চুপকথারা_বিষন্ন পর্ব-১৩

0
4012

#চুপকথারা_বিষন্ন
#জেরিন_আক্তার_নিপা
|পর্ব ১৩|

চোখ না খুলেই নীড় অনুভব করল মাথাটা ছিড়ে যাচ্ছে তার। কী ভীষণ ব্যথা! একটু নড়তেই বুঝতে পারল কেউ একজন তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রেখেছে। ছোট্ট নরম একটা হাত তার বুকের উপর। নীড় চোখ খুলে তাড়াহুড়ো করে উঠতে নিলে দেখল পিচ্চি একটা ছেলে তার বুকের সাথে মিশে কত আরামে ঘুমচ্ছে। কে এই ছেলে? তারই বেডরুম তো এটা? নাকি ভুল করে অন্য কারো রুমে চলে এসেছে। আসতেও পারে। বলা যায় না। নীড় চোখ ঘুরিয়ে ঘরটা দেখল।

-উঁহু। এটা তো আমারই রুম। কোথাও ভুল হচ্ছে না আমার। তাহলে এই ছেলেটা কে?’

নীড় ঘুমন্ত ছেলেটাকে আবার দেখল। বয়স কত হবে ওর? চার/পাঁচ? হ্যাঁ, বড়জোর পাঁচ। এই ছেলের মুখটা চেনা চেনা লাগছে। অথচ নীড় একে আজকের আগে কখনও দেখেনি।

-আজব কারবার! অচেনা অজানা একটা ছেলে আমার রুমে, আমার বেডে, আমাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে আছে! কে এই বাচ্চা? কোত্থেকে এলো এ? কে নিয়ে এসেছে?’

নীড় আকাশ পাতাল ভেবেও কোন কূলকিনারা পেলো না। কে হতে পারে ও। যাক তারপরও স্বস্তি। প্রথমে সে অন্য কিছুই ভেবে নিয়েছিল। ভয়ও পেয়েছিল ভীষণ। তার ঘরে যে অন্য একজন থাকছে এটা মাথায় আসার পর এক মুহূর্তের জন্য মাথা হ্যাং হয়ে গিয়েছিল। চোখ খুলে ওকে না দেখে জীবন বাঁচল। এমনিতেই নাহিদ চৌধুরীর ফাঁদে পা দিয়ে বিয়ে করাই ছিল সবচে বড় সর্বনাশ। এর থেকে বড় সর্বনাশ হওয়ার আগে নিজেকে সামলাতে হবে। মদ খেলেও আর মাতাল হওয়া যাবে না।

-আর মদ খেয়ে ফেরা যাবে না। মাতালের সাথে কোন বিশ্বাস নেই।’

কথা দু’হাত মাথার পিছনে নিয়ে খোঁপা করতে করতে দরজা দিয়ে ঢুকল। নীড়কে জেগে বসে থাকতে দেখে বলল,

-ঘুম ভেঙেছে তাহলে আপনার! বাবা গো বাবা! কী ভারী ঘুম।’

নীড়ের কানে মেয়েটার কোন কথা ঢুকলে তো! তার চোখ কথার ফর্সা কোমল পেটে আটকে আছে। কথা নীড়ের দৃষ্টি লক্ষ করে তাড়াহুড়ো করে হাত নামিয়ে নিয়ে শাড়ি ঠিক করল। কী লুচু মানুষ! কীভাবে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে থাকে!
নীড় নিজেকে কড়াভাবে শাসন করলো। মনে মনে বলল,

-কী হচ্ছে এসব? চোখের উপর কন্ট্রোল নেই কেন তোর? পরের বার থেকে এমন কিছু হলে আমি তোর দু’টা চোখই কানা করে দিব নীড়।’

গলা খাঁকারি দিল নীড়। কন্ঠস্বর কঠিন করল।

-এই ছেলেটা কে?’

-আমার ভাই। আস্তে কথা বলুন। জেগে যাবে ও।’

নীড় পুঁচকে ছেলেটাকে দেখল। এই পিচ্চি ওর শালা! মুখ ফসকে জোরেই বলে ফেলল ও।

-শালা!’

