অপূর্ণতায় পূর্ণতা পর্ব-৫

0
2067

#অপূর্ণতায়_পূর্ণতা
#তানজিলা_তিহা (লেখনীতে)
#পর্ব_০৫

“তখন এভাবে চলে আসলেন কেন ইশারা?” কুর্ণকহরে কারো কণ্ঠস্বর পৌঁছাতেই পিছন ফিরে তাকালাম। ছাদের রেলিং এ হেলান দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন অরিদ্র। তার দৃষ্টি আমাতেই নিবন্ধ।

আমি বললাম, “কিছু মুহূর্ত একান্তই নিজের কাছে। সেই মুহূর্তগুলো কারো সাথে ভাগাভাগি করে নেওয়া যায় না। সেই মুহূর্তটা যে জীবনে কিরূপ প্রভাব ফেলে তা মানুষ একাই বোঝে।”

আমার কথার মাঝেই সে বলে উঠলো, “আর কেউ যদি সেই মুহূর্তগুলো ভাগাভাগি করে নিতে চায় ? কেউ যদি সেগুলোকে আপন করে নিজের সবটা অন্যকে বিলিয়ে দিতে চায়?”

আমি তার কথার আগাগোড়া বুঝলাম না। তাকে প্রশ্ন করলাম, মানে?

সে বললো, কিছু না ইশারা। আচ্ছা ইশারা একটা প্রশ্ন করবো?

আমি বললাম, করুন।

সে বললো, আপনি এতো উদাস হয়ে থাকেন কেন?

আমি বললাম, কোথায় উদাস? আমি তো হাসি খেলি সবার সাথেই কথা বলি।

সে বললো, উহু আমার চোখকে ফাঁকি দিতে পারবেন না আপনি। আচ্ছা বলুন তো শুভ্রের সাথে আপনার পরিচয় কিভাবে?

শুভ্র নামটা শুনেই সেই বিষাদ বেদনা আমায় আবার আঁকড়ে ধরলো। এখন আর তার নাম শুনলে ভালোবাসা জেগে উঠে না জেগে উঠে ঘৃণা। আমি ঘৃণা করি তাকে। প্রচণ্ড রেগে বললাম, আমি এসব নিয়ে কথা বলতে চাই না অরিদ্র। প্লিজ আপনি আমাকে এসব নিয়ে জিজ্ঞাস করবেন না। যেই জিনিসটা আমি ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করছি‌। বার বার কেন সবাই সেটা মনে করিয়ে দিচ্ছে? আমার জীবনে শুভ্র নামের কেউ নেই। না নেই। এমন কাউকে আমি চিনি না।

সে বললো, ইশারা কুল। আস্তে! আমাকে মেরে ফেলবেন নাকি? আর বলবো না ঠিক আছে?

আমি কিছু বললাম না। নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করছি। সে হাসছে। সেটা দেখে আমার রাগ যেন আরো চওড়া দিয়ে যাচ্ছে। তবুও কিছু বললাম না‌।

দুজনেই নিরব হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। কারো মুখে কোন কথা নেই। হঠাৎ সে বললো, ইশারা আগামীকাল একটা জায়গায় যাবেন? আশা করি আপনার ভালো লাগবে।

আমি বললাম, কোথায় যাবো?

সে বললো, গেলেই দেখবেন। যাবেন কিনা তা বলুন।

আমি কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললাম, আমার কোথাও যেতে ইচ্ছে করে না এখন আর। এই চার দেয়ালের মাঝেই আমার আনন্দ।

বলেই চলে আসলাম। ঠিকই তো এখন আর কোথাও যেতে ইচ্ছে হয় না। এই চার দেয়ালে ঘেরা ঘরটাতেই আমি আবদ্ধ। বাহিরে বেরিয়ে যদি আজকের মতো পরিস্থিতিতে আবার পড়তে হয় তখন? তখন কি করে নিজেকে সামলাবো আমি? দীর্ঘশ্বাস ফেললাম।

