অনুভবে তুমি পর্ব-৪

0
4285

#অনুভবে_তুমি
#পর্ব_০৪
#মুমতাহিনা_জান্নাত_মৌ

আমি ক্যান্টিনের কাছে যেতেই দেখি ভার্সিটির বড় ভাই ইভান চিরকুট টা হাতে নিয়ে পড়ছে। আমি তা দেখে দৌঁড়ে ওনার কাছে চলে গেলাম এবং ওনার হাত থেকে চিরকুট টা কেড়ে নিলাম।তখন তিনি আমার দিকে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে বললেন,এটা কি ধরনের বেয়াদবি?এভাবে কেড়ে নিলে কেনো?
আমি কোনো উত্তর না দিয়ে তাড়াতাড়ি করে গিফট বক্সটা হাতে নিয়েই দিলাম এক দৌঁড়।আর এক মুহুর্তও দেরী করলাম না।কারন একদিকে উনি ভার্সিটির বড় ভাই সেজন্য ওনার প্রতি সবসময় একটা ভয় কাজ করে অন্যদিকে এনার প্রতি আমার ভীষণ রাগ জমে আছে। কারন উনি সেদিন আমাকে রাস্তায় পড়ে থাকা দেখেও সাহায্য করেন নি বরং বাইক একদম আমার কিনারা ঘেঁষে নিয়ে গেছেন।
আমাকে এভাবে দৌঁড়াতে দেখে ইভান ভাই চিৎকার করে ডাকতে লাগলেন।এই মেয়ে শোনো?দাঁড়াও বলছি।এভাবে দৌঁড়াচ্ছো কেনো?
আমি একবার পিছন ফিরে তাকালাম।দেখি এখনো তিনি ডাকছেন আমাকে। আমি তা দেখে আরো জোরে দৌঁড়ে ক্লাসরুমের দিকে চলে গেলাম।

ক্লাসরুমে যেতেই দেখি ইতোমধ্যে ক্লাস শুরু হয়ে গেছে।এটাই লাস্ট ক্লাস ছিলো।সেজন্য তাড়াতাড়ি করে আমার সীটে গিয়ে বসলাম।ভীষণ হাঁপাচ্ছিলাম।সেজন্য একটা কথাও বলতে পারছিলাম না।এদিকে আমার বান্ধুবীরা প্রশ্ন করেই যাচ্ছে।আমি তখন বললাম,ক্লাস শেষে বলবো,এখন প্লিজ থাম একটু।সেই কথা শুনে সবাই চুপ হলো।

ক্লাস শেষ হলে সবাই যখন মাঠে বসে এই বিষয় নিয়ে গল্প করছিলাম হঠাৎ ইভান ভাই আবার আসলো সেখানে।ভার্সিটির সবাই হা করে তাকিয়ে থাকলো ওনার দিকে।আমি ভয়ে জড়সড় হয়ে বসলাম।আর ভাবতে লাগলাম ইনি আবার এসেছেন কেনো?আমার বান্ধুবীরাও অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে।উনি সোজা আমার কাছে আসলেন।আর বললেন,উঠে এসো?
আমি তা শুনে নেহাকে বললাম কি করবো এখন?উনি কেনো ডাকছে?তুই কিছু জিজ্ঞেস কর না?
নেহা সেই কথা শুনে নিজেই এগিয়ে গেলো।আর বললো,আসসালামু আলাইকুম ভাইয়া।কি জন্য ডাকছেন ওকে?
ইভান ভাই সালামের উত্তর দিয়ে বললো তোমাকে আমি ডেকেছি?তুমি আসলে কেনো?যাকে ডেকেছি তাকে আসতে বলো।
নেহা ভীষণ সাহসী ছিলো।সে তখন বললো ভাইয়া ও আসতে একটু লজ্জাবোধ করছে।যা বলার আমাকে বলুন।ইভান ভাইয়া সেই কথা শুনে নিজেই আমার কাছে চলে এলেন।আর আমাকে চিৎকার করে বললেন,লাস্ট বারের মতো বলছি উঠে এসো।আমি এবার আর বসে থাকতে পারলাম না।চুপচাপ দাঁড়িয়ে গেলাম।আর নিচ মুখ হয়ে বললাম জ্বি,বলুন।

–বাসায় কি গুরুজ্বন আছে না নাই?