কথা ভেবেছে নীড় ওর ভাইকে গালি দিচ্ছে। দুনিয়ার যে কেউই হোক না কেন? কথা তার ভাইয়ের অপমান একদম সহ্য করবে না। একটু তো জড়িয়ে ধরে শুয়েই আছে। তাই বলে গালি দিবে। কথা চোখে আগুন নিয়ে ঝাঁঝালো গলায় বলল,

-এই খবরদার! আমার ভাইকে একদম গালি দিবেন না। এতটুকু বাচ্চা, ও আপনাকে কী করেছে? গালি দিচ্ছেন কেন?’

নীড় থতমত খেয়ে গেল। গালি কখন দিল সে। কথাকে এতটা সিরিয়াস হয়ে উঠতে দেখে নীড় আপনাতেই দমে গেল। কথার ভুল ভাঙাতে তাড়াহুড়ো করে বলে উঠল,

-গালি দিইনি। ও তোমার ভাই হলে সম্পর্কে আমার শালাবাবু হবে। সেটাই বললাম আরকি। শালা! গালি দিইনি বিশ্বাস করো।’

কথা কিছুটা শান্ত হলো। আসলে তারই বুঝতে ভুল হয়েছে। নীড় কেন শুধু শুধু তার ভাইকে গালি দিবে? কথাই পাগল। উল্টাপাল্টা ভেবে বসে থাকে।

-আচ্ছা ঠিক আছে। তবে ওকে এভাবে শালাও বলবেন না। শুনতে যেন কেমন লাগে।’

-হু।’

-কাল রাতে আপনার কী হয়েছিল? ওরকম করছিলেন কেন? মতিন চাচা ধরে নিয়ে এসে ঘরে দিয়ে গেল। দরজার সামনে দুই বার পড়ে গেছেন। ব্যথা পাননি?’

নীড় কথা ঘুরিয়ে নিল। মদ খেয়ে এসেছিল এটা বলে দিলেই হয়। তবুও কেনই যেন বলল না।

-তোমার ভাই কবে এসেছে?’

-আমি বাড়ি গিয়েছিলাম না, আসার সময় ওকে নিয়ে এসেছি। ও এখনও আপনাকে ভালো ভাবে চিনে না। আপনার জন্য অপেক্ষা করতে করতে রাতে ঘুমিয়ে পড়েছে।’

-হু। ওকে কি এখন একটু সরাবে? আমি উঠব।’

কথা ঘুমন্ত ভাইকে দেখে হাসতে লাগল। নীড় কপাল কুঁচকে ওকে দেখছে। মেয়েটা স্বাভাবিক না। কখন কোন কারণে হাসে, রাগ করে কিছুই বলা যায় না। নীড় জিজ্ঞেস করল,

-হাসছো কেন?’

-দুলাভাই শালার ভাব দেখে হাসছি। কত সুন্দর করে দু’জন দু’জনকে জড়িয়ে ধরে রাতে নাক ডেকে ঘুমিয়েছেন। ওইদিকে আমার ঘুম হারাম করেছেন।’

নীড় বিস্ময়ের চূড়ান্ত পর্যায়ে চলে গেছে। অবিশ্বাস্য গলায় সে প্রতিবাদ করে বলল,

-আমি নাক ডেকে ঘুমাই! অসম্ভব!’

কথাও কম না। তর্ক করতেই থাকল। মুখ মুচড় দিয়ে বলল,

-উহহ আপনি নাক ডাকেন না! ট্রাক চালানোর মত ঘড়ঘড় খড়খড় শব্দ হয়। আপনার নাক ডাকার শব্দ শুনে তিন এলাকার মানুষের ঘুম ভেঙে যাবে।’

নীড় রাগে চেঁচিয়ে উঠল। সাহস কত এই মেয়ের!

