সেঁজুতি পর্ব_৩ ৪

0
2514

#সেঁজুতি(পর্ব_৩)
#লেখা_সুমাইয়া_আক্তার_মনি
৩+৪

৯ টা বেজে ৫ মিনিটে ঘুম ভাঙে সেঁজুতির। পাশে ফিরে দেখলো সাওন নেই। নিশ্চয়ই ওর সাড়াশব্দ পায়নি তাই না বলেই অফিসে চলে গিয়েছে।
এলোমেলো চুলের হাত খোঁপা করে বিছানা ছাড়লো সেঁজুতি। ফ্রেশ হয়ে রুমের বাইরে যাওয়া মাত্রই ওর চক্ষু চড়কগাছ। আনোয়ারা বেগম শাক কাটছেন আর একা-একা বিড়বিড় করছেন। সেঁজুতি যাওয়া মাত্রই একবার তাকিয়ে আবারও নিজের কাজে মন দিলেন, সাথে কথা তো আছেই। সেঁজুতি শুনেও না শোনার ভান ধরে রান্নাঘরে গেল। কোনো খাবার অবশিষ্ট দেখলো না। ছোট একটা নিঃশ্বাস ফেলে ডাইনিং টেবিলের পাশে আসলো। আনোয়ারা বেগম তার পাশেই বসে শাক কাটছেন। সেঁজুতি একবার তাকিয়ে জগ থেকে গ্লাসে পানি ঢেলে ঢকঢক করে খেয়ে নিলো। আনোয়ারা বেগম না তাকিয়ে বললেন, “ হটপটে পরোটা আছে। ভাজি করা আছে, একটা ডিম ভেজে খেয়ে নাও। ”

সেঁজুতি চোখ বড়বড় করে তাকিয়ে বললো, “ আম্মা! আপনি এসব করলেন কেন? আমায় বললে আমি নিজেই তো করতে পারতাম। ”

আনোয়ারা বেগম, সেঁজুতির দিকে একবার তাকিয়ে বললো, “ দুপুরে বানিয়ে দিতে? সকাল ৯টা বাজে এর জন্য অপেক্ষা করলে তো আমার ছেলে খেয়ে যেতে পারতো না। আর তুমিও আধমরা হয়ে থাকতে। রাতে তো কিছুই খাওনি, এখন না খেলে শরীর খারাপ করবে না? ”

আনোয়ারা বেগমের কথা শুনে চোখ পিটপিট করে তাকালো সেঁজুতি। ভালোবেসে সবকিছু তৈরি করে রেখেছে আবার কথাও শোনাচ্ছে। রাতের ঘটনা বললো না সেঁজুতি, তা না হয় আড়ালেই থেকে যাক! সাওন নিজ দায়িত্বে সহধর্মিণীর খাবার নিয়ে গিয়েছিল। এটা শাশুড়িকে কীভাবে বলবে! তাই নিজের মধ্যেই লুকিয়ে রেখেছে।
খাবার মুখের সামনে ধরে আবারও রেখে দিলো সেঁজুতি। আনোয়ারা বেগমকে জিজ্ঞেস করলো, “ সে খেয়েছে কি-না!” আনোয়ারা বেগম জবাবে কিছু না বলে শাক কাটায় ব্যস্ত হয়ে পরলো। সেঁজুতি তাঁর মুখোমুখি বসে পরলো। আনোয়ারা বেগম ভ্রু কুঁচকে তাকানো মাত্রই সেঁজুতি গম্ভীরমুখে বলল, “ আম্মা! সকালে না খেলে কি হয় জানেন? শরীর খারাপ করবে। আর আপনি এসব কারণে অসুস্থ হলে ব্যপারটি কেমন দেখা যায়? ”

সেঁজুতি’র কথায় আনোয়ারা বেগম কিছু বললো না। নাছোড়বান্দা সেঁজুতি, এক কথাতেই হেরে যাবে এমন মেয়ে নয়। উঠেপড়ে লেগেছে আনোয়ারা বেগমকে খাওয়ানোর জন্য। শেষপর্যায়ে, আনোয়ারা বেগম উচ্চস্বরে বললেন, “ এসব কি করছো বউ? এক জনের হাতের খাবার অন্যজন খেতে পারে? ”

আনোয়ারা বেগমের এমন কথায় ভড়কে যায় সেঁজুতি। ধীর ভাবে বলে, “ এটা তো শুকনো খাবার।”

