সেঁজুতি পর্ব_১৫

0
1986

#সেঁজুতি(পর্ব_১৫)
#লেখা_সুমাইয়া_আক্তার_মনি

আশিকের বাবাকে সবাই থামালেও তিনি মুখ দিয়ে কথা বলেই যাচ্ছেন।
খুব শান্ত স্বভাবের মানুষ যখন রেগে যায় তখন তাকে সামলানো ভীষণ কষ্টকর হয়ে যায়। আশিকের বাবা রেগে রেগে বললেন,“ তোর জন্য আমার পরিবারে কেউ শান্তি পায় না, আমার আত্নীয়-স্বজন আসতে পারে না। কিছু বলি না তাই মাথায় উঠে গেছো, তাইতো? সবকিছুতে চুপ থাকলেও আমার ছেলের ক্ষতির কারণ হলে ছেড়ে কথা বলবো? আমার ছেলে নাই পরাণে বেঁচে আছে। না পারো ছেলেকে ঠিকমতো বই পড়াতে, না পারো ওর দিকে কড়া নজর দিতে। সারাদিন আর কীই-বা করো? ”

.
.

আশিকের বাবার কথা শুনে চুপ হয়ে যায় সবাই। সাওনের মেজো দুলাভাই থামাচ্ছে, শান্ত মাথায়। আশিকের বাবা আর কোনো কথা না বলে চুপচাপ গিয়ে সোফায় বসে রইলেন। আশিকও ওর বাবার কোলে গিয়ে বসে আছে। বড় আপু অপমানে কান্না করে দিলেন।
আনোয়ারা বেগম লজ্জায় মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। এখানে মেজো মেয়ের বিয়ের বয়স বছরও হয়নি। সাওনের বিয়ের তিন মাস আগে বিয়ে হয়, বলতে গেলে মেজো জামাই ঘরে এই প্রথমেই এমন কাণ্ড দেখলো। সাথে বড় ভাই, ভাবি আর ওর মাও রয়েছেন। বড় মেয়ের শাশুড়ি আর ছোট দেবর আছে। শ্বশুর বাড়িতে আর যাই হোক কখনো সবার সামনে বকাবকিও করেনি। অথচ আজকে দুই পরিবারের মানুষের সামনে গায়ে হাত তুলেছে।
সবাই ঠাণ্ডা মাথায় বুঝিয়ে সবকিছু শান্ত করলো।

.
.
রুমে যাওয়ার পরে মেজো বোনকে তার স্বামী জিজ্ঞেস করলো, “বড় আপুর সংসারে ঝামেলা হয়?”

জবাবে মেজো আপু বললো,“ একটু-আধটু। ভাইয়ার বোনেরা এসে এটা-ওটা করার হুকুম দেয়। এসব পরের বাড়ির মেয়েরা সহ্য করবে?”

মেজো দুলাভাই ব্যঙ্গাত্মক ভাবে বললো,“ করতে বাধ্য। ভাইয়ের ভাত খায়, বাপের ভিটেমাটিতে থাকে তাহলে তাদের কথা শুনতেই হয়। এমনই তো হয়ে আসছে বহুকাল ধরে। তবে আপুর সাথে এটা মানা যায় না।”
মেজো দুলাভাই কথাও শুনিয়ে দিলো এবং শেষে বউয়ের সাথে ঝগড়া যেন না বাঁধে ; তার জন্য বাক্য ঘুরিয়ে নিলেন। মেজো আপু চালাক থাকায় কথার ইঙ্গিত বুঝতে পারলো। মেজো দুলাভাই আর কিছু না বলে চুপচাপ গিয়ে খাটে বসে মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পরলো। আঁড়চোখে বউয়ের কাণ্ডকারখানা দেখছে।

.
.

সেঁজুতি ও ওর ভাবি চিন্তিত হয়ে বসে রইলেন। সাওনের খোঁজ নেই কোনো। কতবার ফোনকল দিয়েছেন, তবুও ওর হদিস নেই। রিসিভও করছে না আবার কেটেও দিচ্ছে না। এবারে সেঁজুতি শব্দ করে কেঁদে দিলো। সেঁজুতির ভাবি দিশেহারা হয়ে সেঁজুতির ভাইকে ফোনকল দিলো।
এক নিঃশ্বাসে তিনি বলে যাচ্ছেন, সাওনের ফোনে কল দিতে। কতক্ষণ ধরে ফোনকল দিচ্ছে কিন্তু ওর কোনো খোঁজ নেই।

সেঁজুতির ভাই বিরক্ত হয়ে বললো,“ ওর চিন্তা করছো কেন? ও আমার বোনের চিন্তা করে, একবারো? নিশ্চয়ই মা-বোনের সাথে হাসিখুশি আছে, আমার বোনকে কাঁদিয়ে। ”

সেঁজুতির ভাবি ধীর কণ্ঠে সবকিছু বললো। সেঁজুতির ভাই কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পরলেন। শান্ত মাথায় বলল,“ আচ্ছা, দেখছি আমি। ”

সেঁজুতির ভাবি বললো,“ এখানে ফোনকল দিতে বইলো। ”

সেঁজুতির ভাই আর কিছু না বলে কল কেটে, সাওনের ফোন নাম্বারে ডায়াল করছে। দুই বার ডায়ালের পরে ফোনকল কেটে ব্যাক করলো সাওন।
অপরপাশ থেকে বললো,“ আসসালামু আলাইকুম। কেমন আছেন ভাইয়া?”

