বালির নীচে জলের শব্দ পর্ব ২৩

0
1266

বালির নীচে জলের শব্দ
পর্ব ২৩

শান্তিনীড় আজ কোলাহল পূর্ণ। সেই সকাল থেকে হইচই চলছে। ব্যস্ততায় শান্তি বেগম হাপিয়ে উঠেছেন। দারোয়ানকে এক বেলায় কয়েকবার বাজারে যেতে হয়েছে। সবাই আজ বাসায় উপস্থিত। দুপুরে বেশ কয়েক পদের রান্না হচ্ছে। সবকিছুই শান্তি বেগমের ছেলে মেয়ে আর জামাইয়ের পছন্দের। বেশ হইচই করে খাবারের টেবিলে বসে পড়লো সবাই। শান্তি বেগম আজ নিজে হাতে সবাইকে বেড়ে খাওয়াবে। টেবিলে বসেই হিমেল সবার দিকে তাকাল। কিন্তু শ্রাবণকে দেখতে না পেয়ে জিজ্ঞেস করেই বসলো
— শ্রাবণ কোথায়? খাবে না?

সৌরভ একটু কৌতূহলী হয়ে বলল
— সত্যিই তো। আমরা এতো কথা বলছিলাম। অথচ শ্রাবণকে দেখলাম না। ইনফ্যাক্ট আমি তাকে সকাল থেকেই মনে হয় দেখিনি।

তাদের সবার কৌতূহল দমন করতেই নিলু বলল
— ওর শরীরটা একটু খারাপ। তাই রেস্ট নিচ্ছে। আমি ডাকতে গেছিলাম। বলল পরে খাবে।

সবাই বিষয়টাকে সহজভাবে নিলেও হিমেল সেরকম ভাবে কিছু ভাবতে পারলো না। কারণ শ্রাবণের জতই শরীর খারাপ হোক না কেনো সে এভাবে ঘরে শুয়ে থাকে না। বরং বাইরে এসে শরীর খারাপের অজুহাতে সবাইকে বিরক্ত করে। এটা মনে হয় তার প্রিয় কাজগুলোর মধ্যে একটা। হিমেল বিষয়টা শুধু নিজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখলো অন্য কাউকে কিছুই বুঝতে দিলো না। চুপচাপ খাওয়া শেষ করে উঠে গেলো শ্রাবণের ঘরে। গুমোট অন্ধকারে ঢাকা ঘরটায় ফ্যানের মৃদু আওয়াজ কানে আসছে। শ্রাবণ কোথায় আছে সেটাও দেখা যাচ্ছে না। হিমেল দরজাটা খুলে মাথাটা বাড়িয়ে মৃদু আওয়াজ করে ডাকলো
— শ্রাবণ?

নিকষ অন্ধকারের মধ্য থেকেই ক্ষীণ দুর্বল কণ্ঠের আওয়াজটা কানে আসলো
— আমি ঘুমাচ্ছি। তোমরা খেয়ে নাও। পরে খাবো।

হিমেল অবাক হলো। শ্রাবণের কণ্ঠস্বর বলে দিচ্ছে সে অসুস্থ নয়। অন্যকোন ব্যাপার আছে। হিমেল ভেতরে ঢুকে গেলো। সুইচ টিপে আলো জ্বালালো। গুমোট অন্ধকারটা দুর হয়ে তীব্র আলো চোখে পড়তেই শ্রাবণ এক হাত চোখের উপরে রেখে বলল
— কিছু বলবে ভাইয়া?

হিমেল বিছানার উপরে গিয়ে বসলো। শ্রাবণের কোলে জড়িয়ে ধরে থাকা কোলবালিশটা টেনে নিয়ে সেটার উপরে আয়েশ করে হেলে পড়ে বলল
— তোর কি কোন সমস্যা হয়েছে?

শ্রাবণ ভাইয়ের দিকে তাকাল। মলিন হেসে বললো
— কি হবে?

