অপূর্ণতায় পূর্ণতা পর্ব-৪

0
2442

#অপূর্ণতায়_পূর্ণতা
#তানজিলা_তিহা (লেখনীতে)
#পর্ব_০৪

পড়ন্ত বিকেলে রাজধানীর পথে ঘাটে দেখা মিলে কোলাহলের সমাহার। রাস্তায় কিঞ্চিত পরিমাণও জায়গা ফাঁকা মেলে না তখন। হাজার হাজার মানুষ লাইন লাগায় রাস্তার দুপাশে। বিভিন্ন জায়গা থেকে আগত বিভিন্ন মানুষ বেড়িয়ে পড়ে রাস্তায়। এতো কোলাহলপূর্ণ বসতি হওয়ারও কিন্তু একটা কারণ রয়েছে। সেই কারণটা হচ্ছে প্রফুল্লতা। সারাদিনের কর্মব্যস্ততা শেষে বিকেলটা আনন্দপূর্ণ করতে পরিবার নিয়ে শহরের রাস্তায় বেড়িয়ে পড়ে তারা। এই সুযোগটাকে আবার লুপে নেয় ব্যবসায়ীরা। বাহারি জিনিসপত্র নিয়ে রাস্তার দুপাশে ভীড় জমায় বিক্রেতার দল। আবার তাদের অনুসরণ করে তাদের কাছে হুমড়ি খেয়ে পড়ে হাজারো ক্রেতার দল।
খানিকক্ষণ আগে শহরের রাস্তায় বেড়িয়েছি আমি। আপু দুলাভাই আপুর এক ননদ সাথে সেই অপরিচিত। শহরের চারপাশের কোলাহল পূর্ণ দৃশ্য পর্যবেক্ষণ করে চলেছি। শহরে এসব দৃশ্য অহরহ দেখা যায়।

অনেকটা পথ হেঁটে চলেছি। হাঁটতে হাঁটতে একটা পার্কে পৌঁছালাম। পাশেই একটা বেঞ্চি দেখতে পেয়ে এক মুহুর্তও না দাঁড়িয়ে বসে পড়লাম। এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে থাকাটা অসম্ভব। অনেকটা পথ যুদ্ধ করে এসেছি সেটা হচ্ছে হাঁটার যুদ্ধ। হাজারো মানুষের ভেলা থেকে যুদ্ধ করে এসেছি। আমি একটা বেঞ্চিতে বসে হাঁপাতে লাগলাম। আমার পাশে এসে অবনী (আপুর ননদ) বসে পড়লো।

আবনী বললো, বাপরে! এতো মানুষের মেলায় মানুষ আসে নাকি?

আমি হেসে ফেললাম। পাশ থেকে দুলাভাই বললেন, না না মানুষের মেলায় গরু ছাগল আসে যেমন তুই।

অবনী মুখ ফুলিয়ে বললো, আমি গরু ছাগল? এটা বলতে পারলে তুমি ভাইয়া? আমার মতো একটা মাসুম বাচ্চাকে তুমি এটা বললে?

অবনীর দিকে একবার তাকালাম তবে কিছু বললাম না। অবনীর কথা শেষ হতেই সে বললো, তুই অবনী মাসুম বাচ্চা? লাইক সিরিয়াসলি!! এইটাও শুনতে হলো জীবনে?

অবনী বললো, অরিদ্র ভাইয়া এবার কিন্তু বেশি হচ্ছে। আমি কিন্তু কেঁদে ফেলবো।

সে বললো, ফেল না তাতে আমার কি?

ব্যাস বেঁধে গেলো দুজনের ঝগড়া। ঝগড়ার দৃশ্যটা বেশ ভালোই লাগছে। ভাই বোনের দুষ্ট মিষ্টি ঝগড়া। খুব তৃষ্ণা পেয়েছে আমার। আপুর হাত থেকে পানির বোতলটা নিয়ে যেই না মুখে দিবো তখনই সে বলে উঠলো, এই যে মিস. দৌড়ে এসে পানি খেতে হয় না। ইট’স নট রাইট।

মুখের সামনে পানির বোতল নিয়েও থমকে গেলাম। দুলাভাই বললেন, হুম একদম ঠিক। পাঁচ মিনিট ওয়েট কর এরপর।

আমি বললাম, আমার খুব তৃষ্ণা পেয়েছে।

সে বললো, তো দৌড়াতে বলেছিলো কে? ধীরে সুস্থে হেঁটে আসা যেতো না বুঝি?