সেঁজুতি’র কথার কোনো জবাব না দিয়ে উঠে দাঁড়ালো আনোয়ারা বেগম। সেঁজুতি টলমলে চোখে সেখানেই বসে আছে। বেশ তো ভালোই ছিলো সবকিছু, শুধু শুধু নিজের ন্যাকামোর জন্য আনোয়ারা বেগমকে রাগিয়ে দিলো। এসব ভেবে মন খারাপ হচ্ছে সেঁজুতি’র। হাতের প্লেট টেবিলে ঢেকে রেখে কাজে মন দিলো সেঁজুতি। নিজের কর্মকাণ্ডের জন্য নিজেই দুঃখ পেয়েছে। চোখ টলমলে অবস্থায় পেয়াজ কাটা শুরু করলো। নিজের কান্না আর পেয়াজের জন্য কান্না এক মনে হচ্ছে। দুটোর জন্যই সাগর তৈরি হচ্ছে। এক সাগর অভিমান নিয়ে গরম তেলে মাছ ছাড়লো। হাতে তেলের ছিটে পরায় অস্ফুটস্বরে ‘মা’ শব্দটি ভেসে আসলো। আনোয়ারা বেগম তাঁর রুমে থাকায় কিছুই শুনতে পেলো না। তাছাড়া, অন্যকোথাও মন নেই তাঁর। গভীর চিন্তায় মগ্ন সকাল থেকে। বড় মেয়ের ফোনকলের পরেই এই অবস্থা দেখা দিয়েছে, তবুও চুপচাপ ছিল। কিন্তু সেঁজুতি’র ন্যাকামোর জন্য ওর উপরেই সমস্ত রাগ ঝাড়লো।

আনোয়ারা বেগমের বড় মেয়ের সাথে তার শাশুড়ি আর ননদের ভীষণ কথা কাটাকাটি হয়। সকালে যখন আনোয়ারা বেগম নাতির খোঁজ নিতে মেয়েকে ফোনকল দিলেন তখন নাতি নিজে থেকেই এসব বলা শুরু করে। মূলত, তখন থেকেই মন-মেজাজ ভালো নেই আনোয়ারা বেগমের।
শাশুড়ি তো শাশুড়িই হয়। কখনোই মা হয়ে উঠতে পারে না।

কিছুক্ষণ পরে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ালেন আনোয়ারা বেগম। যা ভেবেছিল ঠিক তাই। সেঁজুতি না খেয়েই কাজ করছে, রাতেও খায়নি মেয়েটি। এসব ভেবেই আনোয়ারা বেগম সেঁজুতি’কে উদ্দেশ্যে করে বললো, “বউ, খাবার খাওনি কেন?”

জবাবে সেঁজুতি বলল, “ আম্মা, রান্নাটা করে নেই আগে। বেলা হয়েছে তো। ”

আনোয়ারা বেগম কিছু একটা ভেবে সামনে এগিয়েও আবার পিছনে চলে গেলেন। জড়তা কাজ করছে।
এই বউ শাশুড়ি নামক যুদ্ধ কখন শেষ হবে জানা নেই। একজন নিজের মায়ের মতো ভাবে না, আরেকজন নিজের মেয়ের মতো ভাবে না। এই দুটো কারণেই সংসার এলোমেলো হয়ে যায়।

.

আজ অনেকদিন পরে শাড়ি পরেছে সেঁজুতি। মূলত, তেল ছিটানো হাত শাড়ির আঁচলে লুকিয়ে রাখবে তাই।
দুপুরে বউ, শাশুড়ি একসাথে খেয়ে নিলো। মুখোমুখি হলেও প্র‍য়োজন ছাড়া কেউ কারো সাথে কথা বলেনি। সারা দুপুর শুয়ে-বসে কাটিয়ে দিলো। অপরাহ্নের প্রহরে ব্যালকনিতে এসে নিজের যত্নসহকারে লাগানো ছোট ছোট টবের দিকে চোখ বুলাচ্ছে সেঁজুতি। মাঝেমাঝে ছুঁয়ে দিচ্ছে আর অপেক্ষার প্রহর গুনছে। মেয়েদের বিয়ের পরে স্বামীর বাড়ির সবাই আপন হয়ে যায়। সবকিছুকেই নিজের মতো ভাবে। কিন্তু আফসোস, ছেলের বউকে নিজের মতো ভাবে না কেউ। এর রেষারেষিতে ছেলের বউ পাল্টা জবাব দেয়। এভাবে ক্রমাগত সবকিছু এলোমেলো হয়েই যাচ্ছে, ঠিক হওয়ার নাম নেই।

