চুপকথারা_বিষন্ন পর্ব-২৫

0
3114

#চুপকথারা_বিষন্ন
#জেরিন_আক্তার_নিপা
|পর্ব ২৫|

(অতীত)

-আমি তোর বোনকে বিয়ে করব সৌভিক। ওর সাথে তো আমি টাইমপাস করার জন্য প্রেম করছি না। তারপরও তুমি আমার উপর রেগে আছিস কেন?”

নীড়ের কথা শুনে সৌভিকের রাগ আরও বাড়লো।

-কীভাবে ওকে বিয়ে করবি তুই শুনি?”

নীড় রসিকতা করার চেষ্টা করলো। সৌভিককে সহজ করতে চাইছে সে।

-সবাই যেভাবে করে।”

-সবাই কীভাবে করে? কোন ধর্মের রীতিতে করবি? তোদের ধর্মে মুসলিমরা যেভাবে করে সেভাবে? নাকি আমাদের হিন্দু ধর্মের নিয়মকানুন মেনে?”

নীড়ের চেহারার ভাব কঠিন হয়ে যাচ্ছে। সৌভিক তাকে তিক্ত বাস্তবতার সাথে মুখোমুখি করতে চাচ্ছে।

-বিয়েটা ছেলে খেলা না নীড়। তুই যত সহজ ভাবছিস জিনিসটা যত সহজ হবে না। তোদের মধ্যে থেকে কে সেক্রিফাইজ করবি? তুই তোর ধর্ম ছাড়বি?”

-ধর্ম ছাড়তে হবে কেন? আমাদের একসাথে থাকতে হলে ধর্ম ছাড়াটা কি জরুরি?”

-অবশ্যই জরুরি। তুই কেন বুঝতে চাচ্ছিস না নীড়। আমার পরিবার তোকে কোনদিন মেনে নেবে তো দূর বাবা কাকা যদি এটাও জানতে পারে সিঁথি বিধর্মী একটা ছেলেকে ভালোবেসেছে তাহলে ওকে কাকা জীবিত অবস্থাতেই চিতায় তুলবে।”

-তোর কাকা আমাকে মেনে নিবে না সেটা তোর কাকার ব্যাপার। আমি তো সিঁথিকে বিয়ে করার জন্যই ভালোবেসেছি।”

-তুই সিঁথিকে বিয়ে করলে তোর বাবা ওকে মেনে নিবে?”

-কেন মানবে না? অবশ্যই মানবে। না মানলেও মানতে হবে।”

-সিঁথি তোকে বেছে নিলে আমাদের ছাড়তে হবে।”

নীড় সৌভিকের দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে দেখল।

-তো ছাড়লো। তুই কী চাস? বন্ধু আর বোনকে সুখী দেখতে চাস না? তুইও কি আমাদের ভালোবাসা শুধু ধর্মের জন্য মেনে নিবি না!”

-কথা আমাকে নিয়ে না। সিঁথি তোর সাথে চলে এলে তোদের সমাজে থাকতে হলে ওকে তোদের ধর্ম গ্রহণ করতে হবে। আর এমনটা করলে আমাদের সমাজ ওকে আর কখনও ফিরিয়ে নিবে না। সিঁথি মারা গেলেও কাকা ওর মুখ দর্শন করবে না। আর না কাকা মারা গেলে সিঁথিকে ওর মুখ দেখতে দিবে। এখানে বাঁধা দু’টা ধর্ম। দু’টা সমাজ। এমনকি দু’টা পরিবারও।”

-সিঁথিকে ওর ধর্ম ছাড়তে হবে না। আমিও আমার ধর্ম ছাড়ব না। কিন্তু আমরা দু’জনই পরিবার ছাড়ব। ও এখন যেমন আছে আমার সাথে বিয়ে হলেও সেরকমই থাকবে। আমি ওকে কোনো কিছুতে বাধা দিব না। এখন তো তোর আর কোন আপত্তি নেই, তাই না? আমিও আমার বাবার টাকাপয়সা বাড়ি-গাড়ি সবকিছু ছেড়ে আসব। সিঁথিও ওর বাবা মা’কে ছেড়ে আসবে। আমরা অনেক দূরে কোথায় গিয়ে সংসার পাতবো। যা কিছুই হয়ে যাক তুই আমাদের পাশে থাকবি। থাকবি তো নাকি? বল।”

