বেলীফুল পর্ব-২৭

0
909

#বেলীফুল
পর্ব- ২৭

সাজিদের হঠাৎ মাথাটা ধরে গেল। এতদিনেও ইলা একবার ফোন করেনি, আজ এত রাতে কী মনে করে? সে একটু যেন বিরক্ত হয়েই ফোনটা ধরল। ধরার সময় খেয়াল করল তার হাত কাঁপছে। ইলার জন্য তার অনুভূতিগুলো এখনো তাজা। মেয়েটা বুঝল না!

“হ্যালো।”

“কেমন আছেন?”

“ভালো। তুমি?”

“আমিও ভালো।”

“হঠাৎ ফোন করলে?”

ইলা যেন একটু লজ্জা পেয়ে বলল, “আসলে মন খারাপ বলে কারো সাথেই কথা হয় না৷ খুব ঝামেলার মধ্যে দিনগুলো কেটেছে।”

“এখন ঝামেলা মিটে গেছে?”

“বুঝতে পারছি না।”

“কেন? ছেলেটাকে তোমার বাসায় এখনো মেনে নেয়নি?”

“তা নিয়েছে। এদিকটা মোটামুটি ঠিকঠাক। কিন্তু ওদিক থেকেও তো আমাকে পছন্দ করতে হবে।”

“তার মানে ছেলের বাড়ির লোক আপত্তি করছে?”

“আপত্তি না…আমার মনে হলো আমাকে তাদের পছন্দ নাও হতে পারে।”

“কিছু বলেনি?”

“নাহ।”

সাজিদ হেসে বলল, “ইলা শোনো, তোমাকে যে পছন্দ করবে না সে এই শতাব্দীর অন্যতম বেকুব। তোমাকে পাওয়া যে কারো সৌভাগ্য। তোমার মতো আরেকজনকে সার্চলাইট দিয়ে খুঁজেও ওরা আনতে পারবে না।”

ইলা হেসে ফেলল। “কী যে বলেন না আপনি!”

“সত্যি বলছি।”

“আচ্ছা দেখা যাবে।”

“হুম। চিন্তা করো না।”

“চিন্তা না আসলে…ও আমাকে ছাড়া মরে যাবে জানেন?”

“আর তুমি ওকে ছাড়া?”

“সত্যি বলব?”

“হ্যাঁ বলো।”

“আমার ধারণা আমি তাকে ছাড়া থাকতে পারব। আমার মা বাবা আছে, তাদের মুখ চেয়ে থাকতে হবে। কিছুদিন আগে নিজের সাথে যুদ্ধ করে নিজেকে মানিয়ে নেয়ার চেষ্টাও করেছি৷ এখন তো পরিস্থিতি একটু স্বাভাবিক। কিন্তু ওর অতীতের বিশাল ক্ষতের সাথে এই ধাক্কাটা লাগলে কতটা ক্ষতি হবে আমি ভাবতেও পারি না!” বলতে বলতে কেমন যেন বিষাদে ছেয়ে গেল ইলার কন্ঠস্বর।

সাজিদ বলল, “তাহলে তো বোঝা যাচ্ছে ওনাই দরকার বেশি। উনার বাড়ির লোক উনি সামাল দিয়ে দেবে। চিন্তা করো না।”

“হুমম…আপনার কী খবর?”

“এইতো ভালো।”

“আপনার বাবা?”

“বাবা এখন বেশ ভালো আছেন। তোমার কথা বলে মাঝেমধ্যে।”

“তাই? উনাকে দেখতে ইচ্ছে করে। এখন তো আর এখানে থাকেন না।”

“না। আমার কাছেই আছেন। আমার বাসায় বেড়াতে এসো একদিন, দেখা হয়ে যাবে।”

“যাব, সব গুছিয়ে নেই।”

“আচ্ছা।”

“আমি কি আপনাকে ফোন করে ডিসটার্ব করলাম?”

“না ইলা। তুমি কি কাউকে ডিসটার্ব করতে পারো?”

ইলা মৃদু হেসে বলল, “আপনি আমাকে একটু বেশিই ভালো মনে করেন।”

“তুমি ভালোই।”

“আচ্ছা। তাহলে রাখি?”

