বেলীফুল পর্ব-২৬

0
915

#বেলীফুল
পর্ব- ২৬

সন্ধ্যা হয় হয় যখন, তখন আকাশ কালো মেঘে ছেয়ে গেছে। প্রচন্ড বাতাসে উড়িয়ে নিয়ে আসা ধুলোয় মাখামাখি তুলন শক্ত করে আকাশের হাত ধরে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। এই ঝড়ে একটা রিকশা বা অটো কিছুই পাওয়া যাচ্ছে না। তুলনের ভয় হতে শুরু করেছে। স্বাধীনতা সে মাত্রই পেতে শুরু করেছিল, এখন রাত করে বাড়ি ফিরলে আবার না আটকে রাখতে শুরু করে!

দেখতে দেখতে ঝড় থেমে বৃষ্টির বড় বড় কয়েক ফোটা পড়ল তুলনের গায়ে, মাথায়। তুলন প্রায় কেঁদে ফেলে এমন অবস্থা। আকাশ ওকে টেনে একটা দোকানের ছাউনির নিচে নিয়ে গেল। একটু অভয় দেয়ার ভঙ্গিতে বলল, “বোকা মেয়ে! কেঁদে ফেলবে নাকি? এক্ষুনি পেয়ে যাব কিছু একটা। চিন্তা নেই।”

“তাড়াতাড়ি করো প্লিজ!”

আকাশ ওকে দাঁড় করিয়ে রেখে বেরিয়ে পড়ল। মিনিট দশেক পর ফিরে এলো একটা সিএনজি নিয়ে। তুলন দ্রুত উঠে পড়ল। আকাশও উঠল। তুলনকে বাড়ি নামিয়ে দিয়ে নিজে ফিরে যাবে। তুলন এর মধ্যে অনেকখানি ভিজে গেছে। শাড়ি লেপ্টে গেছে শরীরের সাথে। খুবই অস্বস্তি লাগছে তার। এক কোণায় চেপে বসে আছে সে।

শহর এতক্ষণে বিদ্যুৎহীনতার আঁধারে ডুবে ছিল। হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে এলো। সড়কবাতির লালচে আলোয় কাকভেজা ঝাঁকড়া চুলের চমৎকার ছেলেটাকে অপার্থিব সুন্দর লাগছে! আকাশও তুলনের দিকে তাকাল। চোখে ঘোরলাগা দৃষ্টি। এত সুন্দর সন্ধ্যা সহজে আসে?

বাড়ির কাছাকাছি এসে আচমকা আকাশ তুলনকে জাপটে ধরে চুমু খেয়ে ফেলল। তুলন কিছু বুঝে ওঠার আগেই চলে এলো ওর বাড়ির কাছে। আকাশের দিকে আর তাকাতে পারল না সে। চুপ করে নেমে সোজা ঢুকে গেল বাড়ির ভেতর। সিঁড়ির নিচে একাকী দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ। শরীর বারবার কেঁপে কেঁপে উঠছে। মনে হচ্ছে শরীর ভেঙে জ্বর আসছে! কী ভীষণ অনুভূতি!

***

কোয়েল বেশ জোরের সাথেই বলল, “কানন, তুই বাড়ি ঠিক কর! এখন থেকে বাড়িতে গিয়ে থাকতে হবে।”

“ওখানে একা কী করব? আমার এখানেই ভালো।”

“একা মানে? আমি চার মাসের জন্য এসেছি। পুরো সময় কি শ্বশুরবাড়িতে থাকব নাকি?”

“আমার এখানে এসে…”

“সরি! তোর এই বস্তিতে আমি আজকেই প্রথম আর শেষবার এলাম। আমাকে এরপর ডাকলে বাড়িতে ডাকবি। কালই গিয়ে বাড়ি বাসযোগ্য করার ব্যবস্থা কর। প্লিজ ভাই!”

কানন নিতান্ত অনিচ্ছায় মাথা দোলালো। কোয়েল চোখ নাচিয়ে বলল, “বিয়েও তো করবি। নিজের বাড়ি থাকতে বউকে ভাড়া বাড়িতে রাখবি নাকি?”

“তুমি বিয়ের কথা জানলে কোথায়?”

“আরে সেজন্যই তো আরও তাড়াতাড়ি এলাম। তোর হবু শ্বশুর ফোন করে আমার আর তোর দুলাভাইয়ের সাথে কথা বলল।”

“ওহ।”

“পাশের ফ্ল্যাটেই থাকে ওরা তাইনা?”

“হুম।”

“তাহলে মেয়েটাকে দেখে যাওয়া যায়।”

“ওর মা বাবা এই সময় বাসায় থাকে না। ও একা থাকে। ডাকলে চলে আসবে। ডাকব?”