সেঁজুতি ভাই ধীর কণ্ঠে বললো,“ ওয়ালাইকুম আসসালাম। এই তো আলহামদুলিল্লাহ আল্লাহ এখনো বাঁচিয়ে রেখেছে। তুমি কেমন আছো?”

সাওন শান্ত ভাবে বললো,“ আমিও। বাসার সবাই ভালো আছে?”

সেঁজুতির ভাই বললো,“ হ্যাঁ। ”

সাওন একটা ছোট নিঃশ্বাস ফেলে বলল,“ কিছু বলবেন?”

সেঁজুতির ভাই কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,“ পাগলামি করবা না কোনো। আবোলতাবোল কথা বা চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দাও।”

সাওন কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে বললো,“ ভাইয়া কিছুই বুঝতে পারলাম না। পাগলামি কেন করবো?”

সেঁজুতির ভাই শান্ত ভাবে বললো,“ সেঁজুতিকে কী বলেছো? কিছু একটা করে ফেলবে, মানে কী? খবরদার! আবোলতাবোল কথা যেন মাথায় না থাকে। ”

সাওন হেসে বললো,“ এই কথাটিকে সিরিয়াস নিচ্ছেন কেন, ভাইয়া? এমন আহাম্মক আমি নই, পরকালের চিন্তা আছে মাথায়। এমনিতেই পৃথিবীতে থেকে একেরপর এক পাপ করেই যাচ্ছি, সেগুলোর ভারেই থাকতে পারছি না পৃথিবীতে। আর এমন কিছু করলে পরকালে কীভাবে থাকবো! জাহান্নামেও জায়গা হবে না। ”

সেঁজুতির ভাই কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,“ সেঁজুতির কাছে ফোন দাও। এর আগে কী হয়েছে বা না হয়েছে মনে রাখছি না। একবারের জন্যই মাফ করে দিলাম, এরপরে কিন্তু আমার থেকে কেউ খারাপ হবে না। ভেবো না, আমি দয়ার সাগর। মেয়েদের বিয়ে তো একজনের কাছ থেকে এনে অন্যজনের কাছে দেওয়া যায় না। সে সংসার যদি এর থেকেও ভয়াবহ হয়? তাই বর্তমানকেই শুধরে নিতে হবে। ”

সাওন নিশ্চুপ হয়ে আছে। সেঁজুতির ভাই বললো,“ কোথায় আছো এখন?”

সাওন ধীর কণ্ঠে বললো,“ শিয়া মসজিদ রোড। ”

সেঁজুতির ভাই বললো,“ দ্যা ক্যাফে রিও -এর এদিকে আসতে পারো?”

সাওন কিছুক্ষণ চুপ থেকে সম্মতি দিলো। সেঁজুতির ভাই ‘দ্যা ক্যাফে রিও’ এর কাছে অপেক্ষা করছেন সাওনের জন্য।

.
.

সাওন গাড়িতে উঠে সেঁজুতিকে ফোনকল দিলো। সেঁজুতি রিসিভ করে কথা বলছে না। সাওন বারবার ওর নাম ধরে ডেকে যাচ্ছে। সেঁজুতির ভাবি ছোট একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস নিয়ে রুমে থেকে বেরিয়ে আসলেন। সেঁজুতিকে কথা বলতে না দেখে সাওন শান্ত ভাবে বললো,“ রাখছি তাহলে।”

সেঁজুতি কিছু না বলে ফোনকল কেটে দিল। সাওন মৃদ্যু হাসছে।

.