আমি বললাম, এতো মানুষের ভীড়ে হাঁটার জায়গা আছে নাকি? দৌড়ানো ছাড়া উপায় আছে?

সে আমার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকালো। এরপর বললো, আই থিংক… ভাইয়া! ইশারাও অবনীর মতো গরু ছা…..

সে আর বলতে পারলো না রক্তিম দৃষ্টি নিয়ে উঠে দাঁড়ালাম আমি। রাগ দেখিয়ে বললাম,

কি বললেন আপনি?

সে বললো, বলতে চেয়েছি আপনিও অবনীর মতো মাসুম বাচ্চা।

আমি বললাম, তাই না? আর কি বলেছিলেন যেন?

সে বললো, আর কিছু বলি নি তো।

আপু আর দুলাভাই হো হো করে হেসে ফেললো সাথে অবনীও। আমি মুখ ফুলিয়ে থাকলাম। আপু বললো,

অরিদ্র আমার বোনটাকে আর জ্বালিয়ো না তো। চলো সামনে চলো। ওর মন ভালো করতে ওকে ঘুরতে নিয়ে এলে দিলে তো রাগ উঠিয়ে। এখন কি করবে হু??

সে বললো, ইশারা আমার সাথে রাগ করতেই পারে না। একদমই না। তাই না ইশারা?

আমি তার দিকে রক্তিম দৃষ্টিতে তাকাতেই সে চুপসে গেলো। আর একটা কথাও বললো না। সবাই মিটিমিটি হাসছে। আমার বোধগম্য হলো না। সামনের দিকে হাঁটা শুরু করলাম।

বেশ আনন্দ মুখর পরিবেশটা। চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে হাজারো মানুষ। প্রিয়জনদের নিয়ে চলছে পথের পর পথ। আমি আপু আর অবনী একসাথে হাঁটছি। ভাইয়া আর অরিদ্র অনেকটা সামনে এগিয়ে গেছেন। আমি চুপচাপ হেঁটে যাচ্ছি। অবনী একের পর এক প্রশ্ন করছে কথা বলছে সাথে আপুও। অবনী আমাকে বললো,

ইশা আপু কথা বলছো না যে?

আমি বললাম, কি বলবো বলো?

অবনী আমাকে বললো, কথার কি শেষ আছে নাকি? আমি তো এক মিনিটও চুপ থাকতে পারি না। তুমি এতো চুপচাপ কি করে থাকো? আমার সাথে থাকলে একদম ঠিক হয়ে যাবে। আমার সাথে কিছুদিন থাকো এরপর দেখবে তুমিও আমার মতো নট স্টপ গাড়ি হয়ে যাবে।

ওর কথায় মুচকি হাসলাম। একসময় আমিও তো এমন ছিলাম। হাজারো কথার ঝুলি নিয়ে পার হতো আমার সময়। বাড়িটা মাথায় করে রাখতাম আমি। আমি ছিলাম হাসির ঝুলি। কিন্তু এখন! হঠাৎ করে কি হলো আমার? এক ঝড়ে তছনছ হয়ে ভেঙে চুরমার হলাম আমি। দীর্ঘশ্বাস ফেললাম।

অনেকটা পথ হেঁটে একটা আইসক্রিমের দোকানের সামনে দাঁড়ালাম। আইসক্রিম আমার সবসময়ই প্রিয়। আইসক্রিম দেখলে আমার চাই ই চাই। কিন্তু এই মুহূর্তে কেন জানি তেমন কোনো আগ্রহ পাচ্ছি না। আমি অনুভূতিহীন হয়ে যাচ্ছি। হাঁটছিলাম তখনই সে বললো,

ইশারা আইসক্রিম খাবেন?

আমি হকচকিয়ে গেলাম। মাথা ঝাঁকিয়ে না বললাম। সে বললো,

আপনি বলছেন তো?

আমি অবাক হলাম। আমি যেহেতু সামনে দাঁড়িয়ে তাহলে অন্য কে বলবে? লোকটা তো খুবই অদ্ভুত। আমি বললাম,

আশ্চর্য তো! আমাকে দেখলে কি আপনার ভূত মনে হয়?

সে বললো, তা মনে হবে কেন? আইস তো সবসময়ই আপনার প্রিয়। ঠাণ্ডার সময়েও তো এটা ছাড়া বাঁচতে পারেন না। তাহলে হঠাৎ কি হলো?