“না থাক। একেবারে অফিশিয়ালি দেখি। এখন ডেকে আনলে হয়তো অপ্রস্তুত হয়ে পড়বে।”

“হতে পারে।”

“বিয়ের দিকে মতি ফিরল তাহলে! আমি ভেবেছিলাম ভ্যাগাবন্ড হয়ে কাটিয়ে দিবি সারাজীবন।”

“তাই দিতাম। মেয়েটা কেমন করে যেন চলে এলো…”

“যা হয়েছে ভালো হয়েছে। এখন দেশে থেকে তোকে বিয়ে দিয়ে বাপের বাড়িতে গিয়ে আরাম করে কিছুদিন থাকা যাবে।”

“থেকো।”

“মেয়েটার নাম কী রে?”

“ইলা।”

“পড়াশুনা করছে?”

“হ্যাঁ, থার্ড ইয়ার।”

“একেবারে বাচ্চা!”

“বলা যায়।”

“তোর তুলনায় শিশু।”

কানন চোখ কুঁচকে বলল, “তো?”

“তুই একটা বালিকা বধু নিয়ে আসবি বিয়ে করে?”

“ও মোটেও বালিকা না। আমার চেয়ে ছোটো, কিন্তু এডাল্ট। আর আমি কিছু করিনি, বালিকা নিজেই আমার পেছনে ঘুরত।”

“বাব্বাহ! তোকে দেখে কেউ প্রেমে পড়তে পারে আমার বিশ্বাস হয় না। দাড়িগোঁফ রেখে হনুমান টাইপ অবস্থা!”

কানন হতাশ গলায় বলল, “ইলাও আমাকে হনুমান ডাকে।”

কোয়েল খিলখিল করে হেসে ফেলল। অনেকক্ষণ পর্যন্ত হাসির রেশ রয়ে গেল।

কোয়েলের স্বামী স্বাধীন বলল, “কানন তোমার এখন সত্যি গুছিয়ে নেয়া উচিত। এত এলোমেলো হয়ে বিয়ে করা যায় না।”

“কী করব ভাইয়া?”

“বাড়ি ঠিক করো, আত্মীয়দের সাথে যোগাযোগ করো। নিজেকে ঠিক করে তৈরি করো। মেয়েটাকে যেন ভালো রাখতে পারো এমন একটা পরিবেশ তৈরি করো। মেয়ের মা বাবাও তো চাইবে তাদের মেয়ে সুন্দর একটা পরিবেশে থাকুক তাই না?”

“আমার মনে হয় ইলাই সব গুছিয়ে নিতে পারবে। আমার কিছু করতে ইচ্ছে করে না।”

“তোমাকে দায়িত্ববান হতে হবে শালাবাবু। এভাবে চলবে না। বিয়ে মানে অনেক অনেক দায়িত্ব। শুধু কবুল বলে বউ পেয়ে গেলেই শেষ না, বউ পালতে হয়।”

“বউ পালা কি খুব কঠিন?”

স্বাধীন চোখ মটকে বলল, “একেবারে হাতি পালার মতো।”

কথাটা মাটিতে পড়তে না পড়তে কোয়েল জ্বলে উঠল। হাতের কাছে আর কিছু না পেয়ে মেঝেতে গড়াতে থাকা একটা খালি কোকের ক্যান ছুঁড়ে মারল স্বামীর দিকে। স্বাধীন প্রস্তুত ছিল বলে সময়মতো সরে যেতে পারল।

কোয়েল থামতেই সে হাসতে হাসতে বলল, “দেখলে তো? বউয়ের অত্যাচার সহ্য করার ট্রেনিং নিয়ে রাখাটাও জরুরি।”

কানন হেসে ফেলল।

কানন রাতে কোয়েলদের জন্য খাবারদাবার কিনে এনেছিল। খেতে বসার আগে ঘরটা মোটামুটি গুছিয়ে একটু বাসযোগ্য করে নিল। খেলেও কোয়েল এখানে থাকবে না। ফ্ল্যাটটা অনেক বড় হলেও তিনজনের থাকার মতো অবস্থা নেই। তাই সে আর জোরাজোরি করল না।

বেশ রাত করেই বের হলো কোয়েলরা। তুশি কিছুতেই যাবে না। মামাকে তার খুব পছন্দ হয়েছে। মামার সাথেই থেকে যাবে। অনেক কষ্টে তাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। সে বাবার কাঁধে মাথা রেখে নিজের কষ্ট চাপা দিচ্ছে।

কোয়েল যখন নিচু হয়ে জুতোর স্ট্র্যাপ ঠিকমতো লাগাচ্ছে, তখন পাশের ফ্ল্যাটের দরজাটা আলতো করে খুলে গেল। একটা মুখ উঁকি দিয়েই আবার ভেতরে চলে গেল। বন্ধ হয়ে গেল দরজা। কানন সামনেই ছিল। কোয়েল জিজ্ঞেস করল, “এটা কি…”

“হ্যাঁ, ইলা। ডাকব?”