সেঁজুতির ভাইয়ের কাছে যাওয়ার পরে সে কিছুক্ষণ সাওনের দিকে তাকিয়ে রইলো। ওর ভদ্র, মায়া মায়া মুখ দেখে তার নিজেরই মায়া হচ্ছে। শরীরে যে দুর্বলতা আছে চোখমুখ দেখে স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে ; রাতে ঘুম না হওয়ার কারণেও মুখ ভার ভার হয়ে আছে। সেঁজুতির ভাইকে দেখে সালাম দিয়ে পাশে দাঁড়াল সাওন। সে কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,“ চোখমুখের এমন অবস্থা কেন? ”

সাওন জবাবে কিছু না বলে চুপ রইলো। সেঁজুতির ভাই শান্ত ভাবে বললো,“ ক্যাফেতে চলো।”

ক্যাফেতে গিয়ে সেঁজুতির ভাই বললো,“ ভাইরে! একটা কথা বলি মন দিয়ে শুনবা। আর পারলে সেভাবেই কাজ করবা। তোমার ভালোর জন্যই বলছি, না হলে কিন্তু খারাপ কিছুও ঘটতে পারে। আমিই ঘটাতে পারি, আমার নিজের উপরে নিজেরই বিশ্বাস নাই। ”

সেঁজুতির ভাইয়ের কথা শুনে কিছুক্ষণের জন্য চুপ হয়ে গেল সাওন। সেঁজুতির ভাই সাওনের মুখের অবস্থা দেখে হেসে দিল। তবুও শক্ত গলায় তিনি বললেন,“ একটা সংসার ঠিক রাখতে কমবেশি সবার ভূমিকা থাকে, মানো কথাটি?”

সেঁজুতির ভাইয়ের কথা শুনে মাথা নাড়ালো সাওন। সেঁজুতির ভাই বললো,“ আমার পরিবার দেখছো? তোমার ভাবি আর সেঁজুতির সম্পর্ক দেখেছো? সেঁজুতির কিছু হলে তোমার ভাবি আগে লাফিয়ে পরে। তাহলে ভাবো, তোমার বোনদের ভালো কথা শুনলেও আমার বোনের এমন টান নেই কেন? তার নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে?”

সেঁজুতির ভাইয়ের কথায় চুপচাপ রইলো সাওন। তিনি বললেন,“ আমি দুজনকেই সেভাবে রাখছি যেভাবে রাখলে একে অপরের সম্পর্কের ক্ষতি হবে না বরং মজবুত হবে। যেদিন তিন কবুল বললাম সেদিন থেকেই তোমার ভাবিকে প্রথমেই বলেছি; আমার বাড়িতে কোনো রাজনীতি চলে না। না আমার পরিবারের কেউ করবে, না অন্যকেউ করবে। এমন কিছু যদি কখনো দেখেছি একজনের জন্য অন্যজন কষ্ট পায়, তাহলে তার হিসেব কিন্তু নিতে পারবো। যখন রাজনীতিই চলবে, তখন বিচারক হতে পারবো না কেন?
কথাগুলো তোমার ভাবিকে বুঝিয়েছি। আমার পরিবারের সবাইকে একসাথে রেখে বলেছি, “ যে আসবে এ বাড়িতে, তার দোষ থাকুক গুণ থাকুক মুখ দিয়ে তোমাদের কিছু বলতে হবে না। আমার বউ আমি দেখবো। যদি সে কোনো ভুল করেই থাকে আমি বুঝাবো। তোমরা বুঝালে সে বুঝবে না। তখন ভাববে, তার নিজের দোষ নেই। শ্বশুর বাড়ির মানুষ এমনিতেই পায়ে পায়ে দোষ ধরে। এই কথাটিই ভাবতে দেওয়ার সুযোগ করে দেবো কেন, তাকে? পরিবারের দায়ভার আমার উপরে না?সবকিছু যেহেতু আমার দেখতে হবে, তখন সবার দোষ-গুণ আমিই দেখবো। ”

সেঁজুতির ভাই একটানা কথাগুলো বলে নিঃশ্বাস নিলেন। সাওন চুপচাপ বসে আছে। সেঁজুতির ভাই বললো,“ একটা সংসার ঠিক রাখতে মা, বোন, বউ এমনকি জীবিকা নির্বাহ যে করেন তার নিজেরও ভূমিকা থাকে। তার জন্যই অন্যসবাই খেয়ে দেয়ে ভালো থাকে, তাহলে তার কথা শুনবে না কেন? শুনাতে বাধ্য করা যায় না? সে হোক আমার বোন, অথবা তোমার বোন। আমার বোনকে ভালো বলছি না, ওর যথেষ্ট দোষ আছে। ওকে কেউ কথা শুনালে ও দ্বিগুণ শুনিয়ে বসিয়ে রাখে। যদিও আমাদের বাড়িতে প্রতিবেশী অথবা যাদেরকে আমি নিজেই কথা শুনাই তাদের সাথেই এমন করতো। আমি জানি তো আমার বোনকে। কেউ আঘাত দিয়ে কথা, না বললে ও কিছু বলবে না। তবুও মাঝেমধ্যে বাড়ির বউদের চুপ থাকতে হয়, যদি সে চুপ না থাকে তাহলে তুমি কীসের জন্য আছো? তুমি দায়িত্ব নিয়েছো না? তুমিই ঠিক করতে পারো না? ”

#চলবে

(ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। লেখার পরে পড়িনি আর।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here