#সেঁজুতি(পর্ব_২৪)
#লেখা_সুমাইয়া_আক্তার_মনি
“একে অপরের জন্য হিংসা-বিদ্বেষ না থেকে ভালোবাসা থাকতে হয়। ”
সাওনের কথা শুনে দুজনেই চুপ হয়ে বসে আছে। সাওন দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বললো,”ঘরে কী হবে বা না হবে এসব যেন এই তিনজন ছাড়া বাইরের কেউ না জানে। লোক-সম্মুখে তোমাদের কারো যেতে হয় না, আমার যেতে হয়। অন্ততপক্ষে আমার মানইজ্জত দেখবা, না হলে মানুষের সামনে যাওয়ার মুখ থাকবে না আমার। এখন থেকে চাই না, ঘরে যেন কোনো ঝামেলা হোক। সেঁজুতির সংসার সেঁজুতি সামলাবে, ভালোমন্দ দেখতে হলে সাহায্য করতে পারেন আপনি। আপনাকে কেউ জোর করবে না কোনোকিছুতে, যে এটা করতেই হবে অথবা এই সংসারের ব্যপারে আপনি নাক গলাবেন না ; এমন কিছু কেউ বলবে না। আপনার ছেলের সংসারে আপনি মতামত দিতেই পারবেন কিন্তু সেটা যুক্তিযুক্ত হতে হবে। তাছাড়া সেঁজুতিকে বলে রাখলাম, এমন কোনো কাজ করবে না যার জন্য কেউ আঙুল তুলতে পারে। নিজের ভালো পাগলেও বুঝে, আশা করি আর ভেঙে বলতে হবে না কিছু। ”
সাওনের কথা শুনে সেঁজুতি মাথা নাড়ায়। আনোয়ারা বেগম চুপচাপ বসে আছেন। সাওন কিছু না বলে উঠে যায়। আনোয়ারা বেগম উঠে তার কক্ষে গেলেন। সেঁজুতি বাল্ব, ফ্যান বন্ধ করে নিজের রুমে যায়।
রুমে গিয়ে দেখে, সাওন নিশ্চুপ হয়ে বসে আছে। সেঁজুতি ওর পাশ ঘেঁষে বসে আমতা-আমতা করে বললো,”একটা কথা বলবো?”
সাওন বললো,”হ্যাঁ, বল।”
সেঁজুতি বলতে গিয়েও থেমে গেল। ও বলতে চেয়েছিল, আজকের ঘটনা জানলো কীভাবে! কিন্তু বললো না। সাওন জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালে সেঁজুতি শান্ত ভাবে বললো,” আকাশে মস্ত বড় চাঁদ উঠেছে। ”
সাওন হালকা ঝুঁকে বললো,”তো?”
সেঁজুতি শান্ত ভাবে বললো,” এটাও জানো না, তুমি? আকাশে মস্ত বড় চাঁদ উঠেছে, এর মানে বলতে হবে!”
সাওন থতমত খেয়ে গেল। ধীর কণ্ঠে বললো,”চন্দ্র বিলাস করতে ইচ্ছে করে?”
কপাল কুঁচকে সেঁজুতি বললো,” উফফ! এসব মোটেও না। চাঁদ দেখে ছোট সময়ের কথা মনে পরে গেল। ঈদের আগের দিন চাঁদ রাতে, এই চাঁদ দেখার জন্য ছুটাছুটি করতাম কিন্তু তবুও দেখতে পেতাম না। ”
সেঁজুতির কথা শুনে মাথা হেলিয়ে শব্দ করে হেসে দেয় সাওন। ধীর কণ্ঠে বললো,”ফাজিল মেয়ে।”
সেঁজুতি গাল ফুলিয়ে সাওনের দিকে তাকায় আবার পরক্ষণেই হেসে দেয়।
.
