সেঁজুতি পর্ব_১৬

0
1820

#সেঁজুতি(পর্ব_১৬)
#লেখা_সুমাইয়া_আক্তার_মনি

সেঁজুতির ভাই একটানা কথাগুলো বলে নিঃশ্বাস নিলেন। সাওন চুপচাপ বসে আছে। সেঁজুতির ভাই বললো,“ একটা সংসার ঠিক রাখতে মা, বোন, বউ এমনকি জীবিকা নির্বাহ যে করেন তার নিজেরও ভূমিকা থাকে। তার জন্যই অন্যসবাই খেয়ে দেয়ে ভালো থাকে, তাহলে তার কথা শুনবে না কেন? শুনাতে বাধ্য করা যায় না? সে হোক আমার বোন, অথবা তোমার বোন। আমার বোনকে ভালো বলছি না, ওর যথেষ্ট দোষ আছে। ওকে কেউ কথা শুনালে ও দ্বিগুণ শুনিয়ে বসিয়ে রাখে। যদিও আমাদের বাড়িতে প্রতিবেশী অথবা যাদেরকে আমি নিজেই কথা শুনাই তাদের সাথেই এমন করতো। আমি জানি তো আমার বোনকে। কেউ আঘাত দিয়ে কথা, না বললে ও কিছু বলবে না। তবুও মাঝেমধ্যে বাড়ির বউদের চুপ থাকতে হয়, যদি সে চুপ না থাকে তাহলে তুমি কীসের জন্য আছো? তুমি দায়িত্ব নিয়েছো না? তুমিই ঠিক করতে পারো না? ”

.
.

সেঁজুতির ভাইয়ের কথা শুনে নিশ্চুপ হয়ে বসে থাকে সাওন। সেঁজুতির ভাইয়ের থামার নাম নেই আজ। সে বলতেই থাকে। কয়েকটি ঘন নিঃশ্বাস ফেলে বললো,“ শোনো সাওন। তোমাকে ছোট ভাইয়ের মতো ভাবী। তাছাড়াও আমার বোনের জন্য হলেও তোমার চিন্তা করতে হয়। আমি অন্যকিছু বলবো না, সেটা তোমার ব্যক্তিগত ব্যপার। আশা করি, তুমি ঠিক করবে সবকিছু। কীসে ভালো, কীসে মন্দ! জানার কথা। এমন নয় তুমি অবুঝ। সবকিছুই বুঝো, সত্য-মিথ্যাও বুঝো৷ না বুঝলেও এখন থেকে বুঝতে হবে। যদি আমার বোনের সাথে সংসার করতে চাও তাহলে বুঝতে হবে, কেউ অকারণে আমার বোনের দোষ বলে বেড়াবে সেটা আমি মানবো না। না আমার বোন সহ্য করবে। আর যদি আগেরমতোই থাকতে চাও তাহলে সব সম্পর্কের ইতি টানতে হবে। আমার বোন তোমার সংসারে যাবে না। তাছাড়াও বিয়ের পরে যে, মেয়েরা বাবার বাড়িতে থাকবে সেটাও হতে দেবো না। ওর জীবন গুছিয়ে দেবো। হয়তো সময় লাগবে তবুও সম্পূর্ণ গুছিয়ে দেবো। নিশ্চয়ই কোনো রাজনীতিবিদ সংসারে দেবো না। আমার নিজের বোনও নেত্রী আবার যদি বিয়েও দেই রাজনীতিবিদ ঘরে; তাহলে বিরোধীদলের সাথে সাংঘাতিক সংঘর্ষ লেগে যাবে। যার জন্য আবারও ঝামেলা শুরু হবে। তাই ভাই হয়ে অথবা সেঁজুতির পরিবারে কোনো সদস্যও এমন ভুল করবে না। ”
এবারেও একাধারে কথাগুলো বলে তিনি একটা দীর্ঘশ্বাস নিলেন।
সাওন নিশ্চুপ হয়ে সবকিছু শুনছিলো।

