#বেলীফুল
পর্ব-১৮
ছেলের কোয়ার্টার রইসুদ্দিনের বেশ পছন্দ হয়েছে। সামনে একচিলতে জায়গায় কিছু গাছপালা লাগানো। তিনি ভোরে উঠে হাঁটতে বের হন। গেট দিয়ে বের হয়ে কিছুদূর গেলে একটা ছোট্ট পুকুর পড়ে। কচুরিপানা ভর্তি পুকুরের বাঁধানো ঘাটে বসে থাকেন একা। সময়টা তার ভালোই কাটে। শুধু সমস্যা হচ্ছে নতুন করে মানিয়ে নিতে কষ্ট হয়। পুরানো জীবনটা তাকে এখনো আচ্ছন্ন করে রেখেছে। ছেলেকে তিনি বলেছেন সব ভুলে বসে আছেন। কিন্তু আদতে প্রতিটা মুহূর্তও তার মনে আছে। ছেলের কাছে শিশুর মতো হয়ে থেকে আগের দুঃখ ভুলে যেতে চাইছেন। কতটুকু পারবেন জানেন না, তবে চেষ্টা করবেন খুব!
আজও কিছুক্ষণ হেঁটে টং দোকান থেকে চা খেয়ে ফিরলেন বাড়িতে। এলাকার একটা যুবতী মেয়ে নিখোঁজ হয়ে গেছে, তাই নিয়ে গরম আলোচনা সমালোচনা শুনে এসেছেন। ঘরে ঢুকে দেখলেন সাজিদ বসে আছে নাস্তা সাজিয়ে।
“বাবা! আজকে আমার ছুটি। আমরা একসাথে ব্রেকফাস্ট করব।”
“তোমার কিসের ছুটি?”
“ক্লাস নেই আজ। কিছু কাজ ছিল, ভাবলাম কাল গিয়ে একেবারে করব৷ আজ রেস্ট নেই। তোমার কী খবর বলো? ভোরে যে বের হও একেবারে নাকি দুপুরে ফেরো? আমি তো থাকি না, দেখিও না।”
“ওই তায়িফটা এসব কথা লাগায় তাই না? এই সময়েই তো আসি।”
তায়িফ চাচা পাউরুটিতে মাখন লাগাতে লাগাতে হুহ জাতীয় বিচিত্র শব্দ করে বলল, “সংসার এমন আউলায় থাকব যতদিন না সাজিদ বাবা একটা বিয়া করে। আফনে তো কিছু কন না ভাইজান।”
রইসুদ্দিন হেসে বললেন, “সাজিদ! কবে বিয়ে করছো জানতে পারি?”
সাজিদ মৃদু হাসল। ইলাকে বলতে হবে। কী করে বলবে বুঝতে পারছে না। ঠিক করেছে যেভাবে ক্লাসের লেকচার তৈরি করে সেভাবে কিছু লিখে তারপর সেটা মুখস্থ করে বলে দেবে। শালার জীবনে এতকিছু শিখেও প্রেম নিবেদনটা শেখা হলো না!
***
ইলা বাড়ির ভেতর পা দিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। ক’দিন এত দৌড়াদৌড়ি তার আর সহ্য হচ্ছে না। কাননের অবস্থা সে রাতে একেবারে খারাপ হয়ে গিয়েছিল। তাকে ভর্তি করা হয়েছে হাসপাতালে। ঠান্ডা থেকে নিউমোনিয়া হয়ে গেছে। সেখানে ছুটতে হচ্ছে। এদিকে সেদিন ভোরে তুলনকে আরেক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। ভয়াবহ ডায়েরিয়ায় ভুগে মেয়েটা দু’দিনেই একেবারে অর্ধেক হয়ে গেছে। ইলা একবার এ হাসপাতাল থেকে ও হাসপাতালে ছুটছে।
আজ সকালে কাননকে একবার দেখে আসার সময় তুলনের ওখানে ঢু মেরে এসেছে। তুলনের অবস্থা এখন একটু ভালোর দিকে। কিন্তু মেয়েটা কাহিল হয়ে পড়েছে খুব বেশি৷ গর্তে বসে গেছে চোখ। কাননের অবস্থা ভালোই বলা চলে। আগামীকাল হয়তো বাসায় ফিরতে পারবে। আজ নাকি তার খুব ঝাল খেতে ইচ্ছে করছে। ইলা তাই দ্রুত বাসায় এসেছে। কী রান্না করে নেবে বুঝতে পারছে না। চিন্তায় মাথা ঘুরছে। এ সময় সাজিদের ফোন। ইলা ধরবে না ভেবেও ধরল।
“হ্যালো।”
“কেমন আছো ইলা?”
“ভালো। আপনি?”
“আছি। কী করছো?”
ইলার মাথায় কাজের চিন্তা ঘুরছে। ডীপ ফ্রিজটা খুলে দেখছে কী আছে তাতে। সে ব্যস্ত ভঙ্গিতে বলল, “কাজ করছি। আপনি কি কোনো জরুরি কথা বলতে ফোন করেছেন?”
