#বেলীফুল
পর্ব-১৬
ইশরাত নিজের ফ্ল্যাটের ডোরবেল বাজালেন। দরজা খুলে দিলেন হাবিব। দরজা খুলেই প্রশ্ন করলেন, “এত দেরি করলে যে?”
ইশরাত মুখটা স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে বলল, “আর বলো না! এই মড়ার বৃষ্টি দেরি করিয়ে দিল। বের হতে দেরি, বাস পাই না..ধুর! ইলা কোথায়?”
“রান্নাঘরে। খুব খিদে পেয়েছিল৷ বললাম আমাকে খাবার দিতে। তুমিও চলে এসেছ, একসাথেই খাব।”
“কখন এসেছ তুমি?”
“আজ একটু তাড়াতাড়ি চলে এসেছি। ছুটি হয়ে গেছে বিকেলেই। সন্ধ্যা সন্ধ্যায় চলে এলাম।”
“ওহ। তুমি খেয়ে নাও। আমার একটু দেরি হবে। গোসল করব।”
ইশরাত রান্নাঘরে ঢুকলেন। ইলা লেবু কাটছে। ওর বাবার লেবু ছাড়া খাওয়া হয় না৷ মেয়েটাকে কেমন যেন আনমনা মনে হচ্ছে। ইশরাত খেয়াল করলেন ওর হাত অল্প অল্প কাঁপছে। “ইলা, বাবাকে খাবার দিয়ে এসে শুনে যাও।”
ইলা বাবার খাবার বেড়ে দিয়ে মায়ের ঘরে উঁকি দিল৷ “বলো মা।”
“এদিকে এসো।”
ইলা এগিয়ে গিয়ে মায়ের মুখোমুখি দাঁড়াল। তার কেমন যেন ভেতরটা গুলিয়ে আসছে। পেটের ভেতর পাক খেয়ে উঠছে। টেনশন আর সাসপেন্স একসাথে মিলে ওর এরকম হয়। এই অনুভূতি সবসময় হতো পরীক্ষার রেজাল্টের দিন। আজ হচ্ছে কেন? এমনিতে সব ঠিকঠাক আছে, কিন্তু ওর অবচেতন মন জানাচ্ছে, মোটেও কিছু ঠিক নেই। তোমাকে নিয়ে বড় কোনো ঝামেলা হতে যাচ্ছে!
ইশরাত শীতল গলায় বললেন, “আমরা যাওয়ার পর তুমি সকাল থেকে কী কী করেছ?”
ইলা মনে করার চেষ্টা করল। কিন্তু গলা শুকিয়ে এলো তার। তারা বের হয়ে যাওয়ার পর সে প্রথম কাজটা করেছে কাননের ফ্ল্যাটে ঢোকা। তারপরই সেই অঘটন….ইলার গলা দিয়ে একটা আওয়াজও বের হলো না। ইশরাত কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে চাপা গলায় বললেন, “তুমি পাশের ছেলেটার ঘরে যাও?”
ইলা নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে ওপর নিচ মাথা নাড়ল।
“কেন যাও?”
জবাব দিতে পারল না ইলা। মায়ের এমন স্বরের সাথে সে খুব অল্পই পরিচিত। এভাবে মা কখনো বকেন না৷ মায়ের শাসন বারণ সবকিছুর মধ্যেই প্রচ্ছন্ন কোমলতা মিশে থাকে। আজকের কথা শুনে ইলার ভয় করছে। উত্তর দেবার সাহসই করতে পারছে না।
“ছেলেটা কি তোমাকে ডাকে?”
“না মা।”
“ইলা! তুমি সত্যি কথা বলো! আমি কিছু বলব না।” ইলার ভয়ার্ত মুখ দেখে খানিকটা নরম হলো ইশরাতের গলা।
ইলার চোখে পানি জমে গেল। কাঁপা গলায় সে বলল, “আমি তো…”
“বলো?”
ইলা চোখের পানি চেপে রেখে অতিকষ্টে বলল, “মা, তুমি বললে আমি আর কখনো ওর বাসায় ঢুকব না। কিন্তু শুধু একটু…”
“কী একটু?”