-থাকব। তোকে বন্ধু বানানোর আগে বিন্দুমাত্র সংকোচ করিনি। দু’বার ভাবিনি। যতদিন বাঁচি আমাদের বন্ধুত্ব বাঁচিয়ে রাখব। আর যতদিন বন্ধুত্ব রাখব ততদিন তোর সঙ্গ দিয়ে যাব। কোনোদিনও একা ছাড়ব না।”

নীড় হাসল। সে জানতো সৌভিক কখনও ওদের পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়াবে না। বন্ধুর উপর এটুকু বিশ্বাস ওর ছিল। হাসল নীড়। সৌভিকের কাঁধে চাপড় দিয়ে বলল,

-তাহলে আমাদের পালিয়ে যাবার ব্যবস্থা কর। আগে ভালো একটা বাসা খোঁজ। তারপর সংসারে প্রয়োজনীয় যা কিছু লাগে তোর বোনকে সাথে নিয়ে গিয়ে কিনব।”

হাসল সৌভিক। টিটকারির সুরে বলল,

-বিয়ে ছাড়া সংসার?”

-বিয়েটা শুধু কোর্টে গিয়ে রেজিস্ট্রি করে নিব। ছেলে মেয়ে উভয়ের পক্ষ থেকে একজন সাক্ষী তো তুই আছিসই। আরেকজন সাক্ষী জোগাড় করতে হবে।”

-আচ্ছা। সবই ঠিক আছে। কিন্তু এসবের আগে তুই আমার একটা প্রশ্নের উত্তর দে।”

-আবার কী প্রশ্ন আছে তোর? সবকিছুই তো বুঝিয়ে বললাম। তারপরও প্রশ্ন! ঠিক আছে। বোন দিবি। যার তার হাতে তো আর বোনের দায়িত্ব দিতে পারবি না। একটু বাজিয়ে দেখছিস। দেখ। কর তোর প্রশ্ন।”

সৌভিক ভীষণ শান্ত গলায় বলল,

-ভবিষ্যতে তোদের সন্তান হলে ওরা কোন ধর্ম মেনে বড় হয়ে উঠবে? বাবার ধর্ম নাকি মা’য়ের? বাবার ধর্ম মতে মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়বে? নাকি মায়ের ধর্মের মন্দিরে গিয়ে পুজো দিবে?
ওদের বিয়ে কীভাবে দিবি? তার থেকে বড় যে প্রশ্ন, কার সাথে দিবি? তোরা নাহয় সমাজ ছেড়ে, পরিবার ছেড়ে দূরে গিয়ে থাকবি। তোদের সন্তানদেরও কি সমাজের প্রয়োজন হবে না? বাস্তবতা জেনে কোন পরিবার ওদের আপন করে নিবে?”
—————
কথার মাথাটা ঘুরে উঠল। দাঁড়ানো থেকে টলে বসে পড়লো সে। কাল রাত থেকে কিছু খাওয়া হয়নি হয়তো এইজন্যই শরীরটা সঙ্গ দিচ্ছে না। মাথাটা ঝিমঝিম করছে। বসে পড়ে বুক ভরে শীতল বাতাস টেনে নেওয়ার চেষ্টা করছে। সৌভিক দোকান থেকে পানির বোতল কিনে এনে কথার হাতে দিল।

-তুমি কি অসুস্থ কথা? ঠিক আছো তুমি?”

-হ্যাঁ। আমি ঠিক আছি। কিছু হয়নি আমার।”

পানি খেলো কথা। কিছু পানি গায়ে পড়লো। সৌভিক চায়নি কথা ওসব জানুক। কিন্তু না বলেও যে আর উপায় ছিল না।

-তারপর, তারপর কী হয়েছিল? এত চেষ্টার পরেও ওরা এক হতে পারলো না কেন? সিঁথি কীভাবে মারা গেছে?”

