সেঁজুতি পর্ব_১৪

0
1955

#সেঁজুতি(পর্ব_১৪)
#লেখা_সুমাইয়া_আক্তার_মনি

সাওনের কথা শুনে চুপ হয়ে যায় সেঁজুতি।

সাওন শান্ত ভাবে বললো,“ তর্ক করলে মানুষ জিততে পারে না সেঁজুতি। আমি এটাও মানছি আমার মা আর বোনদের কথাগুলোর জবাব দেওয়া লাগে। তার জন্য এটা বলছি না যে, সারাক্ষণ তাদের কথার উত্তর দিয়ে যাবে অথবা সারাক্ষণ চুপ থেকে সহ্য করবে। যখন আমি নিজে কথা বলি তখন অন্ততপক্ষে চুপ থাকতে পারো। বাড়ির বউদের কতকিছু স্যাক্রিফাইস করতে হয়, জানো তুমি? অন্ততপক্ষে স্বামীর জন্য হলেও চুপ থাকতে হয়। এখন বলবা ভেজা বেড়াল, তাইতো? কী করবো আমি? কী বলবো? কাকে বলবো? সবাই শুনবে আমার কথা? কেউ মায়ের অধিকার দেখাবে, কেউ বোনের আর তুমিতো তুমিই। ভালো ভাবে কথা বুঝিয়ে বললেও তুমি তর্ক করো। অন্ততপক্ষে, তুমি আমায় বুঝবা তো। কারো উপরে ভরসা করতে পারি না। সেই ভাগ্য নেই আমার। কেউ বুঝে না, যে যেভাবে পারে আগে আমায় হেনস্তা করে। বিয়ের আগে আপুদের কিছু বললে বলতো, ছোট হয়ে শাসন করি। এরজন্য মা কথা শুনিয়ে দিতো। মাকে কিছু বললে বলতো ; ছেলে বাহির থেকে মদ, গাঞ্জা খেয়ে এমন আচরণ করে। কত ভালো ভাগ্য আমার তাই না? যখন ক্লাস নাইনে ছিলাম তখন আমার বাবা পরলোকগমন করেন। তখন থেকেই টিউশনির পিছনে ছুটতে হতো। না হলে লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যেতো। আমার মা দায়িত্বশীল আবার দায়িত্বহীন দুটোই। সে অতিমাত্রায় ভালো কাজ করবে, হঠাৎ সামান্যতম ভুল করেই সব ভালো কাজের নাম ডুবাবে। সেই সামান্য ভুলটাই মনে দাগ লাগানোর মতো হয়ে থাকবে। বাবা চলে যাওয়ার পরে সে খুব হিসেবী হয়ে গেল। ওই যে বললাম, সামান্য ভুল করবে সেটাই মনে দাগ লাগানোর মতো।
তার এই সামান্য ভুলটাই হলো, আমার লেখাপড়ায় কী কী লাগবে সেটাই খেয়াল না রাখা। আপুদেরকে প্রয়োজনীয় টিউশন দিতো আর আমাকে দীর্ঘশ্বাস নিয়ে শুধুই ছেড়ে দিতো। আপুরা পড়াবে এই আশায়, অথচ তারা পড়ায় কি-না এই খেয়ালটুকু রাখতো না।
একটা কথা কি জানো! সবাই যে খেলাধুলার বয়সে খেলাধুলা নিয়ে পরে থাকবে এমনটা নয়। লাস্ট বেঞ্চার আর ফার্স্ট বেঞ্চার বুঝো না! আমি ফার্স্ট বেঞ্চার ছিলাম। আবুল, হাবাগোবা বর্তমানে ভেজা বেড়াল যাই হোক। লেখাপড়াকেই নিজের খেলা ভাবতাম। কিন্তু আফসোস পরিবার থেকেই সেভাবে কিছু পেলাম না। যা করার নিজেরই করতে হলো। ক্লাস নাইনে থেকে দুই-তিন জন বাচ্চা পড়াতাম। নিজে খাটুনি করে পড়তাম। এভাবে দিন চলে গেল। সরকারি চাকুরি না থাকুক একটা মানসম্মত প্রাইভেট কোম্পানিতে আছি। চাকরি পেয়ে নিজেকে বদলে ফেলি। এখন চার-পাঁচ জনের সাথে চলতে হয়, চলতে পারি এমন করে তুলি নিজেকে। কিন্তু কপাল! শান্তি নামক শব্দটা আমার ভাগ্যে নেই। চাকরির পরপর অনেককিছু বহন করতে হলো। এই ঝামেলা নিয়েই বিয়ে করলাম, বিয়ের এক সপ্তাহ পর থেকে ঘরেও ঝামেলা শুরু। কেউ প্রমাণস্বরূপ সবকিছু সামনে দিতো, যার জন্য সত্য-মিথ্যা যাচাই করতাম না। তাছাড়া চাকরি, মাথার চিন্তা সবকিছু মিলিয়ে তালগোল পাকিয়ে থাকতো সারাক্ষণ ; তখন প্রমাণের সত্য-মিথ্যা যাচাই করার সুযোগ কখন পেতাম! আমি জানি আমার পরিবারের সবার দোষ আছে। তবুও কেউ যদি প্রমাণ ধরিয়ে দেয় তাহলে দোষ চোখে পরবে না? এমন সাধু মানুষ ক’জন আছে? যে সবকিছুর প্রমাণ পেয়েও রাগ না করে থাকবে? তখন তোমাকে শুধু চুপ থাকতে বলতাম, তুমি কী করতা? মুখের উপরে জবাব দিয়ে দিতে। এই নিয়ে সকালে কথা কাটাকাটি, না খেয়ে যাওয়া। আর মায়ের সাথে তোমার তর্ক শুরু। এভাবে দিন চলে? এখন তোমার যা ইচ্ছে তুমি করতে পারো। আমার মা আর বোনকেও আমি বলে দেবো ঠিক হতে। যদি কারো পরিবর্তন না দেখি তাহলে আমি কিছু একটা করে ফেলবো। এত ঝামেলা আমার ভালো লাগে না। ”

