অপ্রিয়_সেই_প্রিয়জন পর্ব~৪

অপ্রিয়_সেই_প্রিয়জন পর্ব~৪

#Ishita_Rahman_Sanjida(Simran)

রুমের দরজা খোলা রেখেই ঘুমায় মীরা। দরজা ভেজানো থাকে। পিহু দরজা খুলে উকি দিলো রুমের ভেতরে। আরামে ঘুমাচ্ছে মীরা। চুলগুলো এলোমেলো হয়ে মুখের উপর পড়ে আছে। একদম বাচ্চা বাচ্চা লাগছে মীরাকে। কে বলবে যে এই মেয়ের অনার্স ফাইনাল এক্সাম শেষ??পিহু চুল না বেঁধে দিলে মীরা চুল বাধেই না। পিহু গিয়ে মীরার পাশে বসে। আলতো করে মুখের উপর থেকে চুলগুলো সরিয়ে মীরাকে ডাকলো,

‘মীরা মীরা,ওঠ ফজরের টাইম হয়ে গেছে তো??’
ফজরের নামাজের কথা শুনে লাফ মেরে উঠল মীরা। ঘুম বেশি হলেও কান সর্বদা সজাগ থাকে মীরার। মীরা এক মুহুর্ত দেরি না করে দৌড় দিয়ে বাথরুমে ঢুকে গেল। একবারের জন্যও পিহুর মুখের দিকে তাকালো না। কারণ সে জানে পিহুর দিকে তাকালেই বকা খাবে সে। পিহু বিছানায় বসে মুচকি হাসলো। ওযু করে বের হতেই পিহু বলল,’নামাজ শেষ করে চলে আয়।’

মীরা মাথায় ওড়না পেঁচাতে পেঁচাতে বলল, ‘এই দাঁড়াও দাঁড়াও’ পিহু দাঁড়িয়ে পড়লো। মীরা তড়িঘড়ি করে লাইট অন করে বলল,’আগে তোমাকে একটু দেখে নেই তারপর নামাজে দাড়াবো।’
পিহুর ভ্রু জোড়া আপনাআপনি কুঁচকে এলো।বলল,’একটু আগে তো বকা খাওয়ার ভয়ে পালালি এখন ভয় লাগছে না??’

মীরা মুখে হাসি ফুটিয়ে বলে,’ঠিক। তবে আমার যাওয়ার আরেকটা কারণ ছিল। তা হলো আমার মনি’মায়ের পবিত্র মুখটা দেখতে তো আমাকে পবিত্র হতে হবে তাই না??তাই ওযু করে এসেই তোমার কাছে এলাম।’

পিহু অবাক চোখে তাকিয়ে রইল মীরার দিকে। মেয়েটা সত্যি অন্যরকম। পিহু হেসে মাথা নাড়িয়ে চলে গেল। মীরা পিহুর যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইল। এখনো সেই আগের মতোই দেখতে পিহু। শুধু গায়ের চামড়া কিন্ঞ্চিৎ কুঁচকে গেছে। তবে আগের মতই ফর্সা রয়েছ। ফর্সা শরীর হালকা জাম রঙের সুতি শাড়িতে বেশ মানিয়েছে পিহুকে। আচমকাই ঠোঁটে হাসি ফুটে ওঠে মীরার। তাড়াতাড়ি জায়নামাজ বিছিয়ে নামাজে দাঁড়ায় সে।
নামাজ শেষে জায়নামাজ ভাঁজ করে রেখে মাথায় ওড়না পেঁচিয়ে বের হয় মীরা। পিহু এতক্ষণ মীরার জন্যই অপেক্ষা করছিলো। প্রতিদিন তারা একসাথে হাঁটতে বের হয়। আজকেও দু’জনে হাঁটতে বের হলো। সকালে হাঁটলে শরীর ও মন দুটোই ভালো থাকে। কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি শেষ করে দুজনেই বাড়ি ফিরলো। পিহু নিজের রুমে চলে গেল আর মীরা রান্নাঘরে। পিহুকে মীরা রান্না করতেই দেয় না। কারণ পিহুর শরীরটা খুব একটা ভালো যাচ্ছে না। সারাক্ষণ কাশি লেগেই থাকে। ডক্টর ওষুধ দিয়েছে সেগুলোই খাচ্ছে সে। তাই মীরা সাফ মানা করে দিয়েছে। পিহুর শুধু একটাই কাজ আর তা হলো ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করে ওষুধ খাওয়া আর কলেজে যাওয়া। পিহু এখন কলেজে চাকরি নিয়েছে। সেখানেই যায়।
মীরা আটা মেখে রুটি বানালো। তারপর আলু কুচি কুচি করে কাটলো। ফ্রিজে পেপে কুচি রাখা ছিল। কালকেই রেখেছে মীরা তাই আলু এবং পেঁপে ভাজি করলো। সাথে ডিম ভাজলো একটা। ডিম ভাজার সময় ধুম ধাম দরজার আওয়াজ আসতে লাগলো। মীরা এতে প্রচন্ড রেগে গেলো। তবে কে এসেছে তা বুঝতে একটুও বাকি রইল না তার। ডিমটা বাটিতে রেখে খুনতি হাতে নিয়েই দরজার দিকে ছুটলো সে। মীরার আগেই পিহু দরজার কাছে চলে গিয়েছে। মীরা বলে ওঠে,’তুমি দরজা খুলো না মনি’মা। আমি যাচ্ছি।’