-এই মেয়ে, এই। চুপ। আর একটা কথা বললে খবর আছে।’

কথা তো ভয় পেলো না-ই উল্টো নীড়কে চোখ পাকিয়ে বলল,

-শশশ.. পলাশ উঠে যাবে। এভাবে চেঁচাচ্ছেন কেন আজব! সত্য কথা তেতো হয়। হজম করতে শিখুন, বুঝলেন।’

নীড় হতবুদ্ধি। এটা তো তার কথা। সে নাহিদ চৌধুরীকে সব সময় এই কথাটা বলে। এই মেয়ে তার কথা চুরি করলো কীভাবে? নিজের বলা কথা এখন নিজেকেই শুনতে হচ্ছে!
————————-
কথার কলেজ তো খোলা ঠিকই কিন্তু সে বিয়ের পর থেকে এখন পর্যন্ত একদিনও কলেজে যায়নি। বাবা তাকে বইটই নিয়ে আসতে বলেছে ঠিক। কিন্তু কলেজে কবে থেকে যাবে এটা বলেনি।
পলাশ নীড়ের কুকুরটার সাথে খেলছে। কথা অবাক না হয়ে পারল না। এই কুত্তা তাকে দেখতে পারে না। অথচ তার ভাইয়ের সাথে কত খাতির হয়ে গেল।

-বজ্জাত কুত্তা!’

নীড় গোসল সেরে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়েছে। আলমারি খুলে শার্ট খুঁজছে। কোথাও বেরুবে সে। আজকের অর্ধেক দিনটা বাড়িতেই কেটেছে তার।
কথার এক অভ্যাস সে হুটহাট ঘরে চলে আসে। এখনও এসে নীড়কে খালি গায়ে দেখে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে রইল। নীড় কথাকে তার দিকে ওভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে কিছুটা অপ্রস্তুত হলো। এই মেয়ের মত আরেক পিস নীড় এখন পর্যন্ত দেখেনি। ধমক দিলেও ভয় পায় না। উল্টো চোট দেখায়।
নীড় কর্কশ গলায় বলল,

-তুমি এখানে কী করো?’

নীড়ের কথা কানে গেলেও কথা চোখ ফিরালো না। ওভাবে চেয়ে থেকেই বলল,

-কোথাও যাচ্ছেন আপনি?’

-তা জেনে তোমার কাজ কী? নিজের কাজ করো তুমি।’

-আমার আর কাজ! বেকার মানুষের দিন কীভাবে কাটে তা আপনি কী করে বুঝবেন? অবশ্য বুঝতেও পারেন। কারণ আপনিও তো বেকার।’

নীড়ের চোখ কপালে উঠল। আজকের আগে কেউ তাকে এভাবে মুখের উপর বেকার বলেনি। তার সাথে এরকম করে কথা বলার সাহস এই বাড়িতে কারো নেই। অথচ এই মেয়ে নিঃসংকোচে বলে ফেলল।

-আমি বেকার!’

-হু, আপনি তারপরও বাইরে গিয়ে বন্ধু বান্ধব নিয়ে আড্ডা মেরে সময় কাটাতে পারেন। আমি বেচারি চব্বিশ ঘণ্টা ঘরে বসে থাকি। করার কিছু নেই। কলেজে যেতে পারলে অবশ্য দিন কাটতো।’

নীড় রেগেই বলল,

-তো তুমি কলেজে যাচ্ছ না কেন? কে নিষেধ করেছে?’

-যেতে বলছেন?’

-তোমার মন চাইলে যাবে। আমার বলার কী আছে?’

কথা ফোঁস করে দম ফেলল।

-হুহ্, আপনি কী বুঝবেন? মেয়েদের কত নিয়মকানুন, বিধিনিষেধ মানতে হয়। আপনি তো আর মেয়ে না। যখন খুশি ঘুরতে যেতে পারেন কারো অনুমতি লাগে না। আমি এই বাড়ির বউ। কোথাও যেতে হলে শ্বশুর আব্বার অনুমতি লাগবে। আপনার অনুমতি লাগবে। আমার নিজের ইচ্ছেতে কিছু হবে না।’

মেয়েটার কথা শুনে নীড়ের মনে হচ্ছে ছেলে হয়ে জন্ম নিয়ে সে অপরাধ করে ফেলল নাকি? ছেলে হওয়া নিয়ে এই মেয়ে তাকে কেমন খোঁচা মেরে কথা বলছে।

-তোমার কারো কাছ থেকে অনুমতি নিতে হবে না। আজকের পর থেকে যেখানে খুশি চলে যেও। আমি তোমাকে কিছুই বলব না।’