সাওনের কথা শুনে নিশ্চুপ হয়ে যায় সেঁজুতি। সাওন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,“খেয়েছো সকালে?”

সেঁজুতি নিশ্চুপ।

সাওন বললো,“ বেশিই বলে ফেলেছি আমি। এসব মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলো। শুধু নিজের মনের বোঝা খালি করলাম। তোমার শুনতে ইচ্ছে না করলে, মোবাইল পাশে রেখে বসে থাকতে পারতা। শুধু শুধু আমার জন্য অসুস্থ হয়ে যেয়ো না। খেয়ে নিয়ো। বিরক্তও করবো না। ইচ্ছে হলে আমায় বিরক্ত করতে পারো, যদিও ‘বিরক্ত’ নামক শব্দটির সাথে আমি তেমন পরিচিত নই। তবুও অনুমতি দিলাম। ”
কথাটি বলে একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে ফোনকল কেটে দিলো সাওন।

সেঁজুতি এখনও নিশ্চুপ হয়ে বসে আছে।

গায়ে টি-শার্ট জড়িয়ে ঘরের বাহিরে পা রাখলো সাওন। আনোয়ারা বেগম কয়েকবার খাওয়ার জন্য পিছু ডাকলো। সাওন রাগান্বিত স্বরে বলল,“ সবসময় পিছু ডাকো কেন?”

সাওনের কথা শুনে চুপ হয়ে যায় আনোয়ারা বেগম। সাওন শান্ত ভাবে বললো,“ আর কিছু বলবা? আমি বের হচ্ছি। ”

আনোয়ারা বেগম ধীর কণ্ঠে বলল,“ গত পরশু থেকে উপোস আছিস। খেয়ে যা কিছু। না হলে অসুস্থ হয়ে যাবি। ”

সাওন শান্ত ভাবে বলল,“ আমার চিন্তা করতে হবে না। এমনিতেও কেউ কখনো আমার জন্য চিন্তা করোনি, তাই আজকে এই সামান্য ব্যপার নিয়েও চিন্তা করে অসুখে ভুগতে হবে না। ”

সাওনের কথা শুনে আনোয়ারা বেগম বললেন,“ এমন কথা বলো কেন?”

সাওন কিছু না বলে বাহিরে চলে গেল। আনোয়ারা বেগম সেখানেই দাঁড়িয়ে আছেন। সাওনের বড় বোন আশিকের জন্য খাবার তৈরি করে নিয়ে গেল। মেজো বোন এসে আনোয়ারা বেগম-কে জিজ্ঞেস করলো, কী হয়েছে? জবাবে আনোয়ারা বেগম সাওনের কথাগুলো বললেন।
মেজো বোন বললো, “ আগে থেকেই তো তোমার ছেলে রগচটা ছিল, এখন বিয়ের পরের অবস্থা তো চোখেই দেখো। ”

আনোয়ারা বেগম কিছু বললো না।

.
.

সেঁজুতি খাটে স্থির হয়ে বসে আছে। সেঁজুতির ভাবি খাবার নিয়ে আসলো, সাথে সেঁজুতির ভাইও এসেছে। সেঁজুতির ভাই শান্ত ভাবে বললো, “ পায়ের ব্যথা কমছে?”

জবাবে সেঁজুতি বললো, “ হুম।”

সেঁজুতির ভাই বললো, “ কিছু লাগবে? বাহিরে যাচ্ছি আমি। ”

সেঁজুতি ধীর কণ্ঠে বললো, “ কিছু লাগবে না। ”

সেঁজুতির ভাই ‘আচ্ছা’ বলে চলে গেল। সেঁজুতির ভাবি খাবার সামনে রাখলো। সেঁজুতি বললো, সে খাবে না এখন। সেঁজুতির ভাবি চোখ রাঙালে নিম্নস্বরে সেঁজুতি বললো, “ একটা কথা বলবো ভাবি?”

সেঁজুতির ভাবি বললো, “ হ্যাঁ। ”

কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে সেঁজুতি বললো, “ কেউ যদি কোনো কাজের জন্য সবাইকে বারণ করে এবং সবাই যদি সে মানুষটির কথা না শুনে ; তাহলে কিছু একটা করে ফেলা মানে কী?”

