চুপকথারা_বিষন্ন পর্ব-২৪

0
3086

#চুপকথারা_বিষন্ন
#জেরিন_আক্তার_নিপা
|পর্ব ২৪|

রাস্তার পাশে ফুটপাত ঘেঁষে হাঁটছে কথা। মনটা ভালো নেই তার। প্রতিদিন যে লোকটার থেকে হাওয়াই মিঠাই কিনে খেত, আজ সে লোক কথাকে ডাকলেও দাঁড়ায়নি কথা। এখন কোনকিছুই তার গলা দিয়ে নামবে না। সকালেও না খেয়েই বেরিয়েছে। বিষন্ন মনে এলোমেলো পা ফেলে বাড়ির দিকে ফিরছে। কাল রাতে নীড়ের মুখে একটা মেয়ের নাম শুনেছে সে। মেয়েটা কে এটা আর জানার প্রয়োজন নেই। নিশ্চয় প্রেমিকাই হবে। অচেতন অবস্থায় তো আর পাতানো কোন বোনের নাম নিবে না।

-আমি জানি তো, আমার কপালে যে সুখ নাই এটা তো আমার অজানা না। সৎমায়ের খোঁটা থেকে বাঁচতে এত জলদি বিয়ে করে নিলাম। কিন্তু বরও তো মন মতন জুটলো না। দেখতে সুন্দর হলে কী হবে? মাকাল ফলও তো দেখতে সুন্দর। তলে তলে অন্য মেয়ের সাথে ফষ্টিনষ্টি করে আমাকে বিয়ে করে জীবনটা তেজপাতা বানিয়ে ছাড়ল। আমি বাংলা ছবির শাবানার মত জামাইয়ের খেদমত করতে করতে জীবন দিই। আর আমার জামাই আমারই হাত ধরে অন্য মেয়েরে ডাকে! হায় কপাল! হায় কপাল আমার! ফ্রেমে বাঁধিয়ে জাদুঘরে সাজিয়ে রাখার মত কপাল।’

কথার বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে করছে না। এখানেই রাস্তায় বসে হাতপা ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। রাস্তায় গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদতে পারলে মনটা শান্তি লাগতো। কষ্ট কমতো। কিন্তু যে গাড়ি বাস চলাচল করছে! তাকে পিষে যেতে দু’মিনিট লাগবে না।

-কথা! এই কথা, আরে…

পেছন থেকে সৌভিক কথার হাত ধরে টেনে না নিলে এক্ষুনি কথা লাশ হয়ে রাস্তায় পড়ে থাকতো। একটা মাইক্রো ওকে ঘেঁষে চলে গিয়েছে এক্ষুনি। কথার বুক কাঁপছে। ঘনঘন দম নিচ্ছে সে। সৌভিক কথাকে দেখছে। একটু রেগেই বলল সে।

-ধ্যান কোথায় তোমার? আমি না দেখলে কী হতো ভাবতে পারছ একবার? এতক্ষণ তোমার অঙ্গপ্রত্যঙ্গ রাস্তার চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকতো। এত বেখেয়ালি কেন তুমি?’

-এটাই ভালো হতো।’

-কী!’

-এটাই তো ভালো হতো। এই দেহের খাঁচা ছেড়ে প্রাণ পাখি উড়াল দিতো। আমিও মুক্তি পেতাম।’

-মানে! ত-তুমি ইচ্ছে করে.. ‘ সৌভিক বিস্ময়ে অভিভূত। কথাই বলতে পারছে না সে। কথাকে চিনতে কি তার ভুল হয়েছে? এত সহজে হার মেনে নেওয়ার মেয়ে কথা! মরতে যাচ্ছিল ও! কেন? এর পেছনে কি নীড় দায়ী। হ্যাঁ, নীড় ছাড়া আর কেউ না।

-তুমি সুইসাইড করতে চেয়েছিলে কথা! কিন্তু কেন?’

