অপূর্ণতায় পূর্ণতা পর্ব-৬

0
1989

#অপূর্ণতায়_পূর্ণতা
#তানজিলা_তিহা (লেখনীতে)
#পর্ব_০৬

“আমিও আপনার সাথে যাবো অরিদ্র!” নিজের অজান্তেই বলে ফেললাম আমি। খুব জোরেই বলে ফেললাম। সামনে প্রতীয়মান মানুষ গুলোর দৃষ্টি আমাতেই নিবন্ধ। একটা অস্বস্তিকর অবস্থায় পড়ে গেলাম। সবাই চোখ বড় বড় করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। অরিদ্র আমার দিকে কিছুক্ষণ শীতল চাহনি চেয়ে হেসে ফেললেন। আমি চুপ করেই দাঁড়িয়ে থাকলাম।

অরিদ্র বললেন, সত্যি যাবেন? নাকি অর্ধেক রাস্তায় গিয়ে আবার বলবেন বাড়ি যাবো?

আপু আর অভ্র ভাইয়া মুচকি হাসছে। আমি আর কিছু বললাম না। নিজের কাজে নিজেকেই একশোটা গা”লি দিতে ইচ্ছে হচ্ছে।

অরিদ্র হাসতে হাসতে বললেন, চলুন তাহলে।

তিনি আমার দিকে তাকিয়ে হাসছেন। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি হাসছেন কেন অরিদ্র?

সে বললো, ইশারা আপনি হঠাৎ আমার সাথে যেতে চাইছেন? ব্যাপারটা ঠিক হজম করতে পারলাম না।

আমি কি বলবো? আমি নিজেই তো বুঝতে পারছি না কি বললাম আমি! নিজের উপরই নিজের রাগ হচ্ছে। অরিদ্র। বললেন, এতো ভাবতে হবে না। আপনি গিয়ে গাড়িতে বসুন আমি আসছি।

আমি শান্ত পায়ে গিয়ে গাড়িতে বসলাম। কিছুক্ষণ পর অরিদ্র এসে গাড়ি স্টার্ট করলেন। গাড়ি আপন গন্তব্যের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলো। সারাটা রাস্তা বাহিরের দিকেই তাকিয়ে ছিলাম। কোন প্রকার শব্দ করি নি। আমার এহেন কান্ডে অরিদ্র হেসেছেন কয়েকবার। তবুও কিছু বলি নি আমি। নির্ধারিত গন্তব্যে পৌঁছাতেই হুট করে ব্রেক কষে দিলেন তিনি। আচমকা এহেন কান্ডে বেশ সংকিত হলাম তবুও নিজেকে সামলে নিলাম।

তিনি আমাকে বললেন, চলে এসেছি ইশারা। এবার নামুন।

কোন কথা না বলে নামতে গেলাম। বাহিরের দিকে তাকিয়ে প্রকাণ্ড দেয়ালের হাসপাতালটা লক্ষ্য হলো। গাড়ির কপাট খুলে বের হলাম।হাসপাতালের ভিতর প্রবেশ করতেই থমকে গেলাম। চারপাশটা কেমন অন্যরকম। এটা মানসিক হাসপাতাল। ভেতরে আসতেই দেখতে পেলাম এক মহিলা আমার দিকে তাকিয়ে আছে। সে আমার দিকে এগিয়ে এসে বললো, তুমি আইছো? তোমারে আর যাইতে দিতাম না। তুমি আমার কাছেই থাকবা। আমি আর তোমারে বকমু না। তোমারে অনেক আদর করমু। হঠাৎ তার আক্রমণে বেশ ভয় পেলাম। রীতিমতো আমার হাত পা কাঁপাকাঁপি আরম্ভ হয়ে গেলো। মেয়েটা এবার আমার হাত চেপে ধরলো। আমি জোরে চিৎকার করলেই অরিদ্র ছুটে আসলেন। আমার চিৎকারে কয়েকজন নার্স ও ছুটে আসলো। তাকে নিতে গেলে সে বার বার এক কথাই বলতে থাকলো, তুমি আমারে থুইয়া যাইয়ো না।‌ আমি তোমারে আর বকমু না। সত্যি কইতাছি মা। নার্সটা তাকে নিয়ে চলে গেলো।

আমি ভয়ে গুটিয়ে গেলাম। অরিদ্র ব্যস্ত কণ্ঠে আমাকে বললেন, আর ইউ ওকে ইশারা?

