বিভাবতীর জীবন পর্বঃ৮

0
2641

#বিভাবতীর_জীবন
#লেখিকাঃতামান্না
#পর্বঃ৮

–” মান সম্মান নিয়ে টানাটানি হবে এমন মেয়েকে বিয়ে করালে, মেয়ের অভাব পরে নাই। যে মেয়ে মা বাবারে না জানাইয়া অন‍্য ছেলের হাত ধরে পালিয়ে বিয়ে করে সে মেয়ে স্বামী সংসার ফালাইয়া পর পুরুষের সঙ্গে চলে যেতে দ্বিতীয়বার ভাববে না।”
বিভা চটকরে বারান্দা থেকে সরেগেল। ছি! কি একটা লজ্জা। কেউ যদি হঠাৎ উপরে দেখত, সায়েমের মা যা বলেছে তা নিয়ে বিভা খুব একটা মা ঘামালো না।
সব মাই তার ছেলের মঙ্গল চায়। ছেলের মঙ্গলের জন‍্য বিভাকে ঘরের বউ করতে রাজি হবে না।

সায়েম মায়ের এমন হুটকরে এমন আচরণে বিরক্ত হয়েগেল। তারপর সে গাড়িতে উঠে বসল, সবাই চলেগেল।
তারা যাওয়ার পরপরই বিভার বাবা মশিউর রহমান এলেন বাড়িতে। খানিকটা জিরিয়ে নিয়ে বসতেই বিভার মা বিভার ব‍্যাপারে বলেন তার স্বামীকে। মশিউর সাহেব অবাক হয়ে চেয়ে আছেন। এখন যেন তার রাগ চারগুণ বেড়েগেছে, এত কিছু ঘটে যাওয়ার পরও তিনি সতর্ক না হয়ে আবার আরেক কান্ড করছেন। মশিউর সাহেব বলে উঠলেন –

–“তোমার যা মন চায় তাই করো, সারাজীবন যা ভেবেছো তাই করেছো। এখন ও তাই করবে আমাকে বলার কি আছে?”

মশিউর সাহেবের উত্তরে কিছুটা মন খারাপ হয়েগেল বিভার মায়ের।
________________________________

এনজিওর কাজে অভিজাত এলাকা ছেড়ে বিভাকে যেতে হয় অনেক বস্তি, প্রত্নত গ্রাম, বিভা যখনই গ্রামে তার দলবল নিয়ে আসে তখনই তার মনে পরে যায় আগের মুহূর্তের কথা। নিজেকে বহুকষ্টে দমিয়ে রেখে হাসিমুখে সবার সঙ্গে কথা বলে। সবাই খুব মিশুক, আরও ভালো যে বিভা ভুলেই যায় তার সব কষ্টকে। কয়েক সপ্তাহ পরপর বিভাকে উচুনিচু পাহাড় বেয়ে চলতে হয়, চলতে হয় কাদামাখা মেঠোপথ ধরে। কখনও বা যেতে হয় নৌকায় চড়ে এদিক সেদিক। এভাবে চলতে গিয়ে পুরোনো অনেক স্মৃতিই তার মনে পরে যায়। আবার ভুলেও যায়!

বিভা রংপুরের একটি প্রতন্ত গ্রামে এসেছে যেখানে তার এনজিও থেকে গ্রামের প্রাথমিক বিদ‍্যালয় ছাত্র-ছাত্রীদের জন‍্য কিছু উপহার সামগ্রী ও খাবার আনার ব‍্যবস্থা করেছে। বিভাদের দলে প্রায় দশজন আছে, এদের মধ‍্যে অনেকেই বিভার থেকে বড় কয়েকজন খুব ছোট।
বিভা তাদের সঙ্গে হেসেখেলে কথা বলে, অনেক মানুষের সঙ্গে বিভার চলতে হয়, কত গরীব অসহায় মানুষ তার আসেপাশে আছে সে বুঝতেই পারতো না যদি সবুজ তার জীবনে না আসতো। বাবার বাড়িতে রাজকন‍্যার মত বেড়ে উঠা বিভা সবুজের ঘরে পা দিতেই বুঝেছিল মধ‍্যবিত্ত পরিবারের জ্বালা। এখন এই অসহায় মানুষগুলোর সঙ্গে থাকতে থাকতে তাদের দুঃখের বানী শুনতে শুনতে আরও বুঝতে পারল জীবনটা সবার জন‍্য সুখের নয়। প্রত‍্যেকটা মানুষের জীবনেই সুখ আর দুঃখের মিশ্রণ।