ইলা এবার নিজেকে একটু সামলানোর চেষ্টা করল। গলা পরিষ্কার করে বলল, “মা আমি ওর বাসায় এমনি যাই, কোনো খারাপ উদ্দেশ্যে না। ও অনেক ভালো। কখনো আমার দিকে ভালো করে তাকায়ও না। আমিই যাই নিজে থেকে। অনেক এলোমেলো লোকটা, আমার ইচ্ছে করে একটু গুছিয়ে দিতে। আর কিছু না।”
“ছেলেটা না চাইলেও তুমি ওর কাছে যাও?”
ইলা মাথা ঝাঁকাল। ইশরাত হতাশ গলায় বললেন, “তুমি বড় হওনি ইলা? জানো না লোকে দেখলে কী বলবে?”
ইলা নিরুত্তর। ইশরাত বললেন, “তোমাকে আমি কত বিশ্বাস করে একা রেখে যাই জানো?”
ইলা কেঁদে ফেলল। “আমি কিছু করিনি তো…”
“তুমি ছেলেটাকে পছন্দ করো?”
ইলা চুপ করে রইল। শুধু পছন্দ করে না, তারচেয়ে অনেক বেশি কিছু। কিন্তু মায়ের সামনে কি সেটা বলা যায়?
ইশরাত বললেন, “তুমি আর ওখানে যাবে না।”
ইলা কাঁদতে কাঁদতে বলল, “মা তুমি চাইলে আর কক্ষনো যাব না। কিন্তু তুমি কি শুধু আজকে একটু সময়ের জন্য আমাকে যেতে দেবে? ও আজকে বৃষ্টিতে ভিজে ফিরেছে। চোখটোখ লাল হয়ে ছিল। শিওর জ্বর এসেছে। ওকে দেখার তো কেউ নেই। আমার ভীষণ খারাপ লাগছে মা। বাবা ছিল বলে আমি যেতে পারিনি। তুমি কি একটাবার আমাকে যেতে দেবে? শুধু অল্প একটুক্ষণ? তারপর আমি আর কখনো ওর কাছে যাব না।”
এটুকুই বলতে পারল ইলা। বলতে বলতেই সে ফ্লোরে বসে পড়েছে। ব্যকুল হয়ে কাঁদছে। ইশরাত হতভম্ব হয়ে বসে রইলেন।
***
অনেক বছর আগের ঘটনা। ইশরাত তখন ক্লাস নাইনে পড়ে। ভাদ্র মাসের গরমের এক রাতে হঠাৎ তার ঘুম ভেঙে গেল চেঁচামেচির শব্দে। উঠে দেখল পাশে আপা নেই। ঘর থেকে বের হয়ে ভয়ানক এক দৃশ্য দেখতে পেল সে। মা উঠোন ঝাড়ু দেয়ার শলার ঝাড়ু মনের ঝাল মিটিয়ে ভাঙছেন আপার পিঠে। আপা চেঁচিয়ে কাঁদছে। বাবা গম্ভীর মুখে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে এক কোণে। দুই চাচী মাকে উৎসাহ দিচ্ছেন মেয়েকে আরও মারার জন্য। যাতে জীবনে আর কোনোদিন কোন ছেলের সাথে বাড়ি থেকে পালানোর কথা ভাবতেও না পারে।
সেদিন তার আপা পালাতে চেয়েছিল প্রেমিকের হাত ধরে। পারেনি, ধরা পড়ে গিয়েছিল দেয়াল টপকাতে গিয়ে।
পরের সপ্তাহেই আপার বিয়ে হয়ে যায়। বিয়ের কিছুদিন পর আপা বাড়িতে আসে। ইশরাতের স্পষ্ট মনে পড়ে আপাকে দেখে মনে হচ্ছিল সে শ্বশুরবাড়ি থেকে আসেনি, এসেছে জেলখানা থেকে। সুন্দর মুখটা বিষন্নতার ক্লান্তিতে একেবারে বুড়িয়ে গেছে মাত্র ক’দিনেই।
সেরাতে আপা ওকে জড়িয়ে ধরে ব্যকুল হয়ে কাঁদছিল। অনেক কাঁদার পর খুব আদর করে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছিল ওকে। সকালে উঠে আপার গলায় দড়ি দেয়া শরীরটা প্রথম ইশরাতই দেখেছিল।
আজ নিজের মেয়েকে এভাবে কাঁদতে দেখে ইশরাতের ছোটবেলার ভয়টা ফিরে এলো। আপার মৃত্যুর বহুদিন পর পর্যন্তও ইশরাত অনেকটা অপ্রকৃতিস্থ ছিল। ভালোবাসা বিষয়টার সাথে পরিচয় ঘটানোর কোনো চেষ্টাই সে কোনোদিন করেনি। বিয়ে করেছে পরিবারের ইচ্ছেতে। প্রথম প্রেম তাই স্বামীর সাথেই, যাকে সহজে হারিয়ে ফেলার ভয়টা নেই। তবে তার মেয়ে কেন এই পথে পা বাড়াল? কী হতো যদি সে মেয়েকে আগেই এসবকিছু থেকে দূরে রাখত? সাবধান করে দিত?