“আল্লাহ হাফেজ।”

ফোনটা রেখে সাজিদ উঠে গিয়ে জানালার ধারে দাঁড়াল। বৃষ্টি ঝরে যাচ্ছে অনবরত। কেন মেয়েটা ফোন করল? ইচ্ছে করছিল সারারাত গল্প করতে। যদিও গল্পের বেশিরভাগ হবে ইলার প্রিয় মানুষকে নিয়ে, তবুও কেন যেন খারাপ লাগে না। ভালোবাসার মানুষ ভালো আছে এটা ভেবেও শান্তি। ভাবতে ভাবতে সাজিদ বড় করে হাই তুলল। ভেবেছিল ঘুম আসবে না আর, কিন্তু চোখ মেলা যাচ্ছে না। মাথাটা এদিকে এখনো দপদপ করে যাচ্ছে।

শুতে গিয়ে আবারও ফোনকল পেল সে। এবার করেছে মৌরি। আজব তো! এতরাতে এই মেয়েটা কেন ফোন করবে?

“হ্যাঁ মৌরি বলুন।”

মৌরির গলার স্বর খুবই নম্র আর মিষ্টি। সে সুরেলা গলায় একটু ইতস্তত করে বলল, “আমি আপনাকে ডিসটার্ব করলাম না তো?”

এই নিয়ে কথাটা দ্বিতীয়বার শুনল সাজিদ। আর দ্বিতীয়বারের মতো মিথ্যে বলল, “না না, বলুন।”

“আপনি বলেছিলেন না, ওখানে থাকার সময়কার কথা যা মনে আছে বলতে, সেকথাই বলতে ফোন করলাম। সকালে যদি ভুলে যাই! কী যেন হচ্ছে আমার সাথে। শুধু এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে সব। তাই এখনই ফোনটা করলাম। আরও আগে থেকে করছি, বিজি দেখাচ্ছিল। বোধহয় কথা বলছিলেন কারো সাথে…”

“হ্যাঁ, এক বন্ধু। আপনি বলুন কী মনে পড়েছে।”

কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে একটা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে মৌরি বলল, “বলতে ইচ্ছে করছে না। আমি তারচেয়ে বরং কথাগুলো লিখে ফেলি। আপনি পড়ে নেবেন?”

“হুম তা হয়।”

“আচ্ছা রাখি তাহলে। স্যরি আপনাকে বিরক্ত করার জন্য।”

সাজিদ নরম সুরে বলল, “আপনার কোনো বন্ধু নেই তাই না মৌরি?”

মৌরি ফোনের ওপাশে একটু কেঁপে উঠল। কিছু বলতে পারল না।

সাজিদ বলল, “আপনার কথা বলতে ইচ্ছে হলে বলুন। কথা না পেলে যা খুশি বলতে থাকুন। আমার সমস্যা নেই।”

“আপনি…”

“মৌরি! আপনার ব্যাপারটা আমি বুঝতে পারছি। আমাকে বন্ধু ভাবতে পারেন। আমি হয়তো আপনার চেয়ে খুব বেশি বড় নই। হলেও ব্যাপার না, আপনার যদি মনে হয় আমার সাথে কথা বলে একটু হালকা লাগবে, তাহলে বলুন।”

মৌরি রুদ্ধস্বরে বলল, “আমি একটু কাঁদি? ফোন না রেখেই?”

বলেই কাঁদতে শুরু করল মৌরি। কান্নার ফাঁকে দুই একটা শব্দ বলল, যেগুলো ঠিক বোঝা না গেলেও সাজিদ ফোনটা কানে ধরে রাখল। কী ভীষণ কষ্টের কান্না! সাজিদের চোখ জ্বালা করতে থাকল। বোধহয় এক-দু’ফোটা জলও গড়াল!

মৌরি ফোন রাখল অনেকক্ষণ পর। সাজিদের তখনো ঘুম চোখে। ঘুমানোর আগে সে খেয়াল করল, মাথাব্যথাটা আর নেই।

***

আকাশ বিষন্ন গলায় জিজ্ঞেস করল, “এখনই শোবে?”

“তিনটা বাজে মশাই! আর কত কথা বলবে বলোতো? এখন শুয়ে পড়ব।”

“সুইটহার্ট! শোনো!”

“বলো!”

“আবার কবে দেখা হবে?”

“নেক্সট উইক?”

“এত্ত দেরি! মরে যাব আমি।”

তুলন হেসে বলল, “বাবা বাসায় থাকলে বের হওয়া খুবই ভ্যাজালের।”

“তোমার বাবা আজ বাসায় থাকবে?”

“না।”

“তাহলে আজ দেখা করি?”

“আজই?”

