#বেলীফুল
পর্ব-২৫
আকাশে হালকা মেঘ জমছে। মৃদু বাতাসে গাছের পাতাগুলো নড়ছে। ঘাসের ডগা মাথা দোলাচ্ছে তালে তালে৷ তুলন আগে কখনো প্রকৃতির দিকে মনোযোগ দিয়ে তাকায়নি। আজ তার সব ভালো লাগছে। বোটানিক্যাল গার্ডেনের সারি সারি গাছের মাঝ দিয়ে হেঁটে যেতে অপার্থিব আনন্দ হচ্ছে। তার একটা হাত মুঠিতে ধরে রেখেছে আকাশ। মনে হচ্ছে প্রাণ গেলেও ছেড়ে দেবে না। তুলন কী বলবে, মুখরা মেয়েটাও লজ্জায়, ভালোলাগায় চুপটি হয়ে উপভোগ করছে সবকিছু।
আকাশ বলল, “চলো চা খাওয়া যাক।”
“এখানে চায়ের দোকান কোথায়?”
“ওইযে ছেলেটা বিক্রি করছে, ভ্রাম্যমাণ চাওয়ালা।”
বলেই হাক দিল আকাশ, “এই পিচ্চি, এদিকে…”
তুলন অন্য কোনো সময় হলে এসব কাপে চা খাওয়া দূরে থাক, ভাবতোও না। আজ নিল। প্রথম চুমুকেই মনে হলো চা টা অসাধারণ!
আকাশ চোখ মটকে বলল, “কী, কেমন?”
তুলন মৃদু হেসে বলল, “ভালো।”
আকাশ ভ্যাবলার মতো কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল, “তুমি একটু বেশিই সুন্দর তুলন।”
তুলন মনে মনে বলল, “তুমি আমার মন জয় করতে এসব বলছো জানি, কিন্তু তুমি নিজে আসলেই একটু বেশিই সুন্দর।”
***
সাজিদ বাসায় ফিরে নিজের ঘরে শুয়ে শুয়ে প্ল্যানটা সাজিয়ে নিল। খুব সাবধানে সবকিছু করতে হবে। ইউনিভার্সিটিতে পড়ালেও তার যে সেখানে অনেক ক্ষমতা একথা কোনোভাবেই বলা যাবে না। উল্টো তার তেমন কারো সাথে যোগাযোগ নেই বললে চলে। সে শুধুই নিজের সুন্দর চেহারার জন্য পুরো ইউনিভার্সিটির মুখচেনা।
মৌরি নিজের নাম্বারটা দিয়ে রেখেছে। সেটা সেভ করে ফেললে হোয়াটসঅ্যাপ থেকে নোটিফিকেশ এলো। মোরির একাউন্ট অ্যাড হয়ে গেছে তার সাথে। সেখানে ওর একটা ছবি দেয়া। কোনো এক পুকুরপাড়ে শাড়ি পরে আঁচল ছড়িয়ে বসে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে মেঘলা আকাশের দিকে। সাজগোজ নেই,কপালে ছোট্ট টিপ। বেশ সুন্দর লাগছে। ছবিটা কেন যেন স্ক্রিনশট নিয়ে সেভ করে রাখল সাজিদ। পরক্ষনেই মনে হলো, আগেও একটা মেয়ের ছবি সেভ করেছিল সে, ইলা। সেখান থেকে যথেষ্ট কষ্ট পেয়েছে সে। অপমানিতও হয়েছে নিজের কাছে। অতএব, সে দ্রুত গ্যালারিতে ঢুকে মৌরির ছবিটা ডিলিট করে দিল।
মোবাইলটা রেখে জানালার বাইরে তাকাল। আকাশে মেঘ করছে। সন্ধ্যার আঁধারের সাথে মেঘের ছায়া জমে দ্রুত কালো হয়ে আসছে চারপাশ। আবারও মৌরির কথা মনে পড়ল। মেয়েটা কি আর খুব কাঁদবে?
মা মারা যাওয়ার পরেও সাজিদের যেমন মনে হতো, আজ মৌরির জন্য তেমন মনে হলো, একটা কমানোর মেশিন থাকত, মাথাটা তাতে ঢুকিয়ে দেয়া যেত! পুরানো সব কষ্টের স্মৃতি ধুয়ে সাফ করে দিত মেশিনটা! কত ভালোই না হতো তাহলে!
