#চুপকথারা_বিষন্ন
#জেরিন_আক্তার_নিপা
|পর্ব ২৩|
কথা চামচে করে ওই কালো রঙের অখাদ্য তরলটা নীড়ের মুখের সামনে ধরে খাওয়ার জন্য ওকে জোড়াজুড়ি করে যাচ্ছে। নীড় বেচারা শত বার না করেও এই মাথা খারাপ তার ছিঁড়া মেয়েকে দমাতে পারছে না। কথা যেন কসম কেটেছে নীড়কে সে এটা খাইয়েই ছাড়বে।
-অবাধ্য বাচ্চাদের মত কথা শুনছেন না কেন আপনি? একটু খেলে কী হবে? মরে যাবেন? আচ্ছা যদি এটা খেয়ে মরে যান তাহলে আমাকে জেলে দিয়েন।’
-আমি মরে গেলে তোমাকে জেলে দিব কীভাবে? বরং আমাকে মারার আগেই পাগলাগারদে দিয়ে আসি। তবে যদি আমার জীবন বাঁচে।’
-একটু খান না। জ্বর ভালো হয়ে যাবে আপনার।’
-ডাক্তার যে ঔষধ গুলো দিয়েছে সব কয়টা একসাথে আমাকে খাইয়ে ফেলো। তবুও এটা খেতে বলো না।’
-কেন? এটার সাথে আপনার শত্রুতা কিসের আমি তো এটাই বুঝতে পারছি না। আপনি এমন জেদ করছেন কেন?’
-কথা প্লিজ আমি একজন অসুস্থ মানুষ। আমাকে আর প্যারা দিও না। মাফ করো আমাকে।’
-এভাবে বলছেন কেন! আপনি কষ্ট পাচ্ছেন সেটা আমি কীভাবে দেখি বলুন।’
নীড় অসহায় চোখে কথার দিকে তাকালো। এখন যদি সে সুস্থ থাকত তাহলে নিশ্চিত একে মাথার উপর থেকে তুলে আছাড় মারতো। অনেক জ্বালাতন সহ্য করেছে। আর নেওয়া যাচ্ছে না।
-তুমি যাও। প্লিজ তুমি যাও৷ আমি এমনি সুস্থ হয়ে উঠব।’
-দূর! আপনি কি এখনও অবুঝ শিশু! কোন কথা শুনেন না৷ একেবারে বিগড়ে যাওয়া একটা ছেলে।’
নীড়ের ধৈর্য এবার বাঁধ ভাঙলো। চিৎকার করে উঠল সে।
-হ্যাঁ আমি বিগড়ে যাওয়া ছেলে। তাতে তোমার কী? তুমি যদি এই মুহূর্তে আমার সামনে থেকে না গেছো কথা, তাহলে আমি তোমার কী করব তা আমি নিজেও জানি না। তোমাকে মেরে স্যুপ রান্না করে খাব। তোমার হাড্ডি-গুড্ডি আমার জ্যাকিকে খেতে দিব।’
ভ্রু কুঁচকে চোখ ছোট ছোট করে নীড়কে দেখছে কথা। সে যে এসব ধমকে ভয় পেয়েছে তা মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে না। ওড়নাটা ঠিক করে বেঁধে নিচ্ছে কথা। তার মাথায় কোন বুদ্ধি এসেছে। নীড় বুঝতে পারছে না কথা কী করতে চাইছে।
-ভালোয় ভালোয় তো আপনি আমার কথা শুনবেনই না! আচ্ছা ঠিক আছে। আমিও আপনার থেকে কম জেদি না।’
লাফ দিয়ে বিছানায় উঠে পড়ল কথা। এক হাতে নীড়ের গাল চেপে ধরে মুখ হাঁ করালো। আরেক হাতে টুপ করে একটু কাড়া মুখের ভেতর পাচার করে দিল। আবার এক লাফে বেড থেকে নেমে দাঁড়িয়ে নীড়কে দেখছে সে। যুদ্ধে জয় লাভ করে কথার মুখে হাসি ফুটেছে। নীড় কাশতে লাগলো। বিশ্রী স্বাদে তার চেহারার ভাব পাল্টে গেছে। কী দিয়েছে এটা! এত তেতো! থু থু দিয়ে ফেলে দিতে চাচ্ছে। রাগে নীড়ের চোখ দিয়ে আগুন বেরুচ্ছে।