-জানি এই কথা শুধু মুখে মুখেই বলছেন। কাজের বেলা পল্টি খাবেন।’

-এই মেয়ে তোমার সমস্যা কি হ্যাঁ? কোন কথা, কোন বিষয় তুমি সহজ ভাবে নিতে পারো না কেন? এই বয়সেই তোমার মাথায় এত প্যাঁচ কেন? সহজ ভাবে এক কথা বললেও তার একশো মানে বের করো।’

নীড় শার্ট প্যান্ট পরে রেডি হয়ে গেছে। চুল আঁচড়ে নিয়ে বেরিয়ে যেতে নিচ্ছিল সে। এই মেয়ের সাথে কথা বললে মেজাজ ঠিক রাখা বড় কঠিন। ত্যাড়া ত্যাড়া কথা বলা এর অভ্যাস মনে হয়। কথা পেছন থেকে নীড়কে ডেকে থামাল।

-শুনুন, আপনার ওই পাগলা কুত্তাটাকে কি বেঁধে রাখা যায় না? আমাকে দেখলেই কামড়াতে আসে। আমার ভয় লাগে।’

‘পাগলা কুত্তা!’ তার জ্যাকি পাগলা কুত্তা! নীড় ঝট করে পেছন ফিরে দুই লাফে কথার সাথে চলে এলো। আগুন চোখে রেগেমেগে কথার দিকে ঝুঁকে এসে চিৎকার করে বলতে লাগল,

-আবার তুমি আমার জ্যাকিকে কুত্তা বলেছ! এইবার শুধু কুত্তা না, তুমি ওকে পাগলা কুত্তা বলেছ! ওর নাম জ্যাকি। বস্তির মত বারবার ওকে কুত্তা বলবে না। আর একবার তোমার মুখে কুত্তা ডাক শুনলে আমি মেরে তোমাকেই কুত্তা বানিয়ে দেব। বুঝেছ?’

কথা নীড়ের লাল হয়ে যাওয়া চোখের দিকে চেয়ে ভয়ে ভয়ে বলল,

-হুম বুঝেছি।’

-কী বুঝেছ বলো।’

-ওর নাম জ্যাকি। ও কুত্তা না। আমাদের মত মানুষ। ওকে কুত্তা বললে আপনি আমাকে মেরে কুত্তা বানিয়ে দিবেন। আমি কুত্তা হওয়ার পর হয়তো আমাকে খাবারও দিবেন না।’

কথার আবোলতাবোল কথা শুনে নীড় ফোস করে হেসে ফেলল। সব রাগ উধাও হয়ে গেছে ওর। কথার গোবেচারা মুখের দিকে তাকিয়ে হাসতেই আছে। নীড়কে হঠাৎ হাসতে দেখে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল কথা। এসবের মাঝেও কথা একটা জিনিস লক্ষ করল নীড়ের হাসিটা বেশ সুন্দর। কোন পুরুষমানুষকে কখনও এত সুন্দর করে হাসতে দেখেনি কথা। সোহান ভাইয়ের হাসিও সুন্দর। তবে এনার থেকে বেশি না।
নীড় কোনভাবেই হাসি থামাতে পারছে না। দু’হাত কোমরে রেখে ঠোঁট কামড়ে হাসছে আর বলছে।

-জ্যাকি কুত্তা না, ও আমাদের মত মানুষ! জ্যাকি মানুষ! অহ গড! চোখে পানি এসে গেল। পাগল মেয়ে জ্যাকিকে মানুষ বলছে!’

