#চুপকথারা_বিষন্ন
#জেরিন_আক্তার_নিপা
|পর্ব ৩৩|
নীড়কে ছাড়া কথা একাই সোহান ভাইয়ের সাথে চলে গেল। নীড়ের কথা সে বিশ্বাস করেনি। পাতানো মা এমন করতেই পারে না। আর বাবার সম্পর্কে এমন কিছু কথা কল্পনাতেও আনতে পারে না। বাবার মত একজন মানুষ কিনা নিজের স্ত্রীকে ধোঁকা দিবে! অসম্ভব। নীড়ের নিজের বাবার চরিত্রে দাগ লাগানোর আগে একটুও বিবেকে বাঁধলো না! কথা এবার বুঝতে পারছে। নীড় তার জীবনে সঠিক মানুষ না। ভুল একটা মানুষের সাথে সংসার করছে সে। সিএনজিতে বসেও কথা খুব কাঁদল। সোহান ভেবেছে হয়তো শিউলি খালার জন্য কাঁদছে কথা। মেয়েটা মানুষটাকে মা’র মত দেখত। শিউলি খালাও কথাকে কোনোদিন সন্তানের থেকে কম মনে করেনি। সোহান কথাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল,
-কাঁদিস না কথা। সব ঠিক হয়ে যাবে।”
এই কথাতে কথার কান্না থামলো না। কথা জানে কিছুই আর ঠিক হবার নয়। কান্না গেলার প্রাণপণ চেষ্টা করে কথা মনে মনে বলছে,
-কিছুই ঠিক হবে না সোহান ভাই। মানুষটাকে চিনতে আমার বড্ড ভুল হয়ে গেছে। কিছুই আর ঠিক হবে না। উনার সাথে আমি থাকতে পারব না। আমাকে চলে আসতে হবে। ওই মানুষের সাথে ঘরকরা কোন মেয়ের পক্ষেই হয়তো সম্ভব হবে না। মানুষটা ভীষণ স্বার্থপর সোহান ভাই। ভীষণ নির্দয়।”
হাসপাতালে পাতানো মা’কে দেখে কথার বুকের ভেতরটা মুচড় দিয়ে উঠল। শিউলির হয়তো কথাকে দেখার জন্যই এখনও চোখ খুলে রেখেছে। কথাকে অনেককিছু বলার আছে তার। যা এর আগে কোনোদিনও বলার সাহস হয়নি। কিন্তু আজ যে বলতেই হবে। বেশি সময় নেই তার হাতে। তার দুর্বল হাতটা তুলে কথাকে ইশারা করে নিজের কাছে আসতে বলল। কথা ভীষণ কষ্টে কান্না চাপছে। শিউলির পাশে এসে দাঁড়াল সে। হাসবার চেষ্টা করল। কান্না হাসি মিলিয়ে ওর চেহারা অন্যরকম দেখাল৷ ক্ষীণ গলায় শিউলি ডাকল,
-কথা! কথা।”
কথা শিউলির বাড়িয়ে দেওয়া হাতটা শক্ত করে ধরলো। নিজেকে সামলে রাখার চেষ্টায় কোন ত্রুটি রাখছে না সে। তবুও গলাটা কেমন কেঁপে উঠছে।
-বলো মা।”
-নী-নীড় আসেনি, না?”
কথা কিছু বলতে পারল না। ওর চোখ বেয়ে কয়েক ফোঁটা পানি পড়লো শুধু।
-নীড় আজও আসেনি, না! আমি জানি ও আসবে না। ছেলেটা ভীষণ একরোখা।”
-তোমার কষ্ট হচ্ছে? কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে তোমার? আর কথা বলো না৷ শুয়ে থাকো।”
শিউলি কথার কোন কথাই কানে নিল না।
-ওকে তুই ভুল বুঝিস না মা। নিজের হাতে ওকে আমি বড় করেছি। আমি জানি আমার নীড় কেমন। আমার বিশ্বাস তুই ওকে ঠিক বুঝতে পারবি।”
-তুমি চুপ করো না।”
-তোকে অনেক কিছু বলার আছে আমার। অনেকদিন বলব ভেবেছি। কিন্তু বলার সাহস হয়নি। আজ বাধা দিস না।”
-কিছু বলতে হবে না তোমার। কিছু শুনতে চাই না আমি।”
-আমার দ্বারা অনেক বড় একটা ভুল হয়ে গেছিল। ভুলটাকে জঘন্যও বলা যায়। সেই ভুলের প্রায়শ্চিত্ত আজও করতে পারিনি। তুই জানিস ভুলটা কি?”