-ওয়াক! পাগল মেয়ে, আমি তোমাকে, তোমাকে আমি মার্ডার করব। ছি! কী বানিয়ে এটা! আমি তোমাকে খুন করব কথা।’
নীড় সত্যি সত্যিই রেগে গেছে। কথা মনে মনে ভয় পেলেও সেই ভয় নীড়কে দেখাল না। নীড় বাটিটার দিকে দেখল। এখনও অনেকটা বাকি আছে।
-এই সবটুকু যদি আমি তোমাকে না খাইয়েছি তাহলে আমার নামও নীড় না।’
নীড় কথাকে ধরার জন্য উঠতে নিলে কথা চিৎকার করে বাতাসের বেগে ছুটে পালিয়ে গেল।
-ওরে বাবা রে! বাঁচাও…
নীড় রাগে কাঁপছে। মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠেছে বলে আজ কথা বেঁচে গেল। নইলে যে পর্যন্ত দৌঁড়িয়ে ধরতে পারতো। ওর বানানো কুখাদ্য ওকেই গিলাতো।
-পাগলের সর্দারনী! তোমাকে হাতের কাছে পাই। আমি যে কী বানিয়ে খাওয়াবো ওটা খাওয়ার পর জন্মের জন্য ইউটিউব দেখে ডাক্তারি করার শখ মিটে যাবে। গাধা মেয়ে এটাও বুঝে না কাড়া খেয়ে যদি জ্বর ভালো হয়ে যেত তাহলে পৃথিবী থেকে ডাক্তার জাতি বিলুপ্ত হয়ে যেত। এতদিনে সব না খেয়ে মরতো। কিছু একটা পেলেই হলো। চিন্তাভাবনা করার দরকার নেই শুরু হয়ে যায় নাচানাচি। এই মেয়ের মাথায় কি ঘিলু বলতে কিছু নাই! পাগলের পাগল।’
—————-
দুপুরের ওই ঘটনার পর কথা পুরোটা বিকেল ঘরে এলো না। দুই তিন দিন ভুলেও আর নীড়ের সামনে পড়বে না। ওড়নার একটা কোনা আঙুলে প্যাঁচাতে প্যাঁচাতে বারান্দা জুড়ে পায়চারি করছে কথা।
-আমি তো উনার উপকারই করতে চেয়েছিলাম। কে জানতো উপকার করতে গিয়ে অপকার করে ফেলব। অপকারও তো করিনি। কাড়া তো খেতে তিতাই হবে। একটু চিনিও দিয়ে দেওয়া উচিত ছিল। কিন্তু ওই মহিলা তো চিনি দেয়নি। আচ্ছা মানলাম খেতে একটু খারাপ হয়েছে। জোর করে খাইয়ে অপরাধ করেছি। তাই বলে ওভাবে আমাকে দৌড়ানি দিবে! আমি কি উনার বউ না! একটুও মায়া দয়া নেই।’
কথার কপালটাই এমন। সে কিছু করতে গেলে সে কাজ তো হবেই না, উল্টো অকাজ হয়ে বসে থাকবে।
-মানুষের ভালো করতেই নেই। ভালো করতে গেলেই দৌড়ানি খেতে হয়। এখন আমি ঘরে যাব কীভাবে? সারারাত কি বাইরেই থাকতে হবে! উমম…
নাকি কান্না কাঁদছে কথা। এতক্ষণেও নীড়ের রাগ কি একটুও কমেনি? কথা ওর সামনে গেলে কি সত্যি সত্যিই ধরে মারবে!