কথা নীড়কে দেখতে দেখতেই মুখ ফসকে আনমনে বলে ফেলল,

-আপনার হাসি অনেক সুন্দর। আপনাকে হাসতে দেখলে অজান্তেই দুই তিনটা হার্টবিট মিস হয়ে যায়।’

ওর কথা শুনে নীড় সঙ্গে সঙ্গে চুপ হয়ে গেল। ভ্রু কুঁচকে কথাকে দেখছে সে। মুখের উপর এরকম সরল স্বীকারোক্তি শুনে অভ্যস্ত নয় সে।

চলবে🌸

#চুপকথারা_বিষন্ন
#জেরিন_আক্তার_নিপা
|পর্ব ১৩|

চোখ না খুলেই নীড় অনুভব করল মাথাটা ছিড়ে যাচ্ছে তার। কী ভীষণ ব্যথা! একটু নড়তেই বুঝতে পারল কেউ একজন তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রেখেছে। ছোট্ট নরম একটা হাত তার বুকের উপর। নীড় চোখ খুলে তাড়াহুড়ো করে উঠতে নিলে দেখল পিচ্চি একটা ছেলে তার বুকের সাথে মিশে কত আরামে ঘুমচ্ছে। কে এই ছেলে? তারই বেডরুম তো এটা? নাকি ভুল করে অন্য কারো রুমে চলে এসেছে। আসতেও পারে। বলা যায় না। নীড় চোখ ঘুরিয়ে ঘরটা দেখল।

-উঁহু। এটা তো আমারই রুম। কোথাও ভুল হচ্ছে না আমার। তাহলে এই ছেলেটা কে?’

নীড় ঘুমন্ত ছেলেটাকে আবার দেখল। বয়স কত হবে ওর? চার/পাঁচ? হ্যাঁ, বড়জোর পাঁচ। এই ছেলের মুখটা চেনা চেনা লাগছে। অথচ নীড় একে আজকের আগে কখনও দেখেনি।

-আজব কারবার! অচেনা অজানা একটা ছেলে আমার রুমে, আমার বেডে, আমাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে আছে! কে এই বাচ্চা? কোত্থেকে এলো এ? কে নিয়ে এসেছে?’

নীড় আকাশ পাতাল ভেবেও কোন কূলকিনারা পেলো না। কে হতে পারে ও। যাক তারপরও স্বস্তি। প্রথমে সে অন্য কিছুই ভেবে নিয়েছিল। ভয়ও পেয়েছিল ভীষণ। তার ঘরে যে অন্য একজন থাকছে এটা মাথায় আসার পর এক মুহূর্তের জন্য মাথা হ্যাং হয়ে গিয়েছিল। চোখ খুলে ওকে না দেখে জীবন বাঁচল। এমনিতেই নাহিদ চৌধুরীর ফাঁদে পা দিয়ে বিয়ে করাই ছিল সবচে বড় সর্বনাশ। এর থেকে বড় সর্বনাশ হওয়ার আগে নিজেকে সামলাতে হবে। মদ খেলেও আর মাতাল হওয়া যাবে না।

-আর মদ খেয়ে ফেরা যাবে না। মাতালের সাথে কোন বিশ্বাস নেই।’

কথা দু’হাত মাথার পিছনে নিয়ে খোঁপা করতে করতে দরজা দিয়ে ঢুকল। নীড়কে জেগে বসে থাকতে দেখে বলল,

-ঘুম ভেঙেছে তাহলে আপনার! বাবা গো বাবা! কী ভারী ঘুম।’

নীড়ের কানে মেয়েটার কোন কথা ঢুকলে তো! তার চোখ কথার ফর্সা কোমল পেটে আটকে আছে। কথা নীড়ের দৃষ্টি লক্ষ করে তাড়াহুড়ো করে হাত নামিয়ে নিয়ে শাড়ি ঠিক করল। কী লুচু মানুষ! কীভাবে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে থাকে!
নীড় নিজেকে কড়াভাবে শাসন করলো। মনে মনে বলল,

-কী হচ্ছে এসব? চোখের উপর কন্ট্রোল নেই কেন তোর? পরের বার থেকে এমন কিছু হলে আমি তোর দু’টা চোখই কানা করে দিব নীড়।’

গলা খাঁকারি দিল নীড়। কন্ঠস্বর কঠিন করল।

-এই ছেলেটা কে?’

-আমার ভাই। আস্তে কথা বলুন। জেগে যাবে ও।’

নীড় পুঁচকে ছেলেটাকে দেখল। এই পিচ্চি ওর শালা! মুখ ফসকে জোরেই বলে ফেলল ও।

-শালা!’