বিভাদের এনজিওর পক্ষ থেকে প্রাথমিক বিদ‍্যালয়ে একটি প্রতিযোগিতা হচ্ছে যেখানে খেলছে বাচ্চারা।
বিভার পাশেই এনজিও থেকে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ডাঃ আরাফাত রহমান ফাইয়াজ যিনি এই এলাকার নাম করা একজন ব‍্যাক্তিত‍্য। ডাঃফাইয়াজ এই গ্রামেরই ছেলে, ঢাকায় বসবাস করলেও ফাইয়াজ গ্রামে কয়েকদিন বাদে বাদে এসে ঘুরে যায়। আর মাঝে মাঝে স্কুল কলেজের তদারকি করে। ডাঃফাইয়াজ প্রতিযোগিতা মূলক অনুষ্ঠানের বিচারক হিসেবে খেলায় অংশ গ্রহনকারিদের পুরস্কার তুলে দিচ্ছে। ডাঃফাইয়াজের পিছনে বিভা বাচ্চাদের পুরস্কার একে একে তুলে দিচ্ছে।
ফাইয়াজ পুরস্কার বিতরন করে বসে পরল নিজের স্থানে।
বিভা ও কিছু বসল, এর মধ‍্যে সবাই যে যার মত বসে পরল কারন বাচ্চাদের মধ‍্যে অনেকে নাচ করবে। বিভার মধ‍্য থেকে একজন সিনিয়র দাড়িয়ে ডাঃ ফাইয়াজকে দেখিয়ে দিয়েছে তখন । বিভা আড়চোখে ডাঃফাইয়াজ সাহেবের দিকে তাকিয়ে দেখল। লোকটি খুব গম্ভীর একদম গম্ভীর।
সবাই কথা বলছে যে যার মত কিন্তু তিনি চুপচাপ বসে রয়েছেন। ফাইয়াজ সাহেব অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার পর সবার সঙ্গে আরেকবার দেখা করে নিলেন। তারপর চলেগেলেন সেখান থেকে।

পুরোদিন একটি রিসোর্টে থেকেছে বিভাদের দল।
সেখান থেকে বিভা ও তার দল মিলে ঢাকায় এসে পরল।

বাসায় আসার পর বিভা দেখল তার মা কারোর সাথে কথা বলছেন। দরজা লাগিয়ে পাশ কাটিয়ে নিজের রুমে চলে যেতে চাইলে একজন ডেকে বলল –

–” ভাবী কে এসেছে? বিভা নাকি?”
বিভার মা বিভাকে দেখেই ইশারা করলেন এখানে আসতে।
বিভা ক্লান্ত শরীর নিয়ে ভিতরে ঢুকে দেখল মহিলাটি সোফায় বসে আছে। বিভা রুমে ঢুকে সালাম দিয়ে বলল –

–” কেমন আছেন?”

–” খুব ভালো, তুমি কেমন আছো?”

–” জ্বী ভালো আন্টি,”

–” শুকিয়ে কেমন হয়েগেছে চেহারাটা। আহারে যত্ন নিতে পারো না? এত ইয়াং বয়সে চামড়া কেমন হয়েগেছে।
স্মার্ট হও, আগে কি হয়েছে তা মনে রেখো না, ভুলে যাও,
পাস্ট ইজ পাস্ট। এখন একটা কাজ করো মায়ের কথা শুনে চলতে চেষ্টা করো। যে ভুল করেছো তুমি, কেন যে তোমরা এমন করো বুঝি না। বিয়ে করেছো তো করেছো একদম নিচু পরিবারের ছেলেকে। এখন নিজের মত চলাফেরা বন্ধ করে একটু গুছিয়ে চলতে শেখো। মায়ের আর বাবার কথা শুনতে থাকো ক্ষতি হবে না। ”
বিভা চুপ করে শুনতে লাগল। কিছুই বলল না এইসব কথা তাকে উঠতে বসতে শুনতে হবেই, বিভা একদম নিজেকে মানিয়ে নিয়েছে।

–” আচ্ছা, ও কি আবার ফিরে আসবে? ”

–” আন্টি ভুল আমি একবারই করেছি, আর করব না।
আমি আর কখনই তার কাছে ফিরে যাবো না।”

–” হুম ঠিক আছে, আর শুনো যতটা সম্ভব এখন এইসব ভুলে নিজেকে পুরোপুরি ঠিক রাখার চেষ্টা করো। ”
বিভা ওনার সাথে কথা বলে উঠে চলেগেল।
বিভা চলে যেতেই উনি বলে উঠলেন –

–” ভাবী ঐ দিনের ছেলেটির পরিবার বিভাকে পছন্দ করেছিল। কিন্তু মা টা রাজি হয়নি খুব রাগী মহিলা।
ছেলের বিয়ে ঠিক সব ঠিক এর মধ‍্যেই মেয়েটা তার পছন্দের ছেলের সঙ্গে বিয়ে করে নিয়েছে। সেই থেকে উনি আর ভরসা করতে পারেন না। চিন্তা করবেন না সব ঠিক হয়ে যাবে। ”

