অপেক্ষা পর্ব-(০১+০২+০৩)
লেখিকা: সামিয়া বিনতে হামিদ।
০১.
রিধির ঘুম ভাঙল বিকট শব্দে। তড়িঘড়ি করে বিছানা থেকে এক প্রকার লাফ দিয়ে উঠল। আশেপাশে তাকিয়ে দেখল সব ঠিকঠাক। ঘড়িতে বিকাল ৫ টা।কলেজ থেকে এসেই শরীর এলিয়ে দিয়েছে, অনেকদিন পর আজ সে কলেজে গিয়েছিল। অলস শরীর তার, তাই আজকের পরিশ্রমটা নিতে পারছে না। প্রতিদিন কলেজে যাওয়া তার পক্ষে সম্ভব হয় না।কারণ ক্লাস শুরু সকাল ৮ টায়। আর রিধির ঘুম ভাঙে সকাল ১১ টায়, কখনো কখনো দুপুর ১২ টায়।
রিধির পুরো নাম সিদ্দিকা মরিয়ম রিধি, কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। রিধির তখন সাত বছর, যখন সে ভীড়ের মাঝে বাবা মাকে হারিয়ে ফেলে।
ভাগ্যক্রমে মো:জুনাইয়েত হোসেইন এবং তার স্ত্রী মিসেস নবনী হোসেইন তাকে খুঁজে পান। তারা নিজের মেয়ের মতোই রিধিকে বড়ো করেন।
মো:জুনাইয়েত হোসেইন দেশের বাইরে থাকেন।সেখানে তার বিশাল বিজনেস। স্ত্রীকেও নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন কিন্তু নবনী তার পরিচিত শহর ও মানুষজন ছেড়ে যাবেন না। তাদের এক মাত্র সন্তান রক্তিম। পুরো নাম নাদিম হোসেইন রক্তিম।
রক্তিম এখন বাবার সাথেই বিজনেস সামলাচ্ছে। গত দুই বছর হলো সে বাবার সাথেই থাকে। মার্স্টারস দেশের বাইরে করেছিল। এই দুই বছরে একবারো দেশে আসে নি। কারণ কেউ না জানলেও নবনী হোসেইন ঠিকই জানতেন। দেশে যে বিজনেসটা আছে সেটি সামলানোর দায়িত্ব রক্তিমের ছিল, কিন্তু এখন নবনী হোসেইন সে দায়িত্ব নিয়েছেন।
রিধি ফ্রেশ হয়েই মায়ের কাছে আসল।।
রিধি: মা কিসের আওয়াজ ছিল? আমি তো ভেবেছিলাম বোম মেরে দিয়েছে কেউ।
নবনী: তোর উপর সবাই বোমই তো ফাটায়।এতোদিন পর কলেজ কেন গিয়েছিস? একদম পড়াশুনায় ছেড়ে দিলে পারতি।
রিধি: আরে বুঝো না ওসব ক্লাস টাস আমার ভালো লাগে না। আর সারাদিন কলেজ এ থাকলে তোমার সাথে থাকবে কে? একা একা তুমি! কেউ যদি তোমায় কিডন্যাপ করে নিয়ে যায়, তখন আমার কি হবে ভেবে দেখেছো?