তাছাড়া, এই চার রুমের বাসায় সেঁজুতি আর ওর শাশুড়ি ছাড়া কেউ নেই। বড় দুই ননদ তাঁদের শ্বশুর বাড়িতে, সাওন অফিসে। বাকি থাকে সেঁজুতি আর ওর শাশুড়ি। সেঁজুতি ইচ্ছে হলে পাঠ্যবইয়ে চোখ বুলায় নয়তো সেভাবেই পরে থাকে। আনোয়ারা বেগম তসবি নিয়ে ব্যস্ত থাকে। মাঝেমাঝে সেঁজুতি’কে কথা শুনিয়ে নাড়িয়ে দিয়ে যায়। এভাবে বউ শাশুড়ির সময় কেটে যায় ; একে অপরের কথা কাটাকাটি নিয়ে৷

ব্যালকনিতে ফুলের সাথে সময় কাটাচ্ছে আর সাওনের অপেক্ষা করছে সেঁজুতি। কখন আসবে, কখন একাকীত্বের প্রহর কেটে যাবে! অপেক্ষা শেষ হওয়ার নাম নেই, বরং সময় বেড়েই চলেছে। বেশ কিছুক্ষণ পরে সাওনের দেখা মিলে। গেট অতিক্রম করে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করলো সাওন। রুমে এসে টাইয়ের নট খুলতে খুলতে সেঁজুতি’র দিকে তাকালো। সেঁজুতি ধীর পায়ে সাওনের পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে।
সাওনে জিজ্ঞেস করলো, “ খেয়েছো?”

ছোট করে সেঁজুতি’র জবাব, “ হুম।”

সাওন বললো, “ মা খেয়েছে? ”

সেঁজুতি বলল, “ হুম।”

সাওন ছোট করে জবাব দিল,“ ওহ।” তারপরে ফ্রেশ হয়ে বিছানায় মাথা ঠেকিয়ে বসলো। সেঁজুতি এখনো চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। সেঁজুতি’কে উদ্দেশ্য করে সাওন বলল, “ এখনো দাঁড়িয়ে আছো যে! ”

সেঁজুতি ক্ষিপ্রতার সাথে বলল,“ শাড়ি পরেছি, এখন নাচবো। আপনার জন্য অপেক্ষা করেছিলাম। ”

সেঁজুতি’র কথা শুনে বাঁকা হেসে সাওন বললো,“ ওহ, এই ব্যপার!”

সাওনের কথায় দ্বিগুণ রেগে গেল সেঁজুতি। শাড়ি পরেছে, তেল ছিটানো হাত ঢাকার জন্য। কিন্তু সেজেছে তো ওর স্বামীর জন্য। অথচ, একবারের জন্য সাওন ভালভাবে তাকাচ্ছে না। উল্টো মেজাজ খারাপ করছে সেঁজুতি’র ৷ রাগে দুঃখে বিছানার অপরপাশে বসলো, সাথে সাপের মতো ফণি ধরা তো আছেই। সাওন কিছু বলতে যাবে তখনি ফোনের রিংটোন বেজে উঠে। ওর বড় বোন কল দিয়েছে, এখানে আসবে। কোনো ঝামেলা যেন না হয়। বোনের কথা শুনে সাওন ছোট একটা নিঃশ্বাস নেয়। সারাদিন খাটুনির পরে বাড়িতে এসে প্রতিদিন এক কাহিনীর মুখে পরতে হয়।

এর আগে যখন এসেছিল ওর দুই বোন, তখন ঘরের মধ্যে যুদ্ধক্ষেত্র বয়ে যায়। কিছুক্ষণ পরপর কথা কাটাকাটির শুরু হয়। কেউ সেঁজুতি’কে জ্ঞান দেয়, কেউ কথা শোনায়৷ যার একটাও ভালো লাগে না সেঁজুতি’র। সে বরাবরের মতোই মুখের উপরে জবাব দিয়ে দেয়। তার জন্যই এমন সতর্কবার্তা আগে থেকে। এবারে যে ক’দিন থাকুক কোনো প্রকার ঝামেলা চায় না সাওন।

