#চুপকথারা_বিষন্ন
#জেরিন_আক্তার_নিপা
|পর্ব ২৮|
শিমুলকে দেখেই আশা গালাগাল দিতে যাচ্ছিল। রাগে মাথা ফেটে যাচ্ছে তার। সকাল থেকে পাওয়া যাচ্ছে না ছেলেটাকে। এদিকে ঘরে কোন বাজার নেই। সকাল সকাল বাজার না করলে ভালো মাছ পাওয়া যায় না। টাটকা শাকসবজি গুলো মানুষ সকালেই উড়িয়ে নিয়ে যায়। এই ছেলে বড় তো হচ্ছে ঠিকই কিন্তু এখনও সংসারের দায়িত্ব নেওয়া শিখছে না। বাপ তো মরে উদ্ধার হয়েছে। তাকে এদের মাঝে সারাজীবন জ্বলতে রেখে গেছে। শিমুলের সাথে কথাকে দেখে তার মেজাজ সপ্তম আকাশে চড়ে গেল। শিমুল যে কথাকে আনতে যাবে এটা তো তাকে বলেই যায়নি। বোনের প্রতি দরদ দেখিয়ে সাতসকালে বোনকে নিয়ে বাড়ি ফেরা হয়েছে। আপদটাকে বিয়ে দিয়েও কি বাঁচা গেল না। কিন্তু আশার মাথায় তখনই আকাশ ভেঙে পড়ল যখন দেখল কথা একা আসেনি। সাথে ওর বরও এসেছে। জামাই আজ প্রথম ওর বাড়িতে এসেছে। আশা মুহূর্তে রাগ ঝেড়ে ফেলে মুখে হাসি ঝুলিয়ে নিল। তাকে দেখে মনে হচ্ছে, মেয়ে মেয়ের জামাইকে দেখে সে ভীষণ খুশি হয়েছে।
-আরে কে এসেছে এটা! জামাই বাবাজী! কেমন আছ বাবা তুমি?”
নীড় শাশুড়ির থেকেও বড় একটা হাসি মুখে ঝুলিয়ে বিনীত ভঙ্গিতে জবাব দিল।
-আলহামদুলিল্লাহ ভালো। আপনি?”
-আমি কি আর ভালো থাকতে পারি বাবা? মেয়ের মা হয়েছি না, সবসময় ওর চিন্তাই মাথায় লেগে থাকে।”
কথা অবহেলার দৃষ্টিতে মা’র নিখুঁত অভিনয় দেখছে। মা একজন পাক্কা অভিনেত্রী। নাটক সিনেমায় সুযোগ পেলে ভালো কিছু করতে পারত। মা’র এই অভিনয় তার সবই জানা। তাকে নিয়ে চিন্তা হবে! এর থেকে মজার কথা আর কিছু হয় না। তবুও মা’র অভিনয় গুলো তার ভালো লাগে। মিছেমিছি হলেও তার জন্য যখন চিন্তা করে তখন তার ভালো লাগে।
-শিমুলকে কাল রাতেই বলেছিলাম কথাকে গিয়ে নিয়ে আয়। মেয়েটার জন্য মন কাঁদছে। তুমিও এসেছ আমি খুব খুশি হয়েছি। কয়েকটা দিন থাকবে তো বাবা।”
নীড় জবাব দেবার আগে কথা বলল,
-উনার হাতে এতবড় ব্যাগটা দেখতে পারছ না? এত বড় ব্যাগ নিয়ে এসেছি কয়দিন থাকব কল্পনা করো।”
আশার মুখটা কালো হতে গিয়েও সামলে নিল সে। এই ডাকাত মেয়ে বলে কি! এত বড় ঘরের ছেলেকে নিয়ে এই বাড়িতে থাকতে চলে এসেছে। জামাইকে খাওয়াবে কী সে? কোথায় রাখবে এই রাজপুত্রকে। এই মেয়ে মরার পরও তাকে জ্বালাতে চলে যাবে।
কথা নীড়ের দিকে তাকিয়ে বলল,
-দাঁড়িয়ে আছেন কেন? ঘরে আসুন। ব্যাগ ভারী লাগছে না? ওটা আমাকে দিন।”
-তোমার ঘর কোনটা দেখিয়ে দাও।”
-আপনি তো আমার ঘরটাও চিনেন না। আবার শ্বশুরবাড়ি আসার জন্য পাগল হয়ে গেছেন।”
আশা পারলে নীড়ের সামনেই কথার গালে এক চড় বসিয়ে দেয়। এটা কীভাবে কথা বলছে জামাইয়ের সাথে? তাড়াহুড়ো করে সে বলে উঠল,
-যাও বাবা, ঘরে যাও। এটা তোমারই তো বাড়ি। যতদিন থাকবে নিজের বাড়িঘর মনে করে থাকবে। তুমি আমার বড় ছেলে বাবা। তোমাকে আমি মেয়ের জামাইয়ের থেকেও বেশি স্নেহ করি।”