নবনী: থাক বাবা আর বাহানা দেওয়া লাগবে না, আমি বুঝি তোর ঘুম এর জন্যই তুই কোনোদিন কলেজে যেতে পারবি না।
রিধি খুবই ঘুম প্রিয় স্বভাবের আর সারাদিন বসে বসে মুভি দেখে। নবনী আর জুনাইয়েত খুবই ভালোবাসেন তাকে। তার কোনো ইচ্ছার অপূর্ণ হয় না। পরিবারের বাইরে কেউ জানেও না রিধি তাদের আপন মেয়ে না। সমাজের চোখে রিধি তাদের সন্তান।
জুনাইয়েত হোসেইনের মেয়ের বাবা হওয়ার খুব ইচ্ছে ছিল। কিন্তু রক্তিম হওয়ার পর নবনী হোসেইনের জন্য দ্বিতীয় বার সন্তান জন্ম দেওয়া অনেক ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। তাই তারা আর সন্তান নেয় নি। জুনাইয়েত হোসেইনও মেয়ের আশা ছেড়েই দিয়েছিলেন। রিধিকে পাওয়ার পর তারা নিজেদের সম্পূর্ণ পরিবার হিসেবে মেনে নিয়েছেন।
রিধি খুব দুষ্টু প্রকৃতির ছিল, আর সারাদিন বকবক করতো। রাজা-রানি, রাজপুত্র-রাজকন্যা, ঘোড়া, হাতি এসবের গল্প শুনাতো সবাইকে। কোথা থেকে যে এই গল্পগুলো বানাতো তা সে নিজেও জানতো না। আদুরে কথাবার্তা ও তার মায়াবী চেহারার জন্য জুনাইয়েত এবং নবনীদের পরিবার রিধির মায়ায় পড়ে যায়। রিধি নামটিও জুনাইয়েত হোসেইনের রাখা নাম।
কিন্তু তার ভালো নামটি হয়তো তার বাবা মা রেখেছিল, তাই ওইটি পরিবর্তন করেন নি।
রিধির সবচেয়ে ভালো বন্ধু ছিল রক্তিম। তাদের মধ্যে বয়সের ব্যবধান বেশি হলেও রক্তিম তাকে খুব সহজেই মেনে নেই এবং সবচেয়ে ভালো বুঝতোও সে রিধিকে।
রিধি যখন প্রথম রক্তিমদের বাসায় আসে তখন রক্তিম এর চৌদ্দ বছর, বয়স বুদ্ধি দুটিই হয়েছে। রিধিকে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেওয়ার পর রক্তিম প্রতিদিন তাকে নিয়ম করে পড়াতো, স্কুলে নিয়ে যাওয়া থেকে শুরু করে তাদের মধ্যে মারপিট ও বাদ যেত না।
কিন্তু হঠাৎ রক্তিম কেমন পরিবর্তন হয়ে যায়, রিধিকে একদম সহ্যই করতে পারে না। আশে পাশে দেখলেও বকা দিয়ে তাড়িয়ে দেয়। আর দুই বছর হলো দেশে আসার নামই নিচ্ছে না। রিধির বিষয়টা খুব খারাপ লেগেছিল, নিজেকে তখন তুচ্ছ মনে হয়েছিল খুব। অনেক কান্নাও করেছে সে। এখন সব স্বাভাবিক। কিন্তু রক্তিম এর হঠাৎ পরিবর্তনের কারণ কেউ বুঝতেই পারে নি। নবনী হোসেইন ছেলের পরিবর্তনে মনে মনে অনেক কষ্টও পেয়েছেন কিন্তু তার হাতের নাগালে নেই ছেলের সমস্যার সমাধান।
রিধি এখন একপ্রকার রক্তিমকে ভুলেই গিয়েছে। আর এসব নিয়ে মাথা ঘামানোর সময়ও নেই তার। তার শুধু ঘুমোতে আর মুভি দেখতে পারলেই হলো।
তবুও কখনো রক্তিমের কথা উঠলে সে সরে পড়ে, সে চায়ও না রক্তিম ফিরে আসুক। মনে মনে রক্তিমকে বদমেজাজি রাক্ষস বলেই গালি দেয়।
০২.
সকাল থেকেই রাজিয়া রহমান ডিউটিতে আছেন, পেশায় তিনি ডক্টর। তার স্বামী ফয়সাল আহমেদও একজন ডক্টর। কিন্তু তারা দুজনেই আলাদা থাকেন। তাদের দুই ছেলে, এক মেয়ে।
রাজিয়া রহমানের মেয়ে-দিয়া রহমান, রিধির বেস্টফ্রেন্ড, তারা একই কলেজে পড়াশুনা করছে।
ছেলে দিব্য রহমান অনার্স চতুর্থ বর্ষে।
দিব্য আর দিয়াকে নিয়েই তার ছোট্ট সংসার। তিনি স্বামীর সংসার ছেড়েছেন পনেরো বছর হলো। অন্যদিকে ফয়সাল আহমেদ থাকেন ছেলে রোহান আহমেদকে নিয়ে।
রাজিয়া ও ফয়সালের বিয়ে হয়েছিল প্রেমের সম্পর্কে। সুখের সংসার ছিল। আর তাদের প্রথম জমজ সন্তান দিব্য আর রোহান। দিয়ার যখন তিন বছর তখন তাদের সম্পর্ক ভেঙে যায়