পিহু থেমে যেতেই মীরা গিয়ে দরজা খুলে দিল। খুনতি হাতে মীরাকে দেখে এক লাফে দুই হাত পিছিয়ে গেল মুহিত। মীরা ভ্রু নাচিয়ে বলল,’কি??তুই আবার এসে দরজা ধাক্কা দিচ্ছিস কেন?? কলিং বেল নেই??’

মুহিত বোকা হাসি হেসে বলে,’তোমাকে রাগতে দেখে যে আমার খুব ভালো লাগে প্রিয় বউ।’

মীরা কটমট করে দরজার বাইরে এসে বলে,’এতো বউ বউ করিস কেন??তোর থেকে গুনে গুনে পাঁচবছর সাতমাস তের দিনের বড়ো আমি। আর তুই আমাকে বিয়ে করার স্বপ্ন দেখিস??’

‘স্বপ্ন তো দেখি না। আমার ইচ্ছা তোমাকে আমার বউ বানাবো। কিন্তু একটাই সমস্যা আম্মুকে বলতে পারছি না। কি যে করি??ছেলের যে বিয়ের বয়স হয়েছে তা তো আম্মু দেখতেই পায় না।’

মীরা ছোট ছোট চোখে তাকিয়ে বলে,’তোর বয়স তো সতেরো তাহলে বিয়ের বয়স হলো কেমনে??’
মুহিত কিছুটা ভঙ্গিমা করে বলে,’তো কি হয়েছে?? আমার মনের বয়স অনেক আগেই বিয়ের বয়স ছাড়িয়ে গেছে।’

‘ভালোই তো লজিক শিখে গেছিস। দারা আজ তোর একদিন তো আমার কয়দিন। গরম খুন্তির ছ্যাঁকা দিলেই তোর মনের বয়স কমে যাবে।’
মীরা মুহিতকে তাড়া করলো। বাড়ির উঠোন জুড়ে দৌড়াদৌড়ি করতে লাগলো। পিহু দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ওদের কান্ড দেখছে আর হাসছে। মুহিত হলো মুক্তার ছেলে। প্রতিদিন সে আসবে মীরাকে জ্বালাতন করতে। ওদের দুজনের দুষ্টুমি দেখে পিহু সবসময় হাসে। কিন্তু তৎক্ষণাৎ পিহুর ইশানের কথা মনে পড়ে যায়। ইশান থাকলে সেও হয়তো এমন দুষ্টুমি করতো মীরার সাথে। ছোট বেলা থেকেই তো ইশান খুব খেপাতো মীরাকে।
ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়লো পিহু। কতোই না ভালো হতো যদি ইশান আর ইফাজ থাকতো??ওর সংসারটা ঝলমল করতো। কিন্তু সেই সব কিছু অভিমানের নিচে চাপা পরে গেছে।