মাথা নিচু করে কথা জবাব দিল,
-না।”
হাসল শিউলি। চোখের কোণ বেয়ে পানি পড়ছে তার। চেহারায় কাতরতা ফুটে উঠেছে।
-আমি নারী জাতিকে অপমান করেছি। জানিস কথা আমি না তখন ঠিক বুঝতে পারিনি। কী থেকে কী হয়েছে জ্ঞান ছিল না তখন। কিন্তু ঘটনা ঘটার পর যখন বুঝতে পারলাম তখন আমি দূরে সরে এসেছি। কিন্তু সেটা করতেও অনেকটা দেরি হয়ে গেছিল। ততদিনে নীড়ের মা নাজমুন আমাদের সম্পর্কে সব জেনে গেছিল। মেয়েটা ভীষণ অভিমানী ছিল। ওর আত্মসম্মানবোধও ছিল তীব্র। কিছুতেই মেনে নিতে পারেনি ও। আমি অনেকবার মাফ চেয়েছি। কিন্তু ওর ক্ষমা আমি পাইনি। সেই ঘটনার পর স্বামী সংসারের উপর থেকে ওর বিশ্বাস উঠে পড়েছিল। হয়তো ছেলেটার জন্যই সংসারে পড়ে ছিল। ছেলের মাথা থেকে বাবা ছায়া সরাতে চায়নি। ওর মনের ক্ষত ছিল গভীর। ওই ক্ষত নিয়ে বেশিদিন টিকে থাকতে পারেনি। নীড়ের তখন এগারো বছর বয়স, নাজমুন ওর চোখের মণি, একমাত্র কলিজা ছেড়া ধনকে এতিম করে পরপারে পাড়ি জমায়। ছেলেটা মা’কে ছাড়া কিচ্ছু বুঝত না। নিয়তির পরিহাস দেখ, আমার মত পাপীর মাঝে ও নিজের মা’কে খুঁজে নিল। নীড়কে পেয়ে আমার পাপবোধ আরও তীব্র হলো। সারাক্ষণ ভয়ে ভয়ে থাকতাম যেদিন নীড় সত্য জানতে পারবে সেদিন ওর চোখে পৃথিবীর সবথেকে নিকৃষ্ট মানুষটা আমি হবো।”
শিউলির চোখ বেয়ে অঝোর ধারায় অশ্রু ঝরছে। তার মানে নীড় মিথ্যে বলেনি। বানিয়ে বানিয়ে পাতানো মা’র নামে ওসব কথা বলেনি। কথা কাকে দুষবে বুঝতে পারছে না। পাতানো মা’র মুখ থেকে শুনেও বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে না ওর। বাবা এমন একটা কাজ করতে পারল! কীভাবে নিজের অর্ধাঙ্গিনীকে ঠকালেন তিনি! এইজন্যই বাবার সাথে নীড়ের সম্পর্ক ওরকম। বাবার প্রতি ঘৃণা কাজ করে মানুষটার! কথা নিজের কথাই ভাবছে, সে ঘরের বউ থাকা স্বত্বেও নীড় পরনারীতে আসক্ত হলে কথা কি কখনও নীড়কে ক্ষমা করতে পারবে? নাকি ওই মেয়েটাকে ক্ষমা করতে পারবে সে।
-তু-তুমি,,,উনি তোমাকে মা বানিয়েছি, তার মানে কি বাবা তোমাকে বিয়ে…
-না। নীড়ের মা’র সংসারে আমি চাইলেও হয়তো যেতে পারতাম না। আর স্ত্রী মারা যাবার পর ওই মানুষটাও কেমন পাল্টে গেল। আমাকে বিয়ের প্রস্তাব সে কখনও দেয়নি। হয়তো নিজের ভুল বুঝতে পেরেছিল। আমার মতই অনুশোচনার আগুন ওকেও ভেতর থেকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে খাক করছিল।”
পাতানো মা’র উপর নীড়ের রাগ অযৌক্তিক না। বাবার সাথেও ওরকম ব্যবহার করার যথেষ্ট বড় কারণ আছে।
-উনি কবে সব জানলেন? কীভাবে জানলেন?”