আমার আইসক্রিম প্রিয় সে জানলো কিভাবে? বিষয়টাকে পাত্তা না দিয়ে বললাম, ইচ্ছে করছে না।

আপু বললো, ইশা মণি তো আইসক্রিম খেতে খুব পছন্দ করে। তুমি নাও তো। দেখবে ইশা ঠিকই নিবে। চল ইশা।

আপু আমার হাতটা ধরে নিয়ে গেলেন স্টলে। স্ট্রবেরি ফ্লেয়ার অর্ডার করা হলো। আমি আর অবনী দাঁড়িয়ে আছি দোকানটার এক পাশে। আপু আর ভাইয়া একটু সামনে। আর সে ওর্ডার করছে। হঠাৎ কেউ আমাকে বললো, ম্যাডাম সাইড প্লিজ। আকস্মিক কারো কণ্ঠস্বরে চমকে উঠলাম। পিছন ফিরে ব্যক্তিটিকে দেখে আকাশ থেকে পড়লাম।‌ কেন আমার সামনে আসলো সে? আমি আর কোন শব্দ করতে পারলাম না। আমি চুপ করে তাকিয়েই থাকলাম। কোন শব্দ করার শক্তি পাচ্ছি না। ব্যক্তিটিও আমার দিকে তাকিয়ে আছে। কিছুই বলতে পারছি না। এই মুহূর্তটা আমার সাথে পৃথিবীর সবচেয়ে ঘৃণ্যতম মুহূর্ত মনে হচ্ছে। কেন তার সামনাসামনি হতে হলো?
সে আমাকে বললো, কেমন আছো ইশা? তার আওয়াজ শুনে বেশ ঘৃণা হচ্ছে। ঘৃণা আর রাগে ফেটে পড়ছি। আমি কিছু বলবো তার আগেই তার পিছুটান এসে পড়লো। আমি আর এক মুহুর্তও সেখানে দাঁড়ালাম না। এলোমেলো পায়ে সামনের দিকে হাঁটতে থাকলাম। পিছন থেকে আপু অনেক বার ডাকলো। কিন্তু আমি কি তাতে সায় দেই সামনের দিকে হেঁটেই চলেছি। বাধ্য হয়ে তারাও আমার পিছু নিলো। আপু বললো,
কি রে? এভাবে কোথায় যাচ্ছিস?

আমি বললাম, আপু আমি বাড়ি যাবো। আমার একটুও ভালো লাগছে না। প্লিজ বাড়ি চল। আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। প্লিজ চল…আমি আর এক মুহুর্ত ও এখানে থাকবো না। চল প্লিজ।

আপু আমার কথায় ব্যস্ত হয়ে পড়লো। বললো, কি হয়েছে ইশা বল প্লিজ? তোকে এতো অস্থির দেখাচ্ছে কেন?

আমি বললাম, আমি বাড়ি যাবো প্লিজ বাড়ি চল আপু।

সে বললো, কি সমস্যা তা তো আগে বলুন!

আমি বললাম, আমি বাড়ি যাবো ব্যাস। যদি নিয়ে না যান তাহলে কিন্তু দু চোখ যেখানে যায় সেখানেই চলে যাবো। এখানে আমি আর এক মুহুর্ত ও না।

কেউ আর কথা বাড়ালো না। চুপচাপ আমার কথাই মেনে নিলো।

চারপাশে ঘন আঁধার বিরাজমান। আবছায়া আলোরও কোন বিচরণ নেই। অমাবস্যা নেমে এসেছে। চারপাশটা একদম ঘুটঘুটে অন্ধকার। ছাদের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছি আমি। বাহির থেকে আসার পর কারো সাথে কথা বলি নি। মানুষের জীবন এক বিস্তৃত গণিতের অধ্যায়। হিসেব মিললে সুখময় গড়মিল হলে দুঃখের পাহাড়। আজকে এই হাস্যজ্জল মানুষের জীবনটা যতটা সুখে কাটছে কাল হয়তো নাও হতে পারে। জীবন বৈচিত্র্য থেকে বলছি! দীর্ঘ জীবন পথে পাড়ি দিতে ভালোবাসার মানুষটির হাত ধরে চলতে পারলে কত যে সুখময় হয় তা বিরল তা যদি আমার হতো তবে কত ভালো হতো। দীর্ঘশ্বাস ফেললাম।

তখন এভাবে চলে আসলেন কেন ইশারা?

কারো কণ্ঠস্বরে ফিরলাম। বুঝতে বাকি রইলো না কে হতে পারে!

চলবে…….

(অনুগ্রহ করে ভুলত্রুটি গুলো ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here