মাথার উপর ফ্যান চলছে। সোফায় বসে হাপাচ্ছে মীরা আর মুহিত। দৌড়াদৌড়ি করার ফলে দুজনেই ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। একটু জিরিয়ে নিয়ে মীরা উঠতে উঠতে বলল,’আর একদম জ্বালাতে আসবি না আমাকে। দূর হ ফাজিল।’
মুহিত আহত কন্ঠে বলে,’এভাবে বলে না বউ স্বামীর থেকে দূরে থাকতে নেই। আচ্ছা এক গ্লাস পানি খাওয়াও।’
মীরা মুখ বাঁকিয়ে রান্নাঘরে যেতে যেতে বলল, ‘নিজে গিয়ে খা। আমি খাবার রেডি করছি।’

মুহিত টেবিল থেকে পানি নিয়ে খেয়ে গান শুরু করলো,’কবে আইবে আমার পালা রে,,,,, কবে দিমু গলায় মালা রে মালা রে,,,,’

মীরা খাবার রেডি করে পিহুকে ডাকতে গেলো। পিহু মীরা আর মুহিত সকালের নাস্তা সারলো। মীরা ওষুধ আনার জন্য পিহুর রুমে গেলো। ওষুধের পাতা হাতে নিতেই ওর চোখ গেলো ওয়্যার ড্রপের উপর। লাল রঙের টেডিবিয়ারটা সাজিয়ে রেখেছে পিহু। সাথে সাথে মীরার মেজাজ তুঙ্গে উঠে গেল। টেডিবিয়ারটা ধরে নিয়ে পিহুর সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। মীরার হাতে টেডি দেখে পিহু একটুও ঘাবড়ালো না। মীরা রাগে ফুসে উঠে বলে,’তুমি আবার এই আপদটাকে ঘরে তুলেছো কেন??’
পিহু কথা না বলে হাত বাড়িয়ে ওষুধের পাতা নিলো। মীরা জোর গলায় বলল,’আজকে তো এটাকে এমন জায়গায় গুম করবো তা তুমি ভাবতেও পারবে না। দরকার পড়লে এটাকে পুড়িয়ে ফেলবো।’
মীরা হনহনিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেল একটু পর আবার ফিরে আসলো তবে কিছু বলল না। সোফায় বসে মুখটা অন্যদিকে ফিরিয়ে রাখলো। মুহিত একবার মীরার দিকে তো একবার পিহুর দিকে তাকায়। পিহু রুমে গিয়ে রেডি হয়ে নিলো। তারপর বের হয়ে বলল,’মীরা আমি আসছি। দরজা লাগিয়ে দিস। দূরে কোথাও যাস না।’
মীরা এবারও কোন কথা বলে না। পিহু দরজার সামনে যেতেই মীরা গম্ভীর গলায় বলল,’ওই টেডি তুমি আর বাড়িতে আনবে না তাহলে আমি বাড়ি ছেড়ে চলে যাব বলে দিলাম।’
পিহু হাসলো তারপর কলেজের উদ্দেশ্য চলে গেল। মুহিত মীরার রাগ ভাঙানোর জন্য এটা ওটা বলতে লাগলো। পিহু বাড়ি থেকে একটু দূরে আসতেই দেখতে পেল ডাস্টবিনে পড়ে আছে টেডিটা। পিহু এগিয়ে গিয়ে হাতে নিয়ে ময়লা ঝাড়তে লাগে। তারপর সেটা নিয়েই কলেজে চলে গেলো। পিহু জানে যে মীরা টেডিটা ডাস্টবিনেই ফেলবে। ড্রেন বা পুড়িয়ে ফেলার ক্ষমতা থাকলেও মীরার তাতে মন টানে না। তাই তো বারবার মীরা ডাস্টবিনেই টেডিটা ফেলে দেয় আর পিহু বারবার তা বাড়িতে তোলে।
এই সতেরো বছরে অনেক কিছু পাল্টে গেছে। মীরাও বদলেছে অনেক। ইফাজ আর ইশানের নাম সে শুনতেই পারে না। সতেরো বছর ধরে একটু একটু করে ঘৃণা জন্মেছে মীরার মনে। মীরার কাছে পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ ব্যক্তি হলো ইশান আর ইফাজ। সেদিন ছোট ছিল বলে কিছু বলতে পারে নি। ভয়ে চুপসে ছিলো। কিন্তু এখন মীরা একটুও ভয় পায় না বরং অন্যায়ের প্রতিবাদ করে। সবসময় মাথা উঁচু করে চলে। পিহুর মতো নরম মনের মানুষ নয় সে। টেডি বিয়ার টা ইশানের দেওয়া ছিল। যাওয়ার আগে ইশান টেডিটা মীরার হাতে দিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু এখন এই টেডির প্রতি মীরার ঘৃণা হয়। অনেক বার এই টেডিকে সে ফেলে দিয়েছে। কিন্তু পিহু খুঁজে খুঁজে বের করে আবার ঘরে এনেছে। এ নিয়ে অনেক ঝামেলা করেছে মীরা। তবুও পিহু কোন কথা বলেনি এবিষয়ে।
পিহু এই টেডিতে ইশানের ছোঁয়া পায় তাই আগলে রাখে নিজের কাছে। পিহু ভাবতে লাগলো যে আজকে থেকে এই টেডিকে গোপন জায়গায় লুকিয়ে রাখবে যাতে মীরা না দেখতে পায়।