তার একমাত্র কারণ ছিল ঊষা। ঊষা ও ফয়সাল কাজিন। ঊষা ফয়সাল কে পছন্দ করতো ছোটবেলা থেকেই। কিন্তু তার পছন্দের ব্যাপারটা বাড়াবাড়ি পর্যায়ে চলে যায়, ফয়সাল আহমেদ যখন রাজিয়াকে বিয়ে করেন। ঊষা কোনোভাবেই তাদের সম্পর্কটা মেনে নিতে পারে নি।
কাউকে ভালোবাসাটা অপরাধ না, কিন্তু ভালোবাসা জোর করে আদায় করতে চাওয়াটাই অপরাধ। ঊষাও পারতো নতুনভাবে সবকিছু শুরু করতে, কিন্তু তা না করে রাজিয়া আর ফয়সালের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি সৃষ্টি করে। ঊষা ধরেই নিয়েছে ফয়সালকে ছাড়া সে কারো সাথেই ভালো থাকবে না। কিন্তু জীবনকে একটা সেকেন্ড চান্সও দেওয়া লাগে, শুধু অপেক্ষা করতে হয়, হয়তো ভালো কিছু ঘটেও যেতে পারে।
ঊষার কারণে অনেকগুলো অস্তিত্ব শুধু ঠিকানা হারিয়েছে।
আসলে কোনো ভালোবাসা আর বিশ্বাসের সম্পর্কে তৃতীয় কোনো ব্যক্তিকে কোনো ভাবেই ঢুকার সুযোগ দেওয়া উচিত নয়। মনে যতই ভালোবাসা থাকুক না কেন? সন্দেহ সম্পর্ককে ভাঙার জন্য যথেষ্ট।ভালোবাসার সম্পর্কগুলো বিয়ের আগে যতোই প্রমিস নিক না কেন। সন্দেহ মানুষের একটি বৈশিষ্ট্য, সন্দেহ ছাড়া সম্পর্ক হয়! হয়তো পরিণাম হয় সুখের, বিবাদহীন, কখনো বা ধোঁকার সম্মুখীন। রাজিয়া আর ফয়সালের ভালোবাসার গল্পটাও সন্দেহের কারণেই ভাঙে।
কিন্তু ফয়সাল আহমদে ও রাজিয়া রহমান এখনো একে অপরকে ভালোবাসেন। শুধু প্রকাশের ঘাটতি ছিল।
সবকিছু আগের মতো হওয়া আর সম্ভব না হয়তো, অনেক তো অপেক্ষা করেছেন!!
অফিসিয়ালি তাদের তালাক হয় নি। রাজিয়ার খুঁজার সাহস ছিল না, আর ফয়সালের দেওয়ার। একবার তালাক হয়ে গেলে যে সারাজীবনের জন্য হারিয়ে যাবে ভালোবাসার মানুষটি। তারা না হয় অপেক্ষায় কাটিয়ে দিক। সুখ স্মৃতি, আর প্রিয় মানুষটিকে নিয়ে এখনও যে ভাবার অধিকার আছে। অধিকারটি কেন হারাবে তারা?
কিন্তু তাদের মধ্যে এতো বেশি জেদ ছিল, কখনো সমস্যা সমাধানের চেষ্টায় করেন নি। পনেরো বছর কি খুব কম সময়? এতোটা বছর সমস্যার সমাধান ছাড়া কীভাবে কাটাতে পারে দুটো মানুষ? কিন্তু তাদের মধ্যে কারো সামনে নত হওয়ার কোনো ইচ্ছেই নেই, যেখানে একটি সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার জন্য একে অপরকে বোঝার একটু সুযোগ দেওয়া উচিত।
রোহান, দিব্যের সাথেই একই ইউনিভারসিটিতে পড়াশুনা করে। দেখতেও অনেকটা একই, তারা অনেক ভালো বন্ধুও। কিন্তু তারা জানেও না তারা আপন ভাই। কারণ এই পনেরো বছরে ফয়সাল আহমেদ ছেলে রোহানকে তার আসল মা, ভাই বোন থেকে দূরে রেখেছেন। রাজিয়াও কখনো রোহানকে দেখার আগ্রহ দেখায় নি। কারণ হয়তো বাকী দুই সন্তানকে হারানোর ভয় কাজ করতো।
রোহান ঊষাকেই মা হিসেবে মেনে আসছে। যদিও ঊষা আর ফয়সালের বিয়ে হয়নি। তবুও ঊষার ধারণা এক দিন সে লিগ্যালী এই অধিকার পাবে।অন্যদিকে ফয়সাল আহমেদও রোহানকে হারাতে চান না, তাই অতীতের বিষয়গুলো লুকিয়ে রেখেছেন। কারণ যা হয়েছিল তা তিনি নিজেও মানতে পারেন নি।
রোহান এই চিন্তা ভাবনা নিয়ে বেড়ে উঠেছে যে, তার আসল মা তাদের ছেড়ে চলে গিয়েছে। কেন গিয়েছে তার উত্তর নেই। ছেলের প্রশ্নের জবাব দেওয়ার সাহসও ছিল না ফয়সাল আহমেদের কখনো। এখন আর এসব প্রশ্ন করে না রোহান। প্রশ্ন করার বয়স শেষ।
নিশ্চুপ অপেক্ষায় দিন কাটছে কিছু অস্তিত্বের। কবে শেষ হবে এই অপেক্ষা কেউ জানে না।
ক্রিং ক্রিং, ফোন ভাজছে।
রিধি: হ্যালো ডিয়ার আতেল বেবি।
দিয়া: তুই করছিসটা কি বাসায় বসে বসে?
