বালির নীচে জলের শব্দ পর্ব ৩০

0
1214

বালির নীচে জলের শব্দ
পর্ব ৩০

শহর ছেড়ে গ্রামের রাস্তায় এগিয়ে যাচ্ছে গাড়ি। শহরের মতো এদিকের রাস্তা তেমন প্রশস্ত নয়। তাই বেশ ধির গতিতেই চলতে হচ্ছে। রাস্তা ভাঙ্গা থাকায় মাঝে মাঝেই প্রচণ্ড ঝাকুনি হচ্ছে। এরকমই এক তীব্র ঝাকুনিতে হিমেলের ঘুম ভেঙ্গে গেলো। প্রচণ্ড বিরক্তি নিয়ে তাকাল। পাশেই রুশা মোবাইলে গভীর মনোযোগ দিয়ে কি যেন দেখছে। হিমেল জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল। বোঝার চেষ্টা করলো কোথায় আছে। কিন্তু কোনভাবেই বুঝতে পারলো না। ঘুম জড়ানো কণ্ঠে বলল
–আমরা এখন কোথায়?

রুশা ভ্রু জোড়ায় ভাঁজ ফেলে মোবাইলের স্ক্রিনে দৃষ্টি আবদ্ধ রেখেই বলল
–তকিপুরের কাছাকাছি চলে এসেছি। আর হয়তো হাফ আওয়ার এর মধ্যেই পৌঁছে যাবো।

হিমেল বিরক্তিতে আবারো চোখ বন্ধ করে ফেললো। সে রুশার উপর খুব বিরক্ত। কোথা থেকে কোন অনামিকা হাওলাদার রহস্যের খোলাসা করতে সাহায্য চেয়ে মেইল পাঠিয়েছে আর অমনি এই মেয়ে দৌড়ে চলে এলো গ্রামে। এখন গ্রামে বসে নাকি রহস্যের কিনারা খুজবে। এই মেয়ের মাথায় কঠিন সমস্যা আছে। নাহলে এমন সিদ্ধান্ত কেউ নেয়? মেইলের কোন সত্যতা যাচাই না করেই চলে এলো এতোদূর। এখন যদি কোনভাবে এখানে এসে জানতে পারে কেউ মজা করেছে। তাহলে হিমেল তাকে এখানেই হাত পা বেঁধে নদীতে ফেলে রেখে চলে যাবে। নিজের উপরে রাগ হচ্ছে এখন। বিদেশে গিয়ে এক আপদ নিয়ে দেশে ফিরল। কেন যে এক আস্ত পাগলকে সাথে নিয়ে আসলো। নিজের উপরে বিরক্তিটা আরও কিছুটা বেড়ে যেতেই গাড়ি থেমে গেলো। চোখ মেলে কিছু বুঝে ওঠার আগেই ড্রাইভার বলল
–এর আগে আর গাড়ি যাবে না ম্যাডাম। রাস্তা একেবারেই খারাপ।

হিমেল জানালা দিয়ে মাথা বের করে সামনে দেখার চেষ্টা করলো। সামনে যতদূর দেখা যাচ্ছে পানি ছাড়া আর কিছুই নেই। হিমেল কিছুটা উত্তেজিত হয়ে বলল
–রাস্তা কোথায়? এ তো সমুদ্র।

রুশা হেসে ফেললো। হিমেল তীক্ষ্ণ দৃষ্টি তার দিকে ফেলতেই থেমে বলল
–গাড়ি এখান থেকে আর যাবে না সেটা আমি জানি। আর এখান থেকে যাওয়ার ব্যাবস্থাও করে ফেলেছি। তুমি নিশ্চিন্তে থাকো। আমরা সময় মতোই পৌঁছে যাবো।

হিমেল গাড়ি থেকে নামতে নামতে বলল
–তোমার ব্যাবস্থার উপরে আমার কোন ভরসা নেই রুশা। তাই আমি নিজের ব্যাবস্থা নিজেই করে নেবো।

রুশা মুচকি হেসে বলল
–তোমাকে কষ্ট করতে হবে না। ঐ যে দেখো চলে এসেছে।

হিমেল পেছনে ঘুরে তাকাল। সেলিম অটো নিয়ে চলে এসেছে তাদেরকে নিয়ে যেতে। রুশা গাড়ি থেকে নেমে ড্রাইভারকে বলল
–লাগেজগুলো ওটাতে তুলে দাও। তোমার থাকার ব্যাবস্থা আলাদা করা হয়েছে। তুমি ওখানে গাড়িও রাখতে পারবে।

হিমেল চুপচাপ রুশার কাণ্ড দেখছে। পুরো প্ল্যান করে এসেছে এই মেয়ে। কে জানে এবার কি করবে। হতাশ শ্বাস ছাড়তেই সেলিম বলল
–আপনারা উঠে বসুন। আমি এগুলর ব্যাবস্থা করছি।