-কীভাবে জানলো জানি না। হয়তো নাজমুনের কোন ডায়েরিতে ওর কষ্টের কথা লেখা ছিল। সেটাই নীড়ের হাতে পড়েছে। তিনটা বছর আমি নীড়ের কাছে ওর মা সমতুল্য ছিলাম। তারপর একদিন এক দমকা হাওয়ায় সব শেষ হয়ে গেল। তুই প্রায়ই জানতে চাইতি না আমার কপালে এই দাগ কিসের। এই দাগ আমার ছেলের দেওয়া। যাকে আমি পেটে ধরতে পারিনি। তার বাবার বউ আমি কোনোদিন হতে পারিনি।
———–
ড্রাইভিং সিটে বসে সমানে সিগারেট ফুঁকে যাচ্ছে নীড়। অতীত যেন তার পিছুই ছাড়তে চাইছে না। দুনিয়ায় এত মানুষ থাকতে কথার ওই মহিলাকেই কেন মা বানাতে হবে। মা হওয়ার কোন যোগ্যতা আছে ওই মহিলার? কথা বাইরের একটা উটকো মানুষের জন্য তার সাথে ঝগড়া করে গেল। গাড়ি স্টার্ট দিয়ে ফুল স্পিডে কোথাও যেতে লাগলো নীড়। কে বাঁচল কে মরলো তাতে তার কিছু আসে যায় না। নীড় তার নিজের মাকে একটু একটু করে চোখের সামনে শেষ হয়ে যেতে দেখেছে। কিন্তু তখন কিছুই বুঝতে পারেনি। মা’র কষ্ট সে কমাতে পারেনি। বাবার সাথে মা’র মানঅভিমান সে-ও বুঝত। কিন্তু কোন কারণে এই মানঅভিমান তা ঠিক বুঝতে পারেনি।
-যে লোক ঘরে বউ রেখে পরকীয়া করে বেড়ায় ওই লোককে আমি অন্তত বাপ বলে স্বীকার করি না। ওই লোক আমার মা’কে সুখী করতে পারেনি। আমি তোমাকে ঘৃণা করি নাহিদ চৌধুরী। যতদিন তুমি বেঁচে থাকবে আমিও তোমাকে শান্তিতে বাঁচতে দিব। তোমার জীবনকে নরক করে তোলাই তোমার এই অপদার্থ ছেলের জীবনের একমাত্র লক্ষ।”
———–
শিউলির কবর দিয়ে সোহান ফিরে এসেছে। কথা শিউলির ঘরে ও যে খাট টায় থাকতো সেখানে বসে আছে। পৃথিবীতে আপন মানুষ বলতে শিউলির কেউ নেই। তাই আজ তার বিদায় বেলায় চোখের জল ফেলারও কেউ নেই। মানুষটা মনের মধ্যে কতটা কষ্ট নিয়ে এতগুলো বছর কাটিয়েছে। এর জন্য দায়ী কে? তার শ্বশুর, নীড় নাকি শিউলি নিজেই। সে কি জানতো না নাহিদ চৌধুরী বিবাহিত। তার একটা ছেলে আছে। সব জেনেও কেন ওই মানুষটার মায়ায় নিজেকে জড়ালো। আর বাবাও কেমন মানুষ! স্ত্রীকে ভালো না বেসেই সংসার করেছিল! আসলে ভালোবাসা কি এতকিছু বাছবিচার করে হয়। কথার চোখের পানি শুকিয়ে গেছে। নীড়ের কাছে পাতানো মা যেমনই হোক। তার কাছে নিজের মায়ের থেকে বেশি ছিল। তার বয়স তখন কত হবে? দশ কি এগারো। বাবা তার জন্য নতুন মা নিয়ে আসে। সেই মা বাবা যতক্ষণ বাড়িতে থাকে ততক্ষণই তাকে আদর করে। এই দেখানো আদরও শিমুলের জন্মের পর শেষ হয়ে গেল। ঘরের কোন কাজই কি সে ঠিকঠাক মত পারতো। তারপরও করতে হতো। আর পান থেকে চুন খসলেই মারধর তো কপালে ছিলেই।