#চলবে

এখানে বউ শাশুড়ির ঝগড়া আছে, ভালোবাসাও রয়েছে। আশা করি, ধীরে ধীরে বুঝতে পারবেন সবাই।
#সেঁজুতি(পর্ব_৪)
#লেখা_সুমাইয়া_আক্তার_মনি

মোবাইল পাশে রেখে ছোট একটা নিঃশ্বাস ফেলে সাওন। সেঁজুতি’কে উদ্দেশ্য করে বললো, “ আপুরা আসবে আগামীকাল। ”

সেঁজুতি শান্তভাবে বলল, “ ওহ। সকালে বাজার করে দিয়ে যেয়ো, সবকিছু তো গুছিয়ে রান্না করতে হবে। অনেক সময়ের ব্যপার। তাছাড়া, আমার একটু দেরী হয় কাজ করতে, তখন কথা শোনাবে। ”

সাওন দৃঢ় ভাবে বললো, “ আচ্ছা। একটা কথা ছিল।”

সেঁজুতি’র ছোট জবাব, “ হ্যাঁ! বলো। ”

আমতা-আমতা করে সাওন বললো, “ বড় আপু একটু রাগী মানুষ। সে কিছু বললে গায়ে লাগিও না। তাছাড়া, বড়’রা ভালোর জন্যই বলে তার জন্য রাগ করার দরকার নেই৷ তুমি তোমার মতো থাকবা তারা তাদের মতো। ”

সাওনের কথা শুনে তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে সেঁজুতি বলল, “ ফোনে কি এতক্ষণ এসব’ই বুঝিয়েছিল? আগেও বলেছি এখনো বলছি, আমি কোনো কারণ ছাড়া রাগি না কখনো৷ তাঁরা অকারণে জ্ঞান দিতে আসে কেন! এসব বারণ করে দিয়ো। ”

সেঁজুতি’র কথায় দাঁতে দাঁত চেপে সাওন বললো, “ সেঁজুতি! মেয়েদের এত রাগ ভালো না। বছর হয়নি এ বাড়িতে আসছো, এখনি মুখে মুখে তর্ক শুরু করেছো। বাড়ির বউদের সবকিছু বুঝে শুনে চলতে হয়। ”

সাওনের কথায় রেগে গেল সেঁজুতি। সাওনের চোখাচোখি তাকিয়ে বলল, “ বছর হলেই মুখে মুখে তর্ক করা যায়! এরজন্যই হয়তো তোমার বোনদের এমন অশান্তি? তারা তো অনেক জ্ঞানী মানুষ, তাহলে ঝগড়া হয় কেন? বুঝে শুনে চলতে পারে না?”

এবারে সেঁজুতির কথায় দ্বিগুণ রেগে গেল সাওন। একে তো চোখে চোখ রেখে কথা বলছে তারপরে ওর বোনদের নিয়ে তর্ক! রাগ কন্ট্রোল করতে না পেরে সেঁজুতি’র গালে সজোরে থাপ্পড় দিলো সাওন। দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “ আগেও বারণ করেছিলাম, আমার চোখাচোখি হয়ে তর্ক করবে না। মেয়েদের এত তেজ ভালো না। ”

সেঁজুতি রাগে কথা বলতে পারছে না। গালে হাত দিয়ে সাওনের দিকে তাকিয়ে আছে। সেঁজুতি’র এমন রাগান্বিত চোখমুখ দেখে মেজাজ খারাপ হয়ে যায় সাওনের। হাতের মোবাইল ছুড়ে মারলো ফ্লোরে। শার্টের বোতাম লাগাতে লাগাতে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। সেঁজুতি নিশ্চুপ হয়ে বসে আছে।

সাওনকে হন্তদন্ত হয়ে ছুটতে দেখে আনোয়ারা বেগম কয়েকবার ডাকলেন ; সাওন ছোট করে জবাব দিলো, “বাহিরে যাচ্ছি, একটু পরে আসবো।”

আনোয়ারা বেগম কিছু বললো না। কিছুই যে শুনেনি এমন না, এক ছাঁদের নিচে থাকলে সামান্য কিছু জানলেও জানতে পারে। আনোয়ারা বেগম ওদের তর্কাতর্কির আওয়াজ শুনেছিলেন কিন্তু কারণ জানেন না।

রাত ৮ টা বেজে ৪৭ মিনিটে বাসায় আসে সাওন। মোটামুটি বাজার আছে হাতে। কাঁচাবাজার সকালে করে দিবে। সেঁজুতি’র নাম ধরে ডেকে বলল, “ বাজার গুছিয়ে রাখো। ”