রিধি: ডিম পারছি। জানিস, আজকে আমি তিনটা মুভি দেখেছি টানা। কিন্তু আফসোস একটি দেখেও কান্না পায় নি। কি লেইম স্টোরি, কি হইছে জানিস?
দিয়া: ভাইরে ভাই, চুপ করবি তুই? তোর জীবনটা শেষ হয়ে গেল এইদিকে।
রিধি: হয়েছে কি বল? প্লিজ দোস্ত ডাবলা স্যার নিয়ে কিছু বলিসনা। আমি এমনি অনেক হ্যাপি আজকে। লা লা লা লা লা লা লা।
দিয়া: চুপ কর। তোর এই মাসে মাত্র দুই দিন প্রেজেন্ট তাও বাংলা ক্লাসে।
রিধি: হ্যাঁ,ওই ক্লাসেই ভালো ঘুম হয়।
দিয়া: স্যার, ম্যাম সবাই আজকে তোকে খুঁজছিল।
রিধি: ওয়াও আমি অনেক ফেমাস তাহলে।
দিয়া: শুনেন মিস, নেক্সট থেকে যদি ক্লাসে না থাকো আপনাকে আপনার তত্ত্ব, স্কুলের কাগজপত্র উঠিয়ে নিতে বলেছে, আপনাকে আর কেউ গ্রহণ করবে না।
রিধি: আল্লাহ, কি বলিস? আমি অসুস্থ ছিলাম।
দিয়া: রিয়েলি? তাহলে তিনটা মুভি? কি যেন হয়েছিল। হুম হুম।
রিধি: আচ্ছা দিয়া আগামীকাল আসবো। কিন্তু যদি আমাকে একটু ঘুম থেকে…..
দিয়া: আচ্ছা, বাবা। আমি উঠিয়ে দেবো। বাই, বাই।
রিধি: বাই, আল্লাহ হাফেজ। কালকে দেখা হবে।
০৩.
দুই ঘন্টা ধরে ইশা ভার্সিটি মেইন গেইটে দাঁড়িয়ে আছে। ইশার পুরো নাম ফারহানা ফারিয়া ইশা। দেখতে খুবই সুন্দরী। প্রথম দেখায় যে কেউ পছন্দ করে ফেলবে। গায়ের রং দুধে আলতা। চোখগুলো মায়াবী, নীলাভ স্বচ্ছ। তার মুখে হাসি যেন লেগেই থাকে। ঠোঁটের নিচে ছোট্ট একটি তিল আছে।
দিব্য ওই সময় ভার্সিটিতেই ঢুকছিল, ইশাকে দেখতে পেয়ে দাঁড়িয়ে গেল।
দিব্য: হাই, ইশা। তুমি এখানে দাঁড়িয়ে আছো যে?