কতদিন পর নিজের ঘরে এসেছে কথা। নিজের ঘরটা ভাঙাচোরা, ছোট পায়রার খোপ হতে পারে। কিন্তু এখানে এলে যে শান্তি মিলে তা পৃথিবীর অন্য কোথাও নেই। নীড় কথাকে দেখছে। কথার চেহারার তৃপ্তিদায়ক ভাব ওকে সুখ দিচ্ছে। কথার থেকে চোখ সরিয়ে ঘরটা দেখল নীড়। তার বিশাল বেডরুমের কাছে এই ঘর ইঁদুরের গর্ত বলে মনে হবে। দুইটা জানালা। দক্ষিণের জানালা দিয়ে ভুরভুর করে ঘরে বাতাস ঢুকছে। ছোট একটা খাট সুন্দর করে গুছানো। নীড় তার আরামদায়ক বেডের কথা মনে করে মনে মনে হাসল। ঘরের আসবাব একটা আলনা আর এক কোণে একটা পড়ার টেবিল আর চেয়ার এই পর্যন্তই। নীড় ভাবল, বাইরের দুনিয়া সম্পর্কে তার অনেক কিছুই অজানা। সে জানত না মানুষের জীবনযাপন এতটা সাধারণও হতে পারে। ওকে ঘরটা এরকম খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে দেখে কথা উদাস গলায় বলল,
-আপনার ঘরের সাথে এই ঘরের তুলনা দিয়ে লাভ নেই। আপনার রাজপ্রাসাদের মত বাড়ির সামনে আমাদের এই গরিবখানা কিছুই না। এই ঘরের জিনিসপত্র দেখে হয়তো মনে মনে নাট সিটকচ্ছেন। কিন্তু এটাই সত্য। আমাদের জীবনধারা এভাবেই চলে আসছে।”
নীড় কথার এসব কথার কোন উত্তরই দিল না। কথার গা ঘেঁষে ওর পাশ কাটিয়ে যেতে মুচকি হাসল। জানালার সামনে দাঁড়িয়ে বুক ভরে শীতল বাতাস টেনে মনে মনে বলল,
-এই গরিবখানাতেই আমার বউয়ের জন্ম। ওর বেড়ে ওঠা। শৈশব কৈশোর কাটানো। যেখানে ওর এত সুন্দর রঙিন দিন গুলো কেটেছে, যেখানের প্রতিটা জিনিসে ওর ছোঁয়া ওর স্মৃতি লেগে আছে আমি সেই জায়গাটায় এসে কীভাবে নাক সিটকতে পারি?”
কথা তীক্ষ্ণ চোখে নীড়কে দেখছে। মনে মনে ভাবছে, হাবভাব দেখে তো মনে হচ্ছে শ্বশুরবাড়ি উনার ভীষণ মনে ধরেছে। কিন্তু বাছাধন দুইটা দিন এখানে কাটিয়েই দেখো না। তখনই বুঝতে পারবে তোলার বিছানা ছেড়ে এই শক্ত তক্তাপোশে ঘুমানো কত কঠিন। তার উপর রাতের বেলা ইলেক্ট্রিসিটি চলে গেলে তো সোনায় সোহাগা হয়ে যাবে। মশার কামড়ে বাপ বাপ করে বাপের প্রাসাদে ফিরে যেতে চাইবে।”
কথা এতটাই আনমনে কথাগুলো ভাবছিল নীড় ওর সাথে এসে দাঁড়ানোর পরেও খেয়াল করল না। কথার দিকে ঝুঁকে হাতে তুড়ি বাজিয়ে কথার মনোযোগ আকর্ষণ করতে চাইল সে। ধ্যান ভাঙলে নীড়কে ঠিক নিজের মুখের সামনে দেখে পিছিয়ে যেতে গিয়ে পড়ে যেতে নিচ্ছিল কথা। নীড়ও এই সুযোগটা ঝটপট লুফে নিল। নিজের বাম হাতটা কথার কোমরে শক্ত করে পেঁচিয়ে ওকে পড়ে যাওয়া থেকে বাঁচাল। কথা বাকশক্তি হারিয়ে ফেলে ফ্যালফ্যাল চোখে নীড়কে দেখছে। নীড় মুচকি হেসে বলল,
-সাবধানে চলাফেরা করবে তো! অবশ্য আমি তোমাকে ছাড়ব না। ভয় নেই আমার সাথে থাকলে তুমি কোথাও পড়বে না।”
কথা আধ পড়া অবস্থায় বেঁকে নীড়ের বাহুডোরে ঝুলে আছে। নীড়ের চোখের দিকে অপলক চেয়ে আছে সে। নীড় কথাকে কতটা চমকে দিয়েছে বুঝতে পেরে চোখ টিপে হেসে ফেলল।
————-
-বোনকে যে নিয়ে এসেছিস ঘরে একটা বাজার নেই। আমার হাতে টাকা নেই। বোনকে কি এখন বাতাস খাইয়ে রাখবি?”