সতেরো বছরে পিহু একটুও শক্ত হতে পারেনি। উল্টে আরো দূর্বল হয়ে গেছে। ইশান আর ইফাজের প্রতি একটুও রাগ নেই পিহুর। তবে তার শেষ ইচ্ছা যে ওদেরকে সব সত্যিটা জানাবেই। তখন আবার সব ঠিক হয়ে যাবে। ইশান আর ইফাজ আবার ওর কাছে ফিরে আসবে। সেদিন ডিভোর্স পেপারে সাইন করার জন্য আজও পিহু আফসোস করে। কিভাবে সে এতো অভিমান করলো সেদিন?? সেদিনের পর নেহাল আবার এসেছিল। মূলত পিহুর ডিভোর্সের কথা শুনে এসেছিল। কিন্তু সামির আর মুক্তা সর্বদা পিহুর পাশে ছিলো বিধায় নেহাল কিছু করতে পারেনি। এমনকি পুলিশে জানিয়েছিলো। তারপর নেহালকে আর দেখা যায়নি।

কলেজে যেতেই মুক্তার সাথে দেখা। এই কলেজে জয়েন করার বছরখানেকের মধ্যে মুক্তাও এখানে জয়েন হয় যার ফলে দুজন একসাথে একই কলেজে চাকরি করে। ক্লাস শেষ হতে দুপুর দুটো বেজে গেলো। পিহু ক্লান্ত হয়ে বাড়িতে ফিরলো। মীরা তখন নামাজ পড়ে ঘুমাচ্ছে। পিহু চাবি দিয়ে দরজা খুলে টেডিটা আলমারিতে তালা মেরে রাখলো। তারপর চললো গোসল করতে। গোসল সেরে যোহরের নামাজ আদায় করলো। তারপর গেল মীরার রুমে। মীরা তখনও ঘুমাচ্ছে, মেয়েটা যে এতো ঘুম পাগল। উঠতে বসতে তার ঘুম পায় ওর। নিশ্চয়ই না খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। এটাই মীরার একমাত্র স্বভাব পিহুকে ছাড়া সে খাবেই না। পিহু মীরাকে টেনে উঠিয়ে খাবার টেবিলে নিয়ে বসায়। মীরার প্লেটে ভাত বেড়ে দিতে দিতে সে বলে,’নামাজ পড়েছিলি??’

মীরা মুখের সামনে হাত রেখে হাই তুলে বলে,’হুম’

‘আজকে বিকেলে পুষ্পার কবর জিয়ারত করতে যাবো।’
মীরা খাবারের প্লেটের দিকে তাকিয়ে ছোট করে বলে,’হুম’
তারপর আর কেউ কথা বলে না। মীরা এখন আর সেই মিথ্যা ধারনা নিয়ে থাকে না। সে এখন জানে যে তার বাবা মা কেউ বেঁচে নেই। যেদিন প্রথম একথা বুঝতে পেরেছিলো সেদিন পিহুকে আঁকড়ে ধরে চিৎকার করে কেঁদেছিলো। পিহুই সেদিন মীরাকে সামলিয়েছে। মায়ের আদর দিয়ে বড় করেছে।পিহু মীরাকে আরো পড়াবে। রেজাল্ট বের হলে মাস্টার্স এ ভর্তি করাবে। নিজের পায়ে দাড় করাবে মীরাকে।