হেসে ফেলল কথা। বলল,

-আমি এতটা সাহসী নই। হলে হয়তো ভালো করতাম। কিছু সমস্যার সমাধান পেয়ে যেতাম। গাড়ি আসছিল এটা খেয়াল করিনি। আপনি এসে বাঁচিয়ে দিলেন। ধন্যবাদ। অবশ্য আমি আপনাকে ভাই বানিয়েছি। আর বোনকে রক্ষা করা ভাইয়ের কর্তব্য। তাই ধন্যবাদ ফিরিয়ে নিলাম।’

কয়েক সেকেন্ডের জন্য সৌভিক কিছু বলতে পারল না। স্তব্ধ হয়ে চেয়ে রইল। এই মেয়েকে ব্যবহার করে নীড়কে শায়েস্তা করার জন্য ওকে বোন বানিয়েছে। অথচ তার উপর মেয়েটার ভরসা দেখে নিজেই দমে যাচ্ছে। কথার বিশ্বাস এভাবে সে অর্জন করে নিবে ভাবেনি। নীড় এই মেয়েটাকেই কষ্ট দিচ্ছে? কীভাবে পারছে ও?
সৌভিক পাশে দেখল। ঝালমুড়ি ওয়ালা যাচ্ছে।

-ঝালমুড়ি খাবে কথা?’

-না। আজ আমার কোনোকিছু খাওয়ার ইচ্ছে নেই।’

সৌভিক কথার ব্যাগ ধরে ওকে টেনে নিয়ে আসতে লাগলো। আজ অন্য দিনের থেকে কথাকে আলাদা লাগছে। ওর মন ভালো ভাবেই খারাপ বোঝা যাচ্ছে।

-ব্যাগ টানছেন কেন? কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন। বলেছি তো কিছু খাব না আমি।’

-তোমার মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে ভীষণ খিদে পেয়েছে তোমার।’

কথা পেঁচা মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। সৌভিক আড়চোখে ওকে লক্ষ করছে। সৌভিক এটাও লক্ষ করছে ঝালমুড়ি ওয়ালা লোকটা কেমন চোখে ওদের দু’জনকে দেখছে। সৌভিকের এটা মোটেও ভালো লাগেনি। দু’জন ছেলে মেয়ে একসাথে কোথাও গেলেই তারা প্রেমিক প্রেমিকা হয়ে যায় নাকি? রাস্তাঘাটে কি ভাইবোন একসাথে ঘুরতে পারে না! সবাই এই ব্যাপারটাকে এতটা নেগেটিভভাবে নেয় যে, এখন কোন ভাইয়ের নিজের বোনকে নিয়ে বাইরে বেরুবার আগে দু’বার ভাবতে হয়।

-ঝাল দিমু?’

-কথা তুমি ঝাল খাও?’

-হু।’

-হুম মামা। কড়া করে ঝাল দিবেন।’

লোকটা কথাকে দেখছে। হাত চালাতে চালাতে বলছে,

-আপা কি রাগ করছে?’

-রাগ না। কিন্তু কোন একটা কারণে আমার বোনটার মন খারাপ। সেই কারণটা কী আমিও জানি না। আপনার মুড়ি খেয়ে যদি ওর মন ভালো হয় তাহলে আপনাকে পুরষ্কৃত করা হবে।’

কথাগুলো বলে সৌভিক লোকটার চেহারার ভাব লক্ষ করল। মনে মনে মজাই পেলো। নিজের ধারণা কতটা ভুল তা বুঝতে পেরে লোকটা চুপসে গেছে। কথা খাওয়া শুরুই করেছিল মাত্র। হঠাৎ তার একটা কথা মনে পড়ে গেল।

-আপনার বোনের নাম সিঁথি ছিল, না?’

-হুম। কিন্তু কেন?’

দাঁড়িয়ে পড়ল কথা। কাল থেকে মাথার মধ্যে ঘুরতে থাকা একটা প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেছে।

-বেঁচে নেই সে। কীভাবে মারা গেছে ও? কী হয়েছিল।’

কথা হঠাৎ এসব কেন জানতে চাচ্ছে ভেবে পেল না সৌভিক।

-কেন কথা?’

-বলুন আপনি।’

-বলব। কিন্তু হঠাৎ কেন, মানে…

কথা আর ধৈর্য ধরে রাখতে পারছে না। ব্যাকুল হয়ে পড়েছে সে।

-আপনি প্লিজ বলবেন। আমার জানতে হবে। কী হয়েছিল ওর। কীভাবে মারা গেছে।’

-আগুন, আগুনে পুড়ে।’

-আপনি আমার বরের বন্ধু?’

কপাল কুঁচকে উঠল সৌভিকের।

-এটা আবার কেমন প্রশ্ন কথা!’