সেঁজুতি গম্ভীরমুখে সামনে এসে দেখলো চাল, ডাল, আটা, পেঁয়াজ, রসুন, তেল, নুডুলস, ডিম, বিস্কুট, দু’টো মুরগী এসব ফ্লোরে পরে আছে। অন্যান্যগুলো গুছিয়ে মুরগী কাটতে বসলো। বাবার বাড়িতে বসে একবারের জন্যও মুরগীতে হাত লাগায়নি কিন্তু শ্বশুর বাড়িতে এসে সবকিছু নিজ হাতে সামলাচ্ছে। সাথে কথাও শুনছে সবার। সেঁজুতি নিজেকে নিজে অনেক বকা-ঝকা করছে, কেন নিজের ব্যালেন্স করতে পারে না। নিজেরও ভাবা উচিত এটা শ্বশুর বাড়িতে এসেছে, ওর রাগের পরোয়া করবে না কেউ। অথচ, সেই আগের মতোই করে যাচ্ছে। মানুষের খোঁটাও শুনে যাচ্ছে। এমনকি না পারে স্বামীর মন রক্ষা করতে, না পারে নিজের মনকে পড়াতে। কিছুক্ষণের জন্য সবকিছু ঠিকঠাক হয়ে যায় তারপরেই সবকিছু এলোমেলো। সাওনের থাপ্পড় বেশ জোরেই ছিল, যার জন্য গালে দাগ স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে। তবে আনোয়ারা বেগমের সামনে পরেনি সেঁজুতি।
সব দোষ নিজের পরিবারের মানুষদের দিচ্ছে। তাদের জন্যই এই সভ্য বাড়িতে আসতে হয়েছে। তাছাড়া, এমন সভ্য বাড়িতে মেয়ের বিয়ে দিতে হলে সভ্যতা শেখানোর দরকার ছিলো। হয়তো এমন সভ্যতার কিছুই শিখে আসতে পারেনি যার জন্য সবাই কথায় কথায় বেয়াদব উপাধি দিচ্ছে। নিজের স্বামীও দিচ্ছে। সম্পূর্ণ দোষ সেঁজুতির পরিবারকে দিচ্ছে নিজেই। সব আবেগ এসে ভর করেছে, চোখ দুটো ভিজে আছে। চোখের পানির জন্য চোখদুটো ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে, তবুও মুরগী কাটায় ব্যস্ত সে।
এভাবে রাগ, কান্না, অভিমানের মধ্যে কখন যে হাতের তালু কেটে গেল বুঝতে পারেনি। তবুও কোনোরকম শব্দ না করে নিজের মতো কাজ করতে রইলো। হাত দিয়ে রক্ত গড়িয়ে পরছে, তবুও কাজ করছে। বাড়ির বউ কাজের সময়ে হাত কাটতেই পারে তার জন্য কাজ করা তো বন্ধ করে দিবে না। তাহলে আবারও খোঁটা শুনতে হবে। হাতে যন্ত্রণা করছে তবুও সবকিছু গুছিয়ে রাখলো সেঁজুতি।

হাতে বরফ লাগিয়ে ডাইনিং টেবিলের কাছে গেল। রাতের খাবার গুছিয়ে সবকিছু ঢেকে রাখলো। ওর খাওয়ার ইচ্ছে নেই। কাটা হাত তারমধ্যে বারবার মনে হচ্ছে মুরগীর আঁশটে গন্ধ ছড়িয়ে আছে এখনো। এরজন্য খেতে ইচ্ছে করছে না। তাছাড়া, রাগের প্রভাব যায়নি এখনো। সবকিছু মিলিয়ে রুমে যেয়ে বসে রইলো সেঁজুতি। সাওন’কে উদ্দেশ্য করে বললো,“ খাবার বেড়ে রেখেছি, খেয়ে আসেন। ”

সেঁজুতি’র কথায় ওর দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকালো সাওন। শান্তভাবে বললো, “ তুমি খাবে না?”

জবাবে সেঁজুতি কিছু বললো না। সেঁজুতি’র নীরবতা দেখে সাওন কিছু বলতে চেয়েও থেমে গেল। এতদিনের সংসারে একটু হলেও জানা আছে সেঁজুতি’র সম্পর্কে। না খেয়ে থাকতে পারে না এটাও জানা আছে। সাওন নিজেও নীরবতা পালন করছে। কিছুক্ষণ পরে শান্তভাবে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। আনোয়ারা বেগমের রুমে গিয়ে তাকে উদ্দেশ্যে করে বলল, “ আসবো মা?”