(অতীত)
ছোট্ট কথা সেদিন সব দুঃখ কষ্ট থেকে মুক্তি পেতে মনের মধ্যে একরাশ অভিমান নিয়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে যেতে চেয়েছিল। বড় গলিটা পেরিয়ে আর কিছুই চিনতে পারছিল না। রাতের অন্ধকারে ভয় পেয়ে ছোট্ট মেয়েটা কাঁদতে লাগল। বাড়ি ফিরে যেতে চাচ্ছিল সে। কিন্তু অন্ধকার থাকায় বাড়ির রাস্তাও চিনতে পারছিল না। ফিরে যাওয়ার কোন উপায় না পেয়ে গুটিগুটি পায়ে হাঁটতে লাগল। তখনই দূরে বসে থাকা একদল কুকুর ওকে দেখে উঠে দাঁড়ায়। ওই গলিটাতে ও অপরিচিত বলেই হয়তো কুকুর গুলো ওকে দেখে ঘেউঘেউ করতে লাগে। কথা ভয় পেয়ে চিৎকার করে কাঁদে। আশেপাশে কাউকে খুঁজে। কিন্তু তাকে সাহায্য করার জন্য ওখানে একটা লোকও ছিল না। কথা দৌড়ে পালিয়ে আসতে চাইলে কুকুর গুলো ওকে তাড়া করে। সেদিন হয়তো কুকুর গুলো ওকে ছিড়ে খেয়ে ফেলত। কথার কান্নার শব্দে পাতানো মা বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে। কুকুর গুলোর হাত থেকে ওকে বাঁচিয়ে নেয়। ভয় পেয়ে কেঁদেকেটে ঘাম দিয়ে পুরোপুরি ভিজে উঠেছিল। পাতানো মা ওকে বুকে জড়িয়ে নেয়৷ ঘরে নিয়ে গিয়ে ওকে শান্ত করে। সেই দিন থেকেই কথার পাতানো মা হয় শিউলি। তারপর থেকে কথা কোনোদিন মায়ের অভাব বোধ করেনি। তার সবসময়ই মনে হয়েছে তার কাছে তো একটা মা আছে। আজ সেই পাতানো মা’র বিছানা খালি। কথাকে একা রেখে অনেক দূরে পারি জমিয়েছে।
ওসব কথা মনে করেই ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল কথা।
-পাতানো মা। তুমি কোথায় চলে গেলে?”
সোহান কথার মাথায় হাত রাখলো। ওকে শান্ত করার জন্য বলল,
-কাঁদিস না কথা।”
-আমার প্রিয় মানুষ গুলো এত জলদি কেন আমাকে ছেড়ে চলে যায় সোহান ভাই।”
-যার যখন যাওয়ার সময় হবে তখন তো যেতেই হবে রে।”
-তুমিও কি আমাকে ছেড়ে চলে যাবে!”
-তোকে রেখে আমি কোথায় যাব পাগলী! তোর এই ভাইটা শেষ নিঃশ্বাস আব্দি তোর পাশে থাকবে।”
চলবে_
@মায়ামহল (নিপা’র গল্প)