-‘হ্যাঁ’ অথবা ‘না’ তে উত্তর দিন।’

-হ্যাঁ। একসময় তো বন্ধুই ছিলাম।’

কথার চোখ ছলছল করছে। মনে মনে এই কথাটা নিয়ে ভীষণ ভয় পাচ্ছে সে।

-আপনার বোনের সাথে কোনোভাবে কি উনার কোন সম্পর্ক ছিল? বা ওর মৃত্যুর পেছনে কি কোনোভাবে উনি দায়ী? যার জন্য এখন আর আপনাদের বন্ধুত্ব নেই। দয়া করে মিথ্যা বলবেন না। আমাকে বোন বলেছেন আপনি। সত্যিটা আমাকে জানতেই হবে। একটা মানুষ প্রচন্ড জ্বরের ঘোরে যখন দুনিয়ার কোনকিছুর হুঁশ নেই তখনও তার মুখ থেকে এই নামটাই বেরিয়েছে। সিঁথি নামের মানুষটাকে উনি চিনতেন, এটা নিয়ে এখন আমার আর কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু কতটুকু চিনতেন, কীভাবে চিনতেন এটা আমাকে যেভাবেই হোক জানতে হবেই। উনার সাথে সিঁথির কী সম্পর্ক ছিল। ওরা দু’জন দু’জনকে ভালোবাসতো? শেষ পর্যন্ত কি একসাথে ছিল! সিঁথির মৃত্যুই এখন সবচেয়ে বড় রহস্য। সেটা এখনও আমার কাছে অজানা।’

সৌভিক ভাবেনি এত জলদি এভাবে কথার সামনে
সব সত্য এসে যাবে। নীড়ের মুখে সিঁথির নাম শুনেই এতটা আন্দাজ করে ফেলেছে! মনে মনে হাসল সৌভিক।

-এই মেয়েকে আমি বোকা ভেবেছিলাম! ওকে বোকা ভেবে আমি সবচেয়ে বড় বোকামি করেছি।’

কথার তার প্রশ্নের উত্তরের অপেক্ষায় অধীর আগ্রহে অশ্রুসজল চোখে সৌভিকের দিকে তাকিয়ে আছে।

-কী হলো বলুন না। আপনার বোনই কি সেই মেয়ে যার নাম এখনও আমার বরের মুখে উচ্চারিত হয়।’

-হ্যাঁ। তুমি যা ভাবছ সেটাই সত্যি। আমি তোমাকে অনেক আগেই বলতে চেয়েছিলাম কথা। কিন্তু তুমি কষ্ট পাবে ভেবে বলিনি। আর তার থেকেও বড় কথা তুমি আমার কথা বিশ্বাস করতে না। আমি চাই না তুমি কষ্ট পাও কথা।’

-কিন্তু পাচ্ছি তো।’

কথার চোখ বেয়ে টুপটুপ করে পানি ঝরছে। তার স্বপ্নের সংসারে তার অস্তিত্ব আজ ঘোলাটে হয়ে গেল। যাকে নিয়ে সংসার গড়ার স্বপ্ন দেখেছিল সে-ই তো আসলে তার না। কথা এতদিন ভেবেছিল হয়তো নীড়ের জীবনে অন্য কেউ আছে। কিন্তু এই ভাবনাটকে গুরুত্ব দিতে চায়নি। কিছু মানুষ এমন হয়। যারা নিজেকে তুলে ধরতে পারে না। নীড়ও সে প্রকৃতির। তার মনের অনুভূতি সে কাউকে বোঝাতে পারে না হয়তো। কথা ভাবত, নীড়ের যদি তেমন কেউ থাকতো তাহলে কি নীড় আর তাকে বিয়ে করতো। লোকটা তো তাকে মারধর অত্যাচার করছে না। শুধু তার উপর সর্বক্ষণ চটে থাকে। ভালো করে কথাটথা বলে না। তবুও তো কথা নীড়ের আচরণে তার জন্য যত্ন, পরোয়া দেখেছে।