“উমম..হ্যাঁ..ওহ না তেমন কিছু নয়।”
“তাহলে রাখছি৷ আমি একটু ব্যস্ত।”
ইলার তখন মাথায় নতুন বুদ্ধি এসেছে। ইলিশ মাছ আছে অনেগুলো। ইলিশটা সেদ্ধ করে কাটা বেছে বেশি করে পেঁয়াজ মরিচ দিয়ে ঝাল করে ভাজলে বেশ হয়। ওর মা করে মাঝে মাঝে। এটাই করবে সে। কাননের নিশ্চয়ই পছন্দ হবে!
***
তুলন হাসপাতালে শুয়ে শুয়ে যতটা সময় ভালো লাগে মোবাইল স্ক্রল করতে থাকে। শরীর অসুস্থ থাকলেও তার মস্তিষ্ক চলছে পুরোদমে। নিজের একটা ফেইক একাউন্ট খুলেছে সে। সেটাতে কলেজের নামের জায়গায় ভাবির কলেজের নাম দিয়েছে। সেই কলেজের ফেসবুক গ্রুপ খুঁজে বের করে অ্যাড হয়েছে তাতে। এবার যাদের পরীক্ষা হচ্ছে তাদের নিয়ে যত পোস্ট হয়েছে সেসব পোস্টেট লাইক, কমেন্ট চেক করে দেখছে।
এই করতে করতেই সেই ছেলেকে পেয়ে গেল সে। প্রোফাইন পিকচারে ঝাঁকড়াচুলো ছেলেটার হাসিমুখের চেহারা ভেসে আছে। কী দারুণ লাগছে তাকে! হাতে একটা ছোট্ট বিড়ালছানা। পরম মমতা দিয়ে ছেলেটা চেয়ে আছে বিড়ালটার দিকে।
তুলন তক্ষুনি বন্ধু হওয়ার অনুরোধ পাঠিয়ে দিয়েছে। এখন শুধু কথা হবার পালা। উত্তেজনায় তুলনের কেমন যেন অস্থির লাগছে।
***
ইলা টিফিন বক্স খুলে বলল, “উঠে পড়ুন জলদি! গরম গরম খেতে ভালো লাগবে।”
কানন চুপচাপ শুয়ে চেয়ে আছে ইলার দিকে। ক্লান্ত মেয়েটা, বোঝাই যাচ্ছে। গায়ের রঙ ক’দিনে একটু তামাটে হয়েছে। শারীরিক পরিশ্রমের সাথে চিন্তা তো আছেই। রাতে না ঘুমিয়ে বসে গেছে চোখের কোল। সেই চোখে কী শান্ত দৃষ্টি! স্নিগ্ধ সুন্দর মুখের দিকে তাকিয়ে কাননের বেঁচে থাকার তৃষ্ণা প্রবল হয়।
ইলার তাড়ায় উঠে বসে আস্তে আস্তে। জিজ্ঞেস করে, “তোমার বাসার কী অবস্থা?”
ইলা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, “বুঝতে পারছি না। মা খুব ঠান্ডা আচরণ করছে। বাবাকে কিছু বলেছে কিনা তাও জানি না।”
“এখানে আসতে নিষেধ করেনি?”
“না। কিছু বলেনি। আপনার সাথে কথা বলা আমার এমনিতেই নিষেধ। তবে এখন তো আপনি অসুস্থ। নিষেধ করলেও আপাতত শুনছি না। সুস্থ হলে তারপর দেখা যাবে।”
“এখানে আসার কথা জিজ্ঞেস করলে কী বলো?”
“কিছু জিজ্ঞেস করেনি এখনো।”
“আজ যদি করে?”
“করলে বলব এসেছি।”
“তোমরা কি বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে ইলা?”
ইলা বড় করে নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “জানি না তো! যেতেও পারি।”
কানন কিছুক্ষণ চুপ করে কিছু ভাবল। ইলা বলল, “খাবেন না নাকি? আমি অনেক কষ্ট করে রান্নাবান্না করে এনেছি।”
কানন যেন সেটা শুনতেই পায়নি। আনমনে বলল, “আমি যদি তোমাকে বিয়ে করে রেখে দিতে চাই তোমার মা বাবা রাজি হবেন?”
ইলা হতভম্ব হয়ে গেল। এ কথা কানন বলবে সে ভাবতেও পারেনি। এত অবাক হলো যে কথা বলতে ভুলে গেল।
কানন আর কথাটা দ্বিতীয়বার বলল না। টিফিনবাক্স এগিয়ে নিজের দিকে নিয়ে খাবারের ঘ্রাণ নিয়ে বলল, “বাহ! দারুণ হয়েছে মনে হচ্ছে। আর ক’দিন পর সেরা রাঁধুনি হয়ে যাবে এটা জানো? এই ইলা..আমার নিজ হাতে খেতে ইচ্ছে করছে না। খাইয়ে দেবে?”
ইলা প্রাণপণে কান্না চেপে রাখার চেষ্টা করে ভাত মাখিয়ে কাননকে এক লোকমা খাইয়ে দিয়ে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল।
কানন কিছুই বলল না। কান্নারত ইলাকে দেখতে থাকল মুগ্ধ হয়ে। মানুষের কান্না এত সুন্দর হয় কেমন করে?
(চলবে)