————-
সন্ধ্যার পর ভয়ে ভয়ে ঘরে আসে কথা। নীড় ওপাশ ফিরে বিছানায় শুয়ে আছে। পা টিপে টিপে শব্দ না করে বেডের পাশে এসে দাঁড়াল কথা। নীড় ঘুমিয়ে আছে কি-না উঁকি দিয়ে দেখল। ফিসফিস করে বলল,
-আপনি কি ঘুমিয়ে আছেন?’
নীড়ের সাড়াশব্দ না পেয়ে নিশ্চিন্ত হলো কথা। স্বস্তির শ্বাস নিল সে।
-যাক ঘুমিয়ে আছে। জেগে থাকলে আমার খবর ছিল। একটা মানুষের এত রাগ কেন থাকবে? বেশি রাগ স্বাস্থ্যের জন্য ভালো না এটাও জানে না। সারাক্ষণ নাকের ডগায় রাগ থাকে। কথা কিছু করলেই ধমক দিয়ে তার কলিজা কাঁপিয়ে দিতে হবে। হৃদয়হীন পাষাণ মানুষ একটা। বউয়ের সাথে কীভাবে কথা বলতে হয় সেটাও জানে না। অনুর বরের থেকে শিখতে হবে উনার।’
নীড় জেগেই ছিল। কথা ঘরে এসেছে এটা টের পেয়েছে সে। তবুও ঘুমানোর ভান করে থাকল। কথা তাকে কতটা ভয় পায় এটা নীড়ের অজানা নয়। তাই তো ওর ভয়ে এতক্ষণ ঘরে আসেনি। নীড় অবশ্য চাইছিল কথা আসুক। একা একা বোর হচ্ছিল ও। একবার ভেবেছিল কথাকে সে নিজেই ডাকবে। ডেকে ওই ঘটনার জন্য শাসন করবে। কিন্তু বেচারিকে আরও ভয় দেখাতে ইচ্ছে করলো না। কথা আশেপাশে থাকলে কীভাবে যেন সময় কেটে যায়। টেরই পাওয়া যায় না। ওর ছেলেমানুষী কাণ্ডকারখানা গুলোও নীড় এখনো এনজয় করে। কথার উপর হাসছে সে। মেয়েটা তার ভাবনার থেকেও বেশি পাগল। সবসময় নিজে নিজেই কথা বলে। মনে মনে ভাবল নীড়,
-কিন্তু এই অনুর বরটা কে? আর অনুটাই বা কে? বউয়ের সাথে কীভাবে কথা বলতে হয় এটা অন্য কারো থেকে শিখতে হবে আমার! হাহ্, এই নীড়কে তাহলে তুমি চেনোই না কথা।’
-উনাকে আমার হাড়ে হাড়ে, রগে রগে চেনা হয়ে গেছে। আস্ত বদ। শয়তানের নানা শ্বশুর।’
কপাল কুঁচকে গেল নীড়ের। কথা তার সম্পর্কে এমনটা ভাবে!
-কী! আমি বদ? শয়তানের নানা শ্বশুর! আমি শয়তানের নানা শ্বশুর হলে তুমি হবে নানী শাশুড়ী।’
রাতে আবার গা কাঁপিয়ে নীড়ের জ্বর এলো। এই তিন চার দিনে আজকেই সবথেকে বেশি জ্বর এসেছে। গা আগুনের মত গরম হয়ে আছে। কপালে হাত রাখলে যেন পুড়ে যাবে এমন জ্বর। কথা কী করবে ভেবে পাচ্ছে না। নীড় ঘোরের মধ্যে বিড়বিড় করে কিছু বলছে। কথা ভয় পেয়ে নাহিদ চৌধুরীকে ডাকতে যাবে ভাবছে। নীড়ের কপালে হাত দিয়ে আঁতকে উঠল কথা।
-এ বাবা! এ তো অনেক জ্বর! গা পুড়ে যাচ্ছে। ডাক্তার দেখিয়ে ঔষধ খাওয়ার পরেও এমন হচ্ছে কেন? উনার জ্বর ভালো হচ্ছে না কেন?’