সেঁজুতির কথা ভালো ভাবে বুঝতে পারলো না ওর ভাবি। কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে বললো, “ কিছু একটা করে ফেলা মানে! কে বলেছে? এসব ভূত মাথা থেকে ঝেড়ে ফেল। ”

সেঁজুতি কাঁপা কণ্ঠে বললো, “ এর অর্থ বলবে তো। ”

সেঁজুতির ভাবি বললো, “ কে বলেছে?”

সেঁজুতি চোখের টলমল পানি নিয়ে বললো, “সাওন। তার কথা কেউ না শুনলে না-কি, কিছু করে ফেলবে। ঝামেলা ভালো লাগে না তাঁর। ”

সেঁজুতি ভাবি চিন্তিত হয়ে বললো, “কথা হয়েছিল?”

সেঁজুতি মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ সম্মতি দেয়। সেঁজুতির ভাবি বললো, “ ওরে কল দে তো। ”

ভাবির কথা শুনে সাওনকে কল দিয়ে, মোবাইল ভাবির সামনে বাড়িয়ে দিলো সেঁজুতি। সাওন রিসিভ করছে না৷ একেরপর এক ফোনকল দিয়ে যাচ্ছে তবুও সাওনের হদিস নেই কোনো।
এবারে চিন্তিত হয়ে যায় দুজনেই।

.
.

আশিক সারা ঘরে সেঁজুতিকে খুঁজছে। ওর মা ধমক দিয়ে বলল,“এখন কি সম্পূর্ণ পুড়তে চাও?”

মায়ের ধমক শুনে আশিক কাঁদোকাঁদো স্বরে বলল,“ মামী যাবো। ”

আনোয়ারা বেগম আশিককে আঁচলের কাছে নিয়ে বললো,“ যেতে হবে না। তোমার মামী নাই নানা ভাই।”

আনোয়ারা বেগমের কথা শুনে ঠোঁট বাঁকিয়ে কেঁদে দেয় আশিক। আশিকের বাবা ছেলেকে ডেকে তার কাছে নিয়ে গেল। শান্ত ভাবে ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,“ রান্নাঘরে গিয়েছিলে কেন?”

আশিক ওর বাবার দিকে তাকিয়ে বললো,“মামীর কাছে। ”

আশিকের বাবা বললো,“ তারপর? আব্বু, ব্যথা পেয়েছিলে কীভাবে?”

আশিক মাথা নিচু করে বলল,“ মামীকে দৌঁড়ে ধরি তখন পাতিল থেকে ভাত আর পানি পরে।”

আশিকের কথায় জোরে নিঃশ্বাস ফেলে ওর বাবা। আশিকের মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে,“ ছেলেকে ছেড়ে দাও আর কোনো খোঁজ নাও না, তাইতো? ছেলে রান্নাঘরে গিয়েছে, তার খবরও তুমি জানো না। ও যদি ঘর থেকে বাহিরে বের হয়ে যেতো? তখন কী করতা? এখন তো ছেলেকে চোখের সামনে দেখো, আর অন্য মেয়েকে বকাবকি করো। তখন তো তাও করতে পারতা না। তোমার এমন আলসেমির বাজে স্বভাব জীবনেও যাবে না। শান্ত মাথায় থাকতে দেবা না, তাই তো? কিছু বলি না তাই পুরোপুরি বাজে স্বভাবের হয়ে গেছো। এমন চললে স্বামীর বাড়ি গেছো কেন? বাপের বাড়িতে থাকবা আর অন্যের সংসার ভাঙবা। ”

আশিকের বাবা কথা গুলো বাড়ি ভরা মানুষের সামনে স্পষ্ট ভাবে বলে দিলো। আশিকের মা তেড়ে উঠলে আশিকের বাবা গায়ে হাত তুলেন।
সাওনের মেজো দুলাভাইও এ বাড়িতে আছে। তার পরিবারের গুটিকয়েক মানুষও আছে। আনোয়ারা বেগম লজ্জায় মাটির নিচে যাওয়ার প্রার্থনা করলো।

আশিকের বাবাকে সবাই থামালেও তিনি মুখ দিয়ে কথা বলেই যাচ্ছেন।
খুব শান্ত স্বভাবের মানুষ যখন রেগে যায় তখন তাকে সামলানো ভীষণ কষ্টকর হয়ে যায়। আশিকের বাবা রেগে রেগে বললেন,“ তোর জন্য আমার পরিবারে কেউ শান্তি পায় না, আমার আত্নীয়-স্বজন আসতে পারে না। কিছু বলি না তাই মাথায় উঠে গেছো, তাইতো? সবকিছুতে চুপ থাকলেও আমার ছেলের ক্ষতির কারণ হলে ছেড়ে কথা বলবো? আমার ছেলে নাই পরাণে বেঁচে আছে। না পারো ছেলেকে ঠিকমতো বই পড়াতে, না পারো ওর দিকে কড়া নজর দিতে। সারাদিন আর কীই-বা করো? ”

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here