হিমেল পুরো শরীরটা বিছানায় এলিয়ে দিয়ে মুচকি হেসে বললো
— সেটা তো তুই বলবি। আমি এতো কিছু জানিনা। তবে আন্দাজ করতে পারছি।

শ্রাবণ উল্টা দিকে ঘুরে শুয়ে পড়লো। ক্লান্ত কণ্ঠে বললো
— কিছু হয়নি। আমার ঘুম পাচ্ছে।

হিমেল হতাশ শ্বাস ছাড়লো। বিছানা ছেড়ে উঠে গিয়ে জানালার সামনে দাঁড়াল। জানালাটা খুলতেই গরম হাওয়া শরীরে এসে ছুঁয়ে দিলো। টানা দুইদিন বৃষ্টি হওয়ার পর আজ শরীর পোড়া রোদ উঠেছে। ভীষন তপ্ত পরিবেশ। জানালা থেকে সরে এসে পুনরায় বিছানার উপরে গিয়ে বসলো। ভীষন রকম শান্ত কণ্ঠে বলল
— আমি জিজ্ঞেস করছি ভালো লাগছে না? একটু পর যখন মা আসবে তখন উত্তর দিবি? তাহলে মা এসেই জানুক তোর এমন দুঃখ বিলাসের কারণ।

শ্রাবণ উঠে বসলো তৎক্ষণাৎ। এলোমেলো তাকিয়ে বলল
— মা আবার কেনো আসবে?

— তাহলে আমাকে বল। আমি মাকে ম্যানেজ করে নেবো। মা কিন্তু আসতেই চাইছিলো। আমিই আটকে দিয়েছি।

শ্রাবণ দৃষ্টি নত করে ফেললো। আহত কণ্ঠে বললো
— শুভ্রার জন্য ওর বাবা পাত্র দেখছে। যতদূর শুনলাম পছন্দ করে ফেলেছে। হয়তো খুব তাড়াতাড়ি শুনতে পাবো বিয়েও ঠিক হয়েছে।

হিমেল তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষণ। শ্রাবণের মুখের দিকে তাকাতেই তার কষ্ট হচ্ছে। সে খুব ভালোমত শ্রাবণের কষ্টটা উপলব্ধি করতে পারছে। কারণ কুমুকে ভালোবেসে ফেলার পর থেকে একদিনের জন্য হলেও এই যন্ত্রণাটা সে ভোগ করেছে। নিজের অজান্তেই এই মেয়েটা তার জীবনের অনেকটা দখল করে নিয়েছে। যদি কখনো হারিয়ে যায় তাহলে সে কোনভাবেই নিজেকে সামলে নিতে পারবে না। কুমুকে হারানোর কথা ভাবতেই হিমেলের ভেতরটা ভারী হয়ে উঠলো। সে খেয়াল করে দেখলো অল্প সময়ের ব্যবধানে তার শ্বাস কষ্ট হচ্ছে। শ্রাবণেরও হয়তো এমন হচ্ছে। সান্ত্বনা দিতে চায়না সে। ভাইয়ের জীবনটা গুছিয়ে দিতে চায়। ভাইকে এভাবে কষ্ট পেতে সে কোনভাবেই দেখতে পারবে না। হিমেল ঠোঁট গোল করে নিশ্বাস ছেড়ে বলল
— কি করবি কিছু ভেবেছিস?

শ্রাবণ জোরে নিশ্বাস ছাড়ল। আহত কণ্ঠে বললো
— ভাবার মতো কিছু নাই ভাইয়া। শুভ্রা আমাকে পছন্দ করে কিনা সেটাই আমি এখনো জানিনা। আর ওর বিয়ে কিভাবে আটকাবো।

— জানিস না মানে?

কিছুটা অবাক হয়ে প্রশ্নটা করলো হিমেল। কিন্তু পরক্ষণেই তার নিজের পরিস্থিতির কথা মনে পড়ে গেলো। সে তো নিজেই এখনো জানে না কুমু তাকে নিয়ে ঠিক কি ভাবে। বুঝতে পারে কুমুর মনে তার জন্য একটু হলেও অনুভূতি কাজ করে। কিন্তু সেটা শুধুই ভালোলাগা নাকি তার মতো ভালোবাসা সেটা এখনো নিশ্চিত নয়। শ্রাবণের অবস্থাটাও হয়তো তার মতই। তাই উত্তর দেয়ার আগেই প্রসঙ্গ পাল্টে ফেলে বলল
— জানিস না বলে চুপ করে বসে থাকলে তো বিয়ে ঠিক হবেই। কথা বল শুভ্রার সাথে। সে কি আদৌ বিয়েতে রাজি? নাকি জোর করে দিচ্ছে। শুভ্রার সাথে কথা না বলা পর্যন্ত কিছুই জানা যাবে না। তাই ওর ব্যাপারটা আগে জানতে হবে।

