অপূর্ণতায় পূর্ণতা পর্ব-১৩

0
1894

#অপূর্ণতায়_পূর্ণতা
#তানজিলা_তিহা (লেখনীতে)
#পর্ব_১৩

গ্রীষ্মের তাণ্ডবের সমাপ্তি ঘটিয়ে মেঘের পলশা নিয়ে চলে এসেছে বর্ষার মৌসুম। প্রচন্ড গরমে অতিষ্ঠ হওয়া প্রাণিকুলে চলে এসেছে সতেজতা। কালো মেঘের পাহাড় ভেঙে নেমে এসেছে ঝুম ঝুম বৃষ্টি। আকাশে মেঘের গর্জনের পর নেমেছে ঝুম ঝুম বর্ষণ। অর্ককে পড়ানো শেষ করে বাড়ি পথে রওয়ানা দিয়েছি। আজ পড়ানো শেষ করতে একটু দেরিই হয়ে গেলো। গত এক মাস ধরে ছেলেটাকে পড়াই। মাঝ রাস্তায় এসে ঝুম ঝুম বৃষ্টির স্বীকার হতে হলো আমাকে। বর্ষায় সহযাত্রী হিসেবে ছাতাটা সঙ্গে থাকায় কিছুটা সহজ হলো। কিন্তু হঠাৎই নামা এই মুষলধারে বৃষ্টি কি ছাতাকে মানে? ভিজে একাকার হয়ে গেছে আমার সর্বাঙ্গ। এই মুহূর্তে রিক্সার জন্য অপেক্ষা করাটা নিতান্তই বোকামি। বৃষ্টিকে তো কেউ রিক্সা নিয়ে বেড়ুবে না। আমার সারাশরীরে ছেয়ে গেছে বর্ষণের বিন্দু কণা। দেরি না করে জোর পায়ে সামনে দিকে এগুতে লাগলাম। রাস্তায় কোন প্রাণীর চিহ্ন এই মুহূর্তে চোখে পড়ছে না। জনশূন্য রাস্তায় আমিই একমাত্র পথচারী। বেশ ভয় হচ্ছে মনে। নিজেকে নিজেই ভর্ৎসনা দিতে লাগলাম। আন্টি কত বার বললো বৃষ্টি হবে বৃষ্টি হবে এখন বের হতে না কিন্তু আমি শুনি নি। ভেবেছিলাম বৃষ্টির আগেই বাড়ি পৌঁছে যাবো কিন্তু তা হলো না!

যত দ্রুত সম্ভব তত দ্রুত হাঁটতে লাগলাম। অর্কদের বাসা থেকে আমাদের বাসায় পায়ে হেঁটে যেতে প্রায় বিশ মিনিট সময় লাগে। আমি বার বার হাতে ঝুলানো ঘড়ির কাঁটায় নজর দারি করছি আর হাঁটছি। চারপাশটাও খেয়াল করে চলেছি বার বার। হঠাৎ সামনে জনমানবের দেখা পেয়ে ভয়টা আরো তীব্র হলো। আমার দিকেই এগিয়ে আসছে আরেক ছাতার আরোহী। আমি এক নজর দেখে মাথা নিচু করে সামনে দিকে এগোতে লাগলাম। এক মিনিট বাদে ব্যক্তিটির সম্মুখ পানে চলে আসলাম। সে যে আমার দিকে তাকিয়ে আছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। লোকটা অদ্ভুত ভাবে দেখছে আমায়। আমি দ্রুত প্রস্থান করতে নিলেই সে বলে উঠলো,

তুমি ইমতিয়াজ চাচার মেয়ে না?

তার আওয়াজে থমকে গেলাম। ছাতার ঝুপড়ির ভেতরে আমাকে কিভাবে চিনে ফেললো সে? তার সাথে কথা বলা কি ঠিক হবে? কে সে? বুকের ভিতরে ভয়ানক এক কম্পন শুরু হয়েছে। ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে যাচ্ছে সর্বাঙ্গ। সাথে রয়েছে মৃদু কম্পন। আমি কাঁপতে কাঁপতেই বললাম, জ্বি।

তা কেমন আছো? চাচাজান কেমন আছে?

জ্বি ভালো। আপনি কে?

আমি ফাহাদ। পুরো নাম আনোয়ার আলম ফাহাদ। সম্পর্কে আমি তোমার…..। ইমতিয়াজ চাচা আমাকে চিনেন।

আমি ছোট করে ওহ্ বললাম।

‘এতো বৃষ্টির মধ্যে রাস্তায় তুমি?’

‘অর্ককে পড়াতে গিয়েছিলাম।’

‘অর্ক কে?’