-তারপর কী হয়েছিল তা নাহয় আরেক দিন শুনবে। আজ তোমাকে অসুস্থ মনে হচ্ছে। বাড়ি যাও তুমি কথা।”

-না। আজই শুনব। এখনই। আপনি বলুন।”

-ওসব কথা তো অতীত ছাড়া আর কিছু না কথা। কেন শুনতে চাচ্ছ? অনেকটা সময় চলে গেলে। সবাই সবকিছু ভুলে গেছে। অনেকে তো জীবনটাকে নতুন করে গুছিয়ে নিয়েছে। সিঁথির কথা এখন আর কারো মনে নেই।”

-তারপরেও বলুন। সিঁথির সাথে কী হয়েছিল আমরা জানতে চাই।”

-নীড় পাগল ছিল। কোন সিদ্ধান্ত নেবার আগে ভাবতে হতো না ওকে। কিন্তু সিঁথি ঠিকই বাস্তবতা উপলব্ধি করতে পেরেছিল। সিঁথি এটা বুঝতে পেরেছিল ও আর নীড় কখনও এক হতে পারবে না। ওদের দু’জনের মাঝে অনেক বড় দেয়াল। এই দেয়াল ওদের পক্ষে ভাঙা সম্ভব হবে না। ওরা যদি এই দেয়াল ভেঙে এক হয়েও যায় তবুও শান্তিতে বাঁচতে পারবে না। সিঁথি নীড়ের হাত ধরে সমাজ, পরিবার ছাড়তে অস্বীকার করল। দু’জনের ভালোর জন্যই নীড়কে ছেড়ে দিল ও। আমার বোনটা নিজের থেকে বেশি নীড়ের কথা ভেবেছে। নীড় সিঁথির দূরে যাওয়া মেনে নিতে পারেনি। সে নিজেই ওদের সম্পর্কের কথা আমার কাকাকে জানিয়ে দেয়। সেই থেকে শুরু হয় বাড়িতে সিঁথির উপর মানসিক অত্যাচার। সবকিছু জেনে-বুঝে একটা মুসলিম ছেলেকে ভালোবাসার অপরাধে দিনের পর দিন পরিবারের ছোট বড় সবার কথা শুনতে হয়েছে। প্রতিটা মুহূর্তে অপমানিত হতে হয়েছে। কিন্তু কোনোদিনও কোন প্রতিবাদ করেনি সিঁথি। শেষে কাকা ওর বিয়ে দেওয়ার জন্য উঠে পড়ে লেগেছিল। নানান সম্বন্ধ দেখে বিয়েও ঠিক করে ফেলেছিল। বিনা বাক্য ব্যয়ে কাকার কথায় বিয়ের জন্য রাজি হয়ে গেল। কিন্তু সেখানেও বাঁধ সাধল নীড়। বিয়ের দিন দুই পরিবারের উপস্থিতিতে ওর আর সিঁথির সম্পর্কের কথা তুলে ধরে। বরের পরিবার এই কথা শুনে কোনোভাবেই এই মেয়েকে ঘরের বউ করতে রাজি না। বিয়ে ভেঙে দিয়ে বরযাত্রী নিয়ে ফিরে গেল ওরা। চোখের সামনে মেয়ে লগ্ন ভ্রষ্ট হচ্ছে দেখে আমার কাকা সেদিন পাগলের মতো হয়ে গেছিল। তুমি তো জানোই হয়তো, আমাদের ধর্মে মেয়েরা একবার লগ্ন ভ্রষ্ট হলে ওদের আর বিয়ে হয় না। নীড় এটাই হয়তো ভেবেছিল এরকম করেই ও সিঁথিকে পাবে। একবার সিঁথির বিয়ে ভেঙে গেলে ওর হাতে মেয়েকে তুলে দিতে বাধ্য হবে কাকা। সমাজের মানুষের সামনে এত অপমান লাঞ্ছনা সহ্য করতে পারেনি কাকা। ঘরে দরজা দিয়ে গায়ে আগুন দিতে চেয়েছিল। আমরা সবাই কাকাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেলে ওইদিকে সিঁথির দিকে কারো খেয়ালই ছিল না। নিজে অপমান কষ্ট থেকে বাঁচতে, বাবা, কাকাদের আজীবন অপমানের হাত থেকে মুক্তি দিতে নিজেই মৃত্যুর পথ বেছে নিলো। আমাদের সবার চোখের সামনে, এমনকি নীড়ের চোখের সামনেও আগুনে পুড়িয়ে নিজেকে শেষ করে দিল ও। ওকে বাঁচানোর চেষ্টা করতে করতে আগুন অনেকটা ছড়িয়ে গেছিল। হাসপাতালে নেওয়া হয়েছিল। দুই দিন অসহ্য যন্ত্রণা ভোগ করে তৃতীয় দিনে পরপারে পারি জমালো। ভাই হিসেবে বোনের মৃত্যুতে স্বাভাবিক ভাবেই নীড়ের উপর রাগ হয়েছিল আমার। ওর উপর প্রতিশোধ নেওয়ার ধারণা মনের মধ্যে জন্ম হলো। ওর জন্যই বোনকে হারিয়েছে। ওর বিরুদ্ধে কেসও হয়েছিল। কিন্তু নীড়ের বাবার ক্ষমতার জোরে কোর্ট থেকে জামিন পেয়ে যায় ও। নীড়ও তখন সুস্থ ছিল না। পাগলের মত হয়ে গেছিল ও। দুনিয়ার খেয়াল ছিল না ওর। ওকে নিয়ে মাস কয়েক সাইকিয়াট্রিস্টের কাছেও ছুটতে হয়েছে। অনেক কষ্টেও ছেলেকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে পারেননি মিস্টার নাহিদ চৌধুরী। আসল অপরাধী যদি কেউ থেকে থাকে সেটা তো উনি নিজেই। সিঁথি ঠিকই নীড়ের সাথে অন্য কোথাও চলে যেত। সিঁথিকে উনি শাসিয়েছেন। ভয় দেখিয়েছেন সিঁথি যদি নীড়কে না ছাড়ে তাহলে বেঁচে থাকতেই ওর পরিবারের মানুষগুলোকে নরকের যন্ত্রণা ভোগ করিয়ে ছাড়বেন। ওরা বাবা ছেলে দু’জনকেই আমি আজ পর্যন্ত ক্ষমা করতে পারিনি। আর না কোনোদিন পারব। কয়েকটা বছর না যেতে নীড় ঠিকই তোমাকে বিয়ে করেছে। আমার বোনকে ভুলে গিয়ে সংসার করছে ও। মাঝথেকে ওর জন্য আমার নিষ্পাপ বোনটার পরিণতি এতটা ভয়াবহ হয়েছে।”