____________________________

সময় আপন গতিতেই চলে। আরো জন্য সে অপেক্ষা করে না। আর এ সময় চলে গেলে আর ফিরে আসে না। জীবনের বিস্তৃত অধ্যায় থেকে চলে গেছে আরো তিনটি দিন। এই দিনগুলো বেশ ভালোই কাটলো। সারাদিন আপু আর অবনীর সাথে কথা বলতে বলতে পার হচ্ছে সময়। বেশ ভাব জমে উঠেছে অবনীর সাথে। সেও আমি বলতে পাগল। বেশ ভালোই লাগছে এখানে। আজ শুক্রবার, সবারই ছুটির দিন। সবাই মিলে বাহিরে বেড়াতে যাওয়ার প্ল্যান করছে। গতকাল রাতেই সবাই মিলে ঠিক করেছে আজ বেড়াতে যাবে। আমি প্রথমে নাকচ করেছিলাম। কিন্তু অভ্র (দুলাভাই) ভাইয়ার জোরাজুরিতে রাজি হয়েছি। তবে বেশি দূরে যাবো না আগেই বলে দিয়েছি। তাই ঠিক করা হলো আমরা চিড়িয়াখানায় যাবো। বেশি দূরেও না আবার কাছেও না।আমিও হ্যাঁ বলে দিয়েছি। দূর পাল্লার যাত্রা একেবারেই পছন্দ না আমার।

সেই কখন থেকে অবনী জামাকাপড় নেড়ে যাচ্ছে। একটা দেখছে আবার রেখে দিচ্ছে আবার আরেকটা নিচ্ছে। মেয়েটা বেশ শান্ত এবং‌ বাঁচাল স্বভাবের। খুব মিষ্টি একটা মেয়ে। অবনী কোন জামাটা পড়বে তাই ঠিক করতে পারছে না। আমি হালকা হাসলাম। আমি সাদা কালোর মিশ্রনের একটা থ্রি পিছ পড়ে নিলাম। একদম হালকা পাতলা। অবনীর কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। ও আমাকে দেখে ঠোঁট উল্টে দাঁড়িয়ে রইলো। আমি জোরে হেসে ফেললাম। খাটের উপর ছড়ানো জামাকাপড় গুলো থেকে খয়েরী রঙের একটা থ্রি পিছ ওর হাতে ধরিয়ে দিলাম।

এরপর বললাম, এটাতে কিন্তু আমাদের অবনীকে পরি পরি লাগবে। তুমি এটাই পড়ে নাও।

অবনী আমার হাত থেকে জামাটা নিয়ে ওয়াসরুমে চলে গেলো। আমি খাটের উপর ছড়ানো জামাকাপড় গুলোকে ঠিক করতে লাগলাম। কিন্তু হঠাৎই কারো অস্তিত্ব টের পেয়ে পিছন ফিরে তাকালাম। দরজায় দাঁড়িয়ে আছেন অরিদ্র। আমার দিকে হা করে তাকিয়ে আছেন তিনি। আমি ভ্রু কুঁচকে তাকালে সে নিজেকে সংযত করে নিলো।

আমাকে বললো, আপনাদের হয়েছে?

আমি বললাম, আমার শেষ। অবনী রেডি হচ্ছে।

সে বললো, হুম।

আমি আর কিছু বললাম না। সে চলে যেতে গিয়েও থমকে গেলো বললো, আজ আপনাকে খুব সুন্দর লাগছে ইশারা।

সে চলে গেলো। আমি হেসে ফেললাম। কেন যে হেসে ফেললাম তা আমার অজানা!