‘আমার স্টুডেন্ট।’

‘ওহ্। তবে শেষ বিকেলে কাউকে না পড়ানোই ভালো। আজকাল যেই অবস্থা। তোমার সেফটির জন্য বললাম।’

তার কথায় সৌজন্য মূলক হাসি দিলাম। সে আমার সাথে হাঁটতে শুরু করলো। বুঝতে পারছি না সে কি চাচ্ছে। সত্যিই কি সে বাবার পরিচিত কেউ নাকি মিথ্যা? ভাবতে ভাবতেই সামনে এগোচ্ছি।

‘চাচিজান কেমন আছে?’

‘জ্বি ভালো।’

‘তোমার দিন কাল কেমন কাটছে?’

‘জ্বি ভালো।’

‘তুমি এবার কোন ক্লাসে?’

অনার্স সেকেন্ড ইয়ার।

‘তোমার বোনের কি খবর?’

‘সিহা আপুর কথা বলেছেন?’

হ্যা হ্যা তুমি বড় নাকি ও?

সিহা আপু।

ও কোথায়?

আপুর বিয়ে হয়ে গেছে। এখন শ্বশুড় বাড়িতে।

আর তোমার?

হঠাৎ তার প্রশ্নে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। কি বলবো? আমার বিয়ে তো হয়েছে। কিন্তু ডিবোর্সও তো হয়েছে। কি বলবো আমি?

সে দ্বিতীয় বার প্রশ্ন করলো, সিহার কবে বিয়ে হলো?

‘আড়াই বছর।’ লোকটা আমার সাথে চলতে চলতে অনেকটা পথ চলে এসেছে। আশ্চর্য তো! সে আমার সাথে কেন আসছে? এই ঝড় বৃষ্টিতে তার পিছু নেওয়াটা ভালোর লক্ষণ মনে হলো না। আমি আগ বাড়িয়ে প্রশ্ন করলাম, ‘আপনি কি আমার সাথে বাড়িতে যাচ্ছেন?’

‘না এখন যেতে পারবো না। দেখছোই তো কত ঝড় বৃষ্টি বাড়ি না ফিরলে মা চিন্তা করবে। অন্য একদিন যাবো।’

‘তবে আমার সাথে কেন চললেন?’

তোমার বাড়ি দিকে পূর্বে আমাদের বাড়ি। তোমাদের বাড়ির সামনে দিয়েই যেতে হয়। আমি বাড়ির দিকেই যাচ্ছি ম্যাডাম।

আমি আর কোন কথা বললাম না। নিরবে হাঁটতে লাগলাম। সেও কিছু বললো না।

প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় শরীরে কাঁপুনি শুরু হয়ে গেছে। মাত্রই বাড়ি ফিরেছি। ভেজা কাপড় ছেড়ে শুকনো মোটা কাপড়ে নিজেকে বন্দি করে নিয়েছি। হাড় কাঁপা কাঁপি শুরু হয়ে গেছে। আজ রাতে জ্বর আসবে এটা নিশ্চিত। তড়িঘড়ি কম্বলের ভিতরে নিজেকে আবদ্ধ করে নিলাম। মায়ের বকাবকির প্রচণ্ড শব্দ কানের পর্দা ফাটানোর জন্য যথেষ্ট। বাবাও প্রচুর রেগে আছেন। দুজনেরই একই কথা আমার টিউশনি করানোর দরকার কি! কারো কথা কানে না নিয়ে চুপচাপ কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লাম। এই মুহূর্তে একটা ঘুম দেওয়াই আমার মুখ্য উদ্দেশ্য। ঘুমোলে শরীরটা হয়তো ভালো লাগবে।

____________________

কালো মেঘের পাহাড়ের দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে আছে অরিদ্র। সবসময় গাম্ভীর্য মাখা চেহারায় তার বিষন্নতার ছায়া। মন খারাপে ছেয়ে গেছে তার মন প্রাঙ্গণ। তার বক্ষভেদে আরম্ভ হয়ে উত্তাল ঢেউ। এক ভয়ানক ঢেউ। মনের ভিতরটা ছটফট করছে বার বার। শূন্যতা ছেয়ে গেছে সর্বত্র। তার ইশুবতীর জন্য সৃষ্টি হয়েছে এই ঢেউ। গত দেড় মাস যাবৎ ইশুবতীর সাথে তার কোন সাক্ষাৎ নেই। দেখতে পায় নি তার প্রেয়শীকে। উন্মাদ প্রেমিকে পরিণত হয়েছে সে। প্রতিনিয়তই বেড়ে চলেছে তার উন্মাদনা। আজ বেশ করে ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে হচ্ছে তার প্রেয়শীকে। বেশ করে তাকে কাছে টানতে ইচ্ছে হচ্ছে। কেন যে এই অদ্ভুত ইচ্ছে তার মনে হানা দিয়েছে তা তার অজানা। এই অদ্ভুত ইচ্ছেটা এই মুহূর্তে তীব্র হয়ে উঠেছে। কিন্তু কি করে সম্ভব! দীর্ঘশ্বাস ফেলে বেলকনি থেকে চলে আসে সে।

