বালির নীচে জলের শব্দ পর্ব ২৪

0
1360

বালির নীচে জলের শব্দ
পর্ব ২৪

নিস্তব্ধ রাত্রি। জনহীন সরণী। ছাদ জুড়ে থৈথৈ জোৎস্না। বসন্তের মৃদু মন্দ হাওয়া শরীর ছুঁয়ে দিলো তিনজন যুবকের। মধ্যরাতে এই নির্মল জোছনার আলোয় ছাদের রেলিং এর উপরে এক পা তুলে বসে আছে হিমেল। তার আঙ্গুলের ফাঁকে জ্বলন্ত নিকোটিন পুড়ে ধোঁয়া উড়ছে। আকাশের দিকে মিটমিটিয়ে জ্বলে ওঠা তারার দিকে দৃষ্টি স্থির তার। মনে মনে অপেক্ষার প্রহর গুনছে। সৌরভ বেশ জোরেশোরে মশা মেরেই ভীষন বিরক্তিকর কণ্ঠে বললো
— কি রে এখনো তোর সেই শুভাকাঙ্ক্ষীর আশার সময় হয়নি? এদিকে অপেক্ষা করতে করতে মশা তো আমার দেহের অর্ধেক রক্ত সাবাড় করে দিলো।

শ্রাবণ মলিন মুখে বলল
— ফোন দিয়েছিলাম তো। ধরলো না। এতক্ষণ তো চলে আসার কথা ছিলো।

সৌরভ বিরক্তিকর একটা শব্দ করে বলল
— আবার ফোন দে। এতো দেরি করছে কেনো কে জানে?

শ্রাবণ সৌরভের কথা মতো ফোন দেয়ার জন্য আলো জ্বালাতেই হিমেল ধোয়া ছাড়তে ছাড়তে বলল
— আহ! তোরা এতো অস্থির হচ্ছিস কেন? মেয়ে মানুষ। বললেই তো আর এতো রাতে বাড়ি থেকে বের হয়ে ছাদে চলে আসা যায় না। সবদিক সামলে তবেই আসতে হবে। একটু সময় লাগবে।

সৌরভ চোখ মুখ খিচে হিমেলের দিকে তাকাল। ভীষন মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো তার। এতো বছরের বন্ধুকে মশা প্রায় খেয়ে ফেলছে সেটা নিয়ে তার কোন আক্ষেপ নেই। কিন্তু একটা মেয়েকে দো তোলা থেকে ছাদে আসতে একটু তাড়া দিচ্ছে বলেই তার বিরক্তির শেষ নেই। হিমেল কে সার্থপর মনে হলো তার। তার সাথে কোন কথা না বলে শ্রাবণ কে বলল
— শ্রাবণ আদৌ কি আসবে সে? তুই সিওর তো?

শ্রাবণ কোন উত্তর দিলো না। কারণ কুমুর বেধে দেয়া নির্ধারিত সময় পার হয়ে আধা ঘন্টা বেশি হয়ে গেছে। এখন তার নিজেরও সন্দেহ হচ্ছে কুমু আসবে কিনা। হিমেল সিগারেটে শেষ টান টা দিয়ে সেটা ছুড়ে ফেলে বলল
— কুমু যখন বলেছে তখন সে আসবেই।

সৌরভ এবার রেগে গেলো। কপালে গাঢ় ভাঁজ ফেলে কঠিন গলায় বলল
— আসবে বললে তো হবেনা। কখন আসবে সেটা জানতে হবে। সারা রাত কি এখানে অপেক্ষা করবো আমরা?

হিমেল তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল। গম্ভীর গলায় বলল
— তোর যদি এতো সমস্যা হয় তাহলে তুই নিচে যেতে পারিস। কেউ তোকে আটকে রাখেনি। আমি অপেক্ষা করবো কুমুর জন্য। ওর যখন সুবিধা হবে তখন আসবে।

হিমেল এর কথা শেষ হতেই ছাদ জুড়ে নীরবতা নেমে এলো। শ্রাবণের মন খারাপ তাই খুব একটা কথা বলছে না। সৌরভ বন্ধুর আচরনে তার উপরে অভিমান করেছে। তাই সেও চুপ হয়ে গেলো। প্রায় মিনিট দশেক পর কুমু ছাদে আসলো। দরজা পেরিয়ে ছাদে পা রাখতেই আওয়াজ শুনে তিন জোড়া চোখ তার দিকে স্থির হয়ে গেল। অন্ধকারে প্রথমে বিষয়টা তেমন কিছু মনে না হলেও ধীরে ধীরে আলোটা চোখে সয়ে যেতেই বিব্রত হলো কুমু। দৃষ্টি নত করে ফেললো। মাথার ওড়না টা টেনে ঠিক করে দিলো। শ্রাবণ কিছুটা অস্থির হয়ে বলল
— তুমি অবশেষে এসেছো? আমি তো ভেবেছিলাম আসতে পারবে না।

শ্রাবণের কথায় কিছুটা লজ্জা পেলো কুমু। অনেক বেশি দেরি করে ফেলেছে সেটা সেও জানে। নিচের দিকে তাকিয়েই মিনমিনে সরে বলল
— আসলে সবাই জেগে ছিলো তো তাই আসতে পারছিলাম না।