-তাই বলে আপু নিজের বাড়িতে আসবে না?”
-আসবে। কিন্তু আমার কাছে তো আর টাকার গাছ নেই যে, ওই গাছ থেকে টাকা পেরে তোদের ভাইবোনদের বসিয়ে বসিয়ে খাওয়াব। সাথে জামাইও এসেছে। ওর সামনে কি আমরা যা খাই তা দিতে পারব।”
আশা চাপা গলায় ছেলের সাথে তর্ক চালিয়ে যাচ্ছিলেন। সে কী করবে বুঝতে পারছে না। গতবার তো কথার সাথে বিয়াই পুরো বাজারই উঠিয়ে দিয়ে দিয়েছিল। এইবার নিজের ছেলেও এসেছে এটা জেনেও ওদের খালি হাতে পাঠিয়ে দিল! বিয়াইয়ের এই আক্কেল!
-কাকী। আশা কাকী।”
বাইরে থেকে কারো ডাক শুনে গলা তুলে আশা বলল,
-কী হয়েছে? দিনদুপুরে জ্বালাযন্ত্রণা করিস না তো বাপু।”
-শুনে যাও কাকী। জরুরি কথা আছে।”
আশা ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। পাড়ার এক ছেলে উঠানে দাঁড়িয়ে ওকে ডাকছে।
-তোদের আর জরুরি কথা কী? কথা এসেছে কি-না এটাই জানতে এসেছিস তো? কথা এসেছে। কিন্তু এখন ডাকা যাবে না ওকে। জামাইও এসেছে ওর সাথে।”
-আমি জানি কথা আপু এসেছে। এইজন্য ডাকছি না তোমাকে। তোমাকে একজন লোক খুঁজছে। মোড়ে দাঁড়িয়ে আছে সে। তোমাকে যেতে বলেছে।”
আশার বিরক্তির সীমা রইল না। তাকে আবার কে খুঁজছে? মানুষের খেয়েদেয়ে কাজকাম নেই নাকি।
-এখন যেতে পারব না। যে-ই আমাকে খুঁজুক বলে দে আমি বাড়িতে নেই।”
আশা ভেবেছে সে যাদের থেকে টাকা ধার নিয়েছে হয়তো তাদের কেউ এসেছে। কিন্তু বাড়ি না এসে গলির মোড়ে দাঁড়িয়ে থেকে তাকে ডাকার মানে কী? পরক্ষণে মনে পড়ল বাড়িতে জামাই এসেছে শুনেছে না তো! আশা গিয়ে দেখল নাহিদ চৌধুরীর ম্যানেজার দাঁড়িয়ে আছে। অবাক না হয়ে পারল না সে।
-আপনি এখানে দাঁড়িয়ে আছেন কেন?”
-নীড় স্যার আপনাদের বাড়িতে আছে তাই যাইনি।”
-কিন্তু আমাকে ডেকেছেন কেন?”
ম্যানেজার প্যান্টের পকেট থেকে একটি কচকচ টাকার বাণ্ডিল বের করে আশার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
-এটা রাখুন।”
কেউ দেখে ফেলার আগে আশা টাকার বাণ্ডিলটা ছোঁ মেরে নিজের কাছে নিয়ে নিল। শাড়ির আঁচলের আড়ালে লুকিয়ে ফেলল সেটাকে।
-আমি এখন আসি।”
শিমুল সবটাই দেখল। আপু এখন মা’র কাছে সোনার ডিম পারা হাঁস। আপু যতবাই বাড়িতে আসে আপুর শ্বশুর মা’কে টাকা পাঠায়। আপু বাড়ি না এলেও এই কাজ করতে তিনি ভুলেন না। শিমুলের রাগ হয়। আপুকে ওরা বিয়ে দিয়েছে। টাকার বদলে বেঁচে দেয়নি। আপুর শ্বশুর এটা ভালো করেই জানে তার মা লোভী। কিন্তু তাই বলে শিমুল এটা কিছুতেই মেনে নিতে পারবে না।
-তুমি আবার আপুর শ্বশুরের থেকে টাকা নিয়েছ?”