ভালোবাসা যে সবসময় শুধু বিপর্যয় বয়ে আনে তা নয়, এই বয়সের অনেক প্রেম অন্ধ আবেগও হয়। যেই আবেগ একটা বাস্তবতার ধাক্কায় খড়কুটোর মতো ভেসে যেতেও দেরি হয় না। ইশরাত নিজে তেমন কত দেখেছে!
কিন্তু নিজের মেয়ের চোখে অল্প বয়সের আবেগের চিহ্ন দেখা যাচ্ছে না। কী গভীর মনোযোগ দিয়ে সে ছেলেটার সেবা করছে! যত্ন করে মাথায় জলপট্টি দিয়ে দিচ্ছে! ইশরাত অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে সেদিকে। তার মাথায় চিন্তার ঝড়। বুকে কাঁপুনি ধরিয়ে দিচ্ছে ভয়। একটামাত্র মেয়ে তার। আজ কেমন পর পর লাগছে। মেয়েকে সে যেন চেনেই না।
কাননের ফ্ল্যাটে ইশরাত ইলাকে নিয়ে এসেছে একটু আগে। বেল টেপার বেশ কিছুক্ষণ পর দরজা খুলেছে কানন। খুলেই দুর্বল শরীর এলিয়ে পড়েছে মেঝেতে। হাবিবকে তখন ডেকে এনেছে দু’জন। তিনজনে মিলে কাননকে তুলে শুইয়ে দিয়েছে বিছানায়। কাননের গা তখন প্রচন্ড জ্বরের তাপে পুড়ে যাচ্ছে। শরীর কাঁপছে শীতে। ঠোঁট শুকিয়ে গেছে।
ইশরাত তাড়াতাড়ি প্যারাসিটামল খাওয়াতে গেলে ইলা বাঁধা দিয়ে বলেছে, “ও বোধহয় কিছু খায়নি মা!”
তারপর ইলা নিজেই ঘর থেকে ফলের জ্যুস করে এনে খাইয়েছে কাননকে। ঔষধ খাইয়ে এখন মাথায় জলপট্টি দিয়ে দিচ্ছে। ইশরাত শুধু অবাক চোখে দেখছেন সবকিছু। মেয়েটা ছোট থেকেই অনেক বোঝে, অনেক কাজের৷ কিন্তু তাই বলে কবে যে মেয়েটা সত্যিকারের নারী হয়ে উঠেছে তিনি টেরও পাননি!
রাত বাড়লে ইশরাত ইলাকে পাঠিয়ে দিল নিজেদের ফ্ল্যাটে। বলে দিল তার ঘরেই শোবে ইশরাত। সে যেন বিছানা ঠিকঠাক করে রাখে।
হাবিবকে রেখে গেল কাননের কাছে। শেষবার কাননের জ্বর দেখতে কাছে যেতেই অবাক হয়ে শুনল কানন বিড়বিড় করে বলছে, “ইলা, আমি কি মরে যাচ্ছি? আমার এখন মরতে একটুও ইচ্ছে করছে না।”
(চলবে)