বিকেলে পিহু আর মীরা বের হয়। একটা রিকশা নিয়ে কবরস্থানে যায়। পাশাপাশি কবর দেওয়া হয়েছে পুষ্পা আর মিলনকে। পিহু আর মীরা দুজনে কবর জিয়ারত করে বাড়ির পথ ধরে। রিকশা না পাওয়ার কারণে দু’জনে হাঁটছে। একটু সামনে গেলেই রিকশা পাওয়া যাবে। তখনই চোখে পড়লো রাস্তার পাশে কেউ একজন বসে আছে। হয়তো পড়ে গেছে তাই ওঠার চেষ্টা করছে। পিহু সেদিকে এগিয়ে গেল। মীরা পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখে পিহু একটা লোককে সাহায্য করতে গেছে। পিহু লোকটাকে দেখে অবাক হলো তবুও টেনে তুললো তাকে। কিন্তু মীরা যেইনা লোকটাকে দেখলো রাগে ফুস করে উঠলো। দৌড়ে গিয়ে পিহুর থেকে ছাড়িয়ে নিলো লোকটাকে। ধাক্কা লাগায় লোকটা পড়তে পড়তেও পড়লো না। পিহু মীরার দিকে তাকিয়ে গরম চোখে বলে,

‘সমস্যা কি তোর??দেখছিস না সাহায্য করছি।’
মীরাও পিহুর সাথে চোখ মিলিয়ে বলে,’দুনিয়ার সব মানুষকে সাহায্য করতে পারো আমি কিছু বলবো না। তবে এই লোকটাকে কোনভাবেই সাহায্য করা যাবে না।’
মীরা নেহালের দিকে তাকিয়ে বলল,’এই যে আপনি, হঠাৎ কোথা থেকে উদয় হলেন। উদয় হয়েছেন ভালো কথা আবার মনি’মায়ের সামনে কেন এসেছেন?? ইচ্ছে করছে ধাক্কা মেরে ড্রেনে ফেলে দেই। যাতে নোংরার মধ্যে থেকেই মৃত্যু হয়??’
পিহু একটা ধমক দিয়ে বলল,’মীরা এসব কি বলছিস। উনি তোর গুরুজন হয়। আর কারো মৃত্যু কামনা করা ঠিক নয় ক্ষমা চা,,,’

মীরা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলে,’এর থেকে ক্ষমা চাইব আমি??তার থেকে যদি বিশ তলা বিল্ডিং থেকে লাফ দিতে বলো আমি তাতেও রাজি। তবুও এই খারাপ লোকটার কাছে ক্ষমা চাইতে আমি রাজি নই।’

মীরা মুখ ঘুরিয়ে নিল। পিহু কিছু বলার আগেই নেহাল বলে উঠলো,’থাক না পিহু। মীরা ছোট মানুষ ওকে বলতে দাও। আমি কিছু মনে করিনি। আমার পাপের শাস্তি তো সবে শুরু হয়েছে মাত্র।’

নেহালের কথায় পিহু অবাক হয়ে বলল, ‘শাস্তি কিসের??আর তোমার এই অবস্থা কেন??’

পিহু নেহালের দিকে চোখ বুলায়। সাদা একটা পাঞ্জাবি পড়া নেহাল। তাতে ময়লা লেগে আছে। গায়ে একটা পাতলা চাদর তাতেও ময়লা লেগে রয়েছে। নেহাল স্নিগ্ধ হেসে বলল,’তোমার সাথে অন্যায় করেছি তার শাস্তি আমি পাচ্ছি। কয়েকবছর আগে একটা এক্সিডেন্টে আমার হাত ভেঙে যায়। ডক্টর দেখিয়েছিলাম। আমার হাতে রগ বসানো হয়েছে। এতে প্রায় আমার সব টাকাই শেষ। এর জন্য আমার চাকরিটাও হারাতে হয়েছে। হারাতে হয়েছে নিজের পরিবারকেও। মা বাবা তো মারা গেছে। ছেলেমেয়েরা তো নিজেদের খরচ চালাতে হিমশিম খায়। বয়সই বা কতো তাদের?? এটুকু বয়সে তো ওদের আনন্দ ফুর্তি করার সময়। কিন্তু ওরা নিজেদের হাল ধরেছে। তাই আমি আর আমার স্ত্রী সামনের বৃদ্ধাশ্রমে থাকি।’