কথা ভেবেছে নীড় ওর ভাইকে গালি দিচ্ছে। দুনিয়ার যে কেউই হোক না কেন? কথা তার ভাইয়ের অপমান একদম সহ্য করবে না। একটু তো জড়িয়ে ধরে শুয়েই আছে। তাই বলে গালি দিবে। কথা চোখে আগুন নিয়ে ঝাঁঝালো গলায় বলল,

-এই খবরদার! আমার ভাইকে একদম গালি দিবেন না। এতটুকু বাচ্চা, ও আপনাকে কী করেছে? গালি দিচ্ছেন কেন?’

নীড় থতমত খেয়ে গেল। গালি কখন দিল সে। কথাকে এতটা সিরিয়াস হয়ে উঠতে দেখে নীড় আপনাতেই দমে গেল। কথার ভুল ভাঙাতে তাড়াহুড়ো করে বলে উঠল,

-গালি দিইনি। ও তোমার ভাই হলে সম্পর্কে আমার শালাবাবু হবে। সেটাই বললাম আরকি। শালা! গালি দিইনি বিশ্বাস করো।’

কথা কিছুটা শান্ত হলো। আসলে তারই বুঝতে ভুল হয়েছে। নীড় কেন শুধু শুধু তার ভাইকে গালি দিবে? কথাই পাগল। উল্টাপাল্টা ভেবে বসে থাকে।

-আচ্ছা ঠিক আছে। তবে ওকে এভাবে শালাও বলবেন না। শুনতে যেন কেমন লাগে।’

-হু।’

-কাল রাতে আপনার কী হয়েছিল? ওরকম করছিলেন কেন? মতিন চাচা ধরে নিয়ে এসে ঘরে দিয়ে গেল। দরজার সামনে দুই বার পড়ে গেছেন। ব্যথা পাননি?’

নীড় কথা ঘুরিয়ে নিল। মদ খেয়ে এসেছিল এটা বলে দিলেই হয়। তবুও কেনই যেন বলল না।

-তোমার ভাই কবে এসেছে?’

-আমি বাড়ি গিয়েছিলাম না, আসার সময় ওকে নিয়ে এসেছি। ও এখনও আপনাকে ভালো ভাবে চিনে না। আপনার জন্য অপেক্ষা করতে করতে রাতে ঘুমিয়ে পড়েছে।’

-হু। ওকে কি এখন একটু সরাবে? আমি উঠব।’

কথা ঘুমন্ত ভাইকে দেখে হাসতে লাগল। নীড় কপাল কুঁচকে ওকে দেখছে। মেয়েটা স্বাভাবিক না। কখন কোন কারণে হাসে, রাগ করে কিছুই বলা যায় না। নীড় জিজ্ঞেস করল,

-হাসছো কেন?’

-দুলাভাই শালার ভাব দেখে হাসছি। কত সুন্দর করে দু’জন দু’জনকে জড়িয়ে ধরে রাতে নাক ডেকে ঘুমিয়েছেন। ওইদিকে আমার ঘুম হারাম করেছেন।’

নীড় বিস্ময়ের চূড়ান্ত পর্যায়ে চলে গেছে। অবিশ্বাস্য গলায় সে প্রতিবাদ করে বলল,

-আমি নাক ডেকে ঘুমাই! অসম্ভব!’

কথাও কম না। তর্ক করতেই থাকল। মুখ মুচড় দিয়ে বলল,

-উহহ আপনি নাক ডাকেন না! ট্রাক চালানোর মত ঘড়ঘড় খড়খড় শব্দ হয়। আপনার নাক ডাকার শব্দ শুনে তিন এলাকার মানুষের ঘুম ভেঙে যাবে।’

নীড় রাগে চেঁচিয়ে উঠল। সাহস কত এই মেয়ের!