‘তুমি হঠাৎ আমার কাছে? কি হয়েছে ভাবি? কোন সমস্যা?’ সিহাকে দেখে তাকে প্রশ্ন করে অরিদ্র।

হ্যা অনেক সমস্যা।

কি সমস্যা? বলে ফেলো তো।

অরুনিকে তোমার মনে আছে অরিদ্র?

না। কে সে?

এতো তাড়াতাড়ি ভুলে গেলে? আমাদের বাড়িতে যে এসেছিলো আমার খালাতো বোন। মনে পড়েছে?

বলতে পারছি না। কি হয়েছে তা বলো।

কি আশ্চর্য! এ কয়েকদিনে ভুলে গেলে?

মনে রাখার দরকার ছিলো? অপ্রয়োজনীয় জিনিস আমি মনে রাখি না।

তোমাদের ভাইয়ের তো কিছুই মনে থাকে না। তোমরা আজ কি করলে তা আগামীকাল বলতে পারবে না। তোমরা শুধু সারাদিন ডাক্তারি ফাক্তারি নিয়ে পড়ে থাকবে। এসব তোমাদের দিয়ে হয় না।

অরিদ্র হেসে ফেললো।

সিহা মুখ ফুলিয়ে বললো, এখন আমার আসল কথা শোনো।

হুম, বলো।

কাল অরুনি আমাদের বাসায় আসবে।

ওহ্ ভালো।

কিন্তু একটা সমস্যা। তোমাকে ওকে আনতে যেতে হবে।

কেন? আমি কেন?

ও বাড়ি চিনে না তাই।

উফ্, বাড়ি না চিনলে আমার কি? আমার কি কাজ টাজ কিছু নেই যে তোমার বোনকে আনতে যাবো?

কাজ আছে। কিন্তু অল্প কিছুক্ষণের ব্যাপারই তো। তুমি বাসায় দিয়ে তোমার কাজে চলে যেয়ো।

নো নো নো। তুমি বরং রমজান কাকাকে বলো। আমি পারবো না। পসিবল না।

প্লিজ। তোমার ভাইয়া থাকলে তাকেই বলতাম। আমার মেজ খালা কোন ধরনের তা তুমি জানো না। রমজান কাকাকে পাঠালে হাজারটা কাহিনী করবে। তোমার কাছে রিকোয়েস্ট অরিদ্র!

সিহার কথায় অরিদ্র হতাশ হলো।

__________________

গায়ের তাপমাত্রা যে হু হু করে বেড়েই চলেছে তা বেশ আঁচ করতে পারছি। দ্রুত বেগে বেড়ে চলছে এই মাত্রা। বৃষ্টিতে ভেজার ফল স্বরূপ আমার দেহে স্থান করে নিচ্ছে তারা। জ্বরে পুরো শরীর কেঁপে যাচ্ছে বারং বার। মা মাথার পাশে বসে মাথায় জল পট্টি দিতে ব্যস্ত। বাবা বার বার তাপমাত্রার অবস্থা দেখছে। নূর কাকাকে ফোন করা হয়েছে সেই কখন। কাকা এখনো আসেন নি। আমার অবস্থা বেগতিক। জ্বরের ঘরে কিছুই ভালো লাগছে না। বেহুঁশ বেহুঁশ অবস্থা আমার। হঠাৎ ফোনের রিংটোন কানে গেলো। মায়ের সাথে কথা বলছে সিহা আপু। তার কণ্ঠেই বোঝা যাচ্ছে সে কতটা চিন্তিত। কথার এক পর্যায়ে আপু কেঁদেই ফেললো। একমাত্র ছোট বোন বলে কথা। তবে মায়ের প্রতি বেশ বিরক্ত হলাম। আপুকে এই অবস্থায় বলতেই হলো? এখন আপু কতটা টেনশন করবে! এই অবস্থায় টেনশন কি তার জন্য ভালো? আমাদের পুঁচকেটার অসুবিধে হবে না বুঝি? আমি জ্বরে বিড়বিড় করে আওরাতে থাকলাম, ‘আমি ঠিক আছি তুই চিন্তা করিস না আপু!’

চলবে………..

(অনুগ্রহ করে ভুলত্রুটি গুলো ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here