শ্রাবণ ভেতর থেকে হাসফাস করে উঠলো। শুভ্রার মনে তাকে নিয়ে ঠিক কি অনুভূতি আছে সেটা জানতেই সে কুমুকে এই মাঝরাতে ছাদে দেখা করতে বলেছে। এতক্ষণের সমস্ত অস্থিরতা চেপে রেখে অপেক্ষা করলেও এখন আর পারছে না। জানার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠেছে। অস্থির হয়ে বলল
— তুমি ওখানে কেনো দাড়িয়ে আছো কুমু? এখানে আসো।

পাতানো বেঞ্চটাতে হাত রেখে বলল
— এখানে বসো।

কুমু মাথা তুলে একবার সেদিকে তাকাল তারপর হিমেলের দিকে। কিন্তু হিমেলের স্থির দৃষ্টি তার ভেতর কাপিয়ে তুললো। অস্থির হয়ে উঠতেই দৃষ্টি ফিরিয়ে এগিয়ে গেলো। ভীষন অসস্তি নিয়ে দাড়াতেই সৌরভ আর শ্রাবণ দুজনেই বেঞ্চ টা ফাঁকা করে রেলিংয়ের উপরে বসে পড়লো। কুমু বসে পড়তেই শ্রাবণ বলল
— শুনলাম শুভ্রার বাবা নাকি বিয়ের জন্য ছেলে দেখছে?

কুমু মাথা নাড়লো। শ্রাবণ ভীষন হতাশ কণ্ঠে বললো
— তুমি জানতে কুমু? আমাকে জানানোর প্রয়োজন মনে করনি? তুমি তো জানোই শুভ্রার প্রতি আমার অনুভূতি কেমন। তবুও?

কুমু অসহায় দৃষ্টিতে শ্রাবণের দিকে তাকাল। আহত কণ্ঠে বললো
— বিশ্বাস করেন ভাইয়া। আমি নিজেও জানতাম না। জানলে অবশ্যই আপনাকে জানাতাম। শুভ্রার মন খারাপ। তাই গত দুইদিন বাসা থেকে বের হয়নি। আজ আমি নিজে থেকেই সকালে ওকে ফোন দেই। তখনই বলল। আর ওর মন খারাপের কারণ এটাই।

শ্রাবণের নিশ্বাস ভারী হয়ে আসছে। দমবন্ধ লাগছে তার। চোখ বন্ধ করে একটা তপ্ত শ্বাস ছেড়ে কুমুর দিকে তাকাল। ভীষন শান্ত কণ্ঠে বললো
— শুভ্রা কি বিয়েতে রাজী?

কুমু মাথা নাড়িয়ে জানালো শুভ্রা রাজি না। সৌরভ এতক্ষণ চুপ করে কথা শুনছিল। মনে প্রশ্নের উদ্রেক ঘটতেই বলল
— তাহলে শুভ্রা বাসায় বলছে না কেনো সে বিয়ে করবে না। না করে দিলেই তো আর কোন ঝামেলা থাকে না। ও রাজি না থাকলে তো আর ধরেবেধে বিয়ে দেবে না।

সৌরভের কথাটা সবারই যুক্তিসঙ্গত মনে হলো। শুভ্রা চাইলেই বিয়ে ভেংগে দিতে পারে। শ্রাবণ সম্মতি দিয়ে কুমুকে জিজ্ঞেস করলো শুভ্রা কেনো তার বাবাকে না বলছে না। কুমু কিছুটা সময় নিয়ে বলল
— পরিস্থিতি আসলে তেমন না শ্রাবণ ভাইয়া। শুভ্রা বাড়ির বড়ো মেয়ে। তার দায়িত্বটা সবার থেকে একটু বেশীই। এমন একটা পরিস্থিতিতে সে জানতে পেরেছে তখন তার আসলে কিছুই করার ছিল না। মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়েদের ঘাড়ে যখন দায়িত্ত্ব পড়ে তখন নিজের ইচ্ছার ভারটা বোঝা মনে হয়। সেই বোঝা থেকে নিস্তার পেতেই দায়িত্বকে বেছে নেয়। শুভ্রার বাবা যা বেতন পান সেটা দিয়ে শহরে থেকে সংসার চালানো বেশ কষ্টসাধ্য। আর তাদের এই কষ্ট লাঘব করতেই তার বড়ো মামা কিছুটা সাহায্য করেন। আর শুভ্রার বিয়ের জন্য তিনি নিজেই ছেলে নিয়ে আসেন। সেখানে শুভ্রার বাবা না করতে পারেনি। আর কৃতজ্ঞতা স্বীকার করতেই হয়তো শুভ্রাও বিষয়টাকে মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছে। তবে এই বিয়েতে শুভ্রার কোন মত নেই। ওর সাথে যখন কথা হয়েছিলো তখন খুব কাদছিলো।