সেঁজুতির ভাই বললো,“ জানো তো ভাই! একটা সংসারে পুরুষ, মহিলা উভয়েরই সমান ভূমিকা থাকে। একজন পুরুষ দিনের পর দিন খাটুনি করে, জীবিকা নির্বাহের সমস্ত চিন্তা মাথায় নিয়ে সে অন্যের কাজ করে টাকা উপার্জন করে। ক’জনেরই বা নিজস্ব অফিস-আদালত আছে? এবং একজন মহিলা দিনের পর দিন সংসারের কাজগুলো মাথায় বয়ে বেড়ায়। যদিও হাতে গোনা কয়েকজন এসবের ধারেকাছেও ঘেঁষে না ; এবং ছেলেমেয়ের উভয়ের মধ্যেই এই কয়েকজন থাকে। তারা কাজ করবে না অথচ অন্যের কাজে ফোড়ন কাটবে। এটাকে যদি আমরা সমর্থন করি তাহলে কর্মক্ষম ব্যক্তিটি কি পরবর্তী কাজগুলো গুছিয়ে করবে? সেও উল্টাপাল্টা কথা বলবে, জবাব দিবে এবং এসব নিয়ে একেরপর এক ঝামেলা বেঁধেই থাকবে সংসারে। তাহলে সেই টিম্পুনি কাটা ছেলে অথবা মেয়েদের আগে শাসন করা উচিত, না? না হলে তাদের জন্যই সংসারে ঝামেলা হবে। সঠিকভাবে দোষ গুণ বিচার করা যাবে না তখন। কারণ এসব শ্রেণির মানুষ ভয়ংকর বেশি হয়। তারা এমনভাবে সব মিথ্যাগুলোকেও সাজিয়ে রাখবে, যার কারণে বিচারক নিজেই সবকিছু গুলিয়ে ফেলবে ;তখন সত্য -কে মিথা এবং মিথ্যা -কে সত্য মনে করবে। এবং এমন সত্য-মিথ্যাগুলো একদিনেই শেষ হবে না, বিচার না পেলে এগুলো ক্রমান্বয়ে চলতেই থাকবে। যার প্রভাব এসে সংসারে পরবে। আশা করি, আমার কথাগুলোর সত্যতা পেয়েছো! ”

সেঁজুতির ভাই থেমে গিয়ে বললো,“ আমার কথাগুলো হয়তো শুনতে খারাপ লাগছিল এবং আমি একপাক্ষিক বিচার করিনি। যা সত্য তাই বলেছি। না আমার বোনকে বড় করেছি, না তোমার পরিবারের কাউকে ছোট করেছি। যা সত্য আমি তাই বলেছি মাত্র, আমার বোনের কোনো দোষ থাকলে তুমি ঠিক করবা। অবশ্যই আমার বোন কথা শুনবে, ও শুনতে বাধ্য। যদি তখন কোনো তর্ক অথবা বিপক্ষে কিছু করে বা বলে তখন আমায় জানাবা। কিন্তু খবরদার! তোমার পরিবারের কেউ যেন অকারণে তিক্ত কথা দিয়ে অযথা ঝামেলার সৃষ্টি না করে। তখন কিন্তু এর দায়ভার তোমার বহন করতে হবে। আমি ভালোতে ভালো, খারাপের খারাপ। একজন বোনের ভাই অনেককিছু করতে পারে, এটা মনে রাখবা। যেমন তোমার বোনদের জন্য তোমার মায়া তেমনই আমার বোনের জন্য আমার দ্বিগুণ মায়া, ভালোবাসা। তোমার দুই বোন, আমার একমাত্র বোন এবং সে ছোট। যার মান অভিমানের কারণগুলো আগে আমি জানতে পারি, তাহলে অকারণে কেউ আমার কলিজার বোনকে কষ্ট দিবে আর আমি চুপ থাকবো! আমি আবারও বলছি, তুমি তোমার বোনদের পক্ষে থাকবে। ভালোবাসবে, তাদের দুঃখে ছায়া হয়ে থাকবে। কিন্তুউউ কোনোওওও ভুলল কাজের পক্ষপাতিত্ব করবে না।
(শেষের কথাটি তিনি টানিয়ে বললেন।)
কিছুদিন আগে বিচার বসেছিল ঘরে, তাইতো? ভাগ্য ভালো ছিল তখন আমি ঢাকাতে ছিলাম না, না কেউ আমাকে কিছু বলেছে৷ যদি শুনতাম অথবা জানতাম তাহলে সেদিন রাজশাহী থেকেই ঢাকায় চলে আসতাম। ঘরোয়া ঝামেলা হবে তারপরে পরিবারের সব মানুষজন একসাথে থেকে বিচার করবে! এটাতে মানইজ্জতের ব্যপার জড়িয়ে আছে। বিশেষ করে আমার বোনের সম্মান জড়িয়ে আছে। কিছু কিছু জানার পরে যখন বোনকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘সাওন কিছু বলেনি?’ জবাবে কি বলেছে, জানো?

