সেঁজুতি পর্ব_২১

0
1810

#সেঁজুতি(পর্ব_২১)
#লেখা_সুমাইয়া_আক্তার_মনি

সেঁজুতিকে দেখে হাসি-কান্না দুটোই পাচ্ছে সাওনের। এলোকেশী চুলে দরজার বিপরীত পাশে মুখ করে, খাটের সাথে হেলান দিয়ে বসে আছে।
সাওন দরজা চাপিয়ে সেঁজুতির পাশ ঘেঁষে বসলো।
কারো অস্তিত্ব পেয়ে পাশ ফিরে তাকালো সেঁজুতি, সাওনকে দেখে হকচকিয়ে যায় সে। সাওন গম্ভীর ভাবে তাকিয়ে আছে। সেঁজুতি মাথা নিচু করে ফেললো, চোখ দিয়ে কয়েক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পরলো। সাওন কিছু না বলে সেঁজুতির মাথার সাথে মাথা ঠেকালো৷ দুজনেই চুপচাপ।
সাওন বুঝতে পেরেছে, তার অভিমানিনী ভীষণ অভিমান করে আছে৷ একটা জোরে নিঃশ্বাস নিয়ে সাওন বললো,” অভিমান করা ভালো। তখন নতুনভাবে বউয়ের প্রেমে পরা যায় আর বউ নিজেও স্বামীর প্রেমে পরে। ”

সাওনের কথা শুনে ওর কাঁধে মাথা এলিয়ে দেয় সেঁজুতি। সাওন চুপচাপ হেসে দেয়। কিছুক্ষণ নীরবতার পরে সেঁজুতির পায়ের দিকে চোখ বুলালো সাওন। পায়ের অবস্থা আশিকের শরীরের মতো। সেদিন আশিকের চিকিৎসা সাথে সাথে হয়েছিল কিন্তু ওর পায়ের চিকিৎসা হতে বেশ দেরী হয়েছে। প্রায় পাঁচ-ছয় ঘন্টা পরে হয়তো প্রাথমিক চিকিৎসা পেয়েছে। সাওন পা ছুঁয়ে দেখলে, ধড়ফড়িয়ে পা সরিয়ে নেয় সেঁজুতি। সাওন চুপচাপ তাকিয়ে আছে। সেঁজুতি বলল,”হঠাৎ এসেছেন যে! আমাকে তো জানালেন না।”

সাওন ধীর ভাবে বললো,” আমি আসবো জানলে, যদি সদর দরজা লাগিয়ে রাখো রাগে-অভিমানে! তাই বলিনি।”
কথাটি বলে সাওন জোরপূর্বক হাসে।

সেঁজুতি গম্ভীরমুখে বলল,”হ্যাঁ। সত্যি দিতাম। মনে না থাকলেও আপনি যখন সময়মত মনে করিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব নিয়েছেন; তখন দিতেই হতো।”

সেঁজুতির কথা শুনে ভ্রু কুঁচকে তাকালো সাওন। সেঁজুতি কিছু না বলে উঠে যায়। বিছানা থেকে উঠে সাওনকে বলল,” যান হাত-মুখ ধুয়ে আসেন। ”

সাওন কিছুক্ষণ সেঁজুতির দিকে চিন্তিত হয়ে তাকিয়ে রইল। ধীর ভাবে বললো,” য না-কি জ?”

সাওনের কথার অর্থ বুঝতে পারলো না সেঁজুতি। কপাল কুঁচকে বললো,”এখন আদর্শলিপির বই পড়েন না-কি? ”

সাওন ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা টেনে বললো, “পড়তেও পারি, কারণ সব শব্দ স্পষ্ট বুঝি না। ”

সেঁজুতি বলল, “কী বুঝেন না?”

সাওন বাঁকা হেসে বললো, “এই যে একটু আগে বললা, সেটাই বুঝতে পারিনি। অন্তঃস্থ ‘য’ না-কি বর্গীয় ‘জ’? ”

সাওনের কথার ক্যালকুলেশন করে মুখ ঘুরিয়ে হেসে দেয় সেঁজুতি। সাওন ভাব নিয়ে বলল,” মাঝে মাঝে আপনি আপনি করে বললে দোষের কিছু নাই। তাহলে ‘যান’ থেকে ‘জান’ও হতে পারে। তুমি করে বললে তো এসব হতো না। তাতে আমার কী! দুটোর যেভাবে বলবা সেভাবেই আমার লাভ হয়। ”

সাওনের কথা শুনে মুখে মৃদু হাসির রেখা টেনে সেঁজুতি বললো,”হাত মুখ ধুয়ে আসো। ”

সাওন হাসি দিয়ে উঠে গেল।

সেঁজুতি চুল বেঁধে, বিছানা গুছালো।

সাওনের জন্য তোয়ালে রেখে নিজে রান্নাঘরের দিকে আসলো। ওর ভাবিকে সাহায্য করার জন্য।
রান্নাবান্না শেষের দিকে প্রায়।
সেঁজুতি ওর ভাবিকে বললো,”এত তাড়াতাড়ি সবকিছু গুছিয়ে ফেললে ভাবি? এত ভালো কেন, তুমি?”

