বেলীফুল পর্ব-২০

0
1195

#বেলীফুল
পর্ব- ২০

রইসুদ্দিন ঘুম থেকে উঠে দেখলেন সাজিদ বসে আছে বাড়ির সামনের পেয়ারা গাছের নিচে। কেমন স্থির, শান্ত দৃষ্টি তার। রইসুদ্দিনের কাছে গিয়ে কাঁধে হাত রেখে পাশে বসলেন। সাজিদ ঘুরে তাকাল। ওর চোখদুটো কি ভেজা ভেজা?

“কী হয়েছে?”

সাজিদ ক্লান্ত স্বরে বলল, “ঘুম হয়নি বাবা।”

“কেন?”

“জানি না।”

“মন খারাপ তোমার?”

সাজিদ মাথা নাড়ল।

“কারণটা শুনি?”

“না শুনলে হয় না বাবা? ভালো লাগছে না।”

“তায়িফ ঠিকই বলে, তোমার বিয়ে হওয়া দরকার।”

সাজিদ বাঁকা হেসে বলে, “মেয়ে দেখো, বিয়ে দিয়ে দাও।”

“তোর পছন্দ নেই?”

“নাহ…”

রইসুদ্দিন দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, “কেউ কি তোকে কষ্ট দিয়েছে বাবা?”

সাজিদ হতাশ গলায় বলল, “আমি নিজেই নিজেকে কষ্ট দেই বাবা। বারবার। আমাকে কষ্ট দেবার কেউ নেই।”

রইসুদ্দিন উঠে পড়ে বললেন, “চলো হেঁটে আসি।”

“ভালো লাগছে না।”

“আরে চলোই না। চায়ের দোকানের আড্ডায় বসলে এমনিতেই মন ভালো হয়ে যায়।”

অগত্যা সাজিদ উঠল। লেক পেরিয়ে মূল রাস্তার পাশ দিয়ে ইটের রাস্তা গেছে। তারই ধারে বেশ বড়সড় চায়ের দোকান। এই সকালেও লোকে গমগম করছে। সাজিদরা গিয়ে বসতেই এক বৃদ্ধ রইসুদ্দিনকে জিজ্ঞেস করলেন, “আপনার ছেলে নাকি?”

“জি আমার ছেলে।”

“মাশাআল্লাহ। এত সুন্দর ছেলের এখনো বিয়া দেন নাই? পাত্রীর তো লাইন লাগার কথা এর পিছনে।”

রইসুদ্দিন হাসলেন। সাজিদ মনে মনে বলল, চেহারা সুন্দর হলেই তাকে মেয়েরা পছন্দ করবে এটা কোথায় লেখা আছে?

গরম চায়ের সাথে আজকের আলোচনাটাও গরম। এলাকার একটা মেয়ে নিখোঁজ হয়ে গিয়েছিল, সেই মেয়ে গতকাল ফিরেছে। ফিরেছে মানে তাকে বাড়ির সামনে নামিয়ে দিয়ে গেছে একটা গাড়ি। বোঝাই যাচ্ছে কী হয়েছিল। মেয়ের বাবার আর মুখ দেখানোর জো নেই। কত লোকে কত কথা বানাচ্ছে! যারা কোনোদিন মেয়েটাকে দেখেওনি, তারাও নির্দ্বিধায় বলে দিচ্ছে চরিত্র খারাপ ছিল মেয়ের, ইচ্ছে করে গেছে। সাজিদ এক পর্যায়ে বিরক্ত হয়ে বাবাকে টেনে নিয়ে এলো সেখান থেকে।

বাবা ছেলে ঘুরপথে বাড়ি ফিরল। কর্মমুখর হয়ে ওঠা দিনের শুরুটা সাজিদের ভারি ভালো লাগল। একটা রাস্তা পার হওয়ার সময় রইসুদ্দিন তার হাত ধরলে বাবাকে পার করতে করতে সাজিদের মনটা ভরে গেল। নাই বা থাকল একটা ইলা, তার জীবন কি তাতে ব্যর্থ? এইযে এতদিন পর বাবাকে বাবার মতো পেয়েছে এই ভাগ্য যে তার হবে তাই কি ভেবেছিল সে? তাও তো ভালো ইলাকে কথাটা বলেনি সে। বললে প্রত্যাখ্যানের যে অপমান সহ্য করতে হতো তা থেকে তো বেঁচে গেছে!