***
ইলা আজ অনেকদিন পর চোখে কাজল পরেছে৷ কিছুদিন ধরে অনিয়ম আর কান্নাকাটিতে তার চোখের কোল বসে গেছে। আয়নায় নিজেকে দেখতেও কেমন যেন বিদঘুটে লাগছিল। কাজল পরে তবু খানিকটা শ্রী ফিরল। তার গায়ের রঙ এখন শ্যামলা না, কালো মনে হচ্ছে। এমনিতে তো কাননের সাথে দেখা করার সময় সে মাথার চুলটাও আঁচড়াতো না। এখন কি ভূতে পেলো? ইলার খানিকটা লজ্জাও লাগছে।
মা বাবা কেউ আসেনি এখনো। ইলার ভীষণ ইচ্ছে করছিল কাননের সাথে একটাবার দেখা করে আসে। কানন আজ দুপুরের পর চলে এসেছে, সে জানালা দিয়ে একনজর দেখেছে তাকে। একটু দেখে মন ভরেনি। মা তো তাকে বলেই দিয়েছে চিন্তা না করতে। যা হবে তার ভালোই হবে। গ্রীন সিগন্যাল পেয়ে গেছে ইলা। কাননের সাথে কথা বলা বা দেখা করতেও বারণ নেই এখন৷ শুধু ওর ফ্ল্যাটে ঢোকা যাবে না এই যা!
ইলা দরজা খুলে উঁকি দিল ওপাশের ফ্ল্যাটের দিকে। দরজা বন্ধ। কিন্তু দরজার সামনে অনেকগুলো জুতো। চকচকে মেয়েদের জুতো একজোড়া, একজোড়া পুরুষের শ্যু আর একজোড়া বাচ্চা মেয়েদের জুতো। এসেছে কারা? কাননের কোনো আত্মীয় নাকি!
ইলার আর কাননকে দেখা হলো না। একটু মন খারাপ আর অনেকটা কৌতুহল নিয়ে সে দরজাটা ভিড়িয়ে দিল। কিন্তু একটু পরপর খুলে দেখতে লাগল অতিথিরা বের হয় কি না।
***
কাননের চুল খামচে ধরে তুশি বলল, “তোমার চুলগুলো এত সফট কেন মামা? তুমি চুলে কী মাখো? আমার চুল দেখো, কত্ত কার্লি!”
কানন কোনোরকমে চুলটানা সহ্য করে বলল, “আমি প্রতিদিন চুলে হাঙরের তেল মাখি তো!”
“হাঙর কী মামা?”
“শার্ক।”
“মিথ্যে কথা! সত্যি বলো।”
“সত্যি বলছি!”
“আর আমি চুলে কী দেই বলো তো?”
“ক্রোকোডাইলের তেল?”
তুশি খিলখিল করে হেসে গড়িয়ে পড়ল।
“তুশিটুশি, তোমার মা’কে বলো না কান্না থামাতে।”
তুশি হাসতে হাসতে বলল, “মামনি কাঁদলে বিউটিফুল লাগে। কাঁদুক।”
কানন হেসে ফেলল। “তোমার কাছে বিউটিফুল লাগে কান্না?”
“না। বাবা বলে।”
তুশির বাবা একটু লজ্জা পেয়ে গেলেন। আর মা চোখ গরম করে তাকাতে গিয়ে চোখভর্তি পানি নিয়ে হেসে ফেলল।
কানন বলল, “এবার একটু স্বাভাবিক হয়ে কথা বলো আপা। কতদিন তোমার কথা শুনি না।”
“শুনবি কেমন করে? তুই ফোন করিস আমাকে? হারামি কোথাকার!”
“মামনি হারামি কী?” তুশি মাঝ থেকে প্রশ্ন করে উঠল।
তুশির মা কোয়েল গরম হয়ে বলল, “অ্যাই তুই বড়দের কথা শুনছিস কেন? যা ট্যাবে গেমস খেল। একটু আগে না কান্না করছিলি খেলবি বলে? এখানে ওয়াইফাই আছে। কানন কানেক্ট করে দে তো। ওই খাটে বসে খেল যা।”
তুশি মামার গলা ছেড়ে ট্যাব নিয়ে এলো। ওয়াইফাই কানেকশন পেয়ে ছুটে চলে গেল খাটে। ধপ করে শুয়ে চালু করে দিল গেমস।
কানন সেদিকে দেখে একটু হেসে বলল, “আপা মনে আছে, কম্পিউটারে গেমস খেলা নিয়ে আমরা কত ঝগড়া করেছি!”