আমি সেই কথা শুনে ওনার দিকে তাকালাম।আমি বুঝতে পারলাম কেনো উনি এভাবে বলছেন?তখন ওভাবে চিরকুট টা ওনার হাত থেকে কেড়ে নেওয়াতে রাগ করেছেন উনি।
উনি আমাকে চুপ করা থাকা দেখে ধমক দিয়ে বললেন,কি হলো?উত্তর দিচ্ছো না কেনো?
আমি আস্তে করে বললাম জ্বি আছে।
সেই কথা শোনামাত্র উনি আবার চিৎকার করে উঠলেন,আর বললেন,
তাহলে বড়দের সম্মান দিতে শেখো নি কেনো?আমাকে চেনো না তুমি?আমার সম্পর্কে জানো না কিছু?সবাই কত শ্রদ্ধা করে আমাকে।আর তুমি তখন সালাম দেওয়া তো দূরের কথা বেয়াদবের মতো হাত থেকে কাগজ টা কেড়ে নিয়ে এলে।আমি ডাকা সত্ত্বেও দাঁড়ালে না কেনো?এরকম ব্যবহার মোটেও আমি পছন্দ করি না।তুমি তো বলতে পারতে ভাইয়া কাগজ টা আমার হাতে দিন।ওটা আমার কাগজ।এভাবে বললে কি হতো?

আমি জীবনেও ভাবি নি সামান্য একটা ব্যাপার নিয়ে উনি এমন রিয়্যাক্ট করবেন। নিজেকে বাঁচানোর জন্য বললাম, সরি আমি আপনাকে চিনতে পারি নি।আমি জানতাম না আপনি এই ভার্সিটির বড় ভাই।
এই কথা টা শোনার পর উনি মনে হয় আকাশ থেকে পড়লেন।আর কোনো প্রশ্ন না করে উলটো হা করে তাকিয়ে রইলেন।
তখন নেহা এসে বললো, হ্যাঁ ভাইয়া,ও আপনাকে চিনতে পারে নি।সেজন্য মনে হয় এমন করেছে।
এই বলে নেহা আমাকে একটা টেলা দিয়ে বললো,
অতশী!এই ভুল দ্বিতীয় বার যেনো আর না হয়।উনি আমাদের ভার্সিটির বড় ভাই।পুরো ক্যাম্পাসের সবাই ওনাকে অনেক শ্রদ্ধা করে।বুঝেছিস?ভালো করে চিনে রাখ ভাইয়াকে।
এতোক্ষন ভীষণ ভয় লাগলেও নেহার এমন উপদেশ শুনে হাসি বের হচ্ছিলো।কি সুন্দর করে অভিনয় করতে পারে মেয়েটা!
ইভান ভাইয়া কিছু বলতে যাবে কিন্তু সেই মুহুর্তে অয়ন ভাইয়া অতশী অতশী বলে ডাকতে লাগলো।আমি ভাইয়াকে দেখামাত্র যেনো আমার প্রান ফিরে পেলাম।দৌঁড়ে চলে গেলাম ভাইয়ার কাছে।
ভাইয়ার কাছে যেতেই ভাইয়া আমার হাত ধরে টেনে ভার্সিটি থেকে বের হলো।আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না।আজ ভাইয়া এমন আচরণ করছে কোনো?পুরো রাস্তায় ভাইয়া একটা কথাও বললো না।ভাইয়াকে চুপ থাকা দেখে আমি নিজেও আর কিছু জিজ্ঞেস করলাম না।কিন্তু বাসায় এসে ভাইয়া আমাকে একের পর এক প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে লাগলো।
ইভান কেনো আমাদের ডিপার্টমেন্ট এর সামনে?আমার সাথে ইভান কেনো কথা বললো?কি কথা বললো?
আমি ভাইয়াকেও সেম কথাই বললাম,যে আমি ওনাকে চিনি না।উনি কি জন্য যে এসেছে বলতে পারছি না।
অয়ন ভাইয়া তখন বললো, দ্বিতীয় বার আর যেনো ওকে তোর কাছাকাছি না দেখি।শুধু ও না,ভার্সিটির কোনো ছেলের সাথেই কথা বলবি না।বুঝেছিস?
আমি মাথা নাড়লাম।অনেক কিছু জানতে ইচ্ছে করছিলো কিন্তু ভয়ে আর জিজ্ঞেস করলাম না।
রুমের মধ্যে গিয়ে ড্রেস চেঞ্জ করে শুয়ে পড়লাম।
আর চিরকুট টার কথা ভাবতে লাগলাম।ভাইয়া যদি জানতে পারে তাহলে একদম মেরেই ফেলবে।ভাইয়াকে কি বলে দেবো?কিন্তু ভাইয়া যদি উলটো আমাকেই দোষারোপ করে।এই ভেবে আর বাসার কাউকেই বললাম না।