একটা বাড়ির সামনে ঝোপালো বাগানবিলাস দেখে খুব ভালো লাগল সাজিদের। তার বাগান ভালো লাগে, কিন্তু নিজে করতে পারে না। আচ্ছা খুব চমৎকার বাগান করতে পারে এমন একটা মেয়ে দেখে বিয়ে করলে কেমন হয়? গুনগুন করে গান গাইবে আর গাছে পানি দেবে? ভাবতে ভাবতে হেসে ফেলল সাজিদ।

***

“ম্যাডাম, কী করছেন?”

“এইতো আচার খাচ্ছি।”

“আমারও অনেক শখ আচার খাওয়ার, কিন্তু বানিয়ে খাওয়ানোর কেউ নেই।”

“আহারে! আমি বানিয়ে খাওয়াব আপনাকে।”

“শিওর?”

“হ্যাঁ।”

একটু সময় নিয়ে আকাশ পরের মেসেজটা লিখল, “তোমার সাথে ফোনে কথা বলা যাবে?”

তুলন একটু ভেবে বলল, “আচ্ছা। ছাদে গিয়ে নেই।”

“ওকে!”

ছাদে গিয়ে তুলন দেখলে প্রচুর কাক উড়ছে। এত কাক কোথা থেকে এলো? সে কিছুক্ষণ কাকের ওড়াউড়ি দেখল। আকাশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করুক। এত ছাড় দিলেই পেয়ে বসবে। একটু রয়েসয়ে এগুনো যাক!

আকাশ একটু পর বিরক্ত হয়ে মেসেজ দিল, “ছাদে গেছো?”

“হ্যাঁ। কিন্তু এক আন্টি ছিল, তাই ফোন করতে পারিনি।”

“আন্টি গেছে?”

“হ্যাঁ।”

“আচ্ছা ফোন করলাম।”

“করুন।”

তুলনের বুক ঢিপঢিপ করতে লাগল। এই প্রথম সে আকাশের সাথে ভয়েস কলে কথা বলবে! ভাবলেই কেমন যেন লাগছে! আকাশের কি তার কথা পছন্দ হবে? এমনিতে তে পটেই গেছে প্রায়! এখন বাকিটা দেখা যাক!

তুলন কাঁপা স্বরে বলল, “হ্যালো।”

“তুলন!”

“জি।”

“কেমন আছো?”

“ভালো।”

“তুমি কি জানো আমি কোথায়?”

“কোথায়?”

“আমার বাসার একেবারে ওপরের ছাদে। এখান থেকে বহুদূর পর্যন্ত দেখা যায়।”

“তো?”

“আমার চোখের দৃষ্টি যতদূর যাচ্ছে, তার মধ্যে যত মেয়ে আছে, তাদের সবার ভয়েস মিলিয়েও তোমার মতো মিষ্টি হবে না।”

“যাহ! আর ফাজলামো করতে হবে না। আমি জানি আমার গলা ভালো না।”

“বিশ্বাস করো, অসম্ভব ভালো।”

তুলন লজ্জায় লাল হয়ে বলল, “থ্যাংস!”

“আর আমারটা?”

তুলন একটু হেসে বলল, “যতটা এক্সপেক্ট করেছি তারচেয়ে অনেক বেশি সুন্দর!”

“কতটা এক্সপেক্ট করেছিলে?”

“জানি না!”

আকাশ একটু হেসে বলল, “তুলন জানো?”

“কী?”