কিছুক্ষণ হলো বেরিয়ে পড়েছি আমরা। গাড়ি তার গন্তব্যে পাড়ি জমাচ্ছে। গাড়ির ভিতর আমরা পাঁচ সদস্য। জানালা দিয়ে বাহিরের দৃশ্য উপভোগে মগ্ন আমি। বের ভালোই লাগছে। সকালের স্নিগ্ধতায় মুখরিত চারপাশ। সকালের মিষ্টি কিরণ ছড়িয়েছে তার পাশটায়। বড় বড় দালানের উপর এই কিরণ ছড়িয়েছে অন্যরকম সৌন্দর্য।

অবনী আমাকে বললো, ইশা আপু ভাবি বলেছে তুমি অনেক ভালো গাইতে পারো। একটা গান গাও না প্লিজ।

আমি বললাম, আমি তো পারি না।এখন না।

আপু বললো, গা না। অনেক দিন তোর গান শুনি না। একটা গান গাইতে আর কি?

অবনী বললো, প্লিজ আর না করো না গেয়ে ফেলো প্লিজ প্লিজ প্লিজ।

আমি বললাম, এখন না। এখন ইচ্ছে হচ্ছে না।

অবনী বললো, তুমি আমার কথা রাখবে না? আচ্ছা তোমাকে গাইতে হবে না।

অবনী মুখ ফুলিয়ে ওপাশ ফিরে বসলো। সবাই বেশ জোরাজুরি করছে। অভ্র ভাইয়াও বললো। অবনীর বিষন্ন মুখটা দেখে কেমন জানি লাগছে। তাই আর না করতে পারলাম না। গলা ছেড়ে গাইতে শুরু করলাম।

দু লাইন গেয়েই থমকে গেলাম। সবাই আমার দিকে হা করে তাকিয়ে আছে। বিশেষ করে সে। তার দৃষ্টি একদমই কেমন জেনো লাগছে। অভ্র ভাইয়া বললেন, ইশা তো বেশ ভালোই গাও।

অবনী বললো, আরো গাও আরো গাও প্লিজ।

আমি বললাম, আমি আর পারবো না অবনী। প্লিজ আর জোর করো না।

ও আর কিছু বললো না। আমি আড়চোখে তাকাতেই দেখলাম সে হাসছে। কিছু বললাম না।

দীর্ঘ পথের সমাপ্তি ঘটিয়ে চিড়িয়াখানায় এসে পৌঁছালাম। ঘুরে ঘুরে চারপাশটা দেখছি। ঘুরতে ঘুরতেই ভাবছি এই জন্তু জানোয়ার গুলোও জগতের বহুরূপী মানুষ গুলো থেকে অনেক ভালো। আর যাই হোক মালিকের বিশ্বাস তো আর ভাঙে না। অবনী আমার সাথে সাথে হাঁটতে লাগলো। আমি আর অবনী কথা বলেই চলেছি। খুব মিশুক মেয়েটা। এই কয়েকদিনে ওর সাথে বেশ ভালোই শখ্যতা গড়ে উঠেছে আমার। আমরা এক এক করে বন্য পশু গুলোর একেকটার খাঁচা পেড়িয়ে যাচ্ছি। হঠাৎই দেখতে পেলাম অরিদ্র একটা লোকের সাথে কথা বলছে। তাকে বেশ চিন্তিত দেখাচ্ছে এই মুহূর্তে। লোকটার সাথে কথা শেষ করে সে আমাদের কাছে এলো।

সে বললো, ভাইয়া আমাকে এক্ষুনি যেতে হবে।

খুব জানতে ইচ্ছে হচ্ছে কোথায় যাচ্ছে সে? নিজের এই অদম্য ইচ্ছেটাকে নিজের মনে রাখতে পারলাম না। হুট করেই বলে ফেললাম, আপনি কোথায় যাচ্ছেন অরিদ্র?

সে হয়তো আমার কাছে এটা আশা করে নি। সে শান্ত ভাবেই বললো, গতকাল ভর্তি হওয়া পেশেন্টের অবস্থা খুব খারাপ। নিজেকে নিজেই আঘাত করছে।

আমিও আপনার সাথে যাবো অরিদ্র!

চলবে………

(অনুগ্রহ করে ভুলত্রুটি গুলো ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here