ভাবি মৃদু হেসে বললো,” সবাই ভালোবাসে তাই। ”

সেঁজুতি হেসে বললো, “আমি ভালোবাসি না। আমি জ্বালাই সারাক্ষণ, এখনো জ্বালাবো। তোমার কাজে বাগড়া দেবো। কী কী করা লাগবে বলো।”

সেঁজুতির কথা শুনে হেসে দেয় ভাবি। হেসে বলল,”কিছু করতে হবে না। সাওনকে সময় দাও। সবকিছু গুছিয়ে ফেলেছি প্রায়।”

সেঁজুতি বলল,” উহু। এত তাড়াহুড়ো করে করছো! নিশ্চয়ই কিছু না কিছু বাকি আছে। আমাকে দাও, আমি করে দিচ্ছি। ”

ভাবি বললো, ” তোমার ভাইয়ের তো এগারোটার মধ্যে খাবার খেতে হয়। না হলে শরীর কাঁপুনি দেয়। তাছাড়া, সাওন আসছে বেশি রাত করে খাওয়ানো ঠিক হবে! সন্ধ্যে থেকেই তো সবকিছু গুছিয়েছি, মা সাহায্য করেছে তাই কষ্ট লাগেনি সময়ও লাগেনি। ”

ভাবির কথা শুনে, সেঁজুতি সেদিনের কথা মনে করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো।
সাওনের বোনেরা যেদিন এসেছিল, সেদিন কারো সাহায্যই পায়নি। উল্টো মুখ ফুটে বলেছিল আনোয়ারা বেগমকে কিন্তু সে যায়নি।

ভাবি বুঝতে পারলো কোনো কারণে সেঁজুতির মন খারাপ। তিনি বললেন,” শসা আর লেবু কেটে দাও। আর কোনো কাজ বাকি নেই। ”

সেঁজুতিও কেটে গুছিয়ে রাখলো। তারপরে ভাবির পাশে এসে বলল,” সাওন যে ক’দিন থাকবে, সে ক’দিন তো ভালো-মন্দ রান্না করতে হবে। তুমি শিখিয়ে দিয়ো আমি রান্না করবো। তাহলে হাতের রান্না যদি একটু ভালো হয়! ”

ভাবি বললো,” আচ্ছা।”

ভাবি আর সেঁজুতি একসাথে খাবার গুছিয়ে রাখলো। সবাই একসাথেই খেতে বসেছে। মানুষই বা ক’জন! একসাথে খাওয়া আর আলাদা খাওয়ার মধ্যে অনেক পার্থক্য রয়েছে।

আনোয়ারা বেগম কল দিয়েছেন, সাওন এখন কোথায় আছে ? খেয়েছে কি-না? এসব জানার জন্য।

সাওন শান্ত ভাবে বললো, “সেঁজুতির বাড়িতে এসেছি। আপনি খেয়েছেন, মা?”

জবাবে আনোয়ারা বেগম হ্যাঁ বলল।

সাওন বলল,”আসবেন কবে?”

আনোয়ারা বেগম বললেন,” তোর বোন কখন আসতে দেয় জানি না। কিন্তু আমি তিন-চার দিন পরেই আসবো। অন্যের বাড়িতে ভালো লাগে না। ”

সাওন বলল, “আচ্ছা, গাড়িতে উঠিয়ে দিতে বলবেন। তারপরে আমি নিয়ে আসবো। এখন ঘুমিয়ে পরেন।”

আনোয়ারা বেগমও হ্যাঁ সম্মতি দিল।

সাওনের পাশ ঘেঁষে বসে আছে সেঁজুতি। সাওন ইতস্তত বোধ করে বললো,” আমার সাথে কি যাবে বাসায়?”

সেঁজুতি মাথা নিচু করে বলল,” আমি রান্নাটা শিখে নেই ভালোভাবে? তারপরে যাবো।”

সাওন বলল, ” রান্না শিখবে কেন? যা আছে তাতেই চলে।”

সেঁজুতি বলল,” ভালো হচ্ছে না। ”

সাওন বলল, ” অপূর্ণতার মাঝেও কিছু পূর্ণতা থাকে। জানো কথাটি?”

সাওনের কথায় মাথা নাড়িয়ে ‘না’ বলে সেঁজুতি। সাওন বললো,” যখন খেতে বসি তখন উৎসুকভাবে তাকিয়ে থাকো আমার দিকে ; ভালো না-কি খারাপ হয়েছে এসব জানার জন্য। তখন খাবারের স্বাদ নয়, সেই দৃষ্টিকে ভালো লাগে। এটাই অপূর্ণতার মাঝে পূর্ণতা আমার। সবার রান্নার স্বাদ এক হয় না। বউ করে কোনো বাবুর্চি নেইনি, তাই অন্যের কথায় কান দিতে নেই। তোমার রান্না তোমার স্বামীর কাছে ভালো লাগলেই হল।”

সেঁজুতি অস্ফুটস্বরে বলল, “হু।”

সাওন আলতোভাবে সেঁজুতির মাথা নিজের কাঁধে এনে রাখলো। সেঁজুতিও বেশ চুপচাপ হয়ে আছে।

.