হিমেল কোন কথা না বলে উঠে বসলো। রুশা ড্রাইভারের সাথে প্রয়োজনীয় কিছু কথা বলে নিয়ে বসে পড়লো গাড়িতে। সেলিম সব অটোতে তুলে নিয়ে সেও উঠে বসলো। পানির মধ্য দিয়েই অটো চলতে শুরু করলো। হিমেল ভ্রু কুচকে রাস্তার দিকে দেখছে। রাস্তা দেখা যাচ্ছে না। সে খুব চিন্তিত। এর মধ্যে যদি রাস্তা ভেবে ড্রাইভার অন্যদিকে চলে যায় তাহলে অটো উল্টে পানিতে পড়ে যাবে। সেলিম হিমেলের চিন্তাটা ধরতে পারলো। বলল
–একটু বৃষ্টি হলেই এই রাস্তাটা পানিতে ডুবে যায়। তবে এখানকার অটো ভ্যানের চালকদের রাস্তাটা মুখস্ত। তাই অসুবিধা হয়না।

হিমেল বিরক্তিকর কণ্ঠে বলল
–এই রাস্তা ঠিক করা হয়না কেন? এর জন্য তো গ্রামের মানুষের অনেক কষ্ট হয়। চেয়ারম্যান এসবের গুরুত্ব দেয়না কেন?

সেলিম কিছুটা অপ্রস্তুত হয়েই বলল
–আসলে আমিই এই গ্রামের চেয়ারম্যান। আমি চেষ্টা করছি বিষয়টা সমাধান করার। রাস্তার ব্যাপারটা আমরা মন্ত্রনালয়ে জানিয়েছি। তবে এই মুহূর্ত আমি বিদ্যুৎ সংযোগের উপরে গুরুত্ব দিচ্ছি বেশী। সেটা হয়ে গেলেই এটা নিয়ে উঠে পড়ে লেগে যাবো।

হিমেল সেলিমকে আপাদমস্তক দেখে নিলো। এতো কম বয়সী চেয়ারম্যান সে আগে কখনো দেখেনি। হুট করেই বিদ্যুৎ সংযোগের কথা মনে পড়তেই বলল
–গ্রামে কি বিদ্যুৎ নেই?

–না। এখনো সংযোগ হয়নি। তবে কাজ চলছে। শীঘ্রই হয়ে যাবে।

–বিদ্যুৎ নেই মানে? লোকজন থাকে কিভাবে? বিদ্যুৎ ছাড়া তাদের কাজ কর্ম হয় কিভাবে? এখন তো সব কিছু বিদ্যুতের উপরেই নির্ভর করে।

সেলিম হতাশ কণ্ঠে বলল
–আসলে সমস্যা যে শুধু বিদ্যুৎ নিয়ে সেটাও নয়। ভেতরে অনেক সমস্যা আছে। সেসব নিয়ে কথা বলতেই আপনাদের আসতে বলা। এসে পড়েছেন যখন সব জানতে পারবেন। এখনো গ্রামের উন্নতি না হওয়ার পেছনে মুলত গ্রামের মানুষের কু’সংস্কার দায়ী। আর সেটার সুযোগ নিয়েই কিছু অ’সাধু লোকজন অ’নৈতিক কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে। তাদের প্ররোচনায় গ্রাম এগিয়ে যেতে পারছে না। এগিয়ে গেলেই তাদের অসুবিধায় পড়তে হবে। আমার বাবা এই গ্রামের চেয়ারম্যান ছিলেন। তিনিই আমাকে এই দায়িত্ব সপে দেন যাতে আমি নিজের বিদ্যা বুদ্ধি কাজে লাগিয়ে উন্নতি করতে পারি।

হিমেল মনোযোগ দিলো। কৌতূহলী হয়ে প্রশ্ন করলো
–কি ধরনের অ’পক’র্ম চলে এখানে?

–কি চলেনা সেটা বলেন? খু’ন ধ’র্ষ’ণের মতো জ’ঘন্য কাজও এই গ্রামে হয়। আর চো’রাচা’লানের কথা বাদ দিলাম।

হিমেলের ভ্রু জোড়ায় ভাঁজ পড়লো। চিন্তিত হয়ে বলল
–স্ট্রেঞ্জ! এই রিমোট এরিয়ায় এমন জ’ঘন্য কাজ সম্ভব? আচ্ছা এসব কারা করে?