শ্রাবণ অসহায়ের মতো বলল
— কিন্তু কিভাবে? শুভ্রার সাথে আমি অনেকবার কথা বলার চেষ্টা করেছি। বারবার শুধু আমার উপরে রাগ করে। ওর আচরনে আমার কয়েকবার মনে হয়েছে একটু দুর্বলতা আছে। কিন্তু মুখে প্রকাশ করে না। এখন কি করতে পারি আমি।

হিমেল কপালে ভাঁজ ফেললো। গভীর ভাবনায় ডুবে গেলো সে। কিছুটা সময় নিয়ে ভেবে বলল
— আচ্ছা এমন কোন কমন ফ্রেন্ড নাই যার সাথে তোদের দুজনের ভালো সম্পর্ক। সেরকম কেউ থাকলে অন্তত শুভ্রার মনের কথাটা কিছুটা জানা যাবে।

হিমেল এর কথাটা শুনে শ্রাবণ একটুও সময় না নিয়ে বলল
— আছে না! ওই যে কুমু।

হিমেল ভ্রু কুঁচকে তাকাল। অস্পষ্ট স্বরে বলল
— কুমু?

শ্রাবণ লাফিয়ে উঠে বলল
— ভাইয়া তুমি যে আমার কি উপকার করলে বলে বোঝাতে পারবো না। যাই কুমুর সাথে কথা বলে আসি।

হিমেল ভাবনার মধ্য থেকেই আনমনে বলে উঠলো
— এখন ওকে পাবি না। বাসায় নেই।

শ্রাবণ থেমে ঘুরে তাকাল। অবাক কণ্ঠে বললো
— ভাইয়া তুমি?

হিমেল এর ধ্যান ভাঙলো। কিছুটা বিরক্ত হয়ে বলল
— আমি কি?

শ্রাবণ দাত কেলিয়ে হাসলো। বলল
— দেখছি কুমুর প্রতিটা কাজের আপডেট রাখো। তুমি যে এমন হবে আমি ভাবতেই পারছি না। প্রেমে পড়লে মানুষ কতো কিছু শিখে যায়। তোমার কাছ থেকে প্রতিটা প্রেমিকের অনেক কিছু শেখার আছে।

হিমেল নিজের উপরে বিরক্ত হলো। পরিস্থিতি সামাল দিতে বলল
— আমি ঠিক জানি না। কয়েকদিন এই সময় বাইরে যেতে দেখেছিলাম। তাই বললাম। তুই খোঁজ নিয়ে দেখ। আমি বললেই যে সেটা ঠিক হবে তা তো নয়।

শ্রাবণ এবার প্রশস্ত হাসলো। হাসি ঠোটের আগায় রেখেই বলল
— সেটা অন্যকারো কথা হলে আমি মেনে নিতাম। কিন্তু কুমুর ব্যাপারে তোমার কথা ভুল হবে সেটা মানতে পারছি না। যাই হোক। কুমু কখন ফিরবে সেটা জানো কি? তখন নাহয় কথা বলবো।

হিমেল কৃত্রিম রাগ দেখানোর চেষ্টা করে বলল
— আমি কি কুমুর পি এ? ওর যাওয়া আসার সব খবর রাখবো। যতটুকু চোখে পড়েছে সেটাই বললাম। এর বেশি আমি জানিনা।

শ্রাবণ দুর্বোধ্য হাসলো। কিন্তু তার সেই হাসির অর্থ হিমেলের বুঝতে কষ্ট হলো না। হিমেল বিরক্তিটা প্রকাশ করতেই শ্রাবণ কাছে এসে বসলো। হেসে ফেলে বলল
— ঝগড়া করেছো বুঝি?

বলেই শব্দ করে হেসে ফেললো। হাসতে হাসতে ক্লান্ত হয়ে বলল
— তুমি যে একটা মেয়ের সাথে ঝগড়া করতে পারো এটা আমি কোনভাবেই মানতে পারছি না ভাইয়া। কেমন আজব লাগছে। তোমার দিকে তাকালেই কেমন লজ্জা পাচ্ছি।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here