আমার গা দিয়ে ঘাম ঝরছে। অনেকটাই ভয় পেয়ে গেছি এই কাণ্ডে। আমার দিকে এক বোতল পানি এগিয়ে দিলেন তিনি। এরপর বললেন, ভয় পেয়ো না।
আমি ঢক ঢক করে পানি গলতে শুরু করলাম। এরপর চারপাশে চোখ বুলিয়ে দেখলাম হাজারো লোহার শিক। যার মাঝে বন্দী হয়ে আছে মানুষ। আমি অরিদ্রকে বললাম, ওই মহিলা এমন করলো কেন অরিদ্র? তিনি বললেন, উনি মানসিক ভারসাম্য হীন। বেশ অবাক হলাম। আমি বললাম দেখে তো তা মনে হয় না। তিনি বললেন, হ্যা মনে হয় না কিন্তু এটাই সত্যি। গত তিন বছর যাবত এই হাসপাতালে আছেন তিনি। একটা ছেলে আছে তার। প্রতি মাসে এসে হাসপাতালের যাবতীয় খরচ মিটিয়ে দিয়ে যায়। কিন্তু দেখো মায়ের জন্য তার সময় নেই। এরপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, এটাই মানুষের জীবন ইশারা।

বেশ অবাক হলাম। মানুষের জীবন এমনও হয়? বেশ কিছুক্ষণই সেখানে চুপ করে বসে থাকলাম। অরিদ্র বললেন, আপনি ঠিক আছেন ইশারা? আমি বললাম, হুম।

হাঁটতে হাঁটতে আমরা আরেকটা বদ্ধ শিকের পাশে এসে দাঁড়ালাম। অরিদ্র আমাকে বললেন, আপনি এখানেই দাঁড়ান ইশারা। আমি কিছু না বলে দাঁড়িয়ে পড়লাম। বারান্দার শেষ ঘরটার দিকে এগিয়ে গেলেন তিনি। লোহার শিকের দরজা খুলে ভিতরে গেলেন তিনি। সাথে সাথেই প্রকাণ্ড শব্দ ভেসে আসলো কানে। খুব জোরে জোরে চিৎকারের শব্দ। সাথে ভেসে আসছে বেত্রাঘাতের শব্দ।

কেউ চিল্লিয়ে বলছেন, আজ নিজেকে শেষ করে দিবো আমি। আমি শেষ করে দিবো। আমার বেঁচে থাকার অধিকার নেই। আমার জন্য আমার অভীক…আমার অভীক….

হঠাৎ কারো এমন কথা শুনে তাকে বেশ দেখতে ইচ্ছে হলো। আমি ভয়ার্ত দৃষ্টিতে সেদিকে অগ্রসর হলাম। কাছে যেতেই দেখতে পেলাম, একজন মধ্য বয়সী মহিলা নিজেকে আঘাত করছে আর একই কথা বলছে। আমার স্নায়ুতন্ত্র এহেন দৃশ্য আসলে কি তা আন্দাজ করতে পরলো না। সেখানেই দাঁড়িয়ে পড়লাম আমি।

মহিলাটি জোরে জোরে বলতে লাগলো, আমার অভীককে এনে দাও নাহলে আমি নিজেকে শেষ করে দিবো।

অরিদ্র তাকে শান্ত করে বললেন, তোমার অভীক তোমার কাছেই আছে মা। এই যে দেখো আমিই তো তোমার অভীক।

মহিলাটি তার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো। এরপর বললো, তুমি আমার অভীক? তুমি আমার অভীক না। সরো এখান থেকে। আমার অভীককে এনে দাও বলছি।

অরিদ্র তার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো। মহিলাটি প্রায় শান্ত। অরিদ্র বললো, তুমি আমাকে চিনতে পারলে না মা? আমি কিন্তু খুব রাগ করবো।