ইশা: ফ্রেন্ড এর জন্য দাঁড়িয়ে আছি, একসাথে যাবো।
দিব্য: ওহ, আচ্ছা। আমি যায়। পরে দেখা হবে।
ইশা: হুম।
দিব্য ও ইশা প্রতিবেশী। পাশাপাশি বাসায় থাকে। একই ভার্সিটি, একই ডিপার্টমেন্ট-ম্যাথম্যাটিকসে। তবে দিব্য চতুর্থ বর্ষ, ইশা প্রথম বর্ষ।
দিব্য প্রথম দেখাতেই ইশার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে। কিন্তু বলার সাহস পায় নি। ইশা ব্যাপারটি বুঝলেও তেমন পাত্তা দেয় নি। কারণ সে অলরেডি মুহিবের সাথে সিরিয়াস রিলেশনে। মুহিবও প্রথম বর্ষে কিন্তু ইঞ্জিনিয়ারিং ইন্সটিটিউটে পড়ছে।
তাদের মধ্যে ভালোবাসা কম ঝগড়াটায় একটু বেশি। ইশা আর মুহিবের টক, ঝাল, মিষ্টি সম্পর্ক নিয়ে জানতে হলে তিন বছর আগে ফিরে যেতে হবে।
তিন বছর আগে-
ইশা নতুন ফেইসবুক খুলে, তখন সে মাত্র এস.এস.সি পরীক্ষার্থী। সেদিন তার বাংলা এক্সাম ছিল, পরীক্ষার সময় বেশিরভাগ স্টুডেন্ট আইডি ডিএক্টিভ করে দেয়। কিন্তু ইশার একদিন ফেইসবুক নিয়ে ঘাটাঘাটি না করলে ঘুম আসে না। বাংলা এক্সাম দিয়ে এসেই মোবাইল নিয়ে বসে যায়। উদ্দেশ্য প্রশ্ন মেলানো।
হঠাৎ চোখে পড়ে মুহিবুল হাসান নামে একটি ছেলের ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট। ইশা তখন নতুন নতুন ফেইসবুক চালায়। ওর আইডিতেও ফ্রেন্ড কম। তাই মিচুয়েল বেশি দেখলেই কোনো কিছু না ভেবে এক্সেপ্ট করে ফেলতো। ঐদিনও এমন হয়। না দেখে মুহিব এর সাথে ফ্রেন্ড হয়ে যায়। এরপর থেকেই শুরু হয় তাদের চ্যাট।
মুহিব: হ্যালো। হ্যালো।
ইশা: হাই।
মুহিব: তুমি এবারে এস.এস.সি দিচ্ছো না?
ইশা: হ্যাঁ।
মুহিব: আমিও। আচ্ছা, বাংলা পরীক্ষা কেমন দিলে?
ইশা: অনেক ভালো, তোমার?
মুহিব: হ্যাঁ, ওরকমি।
এভাবে তাদের মধ্যে শুরু হয় কথা। ইশা মুহিবের ছবিও দেখে নি। কিন্তু মুহিব ইশার সব ছবিই দেখে এবং একদিন প্রপোজও করে বসে।
মুহিব: একটা কথা বলি।
ইশা: হুম।
মুহিব: আমার তোমাকে ভালো লাগে।
ইশা কি বলবে খুঁজে পাচ্ছে না। এমন কিছু সে আশাও করে নি। আর এসব ফেইসবুক প্রেম তার পছন্দও না।
মুহিব: চুপ করে আছো কেন? কিছু বলবে না?
ইশা: আসলে, আমার প্রেম করার ইচ্ছে নেই।
মুহিব: হুম।
ইশা: আমরা জাস্ট ফ্রেন্ড থাকি?
মুহিব: আচ্ছা, কিন্তু একটা রিকোয়েস্ট।
ইশা: কি?
মুহিব: তুমি তোমার অন্য সব ফ্রেন্ড থেকে আমাকে একটু বেশি ভালো ফ্রেন্ড মনে করবে।
ইশা: আচ্ছা।
এভাবে চলতে থাকে প্রতিদিনকার গল্প। কিন্তু মন বলেও একটা অস্তিত্ব আছে। সেই মনের কাছে একসময় পরাজয় ঘটে। ইশা ধীরে ধীরে মুহিবকে পছন্দ করা শুরু করে।
আসলে বাস্তবতা খুবই ভিন্ন। প্রেম আসে সবার জীবনে, কারো জীবনে সুখ নিয়ে, কাউকে দিয়ে যায় আঘাত।
ইশার জীবনেও এই প্রেম এসেছিল, সে তার মনপ্রাণ দিয়ে ধরে রাখতে চেয়েছিল তার প্রেমটিকে। কিন্তু আমাদের এই জীবনযুদ্ধে অনেক কিছুই সহ্য করতে হয়।
বর্তমানে –
ইশা: এতোক্ষন লাগলো তোর?
নিশু: বাস দেরীতে ছেড়েছে। চল কিছু খাবো। সকালে নাস্তা না করে বাস ধরতে আসলাম।
ইশা: ওহ, চল।
দিব্য অনেকক্ষণ ধরে ক্যাফেটেরিয়াতেই বসে আছে। সে জানে ইশা প্রতিদিন এইখানে আসে ক্লাসে যাওয়ার আগে। তাই আগে গিয়ে বসে থাকে। যাতে কেউ সন্দেহ না করে। কিন্তু মেয়েদের চোখ ফাঁকি দেওয়া যায় না। দিব্যের সব পাগলামো ইশা বুঝতে পারে। কিন্তু সে তো অন্য কাউকে ভালোবাসে।
ইশা-মুহিবের প্রেমের গল্প শুধু তার ক্লোজ ফ্রেন্ডরাই জানে। পাবলিসিটি করার মতো সম্পর্ক তাদের নেই।
আজ আছে তো কাল নেই। ইশা নিজেই খুবই কনফিউজড এই ব্যাপারে।
দিব্যকে দেখে নিশু বলল,
নিশু: দেখ,আজকেও তোর জন্যই বসে আছে। হাউ সুইট!