মাঝে কেটে গেল অনেকদিন। আনোয়ারা বেগম দুই-চার কথা বললে, সেঁজুতি কিছু বলে না। মনোযোগ ফেরাতে সাওনের সাথে কথা বলে ফোনে অথবা নিজের রুমে গিয়ে দরজা চাপিয়ে মোবাইল ধরে। কোনো কথাকেই গায়ে লাগায় না। একসময় কথা বলতে বলতে আনোয়ারা বেগম নিজেই হাঁপিয়ে যায়। তখন সে এমনিতেই চুপ হয়ে যায়।
তবে আনোয়ারা বেগমের মধ্যে কিছু পরিবর্তন হয়েছে। আগেরমতো ইনিয়েবিনিয়ে কিছু বলে না। কারণ তার জানা আছে তার ছেলে সহজে কিছুতেই বিশ্বাস করবে না। আগে তো যা বলতো মোটামুটি সবকিছুই বিশ্বাস করতো সাওন কিন্তু এখন সাওন পরিবর্তন হয়েছে। ধীরে ধীরে ওর জন্য ঘরের মানুষজন পরিবর্তন হচ্ছে৷
আনোয়ারা বেগম যদি মেয়েদের কাছে কিছু বলেন তাহলে ততটুকু পর্যন্তই সীমাবদ্ধ থাকে সবকিছু। কারণ সাওনের সংসারে এসে কেউ দফাদারি করতে পারে না । তাছাড়া, সাওন একবার বলেই দিয়েছে ওর সংসারে বাগড়া দিতে হলে ভাইয়ের পরিচয় যেন ভুলে যায় সবাই। এটা ভেবেও চুপচাপ থাকে সবাই। মেজো আপুর বেবি হবে৷ এমন শরীরে খামোখাই কোনো ঝামেলায় জড়াতে চায় না। বাঁচা মরা আল্লাহর হাতে, কে ফিরে! কে চলে যায়! জানা নেই কারো। শুধু শুধু ভাইয়ের সাথে ঝামেলা করবে কেন!
প্রথম বিবাহ বার্ষিকী উপলক্ষে সেঁজুতিকে খাগড়াছড়ি নিয়ে যাবে সাওন। তবে এসবের কিছুই জানায়নি সেঁজুতিকে। নিজে ছুটি কাটিয়ে সবকিছু ঠিকঠাক করলো। আনোয়ারা বেগমকে কয়েকদিনের জন্য মেয়েদের বাড়িতে রাখলো।
গাড়িতে উঠার পরে সেঁজুতি বারবার জিজ্ঞেস করলে, সাওন ধমক দিয়ে থামিয়ে দেয়। সেঁজুতিও চুপচাপ হয়ে থাকে।
বিয়ের পরে এই প্রথমবার ঘুরতে যাচ্ছে দুজনে। হয়তো এর আগে এমন সময় হয়নি, কত শত ম্যানেজ করে চলতে হয়েছিল সাওনের। তবে বিবাহ বার্ষিকীতে নিজেদের আলাদা সময় দিতে চাচ্ছে। ঘরের দেখাশোনার পাশাপাশি যে, বাড়ির বউদের বাইরের জগতও দেখতে হয়! তাদের নিজেদেরও তো একটা ভালোলাগা রয়েছে। প্রথমে সেঁজুতি কিছুই বুঝলো না। যখন সে খাগড়াছড়ি থেকে চাঁদের গাড়িতে শুভ্র মেঘের রাজ্যে পাড়ি দিল তখন বুঝতে বাকি নেই। শুধু মুগ্ধ নয়নে সাওনের দিকে তাকিয়ে ছিল। সাওন ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা টেনে সেঁজুতির হাত ধরে কটেজে গেল।
নিশ্চুপ সেঁজুতি। সে ঘুরেফিরে সাওনকে দেখছে শুধু। সাওন নিজেও নিশ্চুপ হয়ে সেঁজুতির কাণ্ডকারখানা দেখে যাচ্ছে। কিছুক্ষণ গম্ভীর থেকে কপালে চারটি ভাজ ফেলে বললো,”মেঘের রাজ্যে এসে নিজের মুখমণ্ডলে মেঘ জমিয়ে রেখেছো!”
সাওনের কথায় হকচকিয়ে গেল সেঁজুতি। গম্ভীরমুখে বলল,” একবারো জানাওনি!”
সাওন হালকা হেসে বললো,”মাঝে মাঝে বউকে না জানিয়ে সারপ্রাইজ দিতে হয়। তোমাকে জানালে তো সারপ্রাইজ হতো না! তখন সেই নিরামিষ পান্তা ইলিশ হয়ে যেতো। ”
সেঁজুতি কপাল কুঁচকে বললো,”ইলিশ নিরামিষ হয়?”
সাওন শান্ত ভাবে বললো,” বিয়ের পরেও যদি চাঁদ দেখে চন্দ্র বিলাশ না করে, সেই ছোট বেলার ঈদের কথা মনে পরে। তাহলে ইলিশ নিরামিষ হবে না, কেন! অবশ্যই হবে।” কথাটি বলেই ফিকলে হাসি দেয় সাওন। সেঁজুতি অসহায় দৃষ্টি নিয়ে সাওনের দিকে তাকায়। সাওন স্থির হয়ে সেঁজুতির মাথায় মাথা ঠেকালো।
.