পিহু মুখে হাত রেখে বলে উঠলো,’কি?? এতো কিছু হয়ে গেছে??’
মীরা পিহুর মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলে, ‘দেখলে তো মনি’মা পাপ তার বাপকেও ছাড়ে না। এই লোকটার পাপের ফল শুধু উনি নয় বউ বাচ্চাসহকারে পেয়েছেন। একেই বলে ধর্মের কল বাতাসে নড়ে। প্লিজ মনি’মা তুমি এখন এই খারাপ লোকটাকে দয়া দেখিও না। আমার তো ঘেন্না হচ্ছে।’
পিহু এবার বেশ রেগে গেলো। কড়া গলায় বলল,’মীরা চুপ কর আমাকে বলতে দে।’

পিহু নেহালের দিকে তাকাতেই নেহাল বলল,’তুমি আমায় ক্ষমা করো পিহু। নাহলে সারাজীবন এই পাপের বোঝা বয়ে বেড়াতে হবে আমাকে।’
পিহু বড় একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললো, ‘আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাও। তিনি ক্ষমা করলেই হবে।’

‘আমি তোমার অনেক বড় ক্ষতি করেছি পিহু।এর ক্ষমা তাই তোমার কাছেই চাই। আমি ইফাজকে সবটা সত্যি বলে দেব। কোথায় আছে সে এখন??’

মীরা আর নিজেকে চুপ রাখতে পারলো না। ফোস করে বলল,’এখন বলে কি হবে?? সতের বছর তো চলেই গেল। বাকি জীবনটাও এভাবেই চলে যাবে। চলো মনি’মা, না এই নেহালের সামনে আসবে আর না ইফাজ খান আর ইশান খান। এই লোকগুলো খুব খারাপ মানুষ চলো??’

নেহাল ওদের বাঁধা দিয়ে বলে,’আমার শেষ অনুরোধ টুকু রাখো প্লিজ??ইফাজকে সবটা বলতে যে আমাকে হবে। সামনেই আশ্রম চলো তারপর আমি সব বলছি।’
মীরা প্রথমে আপত্তি করলেও পিহুর জন্য রাজি হয়। আশ্রমে গিয়ে নেহালের স্ত্রীর সাথে পিহু পরিচিত হয়। স্বামীর কৃতকর্মের জন্য তিনিও ক্ষমা চায়। নেহাল পিহুর হাতে একটা চিঠি ধরিয়ে দিয়ে বলল,’এই চিঠিটা ইফাজকে যেভাবেই হোক দিও। তাহলে ও সবটা বুঝে যাবে।

পিহু আর কথা বাড়ালো না মীরাকে নিয়ে চলে এলো। মীরা তো রাগে গমগম করছে। সে পিহুর মতো অতো ভালো মনের মানুষ নয়। দরকার কি এতো ভালো হওয়ার। এই পৃথিবীতে যে বেশি ভালো সেই বেশি কষ্ট পায়। আঘাত ও বেশি পায়। যেমনটা পিহু পেয়েছে। এখনও পিহু মাঝরাতে কাঁদে। সে কি ভেবেছে মীরা কি কিছু জানে না??মীরা সব জানে। এজন্যই তো মীরার মনে ক্ষোভ জন্মেছে ইফাজ আর ইশানের প্রতি। ইফাজ কেন সেদিন পিহুকে বিশ্বাস করলো না??পনেরো বছরে সে এই চিনেছে পিহুকে?? তাহলে কিসের ভালোবেসেছে পিহুকে??ইফাজ তাহলে পিহুকে ভালোইবাসেনি। আর ইশান কেন সেদিন চলে গেল?? একবার ও মায়ের কথা ভাবলো না??মা যে তাকে ছাড়া কষ্টে থাকবে এটা একবার ও ভাবলো না?? এসব কথা ভেবে ভেবে মীরা ওর ঘৃণার পাহাড় উঁচু করে যাচ্ছে তো যাচ্ছেই। কিন্তু মীরার এই ঘৃণার পাহাড় কি আদৌ কখনো ভাঙবে????

#চলবে,,,,,,,,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here