মহিলাটি এবার বিভ্রান্ত। সে বললো, তুমি আমার অভীক এতো বড় হয়ে গেছে? অরিদ্র বললেন, হ্যা মা।

মহিলাটির সাথে এক কথায় দু কথায় সে শান্ত হয়ে গেলো। কিছুক্ষণ পর তিনি ঘুমিয়ে পড়লেন। তিনি তাকে ইনজেকশন পুশ করে বের হয়ে গেলেন। আমি এখনো সেদিকেই তাকিয়ে আছি।

তিনি আমার কাছে এসে বললেন, এই যে ম্যাডাম কি হলো?

আমি বললাম, উনি কে অরিদ্র?

সে বললো, সন্তান হারা মা।

আমি এখনো সেদিকে মগ্ন। অরিদ্র হয়তো আমার অবস্থা উপলব্ধি করলেন।

তিনি আমাকে বললেন, এ দুনিয়ায় এরকম অনেক মানুষ আছে ইশারা। যারা আপনজন হারিয়ে বা আপন জনের কাছ থেকে কষ্ট পেয়ে মানসিক ভাবে ভারসাম্য হয়ে পড়েছে। আমরা এদেরকে পাগল বলে আখ্যায়িত করি কিন্তু আসলে কি আমরা এদের প্রকৃত অবস্থা জানি?

আমি কিছু বললাম না। সত্যিই তো এভাবে ভেবে তো দেখি নি। কি বলবো আমি? এই মানুষগুলো সমাজে ঠাট্টা বিদ্রুপের অংশ হয়ে আছে।

তিনি বললেন, ইশারা আমরা আজ স্বাভাবিক কিন্তু কাল স্বাভাবিক নাও থাকতে পারি। আমাদের আজকের কাজের জন্য কিন্তু ভবিষ্যতে আমাদের পস্তাতে হয়।

আমি কিছু বললাম না। নিশ্চুপ হেঁটে চলেছি। তিনি আমাকে বললেন, ইশারা আমাদের কিন্তু ভুল থেকেই শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে। এই মানুষগুলো নিজেদের অবস্থা মেনে নিতে পারে নি। যার দরুন তাদের এই অবস্থা। কিন্তু আমাদের শক্ত হতে হবে।

আমি তার কথার আগাগোড়া বুঝলাম না। বললাম, আমি কিছু বুঝতে পারছি না।

তিনি হেসে ফেললেন। বললেন, সহজ করেই বলি তাহলে। আপনাকে সামনে এগোতে হবে ইশারা। আপনাকে দেখিয়ে দিতে হবে আপনিও কম নন।

বুঝতে পারলাম সে কি বলতে চাচ্ছে। হঠাৎ করেই মনটা বিষন্নতার ছায়ায় ঢেকে গেলো। হৃদমাঝারে জমানো কালো মেঘের পাহাড় তীব্র হয়ে উঠলো। অতীতের তিক্ততা! আমি চুপচাপ হেঁটে চলেছি। চোখের কর্ণিশে জমে উঠলো জলরাশি।

তিনি আমাকে বললেন, আপন জন হারানোর বেদনা কেমন তা আমি জানি ইশারা। প্রতিটি মুহূর্ত আমাদেরকে কুঁড়ে কুঁড়ে খায় এই বিষাদ বেদনা। প্রতিটা মুহূর্ত তার বেদনাদায়ক স্মৃতি গুলো নিয়ে বেঁচে থাকা কিন্তু একটা যুদ্ধ। কিন্তু এ বেদনা সত্যিই নিরর্থক। যার জন্য আমি কাঁদবো যার জন্য আমি নিজেকে শেষ করে দিবো সে কিন্তু দিব্যি অন্যের সাথে ভালো থাকবে। তাই বলছি নিজেকে ভালো রাখুন। আমাকেই দেখুন আমি তো পাথর হয়ে গেছি।

তার কথায় বেশ অবাক হলাম! আপনজন? তবে কি সে কাউকে ভালোবাসতো?

চলবে….

(অনুগ্রহ করে ভুলত্রুটি গুলো ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here