-এই মেয়ে, এই। চুপ। আর একটা কথা বললে খবর আছে।’

কথা তো ভয় পেলো না-ই উল্টো নীড়কে চোখ পাকিয়ে বলল,

-শশশ.. পলাশ উঠে যাবে। এভাবে চেঁচাচ্ছেন কেন আজব! সত্য কথা তেতো হয়। হজম করতে শিখুন, বুঝলেন।’

নীড় হতবুদ্ধি। এটা তো তার কথা। সে নাহিদ চৌধুরীকে সব সময় এই কথাটা বলে। এই মেয়ে তার কথা চুরি করলো কীভাবে? নিজের বলা কথা এখন নিজেকেই শুনতে হচ্ছে!
————————-
কথার কলেজ তো খোলা ঠিকই কিন্তু সে বিয়ের পর থেকে এখন পর্যন্ত একদিনও কলেজে যায়নি। বাবা তাকে বইটই নিয়ে আসতে বলেছে ঠিক। কিন্তু কলেজে কবে থেকে যাবে এটা বলেনি।
পলাশ নীড়ের কুকুরটার সাথে খেলছে। কথা অবাক না হয়ে পারল না। এই কুত্তা তাকে দেখতে পারে না। অথচ তার ভাইয়ের সাথে কত খাতির হয়ে গেল।

-বজ্জাত কুত্তা!’

নীড় গোসল সেরে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়েছে। আলমারি খুলে শার্ট খুঁজছে। কোথাও বেরুবে সে। আজকের অর্ধেক দিনটা বাড়িতেই কেটেছে তার।
কথার এক অভ্যাস সে হুটহাট ঘরে চলে আসে। এখনও এসে নীড়কে খালি গায়ে দেখে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে রইল। নীড় কথাকে তার দিকে ওভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে কিছুটা অপ্রস্তুত হলো। এই মেয়ের মত আরেক পিস নীড় এখন পর্যন্ত দেখেনি। ধমক দিলেও ভয় পায় না। উল্টো চোট দেখায়।
নীড় কর্কশ গলায় বলল,

-তুমি এখানে কী করো?’

নীড়ের কথা কানে গেলেও কথা চোখ ফিরালো না। ওভাবে চেয়ে থেকেই বলল,

-কোথাও যাচ্ছেন আপনি?’

-তা জেনে তোমার কাজ কী? নিজের কাজ করো তুমি।’

-আমার আর কাজ! বেকার মানুষের দিন কীভাবে কাটে তা আপনি কী করে বুঝবেন? অবশ্য বুঝতেও পারেন। কারণ আপনিও তো বেকার।’

নীড়ের চোখ কপালে উঠল। আজকের আগে কেউ তাকে এভাবে মুখের উপর বেকার বলেনি। তার সাথে এরকম করে কথা বলার সাহস এই বাড়িতে কারো নেই। অথচ এই মেয়ে নিঃসংকোচে বলে ফেলল।

-আমি বেকার!’

-হু, আপনি তারপরও বাইরে গিয়ে বন্ধু বান্ধব নিয়ে আড্ডা মেরে সময় কাটাতে পারেন। আমি বেচারি চব্বিশ ঘণ্টা ঘরে বসে থাকি। করার কিছু নেই। কলেজে যেতে পারলে অবশ্য দিন কাটতো।’

নীড় রেগেই বলল,

-তো তুমি কলেজে যাচ্ছ না কেন? কে নিষেধ করেছে?’

-যেতে বলছেন?’

-তোমার মন চাইলে যাবে। আমার বলার কী আছে?’

কথা ফোঁস করে দম ফেলল।

-হুহ্, আপনি কী বুঝবেন? মেয়েদের কত নিয়মকানুন, বিধিনিষেধ মানতে হয়। আপনি তো আর মেয়ে না। যখন খুশি ঘুরতে যেতে পারেন কারো অনুমতি লাগে না। আমি এই বাড়ির বউ। কোথাও যেতে হলে শ্বশুর আব্বার অনুমতি লাগবে। আপনার অনুমতি লাগবে। আমার নিজের ইচ্ছেতে কিছু হবে না।’

মেয়েটার কথা শুনে নীড়ের মনে হচ্ছে ছেলে হয়ে জন্ম নিয়ে সে অপরাধ করে ফেলল নাকি? ছেলে হওয়া নিয়ে এই মেয়ে তাকে কেমন খোঁচা মেরে কথা বলছে।

-তোমার কারো কাছ থেকে অনুমতি নিতে হবে না। আজকের পর থেকে যেখানে খুশি চলে যেও। আমি তোমাকে কিছুই বলব না।’