আনোয়ারা বেগম শোয়া থেকে উঠে বসলো। শান্তভাবে বললো, “হ্যাঁ।”

সাওন রুমে যেতে যেতে বললো,“আগামীকাল আপুরা আসবে।”

আনোয়ারা বেগম বললো, “জানি।”

সাওন বললো, “রাতের খাবার খেয়েছো?”

আনোয়ারা বেগম বললো, “তোরা খাবি না?”

সাওন একটু চুপ থেকে বললো, “হু। অনেক রাত হয়ে গেল, তুমি খেয়ে নাও।”

সাওনের কথায় কিছু বললো না আনোয়ারা বেগম। তিনি কিছু হলেও আন্দাজ করতে পেরেছেন। সাওন আর কিছু না বলে উঠে আসলো।
রুমে এসে দেখলো পাতলা কাঁথা গায়ে দিয়ে শুয়ে আছে সেঁজুতি। সাওনের উপস্থিতি টের পেলেও নিশ্চুপ হয়ে শুয়ে আছে। সাওন পাশ ঘেঁষে বসে বললো, “ খাবে না?”

সেঁজুতি এবারেও কোনো জবাব দিলো না। সাওন নিজেও আহাম্মক হয়ে আছে। হয়তো সবকিছু গুছিয়ে বলা যেতো, তাহলে এমন রাগারাগির কিছুই হতো না। সারাদিন খাটুনির পরে বাসায় এসে যদি গায়ে টানা কথার সম্মুখীন হয় ; তাহলে রাগ করাটাও স্বাভাবিক ব্যপার। কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইলো সাওন। তারপরে নিজ থেকেই রুমের বাহিরে গিয়ে খাবার নিয়ে আসলো। নিজের বাহুবলে সেঁজুতি’কে উঠিয়ে বসালো। সেঁজুতি নিশ্চুপ হয়ে বসে আছে, খিদের জন্য পেট জ্বালাতন করছে। তবুও তীব্র অভিমান জমার কারণে খেতে ইচ্ছে করছে না। সাওন ভাতের লোকমা সেঁজুতি’র ঠোঁটের সামনে ধরলো। এবারে সব অভিমানের টনক নাড়ে, চোখ দুটো নিমিষেই ভিজে যায়। কপোল বেয়ে ঝর্ণার মতো পানি ঝড়ছে। হঠাৎ এমনকিছু হতে পারে বুঝতে পারেনি সাওন। ও ভেবেছিল হয়তো এখনো রাগ দেখাবে সেঁজুতি ; কিন্তু ওর ভাবনাকে ভুল প্রমাণ করে অশ্রু ঝড়াচ্ছে সেঁজুতি। বা-হাতের বৃদ্ধাঙ্গুল দিয়ে কপোলের অশ্রুজল মুছে দিলো সাওন। তারপরে ভাতের লোকমা আবারও সামনে ধরলো, এবারে সেঁজুতি চুপচাপ খেয়ে নিলো। কিন্তু একবারের জন্যও সাওনের চোখাচোখি হয়ে তাকায়নি। সেঁজুতি’কে খাওয়ানোর পরে একই প্লেটের খাবার নিজেও খেয়ে নিলো সাওন।

হাত ধুয়ে এসে সেঁজুতি’র পাশ ঘেঁষে বসা মাত্রই চোখ গেল হাতের দিকে। কাপড় পেঁচানো হাত, তেল ছিটানো ফোসকা স্পষ্ট হয়ে আছে। সেঁজুতি’কে কিছু না বলে নিজেই হাতের পেঁচানো কাপড় খুললো, হাত কেটে গিয়েছে৷ সাওনের বুঝতে বাকি নেই যে, মুরগী কাটার জন্যই এমন হয়েছে। এখন এসব আনা একদম উচিত হয়নি, এমনিতেই রেগে ছিলো সেঁজুতি তারমধ্যে মুরগী! নিশ্চয়ই রেগে রেগে কেটেছে। সাওন অপরাধীর মতো নিশ্চুপ হয়ে বসে আছে। সেঁজুতি মুখ থেকে একটু শব্দ বের করলো না।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here