“নাহ থাক। লজ্জা পাচ্ছে।”

কোয়েল নিচে নামতে নামতে ভাবতে লাগল মুখটার কথা। শ্যামলা রোগাটে একটা চেহারা। মুখে স্নিগ্ধ মায়া আছে ঠিকই, কিন্তু খুব একটা সুন্দর বলা যায় না মেয়েটাকে। কাননের সাথে ঠিক মানায় না। তার ওপর অত স্মার্টও নয়, হলে এগিয়ে এসে কথা বলত। কোয়েলের তেমন ভালো লাগল না।

***

অনবরত বৃষ্টি পড়ছে। ইলা হাত দিয়ে বৃষ্টি স্পর্শ করছে। ভেজা হাত দিয়ে ছুঁয়ে দিচ্ছে নিজের মুখ। বৃষ্টির ঘ্রাণ ভারি ভালো লাগে তার। আকাশের মুখ ভীষণ ভার, আজ রাত বাড়ার সাথে সাথে বৃষ্টিও বাড়বে। ইলার কেমন ভয় লাগতে থাকে, প্রশান্তির বৃষ্টি তার মনের অশান্তি দূর করে দিতে পেরে ওঠে না!

কাননের ফ্ল্যাটে যারা এসেছিল তারা নিশ্চিত ওর আপা দুলাভাই। বোনের চেহারার সাথে কাননের চেহারার বেশ মিল আছে। আপা আমেরিকা থাকে! কী ভীষণ স্মার্ট! ডিজাইনার সাদা ধবধবে জামা, চুলের একপাশে হালকা লালচে রঙ করা, চুলগুলো ছোটবড় করে কাটা, মুখ চকচকে পালিশ করা যেন। হাতে, কানে, গলায় ছোটো ছোটো মুক্তোর গহনা। এক ঝলকে অনেকটা দেখে নিয়েছে ইলা। সব মিলিয়ে গর্জিয়াস! সে নিজে তার সামনে ভূত!

আপা কি তাকে পছন্দ করবে? না করলে কি বিয়ে হবে না? কী হবে তারপর? আপা যে আসবে সেটা কানন তাকে কেন বলল না? ইলা বড় করে নিঃশ্বাস ফেলে জানালা বন্ধ করে দিল।

বিছানায় শুয়ে খুব ইচ্ছে করল কারো সাথে কথা বলতে। কাননকে কয়েকবার ফোন করতে গিয়েও করল না। কাননের সাথে তার সম্পর্ক অনেক গভীর হলেও ঠিক গল্প করার মতো হয়নি। কখনো কখনো মানুষকে গভীরভাবে অনুভব করার জন্য কথাবার্তার প্রয়োজন হয় না। আর কাননের সাথে সে এখনকার সমস্যাটা শেয়ারও করতে পারবে না। কারন ইলার মানসিক দ্বন্দ্বটা হচ্ছে ওর বোনকে নিয়েই।

অগত্যা তুলনকে ফোন করল ইলা। কিন্তু ওয়েটিং দেখাল। নিশ্চয়ই ওর নতুন প্রেমিকের সাথে প্রেমে ব্যস্ত। আজ প্রথম ডেট ছিল ওর। কেমন কাটল তাও তো বলল না৷ বলবে হয়তো সময় করে। এখন নতুন মানুষের সাথে সময় কাটাক। ইলা কাকে ফোন করবে আর ভেবে পেল না। এলোমেলো ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ সাজিদের নাম্বার সামনে চলে এলো। সাজিদের সাথে বেশ কিছুদিন কথা হয় না। লোকটা তার উপর রাগই করল কি না! কানন যখন অসুস্থ ছিল, তখন সাজিদের সাথে সে ঠিকমতো কথা বলেনি। সেজন্য রেগে থাকতে পারে! ফোন করলে রাগ ভাঙবে হয়তো।

লোকটা বেশ ভালো বোঝাতে পারে, পড়ায় কি না! তাকে কি সমস্যাটা বলা যায়? কিন্তু সাজিদ যদি হেসে উড়িয়ে দেয়? ছেলেমানুষী মনে করে? মনে হয় করবে না। করলেও প্রকাশ করবে না। লোকটার মন ভালো।

ইলা ফোন করল সাজিদকে।

ঝড়বৃষ্টির কারনে লোডশেডিং হওয়ায় সাজিদের আজ আর পড়াশোনা করা হয়নি। সকাল সকাল শুয়ে পড়েছে সে। ঘুমও এসেছে চোখজুড়ে।

কাচা ঘুমটা তার ভাঙল ফোনের শব্দে। স্ক্রিনে ইলার নাম দেখে বেশ চমকে উঠে বসল সে। এত রাতে ইলা কেন ফোন করছে?

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here