আজকের সব রান্না সেঁজুতি করেছে। সাহায্যকারী হিসেবে ভাবি পাশে ছিল।

সাওন আধশোয়া হয়ে মোবাইল ঘাটছে। সেঁজুতি পাশে এসে বসা মাত্রই মোবাইল রেখে দেয় সাওন। শান্তভাবে পলকহীনভাবে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। অতঃপর বলল, ভালোবাসার থেকে ভয়ংকর অসুখ হয়তো কিছু নেই পৃথিবীতে৷ এই অসুখে যে ভুগে সে বুঝে, প্রতিটি পদক্ষেপ কত কঠিন। নিজের জন্য না হলেও ভালোবাসার মানুষের জন্য সবকিছু করতে পারে। হোক সে অসুস্থ, তাতেও কিছু আসে যায় না। তবুও সে নিজের স্থানে নিজে অনড় থাকবে, শত বারণেও কথা শুনবে না। একদমই শুনবে না। এত ভয়ংকর কেন, এই অসুখ? সব অসুখ আমার সেঁজুতিতে বিরাজমান কেন?

সাওনের কথা শুনে চুপ হয়ে যায় সেঁজুতি। সাওন মৃদু হেসে আবারও সেঁজুতির মাথা নিজের বক্ষে রেখে বলল,” পা ব্যথা, নিজের অসুস্থ শরীর, এসব নিয়ে রান্না করাটা কী বেশ জরুরী ছিল? আমিতো বারণ করেছিলাম, যেমন আছে তেমনই ভালো লাগে আমার। তবুও রান্না করতে গেলে?”

সেঁজুতি ধীর ভাবে বললো,” আমায় সাহায্য করবে? ”

সাওন বলল, “হ্যাঁ। তোমার সাহায্য লাগবে কেন? ভালো-মন্দ সবকিছুর খেয়াল রাখবো আমি। আগে ভুল থাকলেও এখন ঠিক করবো। ”

সেঁজুতি বলল,” আমাকে গুছাতে সাহায্য করবা? ঝামেলা সহ্য করতে পারি না। সব ঝামেলার কারণ যদি আমি হই তাহলে সেটা ঠিক করার দায়িত্বও আমার। নিজেকে গোছাবো আমি। আমি জানি, কেউ আমার দিকে আঙুল তুললে প্রথম অপমান তোমারই হয়। সেসব হতে দেবো না আমি। নিজেকে গোছাতে কষ্ট হবে না বরং মানুষের সামান্যতম কথা শুনলেও কষ্ট হয়। এ কষ্ট লোক-সম্মুখে প্রকাশ করা যায় না। প্রিয়জনদের থেকে কষ্ট পাওয়ার আর্তনাদ যে ভয়াবহ কঠিন। তর্ক করলে মানুষ জিততে পারে না, এ ব্যপারে বারবার সতর্ক করেছে সবাই। কিন্তু একটা বিষয় হল, তর্ক করলে মানুষ জিতে না আবার কটুক্তি করে কথা বললেও ছাড় দিতে হয় না। তাহলে আরও বেশি কথা শুনতে হয়। কিন্তু শ্বশুর বাড়ির ক্ষেত্রে হয়তো আলাদা, স্বামী পাশে থাকলে সবকিছু করা যায়। আমিও তেমনই নিজেকে গোছাবো। কথা দিয়ে নয়, মন দিয়ে জিতবো। সবাই তখন ভাবির মতো ভালোবাসবে। আমি যে বড়ই কাঙাল।”

সেঁজুতির কথা শুনে অজান্তেই দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে সাওনের। আশ্বাস দিয়ে বলল,” এ কারণে একদম মন খারাপ করবে না। যা হওয়ার ছিল তাই হয়েছে এবং ভবিষ্যতেও সেরকমই হবে। কোনো খারাপ কিছু হলেও ভেঙে পরা উচিত নয়। হয়তো এটাই হওয়ার ছিল তাই হয়েছে৷ একটা সত্যি কথা হল, আমি যেকোনো পরিস্থিতি মানিয়ে নিতে পারি। ভালো হোক কিংবা মন্দ। তবুও দৃঢ়ভাবে বলতে পারি, ভবিষ্যতে এমন কিছু হবে না। আমি কিছু হতে দেবো না। গাছের শিকড় মজবুত থাকলেই তো গাছ সতেজ থাকে। আমিও নিজে ঠিক থাকলে আমার পরিবার ঠিক থাকবে। হয়তো এতদিন নিজের মধ্যে ব্যর্থতা ছিল, তাই কিছুই করতে পারিনি। কিন্তু সবসময় মানুষ এক থাকে না, পরিবর্তন হয়। হয়তো ভুল পথের সব মানুষদের পরিবর্তন হয়ে, সঠিক পথের সন্ধান পাওয়া যায়। ”

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here