“সাওন বাহিরে খাটুনি করে তাকে ঘরোয়া ব্যপারে জড়াতে পারবো না। রাস্তাঘাটের যে অবস্থা, তখন যদি ঘরের চিন্তায় রাস্তায় পরে থাকে তখন! সবাই একদিন ঠিকই বুঝবে, কিন্তু যে মানুষটিকে ক্ষতির দিকে ফেলে দেবো সে যদি ঠিক না থাকে!” এসব বলে আমার বোন কেঁদে দেয়। ওকে সহজে কাঁদতে দেখেছো তুমি? ভাই হয়ে এসব বলতে মুখে বাঁধে তবুও পরিস্থিতির জন্য বলতে হলো। ওর কণ্ঠের আওয়াজ শুনেই সবকিছু বুঝতে পারি, কী চলে ওর মনে। ও বাস্তবে অতিমাত্রায় আঘাত না পেলে কাঁদে না, আর জল্পনাকল্পনার জন্য কাঁদবে! হাহ! নিশ্চয়ই কল্পনাগুলো ভয়ংকর ছিল, তাই তোমার ওই কথাগুলো বলার পরেই কেঁদে দেয়। তারপর থেকে আমি বোনকে কিছু জিজ্ঞেস করতাম না। কারণ ওর মনের অবস্থা বুঝি, কী হবে বা হতে চলেছে এসব বুঝি যা ভাই হয়ে মানসম্মত নয়। প্রয়োজনে তোমার ভাবিকে দিয়ে কথা বলাই, আমি শুধুই বোন কেমন আছে? কী করে? খেয়েছে কি-না এগুলো পর্যন্তই সমাপ্ত করি।
সত্যি বলতে কি! একটা সুন্দর পরিবারের জন্য ছেলে কিংবা মেয়ে উভয়ের সমান অধিকার আছে। মেয়েরা সংসার সামলায়, ছেলেরা টাকা রোজগার করে। এতটুকুতেই কি সবকিছুর দায়িত্ব শেষ? না দায়িত্ব শেষ হয় না। অনেক দায়িত্ব থাকে। মেয়েদের দায়িত্ব হল, যে মানুষটি দিনের পর দিন বাহিরে খাটুনি করে মুখের খাবার জোগায় তার মন-মানসিকতার খেয়াল রাখা, যত্ন করা। এবং একজন ছেলের দায়িত্ব হল তার মন- মানসিকতার যত্ন যারা নেয় বা যাদের দায়িত্ব তাদের সমস্ত কাজকর্মেও খেয়াল রাখা। না হলে ভালো খারাপের বিষয়গুলো উন্মোচিত হবে কীভাবে? সবকিছুর যেমন ভুল আছে, তেমনই সবকিছুর সমাধানও রয়েছে। আশা করি, আর কিছু বুঝাতে হবে না। যা বুঝানোর আজকেই বুঝিয়েছি, এরপরে জল কতদূর গড়াতে পারে দেখে নেবো। এখন বাকিটা তোমার ইচ্ছে, কী করবে বা আগে করেছো সেগুলো মাথায় রাখবে না-কি ফেলে দিবে সেসব সম্পূর্ণ তোমার ব্যপার। সবকিছুর সমাধান না করা অবধি আমার বোন তোমার সংসারে পা রাখছে না। ”

সেঁজুতির ভাইয়ের কথাগুলো চুপচাপ শুনছিল সাওন। মুখের অবস্থা ভীষণ করুণ। এমনিতেও না খাওয়ার জন্য শরীরও অনেকটা দুর্বল হয়ে আছে।

সেঁজুতির ভাই মুখে মৃদ্যু হাসির রেখা টেনে বললো,“চোখমুখ দেখে তো বুঝা যাচ্ছে, বনবাসে ছিলা তুমি। খাওয়া-দাওয়া কিছুই হয়নি। এখন কী খাবে বলো?”