কথা পাথর হয়ে বসে থাকল। তার কিছু বলার নেই। আর কিছু শোনারও নেই। যেই মানুষটাকে সে এত সম্মান করে এসেছে সে কিনা এতসব করেছে! একটা মেয়েকে কতটা অসহায় বানিয়ে ফেলেছিলেন তিনি! যার জন্য মেয়েটা ভালোবাসার মানুষকে ছাড়তে বাধ্য হয়েছে। বাবা তাকে এত আদর করেন। নিজের মেয়ের থেকেও বেশি ভালোবাসা দেন। অথচ তিনিই একটা সময় তার মতোই একটা মেয়ের জীবন নিয়ে এভাবে খেলা করেছেন! সিঁথির তো কোন দোষ ছিল না।
কথা কাঁপতে কাঁপতে উঠে দাঁড়াল। থরথর করে পুরো শরীর কাঁপছে ওর। ভাষাহীন চোখে সৌভিলের দিকে তাকাল সে।

-সিঁথির মৃত্যুর জন্য ওই মানুষটাকে অপরাধী করবেন না। উনি আজও সিঁথিকে ভুলতে পারেননি। সিঁথি আজও উনার মনে জীবিত আছে। আমাকে বিয়ে করে সংসার করার কথা বলছেন? আমাদের বিয়েটা বাইরের মানুষের চোখে একটি সুখী বিয়ে মনে হতে পারে। কিন্তু উনি কোনোদিনও আমাকে স্ত্রী রূপে গ্রহণ করেননি। হয়তো কোনোভাবে আমাকে বিয়ে করতে বাধ্য হয়েছেন। আমাকে উনি কোনোদিনও ভালোবাসতে পারবেন না। উনি কেন আমার সাথে এমন করেন এই প্রশ্নের উত্তরে আমি অনেককিছু ভেবেছি। কিন্তু আজ তার সঠিক উত্তর পেয়েছি। যা হয়েছে তা হয়তো হবারই ছিল। মনের মধ্যে প্রতিশোধের আগুন নিয়ে আপনিও কি এই কয়েকটা বছর ভালো থাকতে পেরেছেন? পারেননি। প্রতিশোধ, রাগ, ঘৃণা এই তিনটা জিনিস কখনও মানুষকে ভালোভাবে বাঁচতে দেয়না।”

কথাগুলো বলে অবশ শরীরটাকে টানতে টানতে হাঁটা ধরলো কথা। সৌভিক টলমল চোখে মেয়েটাকে দেখছে। আজ কথার মাঝে সিঁথিকে দেখতে পারছে ও।

চলবে_

বিঃদ্রঃ এই পর্বের সকল ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here