পরের দিন আবার আমার নামে পার্সেল আসলো।আজকের পার্সেল টাও আমি অর্ডার দেই নি।তার মানে সেই নাম না জানা মানুষ ই আবার পাঠিয়েছে।বাসায় শুধু আমি আর দাদী ছিলাম।সেজন্য ঠিক করলাম আজ ডেলিভারি ম্যান এর সাথে এ নিয়ে কথা বলবো।দরজা খুলতেই ডেলিভারি ম্যান জিজ্ঞেস করলো অতশী কে? তার নামে এই পার্সেল টা এসেছে।এই বলে আমার হাতে বক্স টা দিলেন।আমি সাথে সাথে বললাম, আমি তো কোনো কিছু অর্ডার দেই নি।আপনাদের পার্সেল ফেরত নিয়ে যান।আমি এটা নিতে পারবো না।

–কেনো ম্যাম?

–কেনো মানে?এইভাবে নাম পরিচয়বিহীন কারো পার্সেল আমি গ্রহন করতে পারি না।কে পাঠিয়েছে তার পরিচয় দিন আগে।

–আমার দায়িত্ব ঠিকানা মতো পৌঁছে দেওয়া।
আমি সেটাই করেছি।এখন আপনি নিবেন কি ফেলে দেবেন সেটা আপনার ব্যাপার।এই বলে পার্সেল টা দরজার সামনে রেখে ডেলিভারি ম্যান চলে গেলো।

আমি বুঝতে পারছি না কি করে খুঁজে বের করবো এই মানুষ কে?এসব ভাবতে ভাবতে পার্সেল টা তোলার কথাই ভুলে গেলাম।

কিছুক্ষন পর অয়ন ভাইয়া বাসায় আসলো।আর দরজার কাছে আসতেই পার্সেল টার দিকে চোখ পড়লো তার।অয়ন ভাইয়া পার্সেল টা হাতে নিয়ে উল্টিয়েপাল্টিয়ে দেখতে লাগলো। ভাইয়া কলিং বেল বাজানোর সাথেই আমি দরজা খুলে দিলাম।আমাকে দেখামাত্র ভাইয়া বললো,
এটা কি তোর পার্সেল?

ভাইয়ার হাতে পার্সেল টা দেখামাত্র ছোঁ মেরে কেড়ে নিলাম।
ভাইয়া তা দেখে জিজ্ঞেস করলো,

–কি আছে এতে?কখন অর্ডার দিয়েছিস?

আমি তখন বললাম আসলে ভাইয়া কিছু দরকারী জিনিস কেনার ছিলো।সেজন্য অর্ডার দিয়েছিলাম।

–ও, আচ্ছা।মনে হয় ঘুমিয়েছিলি সেজন্য টের পাস নি।সেজন্য ডেলিভারি ম্যান দরজার সামনে রেখে গিয়েছে।
এই বলে ভাইয়া তার রুমে চলে গেলো।আমি মনে মনে ভাবতে লাগলাম ভাগ্যিস আজ আম্মু বাসায় নাই।তা না হলে কি যে হতো উপরওয়ালাই জানে।আমি রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে বক্স টা খুলে ফেললাম।সেদিনের মতো আজও একটা চিরকুট, একটা চকলেট বক্স,কয়েক টা লাল গোলাপ,আর সুন্দর একটা শো-পিস আছে।

বাসার কেউ যদি এই বক্স ওপেন করে তাহলে কি জবাব দিবো আমি?আর এই মানুষ টাই বা কে?কেনো আমার পিছু পড়ে আছে এভাবে?এসব ভাবতে ভাবতে আমি চিরকুট টা পড়তে লাগলাম।

❝হৃদয়ের সীমানায় রেখেছি যারে
আজও বলতে পারলাম না ভালোবাসি তারে
ভালোবাসি বলতে গিয়ে বার বার ফিরে আসি
আজ বলেই দিলাম,,,,,
তোমাকে অনেক বেশি ভালোবাসি❞

❝সারাক্ষন আমি শুধু দেখি তোমার ছবি,
সেই ছবি দেখে শুধু তোমাকেই ভাবি।
ভাবতে ভাবতে আরো বেশি ভালো লাগে তোমাকে
তোমার মাঝে আমি হারিয়ে ফেলেছি নিজেকে❞
ইতি
তোমার ভালোবাসার ক্ষুধায় জর্জরিত এক অসহায় প্রেমিক
যে শুধু মনে মনেই ভালোবেসে যাবে।
তোমার সামনে ভালোবাসা প্রকাশ করার সাহস তার নেই।
তবে তুমি অপেক্ষা করে থেকো প্রিয়
ঠিক সময়মতো আসবো তোমার সামনে।
তখন একটু জায়গা দিও তোমার ঐ মনে।