ইশা: হুম।
নিশু: এখন দেখবি, কিভাবে লুকিয়ে লুকিয়ে তোকে দেখবে!
দিব্য প্রতিদিন ক্যাফেটেরিয়ার সামনের বেঞ্চে বসে, যেখান থেকে ক্যাফেটেরিয়ার পুরো অংশ দেখা যায়। আর সে লুকিয়ে লুকিয়ে ইশাকে দেখতে পারে।
দিব্যের দৃষ্টিতে,
ইশার কথা বলার ভঙ্গিমা- যেন ভেঙে দেয় সব বাধা-জড়তা, তার মিষ্টি হাসি- যেন কাব্যের আড়ালে লুকিয়ে থাকা মুক্তোর মালা, যা দেখা যায় শুধু মনের চোখ দিয়ে। বাতাসে যখন চুলগুলো উড়ে আসে মনে হয় তার অবাধ্য চুলগুলোকে একটু শাসন করে দিয়ে আসি, দিব্য এসব দেখতে দেখতে যেন ঘোরের মাঝেই চলে যায়।
এরই মাঝে দিব্যের বেষ্ট ফ্রেন্ড অনিক চলে এলো। সে বন্ধুকে রূপকথার রাজ্যে ডুবে থাকতে দেখে বলে উঠল,
অনিক: মহাশয়ের রাজ্য সভায় কি এখনো রাণীর বিচরণ হচ্ছে? তিনি যদি প্রজাদের দিকে একটু নজর না দেন, রাজ্যের যে বড়ো একটা ক্ষতি হয়ে যাবে।
দিব্য: আরে দূর, বল কি বলবি?
অনিক: চা কি আরো কয়েক কাপ খাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিস?
দিব্য: কি করবো? এখন চা দিয়েই কাজ চালিয়ে নিতে হবে।
একটু জোরে আওয়াজ দিয়ে দিব্য বলল,
ও মামা, আরো দু’কাপ দিয়ে যান।
অনিক: সামনের সপ্তাহে কালচারাল প্রোগ্রাম, কিছু কি প্ল্যান আছে তোর?
দিব্য: না, এখনো এসব নিয়ে ভাবি নি।
অনিক: সারাদিন ওই মেয়েটির দিকে তাকিয়ে থাকলে, ভাববি কিভাবে?
দিব্য: হুম, শোন। রোহানকে দায়িত্বটা দিলে ভালো হয়।
অনিক: ও পারবে না। ও দেখিস না কেমন চুপচাপ থাকে! আমার মনে হয় না ও সবার সাথে মানিয়ে নেবে।
দিব্য: পারবে, পারবে।
অনিক: এতো বছর পারে নি, আর এখন? ও শুধু গানটায় ভালো গাইতে পারবে। এসব দায়িত্ব দিলে পরে একটা না একটা সমস্যা বাধিয়ে দেবে।
দিব্য: দেখ, দায়িত্ব দিয়ে! আমি বলছি, এবারের প্রোগ্রামটায় সবচেয়ে সুন্দর হবে।
অনিক: আর তুই?