-নীড় আমার বন্ধু। আমরা দু’জন আলাদা ধর্মের হলেও এই ব্যাপারটা কখনও আমাদের বন্ধুত্বের মাঝে বাধা হয়নি। আমাদের বন্ধুত্ব এমন ছিল যাকে বলা যেত, এক দেহে দুই প্রাণ। কলেজ, ভার্সিটি একসাথেই শেষ করি। আমার বা ওর জীবনের এমন কোন ঘটনা ছিল না যা আমরা জানি না। একজন আরেকজনের কাছে ছোট থেকে ছোট বিষয়ও শেয়ার করতাম। ততদিন পর্যন্ত সব ভালোই যাচ্ছিল। কিন্তু বিপত্তি ঘটল তখন যখন নীড় আমারই কাকার মেয়ে যাকে আমি নিজের বোনই মনে করতাম তার সাথে রিলেশনে জড়িয়ে গেল। নীড় এটা আমাকে জানায়নি। আমার থেকে লুকিয়ে রেখেছে। ওদের সম্পর্কের চার মাসের মাথায় আমি সব জানতে পারি। বন্ধুর থেকে এত বড় বেইমানি সহ্য হয়নি। নীড় নিজেই যদি প্রথম দিকেই আমাকে জানিয়ে দিত তাহলেও হয়তো আমার এত কষ্ট লাগতো না। সত্যি বলতে কী জানো কথা, নীড়ের এই ঘটনার পর বন্ধুত্বের উপর থেকে বিশ্বাস নড়ে গেছিল আমার। আমি আর আগের মত ওকে অন্ধ বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। শুধু এটাই মনে হতো, নীড় এখনও আমার থেকে কিছু লোকাচ্ছে না তো! আমাদের মাঝে কেমন যেন একটা অদৃশ্য দেয়াল উঠে গেছিল। নীড়ও সেটা বুঝতে পেরেছিল। আমি নিজের দিক থেকে সব ভুলে গিয়ে স্বাভাবিক হওয়ার অনেক চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু কেনই যেন পারিনি। বন্ধুর থেকে ধোঁকা পেয়েছিলাম বলে কথা। নীড় আমার বোনকে ভালোবেসেছে এতে কোন অন্যায় নেই। ভালোবাসা অন্যায় না। কিন্তু ওরা কখনও একসাথে ভালো থাকতে পারবে না জেনে এই সম্পর্কে জড়ানো এটা নীড়ের অন্যায় ছিল। ওদের ভালোবাসায় ধর্মটা অনেক বড় দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়েছিল। সিঁথি নীড়কে বিয়ে করতে হলে আমাদের সবাইকে ছেড়ে আসতে হতো। কারণ আমার পরিবার এটা কখনো মেনে নিত না তাদের মেয়ে একজন মুসলিম ছেলেকে বিয়ে করবে। আবার নীড়ও ওর ধর্ম ছাড়তো না। নীড়কে ধর্ম ছাড়ার কথা আমি কখনও বলতেও পারতাম না। ওদের মিল হওয়াটা অসম্ভব ছিল। নীড়ের বাবাও একটা হিন্দু মেয়েকে ছেলের বউ মানতেন না। ওদের দু’জনের একজনকে তো কুরবানিটা দিতেই হতো। হয় নীড়কে তার পরিবার ছাড়তে হতো নাহয় সিঁথিকে।’

কথা বিস্ময়াহত চোখে তাকিয়ে সৌভিকের কথাগুলো শুনছিল। সৌভিক থেমে গেলে বলল,

-সিঁথি কি আত্মহত্যা করেছে? ওর মারা যাবার পেছনে এটাই কারণ ছিল? ওরা চাইলে দূরে কোথাও গিয়ে দু’জন একসাথে থাকতে পারতো।’

-না। বালাট সহজ কথা। কিন্তু বাস্তবতা বড় কঠিন। ওরা দূরে কোথাও চলে গেলেও কি ভালো থাকতে পারতো? সমাজ ওদের ভালো থাকতে দিতো?’

-ভালোবাসার দু’জন মানুষ একসাথে ভালো থাকার চেষ্টা তো অন্তত করতে পারতো।’

-সেই চেষ্টা করতে গেলেও হয়তো নীড়ের বাবার ক্ষমতার কাছে ওদের হার মানতে হতো। ছেলেকে যেভাবেই হোক ফিরে পেতে চাইতেন তিনি।’

চলবে_
বিঃদ্রঃ পরীক্ষার জন্য এতদিন গল্প দিতে দেরি হয়েছে। আশাকরি পাঠক মহল আমার দিকটাও বুঝবেন।

@মায়ামহল (নিপা’র গল্প)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here