সাওন ধীর কণ্ঠে বললো,“ কিছু না। ”

সেঁজুতির ভাই বললো, “ আমার কথায় আক্ষেপ, ভালোবাসা, দায়িত্ব সবকিছুই ছিলো। মন খারাপের কিছু নেই। ”

সেঁজুতির ভাইয়ের কথা শুনে হেসে দেয় সাওন। খাওয়া-দাওয়ার পরে বিল পে করে সাওন। সেঁজুতির ভাই বাঁধা দিলেও সাওন শুনেনি।
বাহিরে বের হওয়ার পরে শান্ত ভাবে সেঁজুতির ভাই বললো,“ আমাদের বাসায় চলো। ”

সাওন কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,“ সবকিছু এলোমেলো আছে, নিজেকে গুছিয়ে নেই তারপরে যাবো। ”

সাওন কথাটি বলেই মাথা নিচু করে ফেললো। সেঁজুতির ভাই মুখে মৃদ্যু হাসির রেখা টেনে সাওনকে জড়িয়ে ধরলো৷ শান্ত ভাবে বললো, “রাগ পতনের মূল। সবসময় মাথা ঠাণ্ডা করে পদক্ষেপ নিতে হয়। যদি তাতেও না হয়, নিজেকে সময় দিতে হয়। অনেকবেশি বেশি সময়, যতক্ষণ না পর্যন্ত রাগ গলে পানিতে পরিণত না হয়। গতকাল আমিও নিজেকে সময় দিয়েছি, নিজের পরিবার, বোনের কথা ভেবেছি। সবাই একেকটা অস্তিত্ব। তাহলে সে অস্তিত্বদেরও উচিত সবকিছুর যত্ন নেওয়া। শুধু শুধু ঝামেলা বাঁধিয়ে কী লাভ? একজন অবুঝ থাকতে পারে, হোক সে ছোট কিংবা বৃদ্ধ। অবুঝের প্রকারভেদে ছোট আর বৃদ্ধদেরকেই ধরা হয়। কিন্তু মাঝখানে যদি অন্যকেউ এসে অবুঝের ভান ধরে তাহলে তাকে বুঝাতে হয়, নিশ্চয়ই কঠোরভাবে বুঝাতে হবে। তবে অতিমাত্রায় কঠোর হওয়া চলবে না। বুঝেছো?”

সেঁজুতির ভাইয়ের কথায় মাথা নাড়ায় সাওন। সেঁজুতির ভাই মুখে হাসির রেখা টেনে বিদায় দিলো সাওনকে। বাসায় ফুচকা, চকলেট নিয়ে গেল সেঁজুতির জন্য। শ্বশুর বাড়িতে থেকে এসব চোখের সামনে দেখেছে কি-না সন্দেহ সেঁজুতির ভাইয়ের। সবাই তো ওর মতো না, ক’জনেই বা বাড়ির বউদের খেয়াল রাখে! হয়তো সাওন রাখে তবে মাঝে মাঝে পরিস্থিতির চাপে পরে সবকিছু গুটিয়ে নিতে হয়।
এসব ভেবে একটা দীর্ঘশ্বাস নিলো সেঁজুতির ভাই।

.
.

সেঁজুতি চোখমুখে মেঘের রাজ্য নামিয়ে বসে আছে। কতক্ষণ ফোনকল দিচ্ছিলো তবুও রিসিভ করেনি সাওন। যখন কল ব্যাক করলো তখন অভিমান করে কল কেটে দিলো সেঁজুতি। অথচ একবারের জন্যও সাওন কল ব্যাক করলো না। বাজে লোক একজন! হাহ! কখনোই ভালো-মন্দের খেয়াল রাখেনি। সবসময় ধমক দিয়েছে আর মা-বোনের পক্ষপাতিত্ব করেছে। মনে হয়, সেঁজুতি নিজ থেকে হেঁটে হেঁটে সাওনদের বাড়িতে গিয়ে উঠেছিল। মাঝেমাঝে দয়া দেখাতে আসতো সাওন। সেঁজুতি না খেয়ে থাকতে পারে না, সেসবের খেয়াল রাখতো। পরম যত্নে সেঁজুতির মাথা সাওনের বুকে রেখে আহ্লাদীস্বরে বাবুই বাবুই বলে ডাকতো৷ তখন মনে হতো, কত ভালোবাসা যেন সাওনের মধ্যে লুকিয়ে আছে। যা বুঝাতে পারছে না অথবা বুঝাতে চাচ্ছে না সেঁজুতিকে। তাহলে অতিরিক্ত ভালোবাসায় ছন্নছাড়া হয়ে যাবে। এসব ভেবে ভেবে কপোলের পানি গড়িয়ে পরছে সেঁজুতির। হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে পানি মুছে চুপচাপ বসে আছে।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here