“আমার হার্টব্রেক হয়েছিল গত বছরের ডিসেম্বরে। এত কষ্ট পেয়েছিলাম যে….. আমি জানি না কতরাত জেগে থেকেছি, দু’চোখের পাতা এক করতে পারিনি। কষ্টে কেঁদেছি রাতভর। শুধু মনে হতো সে যদি একবার ফিরে আসতো…কিন্তু আসেনি। বিয়ে হয়ে গেছে তার। সেদিন আমাকে মেসেজ দিয়ে বলল, আমি নাকি মামা হব। তুমি ভাবতে পারো তুলন কী পরিমাণ কষ্ট সে আমাকে দিয়েছে? ও চলে যাওয়ার পর পড়াশোনা একেবারে গোল্লায় গেছে। কী পরীক্ষা দিয়েছি জানি না। বহুদিন পর আমার কোনো ভালো বন্ধু হলো। সেটা তুমি তুলন। থ্যাংস আ লট!”

তুলন সহানুভূতির গলায় বলল, “খারাপ লাগছে আপনার জন্য।”

“এখন অনেকটা সামলে নিয়েছি। তবু মনে পড়লে ক্ষতটা ব্যথা দেয়।”

“আর মনে করবেন না।”

“কী করে? সারারাত মনে পড়ে। ঘুম আসে না।”

তুলন হেসে বলল, “রাতে কথা হবে। আপনাকে ঘুমানের ঔষধ দিয়ে দেব।”

“সত্যি?”

“হ্যাঁ।”

“আচ্ছা তুমি কী করছো এখন?”

“কেন কথা বলছি আপনার সাথে।”

“আর কী করছো?”

“হাঁটছি।”

“ওয়াও! আমিও।”

হেসে ফেলল দু’জন। কথা চলল সন্ধ্যা পর্যন্ত।

***

কানন অনেকদিন পর অফিসে গেল। কেমন যেন নতুন লাগছে সবকিছু। এইযে পাতাবাহারটা, এটা কি আগে ছিল? পাপোশটা নতুন না? অফিসে কি নতুন রঙ করেছে এর মধ্যে? সবার চেহারা এমন অপরিচিতদের মতো লাগছে কেন?

কানন ঢুকতে ঢুকতে পিওন ওবায়দুল্লাহকে সালাম দিয়ে বলল, “কেমন আছেন চাচা?”

ওবায়দুল্লাহ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। কানন স্যার তার সাথে এ পর্যন্ত প্রয়োজন ছাড়া একটার বেশি দু’টো কথা বলেনি। আজ কী হলো? সে অভিজ্ঞ লোক। বিষ্ময় চেপে দ্রুত বলল, “আলহামদুলিল্লাহ ভালো স্যার। আপনি কেমন আছেন?”

“আমিও আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি।”

কানন এগিয়ে গেল নিজের ডেস্কের দিকে। তার তেমন বন্ধু নেই একথা সত্য, তবে কিছু মানুষ আছে, যারা তার সততার কারনে তাকে পছন্দ করে। সে অসুস্থ শুনে তারা হাসপাতালে দেখতে গিয়েছিল। কানন একে একে তাদের সবার কাছে গিয়ে টুকটাক কথা বলে এলো। ভালো লাগছে তার। ফ্রেশ লাগছে অনেক। আগের মতো ধোঁয়াশা অন্তরাত্মা পর্যন্ত জেঁকে বসে নেই।

বেশ কিছুক্ষণ কাজ করার পর হঠাৎ কেমন যেন খালি খালি লাগতে শুরু করল। কী নেই? কী নেই? ভাবতে ভাবতে মনে পড়ল সে অফিসে এলে একটু পরপর ইলার মেসেজ আসতে থাকে। সেটা আসছে না। সে ইলার ইনবক্স থেকে ঘুরে এলো। নতুন কোনো মেসেজ আসেনি। ইলা আর তার ব্যাপারটা ওর বাড়ির লোক জেনে গেছে। এখন হয়তো ইলাকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে। কানন কি তখন বাঁচবে? নাকি নতুন করে মরতে ইচ্ছে হবে? খোলা আবহাওয়াতেও তার কেমন যেন দমবন্ধ লাগতে শুরু করল। জীবন কি তার থেকে শুধু নেবেই? কিচ্ছু দেবে না?

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here