“হু, আজই। প্লিইইজ?”

“আচ্ছা। দেখি। বাহানা বানাতে পারলে বের হব।”

“ওকে। এখন তাহলে ঘুমাতে পারো।”

“গুড নাইট।”

“গুড নাইট সুইটহার্ট।”

ফোনটা রেখে আকাশ মুচকি হাসল। মোবাইলে গতকাল তোলা তুলনের কিছু ছবি আছে। বলা বাহুল্য, ছবিগুলো গোপনে তোলা। কয়েকটা স্পষ্ট, কয়েকটা অস্পষ্ট। ওর বেখেয়ালে আচল সরে গেলে, উঁচু হয়ে ফুল ছেঁড়ার সময় পেট বের হলে, সিএনজিতে ভেজা অবস্থায়, যতগুলো পেরেছে ছবি তুলেছে আকাশ। খুটিয়ে ছবিগুলো দেখে সেগুলো সাঈফকে পাঠিয়ে দিল সে।

সাঈফ খানিক পরেই কলব্যাক করল।

“এইটা তোমার নতুন জিনিস?”

“হু। কেমন?”

“কই পাইলা মামা এরে? আমার তো…” বলতে বলতে জিভ দিয়ে জল টানার শব্দ করে সাঈফ।

আকাশ হেসে বলে, “পাইছি ফেসবুকে। পাখি নিজে হাঁইটা আসছে শিকার হইতে। এত্ত বদল মাইয়া আমি বাপরে জন্মে দেখি নাই।”

“তাইলে? কেমনে কী?”

“ব্যবস্থা কর। আজকেই। বিকালের মধ্যে। নয়তো আর এক সপ্তাহেও হবে না। আমার এতদিন ওয়েট করা সম্ভব না। আজকে অনেক কষ্টে সংযত ছিলাম।”

সাঈফ মুখ দিয়ে বাতাস বের করে বলল, “হুহ! আজকে গেলে তো সেই জায়গা ছাড়া অন্য কোথাও হইব না।”

“তো সেইখানেই চল!”

“আচ্ছা আমি অন্য সবাইরে খবর দেই।”

“সবাইরে না। তোরা চারজন বাদে অন্য কেউ যেন না আসে।”

“আরেহ সবাই মানে আমরা চারজনই। মাইয়ারে মার্ডার করার ইচ্ছা নাই ভাই।”

“ওকে।”

আকাশ ফোন রেখে চোখ বুজল। তুলনকে অন্যদের সাথে ভাগাভাগি করার তার একদম ইচ্ছে ছিল না। নিজেই রেখে দিত ওকে। প্রেম করে যেত, সাথে মজাও পেতে থাকত। কিন্তু তুলনের কথাবার্তা শুনে মনে হলো পরিবার থেকে এত ছাড় দেয়া হয় না। হুট করে বিয়ে হয়ে যাবে। তাছাড়া কমিটমেন্ট মানেই ঝামেলা। দু’দিন পর বলতে থাকবে, বিয়ে করো, বিয়ে করো! হাজারটা প্যাচাল শুনে বুঝিয়ে সুঝিয়ে রাজি করাতে হবে এইটুকুর জন্য। এত ধৈর্য তার হচ্ছে না। জোর করলে একবারেই কাজ খতম। কিন্তু সেটা সে একা পারবে না। ব্যাকআপ লাগবে। আর সেই আশাতেই সাঈফকে ফোন করা। ওরা একেকটা নেকড়ের চাইতে কম না। শিকারের গন্ধ পেলে একেবারে হা করে ছুটে আসবে।

আকাশ হাই তুলল। মেসেজ আসছে তার৷ এর আগে একটা মেয়েকে পটানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে। হাল ছেড়ে দেয়ার পর মেয়ে এখন তার পেছনে ঘুরছে! এই মেয়ে জাতি আজব জিনিস! একটা গালি দিয়ে ফোনটা হাতে নিল আকাশ। মেয়েটা ছবি পাঠিয়েছে। মাথা খারাপ করে দেয়ার মতো ছবি! আকাশ ভাবল আজ রাতটা না ঘুমালে তেমন কিছু যায় আসবে না। তারচেয়ে এই মেয়ের সাথে প্রেমালাপ করা ভালো। এমনিতেও দিনে অনেক ধকল যাবে। নেশাপানিও ভালোই হবে। উত্তেজনায় শরীরে অন্যরকম শিহরন জাগছে বারে বারে।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here