–” আমি যে কি করবো আপা, মেয়েটা আমার এমন বোকা, কি করে এমন ঘটনা ঘটিয়ে ফেলল। কি ভাবে কি সামলাবো বুঝতে পারছিনা। আবার মেয়ের বাবা রেগে আছে, কেন আমি ঐ ঘটনার পর আবার বিয়ে দেওয়ার জন‍্য অপেক্ষা করছি। অপেক্ষা না করেও তো উপায় নেই,
এই মেয়েকে আমি যদি ফেলে রাখি সামনে তো আর বিয়ের ঘর পাবো না।”

–” কি করবেন আর এখন।”

সায়েমের পরিবারে সবাই বিভাকে পছন্দ করেছে, বিভা দেখতে যথেষ্ট মার্জিত ও সুন্দর। ভদ্রই বুঝা যায় বিভাকে দেখে। বিভার পরিবার ও তাদের পছন্দ হয়েছে। কিন্তু বাদ সাধলো বিভার বিয়ের ঘটনা নিয়ে। বিভার বিয়ের পরবর্তী জীবনের কথা শুনেও তারা খুব আফসোস করেছে। যা বিভার শরীর দেখেই বুঝেছে। হয়তো মেয়েটার চোখের দিকে তাকালে খুব সহজে বুঝা যায় মেয়েটি খুবই দূর্বল।
কিন্তু বাদ সাধলেন সায়েমের মা। তিনি কোন ভাবেই এই মেয়েকে ঘরে তুলবেন না। এই নিয়ে সায়েম ও খুব ক্ষুদ্ধ।
মাকে বুঝিয়ে ও সে কিছুই করতে পারছেনা। অনেক সময় অনেক কিছুই চেয়ে করা যায় না, মেনে নিতে হয় সব।

বিভা ফ্রেশ হয়ে ক্লান্ত শরীর নিয়ে শুয়ে পরল। বিছানায় শুতেই দেখল রায়হানের মায়ের কল। কিছুটা বিরক্ত হলো বিভা আবার কিসের জন‍্য ফোন করল।
ধরতেই অপর পাশ থেকে তিনি বলে উঠলেন –

–” কেমন আছো মা তুমি?”

–” জী ভালো, ”

–” ও, তোমার শরীর কেমন আছে?”

–” ভালোই আছে,”

–” ও, সবুজের মা বলতেছিলি সবুজরে নাকি বিয়ে করাইবো। মানি মানুষের লজ্জা শরম বলতে কিছু নাই।
কয়দিন হইছে তোমারে এমন কইরা বিদায় করলো এখন আবার বিয়ার জন‍্য চেষ্টা করতেছে। আর পোলাডারে ও ভালো মানুষ মনে করছিলাম, পোলাডা আরও খারাপ।”

–” চাচি এগুলো আমাকে বলে কি লাভ? আমি তার স্ত্রী এখন? না আমার বাচ্চা আছে? যে আমি তার কথা চিন্তা করবো? বাচ্চা থাকলেও হয়তো সেই চিহ্ন ও প্রমাণ স্বরূপ আমার বারবার তার কথা মনে পরতো। কিন্তু এখন আর মনে পরবে না চাচি।”

–” কি বলো এইগুলো, বাচ্চা থাকলে মানে?”

–” চাচি রাখছি, আমি আর এই বিষয়ে কোন কথা বলতে পারবো না।”

বিভা ফোন রেখে ভাবতে লাগল সবাই মানুষকে করুণা করতে ভালোবাসে। সহানুভূতির আড়ালে মানুষের কথা নিয়ে বেচাকেনা করা গ্রামের মানুষের স্বভাব। যেদিন রায়হানের মা তার সাথে কথা বলে সেদিন সবুজ তাকে ফোন করে ডিস্টার্ব করে। নিশ্চয়ই উনি ও গিয়ে কথার তালে বলে ফেলেন বউ তো এটা বলেছে ওটা বলেছে।
বিভার মাথাটা খুব ধরেছে। সন্ধ‍্যা ধরেই বিরক্ত লাগছে তার। আবার এই মহিলার এইসব কথা, বিভা ফোন নাম্বার টা ব্লক করে দিয়ে ভাবলো যার সঙ্গে সম্পর্কই নেই তার গ্রামের লোকের সঙ্গে কথা বলে লাভ কি? নাম্বারটি ব্লক করে ফেলে রাখলো।

চলবে।
ওয়েবসাইটে বা কোন গল্পের লিংকে এই গল্পটি শেয়ার করবেন না। অনেকে আমাকে না জানিয়ে তিনটি গল্প ওয়েবসাইটে দিয়েছেন এটা করবেন না প্লিজ ।
গল্পটি দরকার হলে টাইম লাইনে শেয়ার করুন তবুও অন‍্যকোন ওয়েবসাইটে দিবেন না।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here