কথার কান্না পাচ্ছে। মানুষটা কয়টা দিন ধরে কী ভীষণ কষ্টে ভুগছে। নীড়ের মুখের কাছে কান নিয়ে শোনার চেষ্টা করল কথা নীড় কী বলছে।
-কী বলছেন? বুঝতে পারছি না। কষ্ট হচ্ছে আপনার? পানি খাবেন? আমি বাবাকে ডেকে নিয়ে আসি।’
নীড় অচেতন অবস্থাতেই কথার একটা হাত ধরে ফেলল। ক্ষীণ গলায় অস্ফুটস্বরে বলতে লাগল,
-যে-ও না। যেও না সি-স…
-কী বলছেন আপনি? আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।’
কথা নীড়ের দিকে ঝুঁকে গিয়ে ওর কথা বোঝার চেষ্টা করছে। নীড় জ্বরের ঘোরে একটা শব্দই বারবার উচ্চারণ করছে।
-সি-ই… কথা কোনোভাবেই বুঝতে পারছে না। সি সি কী? শীত লাগছে বলতে চাচ্ছে নাকি? নীড়ের গায়ের চাদরটা আরও ভালো করে টেনে দিল কথা। আলমারি থেকে কম্বল বের করে এনে নীড়ের উপর দিয়ে দিল।
-এখন আর শীত লাগবে না।’
-সিঁথি। আ-আমি… কেন এ-এমন করলে? কেন ছেড়ে গেলে।’
-‘ছেড়ে গেলে’ কে ছেড়ে গেল?’ কথা এবার কিছুটা বুঝতে পারছে। মুখে চিন্তার ভাঁজ পড়ল কথার। কী বলছে নীড়! নীড় বাচ্চাদের মত ঠোঁট বাকিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। ওর চোখের কোন বেয় উষ্ণ অশ্রুধারা ঝরছে। অজান্তেই কথার হাতটা আরও শক্ত করে ধরল ও।
-আমি তোমাকে অনেক বেশি ভালোবাসি। কেন তুমি এমন করলে সিঁথি? কেন আমাকে কষ্ট দিলে।’
-সিঁথি! ‘ নামটা চেনা লাগলেও এই নাম আগে কোথায়, কার মুখে শুনেছে এই মুহূর্তে তা মনে করতে পারল না কথা। কিন্তু নীড়ের মুখে নিজের নামের বদলে অন্য কারো নাম শুনে কথার মনটা বিষন্ন হয়ে গেল। বুক ভার হয়ে আসতে লাগল ওর। সিঁথি! সিঁথি নামটা কোথাও শুনেছে সে।
নীড় বলেই চলছে।
-তোমাকে তো আমি ভালোবাসতাম। তারপরও তুমি… বলতে বলতে নীড়ের কান্না আরও গাঢ় হয়ে আসছে। কথা আর শুনতে পারছে না। তার স্বামী কাউকে ভালোবাসতো! জ্বরের মধ্যে তার নামই বলে যাচ্ছে। তার মানে সেই মেয়েটাকে এখনও ভুলতে পারেনি উনি। হয়তো এখনও ওই মেয়েকেই ভালোবাসে নীড়। তাই তো কথার সাথে সবসময় ওরকম ব্যবহার করে। কথাকে দেখতে পারে না।
-আপনি কি সত্যি সত্যিই অন্য কোন মেয়েকে ভালোবাসেন! তাহলে আমাকে বিয়ে করলেন কেন? আমার তো শুধু আপনাকেই চাই। আপনি আমাকে চান না?’
চলবে_