–আমি বাইরে থেকে পড়াশোনা করেছি তাই তেমন কিছুই জানিনা। তবে আমার মনে হয় গ্রামের অনেকেই জানেন। মুখ খুলতে ভ’য় পায়। তাই আপাতত সবকিছু অজানা ধরেই এগোতে হচ্ছে। আর এমন অনুন্নত গ্রাম বলেই প্র’শাস’নের খুব একটা হস্তক্ষেপ পাওয়া যায়না।

রুশা এতক্ষন ফোনের দিকে তাকিয়ে ছিল। সব কথাই সে শুনেছে। সেলিমকে জিজ্ঞেস করলো
–অনামিকা হাওলাদার কে? ওনার মেইলে বলেছেন যে দুইদিন আগে নাকি একটা খু’ন হয়েছে। মে’রে’ ফেলার আগে মে’য়েটাকে নাকি রে’প করা হয়েছিলো।

সেলিম ঠোঁট জোড়া ভাঁজ করে একটা শ্বাস ছাড়ল। নিচের দিকে তাকিয়ে বলল
–আমার স্ত্রী। উনিই মেইল করেছিলেন আপনাদের। ঠিকই বলেছেন। মেয়েটা অনেক ভ’দ্র ছিল। ওর সাথে এমন ঘটনা আসলেই অপ্র’ত্যা’শিত।

রুশা গভীর দৃষ্টিতে তাকাল সেলিমের দিকে। কিছু একটা আন্দাজ করে ফেললো তৎক্ষণাৎ। কিন্তু নিজের মুখভঙ্গি স্বাভাবিক রেখেই বলল
–মেয়েটার নাম কি ছিল? ওর ডিটেইল টা যদি একটু বলতেন। তাহলে আমার জন্য বুঝতে সুবিধা হতো।

–আসলে ওর বাড়ির লোকজন ঠিক মতো কিছুই বলতে পারছে না। রাতে নাকি একা একা বাড়ি থেকে বের হয়ে যায়। তারপর আর খুঁজে পাওয়া যায় না। সকালে লা’শ’ পাওয়া যায় শালবনে।

রুশা কিছুক্ষন ভেবে বলল
–রাতে গ্রামের মেয়ে একা বাইরে যাওয়ার দুটো কারণ থাকতে পারে। হয়তো ওয়াশরুমের কোন সুব্যাবস্থা নেই। অথবা কারো সাথে দেখা করতে যেতে পারে।

কথাটা শুনেই সেলিমের ঝুমের কথা মনে পড়ে গেলো। সে বলেছিল শামিমের সাথে দেখা করতে গিয়েছিল। রুশাও একই রকমের আন্দাজ করছে। তাহলে কি সত্যি? তার ভাবনার মাঝেই এসে পৌঁছল তারা। অটো থেকে নামার আগে সেলিম কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে বলল
–একটা কথা আপনাদের একটু বলে দিতে চাই। আমি বলেছি শহর থেকে আমার এক বন্ধু আর তার স্ত্রী আসছে বেড়াতে। তাই আপনাদেরও নিজেদের স্বামী স্ত্রীর পরিচয় দিতে হবে গ্রামবাসীদের কাছে।

হিমেল আঁতকে উঠে বলল
–হোয়াট? স্বামী স্ত্রী মানে?

রুশা শুকনো ঢোক গিলে ফেললো। এমনিতেই হিমেলকে এক রকম জোর করে এনেছে। তার উপর আবার এই স্বামী স্ত্রীর নাটকের ব্যাপারটা বাড়াবাড়ি হয়ে গেলো। হিমেল তাকে আস্ত রাখবে না। হিমেল তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রুশার দিকে ফেলতেই সে অসহায়ের মতো তাকাল। হিমেল রাগে ফুঁসছে। তার মন চাচ্ছে এখনই এখান থেকে চলে যেতে। রেগে অটো থেকে নেমে গেলো সে। রুশা শুকনো ঢোক গিলে তার পেছন পেছন চলে গেলো। সেলিম নামতেই মতি মেম্বার এসে দাঁড়ালো। এক গাল হেসে বলল
–আইছেন বাজান। আমি মেহমানদের ব্যবস্থা কইরা দিছি। কোন সমস্যা হইব না।

সেলিম মৃদু হেসে বাড়ির দিকে পা বাড়াতেই আবার থেমে গেলো। ঘুরে থমথমে কণ্ঠে বলল
–মেম্বার চাচা শামিম কোথায়?

শামিমের কথা হুট করেই জিজ্ঞেস করায় মেম্বার কিছুটা হকচকাল। কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে মৃদু সরে বলল
–হেয় তো শহরে গেছে বাজান। কইছিলাম না চাকরি পাইছে। অইহানেই নাকি থাইকা যাইবে। এইহানে আর আইতে চায়না।

সেলিম উত্তর না দিয়ে চলে গেলো। মেম্বার স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সেলিমের দিকে। সেলিমের প্রশন করার ভঙ্গী মতি মেম্বারের কপালে ভাঁজ ফেলে দিলো। এভাবে প্রশ্ন করার কারণটা ঠিক কি হতে পারে?

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here