“হুম।”
“তোমার একটা ছেলে হলে হয়ে যেত। একেবারে নিজের ছোটবেলা ফিল করতে পারতে।”
কোয়েল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তার বারবার চোখে পানি চলে আসছে। কানন মুগ্ধ চোখে বোনের দিকে তাকিয়ে রইল। আমেরিকায় থেকে বোনটা আরও সুন্দর হয়েছে। কত মায়া জমে আছে মুখে! এই বোনের থেকে কতদিন সে দূূরে ছিল! অথচ ছোটবেলা থেকে এই বোনের কাছেই তার যত আদর আবদার ছিল। কোয়েলের যখন বিয়ে হয় তখন কানন ক্লাস নাইনে পড়ে। ওই বয়সে ছেলেমেয়ে এমনিতেও একটু চুপচাপ আর লাজুক হয়ে যায়৷ কাননেরও তাই হয়েছিল। তবু কোয়েলের বিদায়ের সময় সে বাচ্চাদের মতো ভেউভেউ করে কেঁদেছিল কোয়েলকে জড়িয়ে ধরে। সেই বোনের সাথে সে বছরের পর বছর ঠিক করে কথাই বলেনি৷ সে আসলেই হারামি হয়ে গেছে। কিংবা সময় তাকে এমন বানিয়ে দিয়েছে! মাঝের দিনগুলোতে সে নিজের কাছেই অপরিচিত এক অস্তিত্ব ছিল, যার মাথায় শুধু একটা কথাই ঘুরত, বেঁচে থেকে কী লাভ? তার কপালে বেঁচে থাকার আনন্দ বাকি ছিল বলেই হয়তো ডিপ্রেশন থেকে ফিরতে পেরেছে!”
কোয়েল বিরক্তি নিয়ে বলল, “ভ্যাবলার মতো তাকিয়ে আছিস কেন? সমস্যা কী তোর? সোজাসুজি বল।”
“কোনো সমস্যা নেই।”
“তুই বাড়িঘর ছেড়ে বস্তিতে থাকিস কেন?”
“এটা বস্তি?”
“তা নয়তো কী? এত নোংরা ঘরবাড়ি হয় মানুষের? আমি বাপের জন্মে দেখিনি কারো টিভির ওপর ময়লা মোজা ঝুলছে!”
কানন হাসল।
কোয়েল কোনোমতে কান্না চেপে রেখে বলল, “তুশির জন্মের পর নানা জটিলতায় চার বছর ধরে আসতে পারিনি দেশে। এই চার বছরে তুই আমাকে ফোন করেছিস মাত্র চার বার। তাও কেমন আছো বলেই তোর কথা শেষ। আমি দশটা ফোন করলে একটা ধরতিস, বিশটা কথা জিজ্ঞেস করলে একটার দায়সারা জবাব দিতিস। কেন ভাই? কী করেছিলাম আমি? রাগ করে গত এক বছর তোকে ফোন করা বন্ধ করেছি। জানি, মা বাবা যাওয়ার পর থেকে তুই একটুও ভালো নেই, কিন্তু তাই বলে আমার সাথে তোর কিসের দূরত্ব বল তো?”
কানন মাথা নিচু করে বলল, “আপা, আমি এই ক’বছর কী করেছি, কিভাবে দিন কাটিয়েছি আমি নিজেও জানি না। কোনো বন্ধু, কোনো আত্মীয়, কারো সাথে আমার কোনো যোগাযোগ নেই। শুধু মনে হতো একটা ব্যর্থ জীবন শেষ করে দেই। মরার অনেক চেষ্টাও করেছি। কিন্তু অন্য সবকিছুর মতো এ ব্যাপারেও আমি ব্যর্থ।”
কোয়েল আচমকা উঠে এসে একটা চড় বসিয়ে দিল কাননের গালে। তারপর তাকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কেঁদে ফেলল। কাননেরও চোখ বেয়ে জলের ধারা নেমে এলো। অনেকদিন পর মনে হলো বুক থেকে ভারি পাথর সরে গিয়ে মনটা তরল হয়ে উঠেছে।
তুশি মায়ের কান্না দেখে ছুটে এলো। তার বাবা তাকে ধরে ফেলে কোলে বসিয়ে কানে কানে বলল, “ওরা কাঁদুক। দেখো, কত বিউটিফুল লাগছে দু’জনকে!”
(চলবে)