দিব্য: ফটোগ্রাফির দায়িত্ব আমার উপরেই থাকবে।
অনিক: ভাই, তুই বেশিরভাগ ছবিতো ওই মেয়েটারি উঠাস।
দিব্য: তোর কি সমস্যা? ভালো লাগে তাই উঠায়।
অনিক: আমার মনে হয় না মেয়েটা তোকে পছন্দ করে।
দিব্য: আমি কি ওকে বলেছি আমাকে পছন্দ করতে হবে? আমি পছন্দ করলেই হলো। আর শোন, কাউকে ভালোবাসলে, বিনিময়ে ভালোবাসা পাওয়ার আশা করা উচিত নয়। আমি ভালোবাসি এটা আমার ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত। ওর আমাকে ভালো নাও লাগতে পারে। আমি ওর মতামতের সম্মান করি। জোর করে ভালোবাসাতো আর পাওয়া যায় না। আর ইশাকে আমি অনেক ভালোবাসি। ওকে আমি বাধ্য করে, মানসিক চাপ দিতে চাই না। আর যাদের এক হওয়ার তারা এক হবেই, ও আমার ভাগ্যে থাকলে আমারি হবে। আমি শুধু অপেক্ষায় থাকবো। অপেক্ষার মধ্যেও অনেক শান্তি, ভালোলাগা থাকে। এখানে শুধু আমার অধিকার। অন্য কিছুর চাপ নেই।
অনিক: ওরে আমার প্রেমিকপুরুষ। চল ক্লাসে, একটু স্বাধীনতা দে মেয়েটিকে। তোর চোখগুলো সরা ওর দিক থেকে। কেউ উঠাই নিয়ে যাবে না তো।
দিব্য: চল, যায়। চা খেয়ে অনেক ভালো লাগছে।
অনিক: হুহ, বল যে মেয়েটিকে দেখে ভালো লাগছে।
দিব্য: মেয়েটি মেয়েটি কি? ওর একটা নাম আছে তো? কি সুন্দর আকীকা করে নাম রেখেছিল ওর বাবা মা।
অনিক: ও আচ্ছা আচ্ছা, তাই? কি জানি নাম মেয়েটির?
দিব্য ভ্রু কুচকে জবাব দিল, ফারহানা ফারিয়া ইশা।
অনিক: ইয়েস,
ফারহানা ফারিয়া ইশা,
তুমি আমার বন্ধুর নেশা,
এতো কেন তুমি ন্যাকা,
দাও বারে বারে তারে ছ্যাকা।
চা খেতে খেতে ঢুল,
তোমাতে মশগুল।
একবার ফিরিয়ে দেখো,
মনেতে দুই হাত রেখো।
দিব্য: ওয়া বস ওয়া, কিয়া কাবিতা কাহি হে।
অনিক: কলার উঁচিয়ে বলল, আমার মতো হতে চাও?
দিব্য: আজ্ঞে না, আমি আমার মতোই ঠিক আছি।
এদিকে নিশু আর ইশার নাস্তাও শেষ। তারাও ক্লাসের দিকে রওনা দিলো।
যেতে যেতে নিশু ইশাকে বলল,
নিশু: আমার না ভালোই লাগে দিব্যকে। ছেলেটা ভদ্র, তোর জন্য পারফেক্ট।
ইশা: তুই জানিস, আমি অলরেডি…….
নিশু: ওকে, ওকে। বুঝেছি, এক দিন থাকে পরের দিন থাকে না টাইপ সম্পর্ক তোর মুহিবের সাথে। যেকোনো একটা সিদ্ধান্ত নেওয়া ভালো। আমার মনে হয়, মুহিব তোর জন্য ভালো হবে না।
কথাটা শুনেই ইশার মন খারাপ হয়ে যায়। মনে পড়ে গেল পুরোনো স্মৃতি।
অতীতে–
ইশা আর মুহিবের নামহীন সম্পর্কটা বেশ চলছে, দু-তিন মাস হতে চলল। ইশার ক্লোজ ফ্রেন্ডরাও জেনে গেছে। ফেইসবুক প্রেম যেহেতু স্ট্যাটাসও দেওয়া হয়ে গেছে ‘ইন এ রিলেশনশিপ’। কিন্তু এই সম্পর্কে কেমন ভালোবাসা ছিল আদৌ কেউ জানতো না।
ইশা মুহিবের স্কুল জীবন শেষ, কলেজ জীবন শুরু। নতুন কলেজ, নতুন পরিবেশ, অপরিচিত মানুষজন। ইশা চট্টগ্রামেই থাকে। এখানেই একটি মহিলা কলেজে ভর্তি হয়। মুহিব ঢাকা চলে যায়। ঢাকার নামকরা কলেজের ছাত্র এখন সে। হয়তো তার মধ্যে ভাব চলে আসে। কিসের ভাব? ভালোবাসায় কি ভাব বলতে কিছু থাকে?