-আমি চেয়ে নিয়েছি নাকি? উনি দিলে আমি না করব কেন? এতে উনার অপমান হবে না!”
-মা তুমি এত লোভী কেন?”
-আমি লোভী! তোর আমাকে লোভী মনে হয়? তোর বোনকে বড় করতে আমার কম কষ্ট হয়েছে? এখন যদি তার মাধ্যমে আমি সুখ করতে পারি তাহলে সেটা কেন চাইব না আমি? ছোট থেকে ওকে এতটুকু বড় করেছি আমি। ওর উপর আমার দায় আছে।”
—————-
জামাই আদর মনে হয় একেই বলে। এতদিন শুধু শুনেই এসেছিল। আজ নিজেই উপলব্ধি করল জামাই আদর কাকে বলে! শাশুড়ী মা খাইয়ে খাইয়ে তাকে মারার ধান্দায় ছিল মনে হয়। একটা আইটেমও বাদ রাখতে দেয়নি। জোর করে ঠেসেঠুসে সব খাইয়ে ছেড়েছে। এখন ভুঁড়ি নিয়ে নড়াচড়া করতেই জান যাচ্ছে। খাবার পরে ঘরে এসে হাতপা ছড়িয়ে বিছানায় পড়ে রইল নীড়। শ্বশুরবাড়ির আসার শখ মিটেছে ওর। এখানে যদি ও এক সপ্তাহ থাকে। আর এই এক সপ্তাহই শাশুড়ী মা তাকে এভাবে খাওয়ায় তাহলে হয়েছে! তার শখের বডির ইন্না-লিল্লাহ। দু’দিনে সিক্স প্যাক ডুবে গিয়ে গোপাল ভাড়ের মত এত্ত বড় একটা ভুড়ি হবে। কথা ঘরে এসে দেখল নীড় চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে।
-বেঁচে আছেন নাকি গেছেন?”
-শাশুড়ী মা মেয়েকে বিধবা করতে চেয়েছিল কি-না কে জানে।”
-আছেন তাহলে।”
-হ্যাঁ। আমি মরলে তুমি বিধবা হবে ভেবেই এখনও মরিনি।”
-বাবা গো বাবা! মানুষ এত খায়! একটা মানুষ কীভাবে এতগুলো খাবার খেতে পারে!”
নীড় চোখ খুলে কথাকে দেখল। কথা তাকে টিটকারি মারছে!
-কথাটা অন্য ভাবেও বলা যেতে পারে। একটা মানুষকে জোর করে কীভাবে এতগুলো খাবার খাওয়াতে পারে! মায়া দয়া নাই মনে? যদি আমি মরে যেতাম!”
-আপনার মুখ নেই? না করতে পারলেন না!”
-আমার না তোমার মা শুনেছে! তুমিই বা কেমন বউ? বরকে তোমার সামনে নির্যাতন করা হচ্ছে তুমি বাধা দিলে না!”
-আমি কেন বাধা দিব। যাই হোক, আপনি শুয়ে থাকুক আমি একটু ঘুরে আসি।”
-কোথায় যাবে?”
-পাশেই। দেখে আসি সবার কী খবর।”
-যাও আমাকে এখন এক কোটি টাকা দিলেও উঠতে পারব না।”
-ঠিক আছে। আমার দেরি হলে মা’কে কিছু বলবেন না। আমি একটু আলম ভাইদের বাড়ি যাব।”
কথার মুখে আলম ভাই নাম শুনেই নীড় ঝট করে উঠে বসল। কথার সোহান ভাইকে তো সে দেখেছে। এখন আবার এই আলম ভাইটা কে? এর নাম তো আগে কখনও শুনেনি! এই মেয়েটার ভাইয়ের সংখ্যা এত বেশি কেন?
-দাঁড়াও। আমিও যাব।”
চলবে_
আসসালামু আলাইকুম
(১৫০০+ শব্দের পর্ব। যারা যারা পড়বেন কষ্ট করে কমেন্ট করবেন। আর অনেকদিন বিরতি নিয়ে লেখার জন্যই হয়তো গল্পটা লিখে তৃপ্তি পাচ্ছি না। আপনাদের কাছে কেমন লাগছে জানি নাহ।)