা করে তাকিয়ে আছি। এমন কেন সে?

চলবে……

(অনুগ্রহ করে ভুলত্রুটি গুলো ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here