তাদের মধ্যে নম্বর আদান প্রদান হয়। এখন আর ফেইসবুকে প্রেম চলবে না। মুহিব যে হোস্টেলে থাকে ঐখানে এন্ড্রয়েড ব্যবহারের নিয়ম নেই। তাই তখন থেকেই চলতে থাকে তাদের ফোন আলাপ।
কিন্তু হঠাৎ ঝড়ের বেগে পালটে যায় মুহিব। কোনো কারণ ছাড়া বলে বসে সে আর এই সম্পর্ক রাখতে চায় না। এই কয়েকমাসের সম্পর্কে ইশা আর মুহিব এখনো কেউ কাউকে দেখে নি। শুধু ফেইসবুকে ছবিই দেখেছিল। তাদের ভিডিও কলও হয়নি। ইশাও পছন্দ হওয়ার পর মুহিবের ছবি দেখেছিল।
মুহিবের এমন সম্পর্ক ভাঙার কথা ইশা মেনে নিতেই পারছে না।
এই বয়সে মানুষের আবেগ খুব বেশি। কয়েকমাসেই না দেখা মানুষকে ভালোবাসা যায় না। এটি এক ধরণের আবেগ। ইশার কাছে এই আবেগ এখন নিজের জীবনের চেয়েও দামী হয়ে গিয়েছে।
ইশা: তুমি কেন এমন করছো? আমাকে কারণ বলো। আমার কি ভুল হয়েছে?
মুহিব: আমার তোমাকে ভালো লাগে না। আর কিছু আমি বলতে পারবো না।
ইশা: কেন ভালো লাগে না? হঠাৎ কি হয়েছে বলো না!
মুহিব কিছু না বলে ফোন কেটে দেয় আর নম্বরটি ব্ল্যাকলিস্টে পাঠিয়ে দেয়। সারারাত পড়াশুনা বাদ দিয়ে ইশা লেগে পড়ে মুহিবকে ফোন দেওয়ায়। ফেইসবুকে মেসেজ দিতেই থাকে। সারারাত ছটফট করতে থাকে, প্রিয় মানুষটির কন্ঠের স্বর শুনার জন্য। সারারাত সে কান্নাকাটি করে। সকালে হয়তো মুহিবের দয়া হয়। সে নম্বর আনব্লক করে।
তারপর-
কাঁদোকাঁদো স্বরে ইশা বলল,
ইশা: তুমি সারারাত নম্বর ব্লক করে রেখেছো কেন? আমাকে একটু কারণ বলো প্লিজ।
মুহিব: তুমি আমাকে এতো ভালোবাসো?
ইশা: হ্যাঁ, সত্যি ভালোবাসি।
মুহিব: আমি চট্টগ্রাম আসবো। দেখা করবো তোমার সাথে।
ইশা: দেখা করবে মানে? আমার ভয় লাগে এসব। কেউ দেখে ফেললে?
মুহিব: তুমি যে স্যার এর কাছে পড়ো ঐখানেই থাকবো। দূর থেকে দেখেই চলে যাবো।
ইশা: আচ্ছা। তুমি কালকে ব্লক করলে কেন আমাকে?
মুহিব: মুড ভালো ছিল না।
ইশা: তুমি আমাকে সত্যি ভালোবাসোতো?
মুহিব: হ্যাঁ, ভালোবাসি।
ইশা: আচ্ছা। আমাকে যদি তোমার পছন্দ না হয়? তুমি তো আমাকে ফেইসবুকেই দেখেছো। আর ঐখানে তো সবচেয়ে ভালো ছবিটায় দেয় সবাই।
মুহিব: দেখি। তুমি যদি সুন্দর না হও, তাহলে হয়তো আমাদের ব্রেকাপ হয়ে যাবে।
ইশা: মানে কি? ভালোবাসা কি সুন্দর অসুন্দর দিয়ে হয়? চরিত্র, ব্যবহার, আচার-আচরণ এসব হচ্ছে প্রধান।
মুহিব: জানি, তবে সুন্দরও হতে হবে, সুন্দর না হলে আম্মু তোমাকে পছন্দ করবে না।
ইশা: মুহিব! এসব কি ধরণের চিন্তা ভাবনা। তুমি তো নিম্ন মন-মানসিকতার পরিচয় দিচ্ছো।
মুহিব: কি? কি বললে তুমি? আমি নিম্ন মানের? তুমি আমাকে এতো বড়ো কথা বললে? যা তোর সাথে ব্রেকাপ, ফোন দিবি না আমাকে।
ইশা: সরি, আমি ওভাবে বলতে চায় নি। তুমি সুন্দর এর কথাটা বলেছো তাই ভালো লাগে নি। এখন তোমার যদি আমাকে সুন্দর না লাগে! আমি তো এসব দেখছি না।
ইশা মন খারাপ করে কথাগুলো বলল।
মুহিব: ছেলেদের সুন্দর হওয়া লাগে না।
এভাবে কথা কাটাকাটি চলতে থাকে তাদের।
বিষয়- সুন্দর-অসুন্দর।
চলবে-