কটেজ থেকে পাহাড়ের সারিগুলো দেখা যাচ্ছে। পাহাড়ের উপরে চাদরে ঘেরা শুভ্র মেঘপুঞ্জ। ‘সবুজ চাদরের উপরে সাদা মেঘের ভেলা’ও বলা যায়।
খুব মনোযোগ দিয়ে উপভোগ করছে পর্যটক’রা। সেঁজুতি কটেজের বারান্দায় গিয়ে চারিপাশে চোখ বুলাচ্ছে। এত অপরূপ সৌন্দর্য!
সবুজের চাদরে,
ঘিরে রাখবো আদরে।
মমতা, সোহাগ, অনুরাগে ;
এই মায়াময় মুখ দেখতে চাই মরনেরও আগে।
সাওন ছন্দ মিলিয়ে বললো আর সেঁজুতির পাশ ঘেঁষে দাঁড়ালো। সেঁজুতি হালকা হেলেদুলে বললো,তুমি দেখতে পারবা। কারণ, আমি সেঁজুতি! এত মমতা, সোহাগ নেই। আমার স্বামীর জন্য মোটেই নেই। প্রার্থনা শুনবা আমার? যদি পৃথিবীতে বেঁচে থাকি, যতদিন বাঁচবো ততদিন দু’জনে একসাথে বাঁচবো। যদি আল্লাহর জিনিস আল্লাহ নিয়ে যায় তাহলে আমি মরার আগে তোমাকে সাথে নেওয়ার প্রার্থনা করেছি। না হলে আমি গেলে তুমি আবার বিয়ে করবা। এটা সম্ভব না। একদমই না। এত দরদ নাই আমার। তোমার আয়ু সবসময় চাই কিন্তু আমি না থাকলে ; তখন নয়। তখন আমার সাথেই নিয়ে যাবো। হুহ! তখন আমার মায়াময় মুখ দেখে এমনিতেই চলে যাবে। ”
কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলে পাহাড়ের দিকে তাকায় সেঁজুতি। সাওন নিশ্চুপ হয়ে ওর পাশে দাঁড়িয়ে আছে। ওর মুখে সবকথা শুনতে পারে, কিন্তু এরকম ধরণের কথা একদমই না। শান্ত ভাবে বললো,”আমার সেঁজুতি! কী হবে? কিছু হতে দিবে না তার সাওন। কখনোই না। তখন প্রার্থনা লাগবে না, এমনিতেই চলে যাবে তার কাছে।”
সাওনের কথায় খুব শান্ত হয়ে যায় সেঁজুতি। তারপরে বললো,” তুমি প্রার্থনা শুনেই এমন হয়ে গেলা! অন্য একটা কথা শুনবে না?”
সাওন ভ্রু কুঁচকে বললো,’কী?’
সেঁজুতি বলল,”এই যে। পৃথিবীতে যদি এমন একটা খেলা হয় যেখানে জামাই পাগলি হিসেবে পুরস্কৃত করবে, সেখানে প্রথম আমিই হবো। জামাই পাগলি সেঁজুতি। ”
সেঁজুতির কথা শুনে মুখ টিপে হেসে দেয় সাওন। সেঁজুতি জোরেসোরে নিঃশ্বাস ছেড়ে বললো,”ভাবি বলেছে। আমি না-কি জামাই পাগলি। তারপরে নিজে ক্যালকুলেশন করে দেখলাম, সত্যিই! আমার সাওন বুড়োর মতো যদি সবাই থাকতো, তাহলে সবাইই জামাই পাগলি হতো। এতে হাসার কিছু নেই। ”
সাওন ধীর কণ্ঠে বললো,” তুমি আগেরমতো নেই সেঁজুতি।”
সাওনের কথা শুনে কপাল কুঁচকে তাকালে সাওন বলে,” এই যে কত কথা পেটের মধ্যে লুকিয়ে রেখেছো। আগেরমতো থাকলে এতদিনে এ কথা শোনার সাথে সাথে আরও তিনগুণ কথা শুনতে পেতাম। এই জন্যই তো বলি, আমার কান এত ভালো হল কীভাবে। না হলে তব্দা দিয়ে থাকতো। তুমি আগেরমতো নেই, পুরো ভালো হয়ে গেছো। ”
#চলবে