চিরকুট টা একবার নয় দুইবার নয় বার বার পড়তে লাগলাম আমি।কেমন যেনো এক অন্যরকম ভালোলাগা, আর অন্যরকম ভালোবাসা জেগে উঠেছে মনে।সারাক্ষন চিরকুটের কথাগুলো মনে করি আর মিট মিট করে হাসতে থাকি।বলতে গেলে প্রেম প্রেম পাগলামি শুরু হয়েছে আমার মনে।অচেনা যুবক টিকে দেখার আকুতি দিন দিন বেড়েই যাচ্ছে।
সারাক্ষন শুধু ভাবতে থাকি কে হতে পারে এই যুবক?
যার কথায় এতো মায়া!
যে এতো সুন্দর করে লিখনির মাধ্যমে তার রুপের বর্ননা দেয়!তাকে কি আমি আগে দেখেছি?না সে সত্যি সত্যি অচেনা!ইশঃনা জানি সে দেখতে আরো কতো সুদর্শন!
কত আকর্ষণীয়!সেই কাঙ্ক্ষিত স্বপ্নের পুরুষ কে দেখার জন্য আমি পুরো দিওয়ানা হয়ে গেলাম।

এইভাবে ডেইলি পার্সেল আসতে থাকে আর আমি সবার আগে গিয়ে দরজা খুলে পার্সেল রিসিভ করি।
এইভাবেই চলছিলো,,,,,,,

আজ লিশার বার্থডে পার্টি আছে।ভাইয়াকে কত করে রিকুয়েষ্ট করলাম তবুও যেতে দিলো না।সেজন্য মন খারাপ করে ছাদে চলে গেলাম।কেমন যেনো এলোমেলো লাগছিলো জীবন টা।এইভাবে বন্ধ ঘরে কিছুতেই থাকতে ইচ্ছে করছিলো না।বাকি সবার মতো আমারও একটু আনন্দ করতে মন চায়।কিন্তু ভাইয়া কেনো যে এমন কড়া পাহারায় রাখে বুঝি না কিছু।
হঠাৎ কে যেনো আমাকে একটা ঢিল মারলো।আমি সাথে সাথে চমকে উঠলাম।আর পিছন ফিরে তাকালাম।এদিক ওদিক তাকিয়েও কাউকে খুঁজে পেলাম না।

হঠাৎ মেঝেতে একটা চিরকুট দেখতে পেলাম।চিরকুট টা দেখামাত্র আমি হাতে তুলে নিলাম।চিরকুটে লেখা ছিলো,

❝জীবন টা অনেক ছোট,
সেজন্য যে সময়টুকু পাবে পুরোটাই উপভোগ করবে,
আর সবসময় হাসবে।
তোমার মুখে বিষন্নতা মানায় না প্রিয়া।
মনে হয় আকাশে আজ মেঘের ঘনঘটা
এই বুঝি বৃষ্টি নামবে।
কিন্তু আমি তো বৃষ্টি নামতে দিবো না।
কথা দাও আমার সব কথা রাখবে,
আর আমায় তুমি ভুলে যাবে না।
যদি ভুলে যাও,
তখন কিন্তু প্রানে বাঁচবো না।

চিরকুট টা পড়া মাত্র আমি চিৎকার চেঁচামেচি করতে লাগলাম।কে দিলো এটা?কে?সামনে এসো।কেনো এমন করছো আমার সাথে?সাহস থাকলে দেখা করো।

এদিকে আমার চিৎকার শুনে বাসার সবাই ছাদে চলে এলো।
কি হয়েছে অতশী?চিৎকার করছিস কেনো?

আমি সবাই কে দেখামাত্র স্বাভাবিক আচরণ করতে লাগলাম।আর বললাম,কই কি?কিছু না তো।
কিন্তু চিরকুট টা লুকিয়ে রাখতে ভুলে গেলাম।

হঠাৎ ভাইয়া আমার হাতে চিরকুট টা দেখতে পেলো।
সে তখন বললো তোর হাতে কি ওটা?আমি তা শুনে ভীষণ ভয়ের মধ্যে পড়ে গেলাম।এখন কি করবো আমি?চিরকুট টা ফেলে দিতেও পারছি না আবার লুকিয়ে রাখতেও পারলাম না।

#চলবে,,,,,,,
কেমন লাগছে গল্পটি অবশ্যই জানাবে।
অনেকেই গল্প লেখা নিয়ে অনেক মন্তব্য করছো তাদের কে বলছি আমি কোনো লেখিকা নই,সেজন্য সাজিয়ে গুছিয়ে তেমন লিখতে পারি না।মনের শখে গল্প লিখছি।
ভুলত্রুটি হলে অবশ্যই ধরিয়ে দেবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here