-জানি এই কথা শুধু মুখে মুখেই বলছেন। কাজের বেলা পল্টি খাবেন।’

-এই মেয়ে তোমার সমস্যা কি হ্যাঁ? কোন কথা, কোন বিষয় তুমি সহজ ভাবে নিতে পারো না কেন? এই বয়সেই তোমার মাথায় এত প্যাঁচ কেন? সহজ ভাবে এক কথা বললেও তার একশো মানে বের করো।’

নীড় শার্ট প্যান্ট পরে রেডি হয়ে গেছে। চুল আঁচড়ে নিয়ে বেরিয়ে যেতে নিচ্ছিল সে। এই মেয়ের সাথে কথা বললে মেজাজ ঠিক রাখা বড় কঠিন। ত্যাড়া ত্যাড়া কথা বলা এর অভ্যাস মনে হয়। কথা পেছন থেকে নীড়কে ডেকে থামাল।

-শুনুন, আপনার ওই পাগলা কুত্তাটাকে কি বেঁধে রাখা যায় না? আমাকে দেখলেই কামড়াতে আসে। আমার ভয় লাগে।’

‘পাগলা কুত্তা!’ তার জ্যাকি পাগলা কুত্তা! নীড় ঝট করে পেছন ফিরে দুই লাফে কথার সাথে চলে এলো। আগুন চোখে রেগেমেগে কথার দিকে ঝুঁকে এসে চিৎকার করে বলতে লাগল,

-আবার তুমি আমার জ্যাকিকে কুত্তা বলেছ! এইবার শুধু কুত্তা না, তুমি ওকে পাগলা কুত্তা বলেছ! ওর নাম জ্যাকি। বস্তির মত বারবার ওকে কুত্তা বলবে না। আর একবার তোমার মুখে কুত্তা ডাক শুনলে আমি মেরে তোমাকেই কুত্তা বানিয়ে দেব। বুঝেছ?’

কথা নীড়ের লাল হয়ে যাওয়া চোখের দিকে চেয়ে ভয়ে ভয়ে বলল,

-হুম বুঝেছি।’

-কী বুঝেছ বলো।’

-ওর নাম জ্যাকি। ও কুত্তা না। আমাদের মত মানুষ। ওকে কুত্তা বললে আপনি আমাকে মেরে কুত্তা বানিয়ে দিবেন। আমি কুত্তা হওয়ার পর হয়তো আমাকে খাবারও দিবেন না।’

কথার আবোলতাবোল কথা শুনে নীড় ফোস করে হেসে ফেলল। সব রাগ উধাও হয়ে গেছে ওর। কথার গোবেচারা মুখের দিকে তাকিয়ে হাসতেই আছে। নীড়কে হঠাৎ হাসতে দেখে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল কথা। এসবের মাঝেও কথা একটা জিনিস লক্ষ করল নীড়ের হাসিটা বেশ সুন্দর। কোন পুরুষমানুষকে কখনও এত সুন্দর করে হাসতে দেখেনি কথা। সোহান ভাইয়ের হাসিও সুন্দর। তবে এনার থেকে বেশি না।
নীড় কোনভাবেই হাসি থামাতে পারছে না। দু’হাত কোমরে রেখে ঠোঁট কামড়ে হাসছে আর বলছে।

-জ্যাকি কুত্তা না, ও আমাদের মত মানুষ! জ্যাকি মানুষ! অহ গড! চোখে পানি এসে গেল। পাগল মেয়ে জ্যাকিকে মানুষ বলছে!’

কথা নীড়কে দেখতে দেখতেই মুখ ফসকে আনমনে বলে ফেলল,

-আপনার হাসি অনেক সুন্দর। আপনাকে হাসতে দেখলে অজান্তেই দুই তিনটা হার্টবিট মিস হয়ে যায়।’

ওর কথা শুনে নীড় সঙ্গে সঙ্গে চুপ হয়ে গেল। ভ্রু কুঁচকে কথাকে দেখছে সে। মুখের উপর এরকম সরল স্বীকারোক্তি শুনে অভ্যস্ত নয় সে।

চলবে🌸

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here