হিমেল গভীর মনোযোগ দিয়ে তার কথা শুনছিল। কুমুর কথা শুনে মনে ভয় তৈরি হলো। এরকম পরিস্থতিতে হয়তো সে নিজেও হার মেনে দায়িত্ব বোধকে বেছে নেবে। কিন্তু হিমেল কিভাবে মেনে নেবে সেটা। এই অবস্থায় নিজেকে ভীষন অসহায় মনে হচ্ছে। আর যাই হোক সে কুমুকে হারাতে পারবে না। এদিকে শ্রাবণের অবস্থাটাও বুঝতে পারছে। এটার একটা সমাধান করতেই হবে। সে থাকতে শ্রাবণ এভাবে কষ্ট পাবে সেটা কোনভাবেই কাম্য নয়। হিমেল বলল
— শুভ্রার সাথে কথা বলাটা এই মুহূর্তে খুব দরকার। ওর সাথে কথা বললেও অন্তত বোঝা যেতো সে কি চায়। তারপর একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারতাম।

কুমু তাচ্ছিল্য হাসলো। মুখে হাসি রেখেই বলল
— আপনার কি মনে হয় এই পরিস্থিতিতে শুভ্রাকে জিজ্ঞেস করলেই সে নিজের মনের কথা বলে দেবে? অসম্ভব! এই মুহূর্তে ওর কাছে নিজের পরিবারের সুখটাই আগে। আমি যতদূর শুভ্রাকে চিনি সে সেটাকে বিসর্জন দিয়ে কখনোই নিজের সুখের কথা ভাববে না। প্রয়োজনে সারাজীবন কষ্ট পাবে। তবুও নিজের পরিবারকে অসম্মান করবে না।

সৌরভ উদাস কণ্ঠে বলল
— এটা কেমন কথা বললে? একজনকে মনে রেখে আরেকজনের সাথে সংসার কিভাবে করবে? এটাও কি সম্ভব?

কুমু হাসলো। সৌরভের দিকে তাকিয়ে বলল
— সম্ভব ভাইয়া। মেয়েরা সব পারে। নিজের সুখ বিসর্জন দিয়ে অন্যকে সুখী করতে মোটেই ভয় পায়না।

কুমুর কথাটা হিমেলের বুকের ভেতরে গিয়ে বিধলো। চিনচিন করে উঠলো ভেতরে। শ্রাবণ দীর্ঘশ্বাস ফেলে আকাশের দিকে তাকাল। শেষ সুযোগটাও হয়তো হাতছাড়া হয়ে গেলো। হিমেল খুব গোপনে লুকানো নিশ্বাস টা ছেড়ে শ্রাবণের ঘাড়ে হাত রেখে বলল
— ভাবিস না। কিছু একটা ব্যাবস্থা হয়ে যাবে।

— আর কি হবে ভাইয়া? এভাবে সান্ত্বনা দেয়ার দরকার নাই। আমি সবটা বুঝতে পারছি।

শ্রাবণের কণ্ঠে অসহায়ত্ব। এলোমেলো লাগছে নিজেকে হিমেলের। চোখের সামনে ভাইকে ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হতে দেখে মেনে নিবে কিভাবে? এই যন্ত্রণা যে ভয়ানক! পৃথিবীর সমস্ত যন্ত্রণা থেকেও বিশ্রী এই ভালোবাসা না পাওয়ার যন্ত্রণা। হিমেল কিছুটা সময় নিয়ে ভেবে বলল
— শুভ্রা যদি শ্রাবণকে পছন্দ করে তাহলে আমি কালকেই এই বিষয়ে মায়ের সাথে কথা বলবো। একমাত্র মাই পারবে এই বিষয়টা সমাধান করতে।

শ্রাবণ শুকনো ঢোক গিলে বলল
— তোমার কি মাথা খারাপ? শেষ পর্যন্ত আমাকে বাড়ি ছাড়া করতে চাও?

হিমেল শ্রাবণের কথার গুরুত্ব দিলো না। কুমুর দিকে তাকিয়ে সরাসরি প্রশ্ন করলো
— কুমু শুভ্রা কি কখনো তোমাকে এমন কিছু বলেছে যা থেকে মনে হয় সে শ্রাবণকে পছন্দ করে?

কুমু মিনমিনে সরে বলল
— শুভ্রা শ্রাবণ ভাইয়াকে পছন্দ করে। এতদিনে যেকোন কারণেই হোক বলতে পারেনি। কিন্তু আমি জানি।

হিমেল রেলিং থেকে নেমে গেলো। শ্রাবণের ঘাড়ে হাত রেখে বলল
— তুই নিশ্চিন্তে ঘুমা। একদম টেনশন করবি না। কাল সকালে উঠেই অমি মায়ের সাথে কথা বলবো। আর আমার সাথে থাকবে সৌরভ আর কুমু।

নিজের নামটা শুনে এক প্রকার ঝটকা খেলো কুমু। বিস্মিত কণ্ঠে বলল
— আমি?

চলবে…

( ভীষন ব্যস্ততার মাঝে পর্বটা লিখেছি। রিচেক করার সময় পাইনি। ব্যস্ত সময় কাটছে হয়তো প্রতিদিন গল্প দেয়া সম্ভব হবে না। তবে আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here