সেঁজুতি পর্ব_২৬

0
2612

#সেঁজুতি
#লেখা_সুমাইয়া_আক্তার_মনি
#অন্তিম_পর্ব

সেঁজুতি সবার সাথে বেশ মিলেমিশে আছে। কেউ কিছু বলে না আর বলার সাহস পায় না। কেউ কিছু বললে সবার আগে আনোয়ারা বেগম নিজেই চুপ করিয়ে দেন। এরজন্য কেউ বলেও না কিছু। তার মেয়ে নাতি-নাতনি আছে কিন্তু সে মরিয়া হয়ে আছে ছেলের ঘরের নাতি-নাতনি দেখার জন্য। এসব নিয়ে কেউ রেগে থাকে, কেউ হেসে দেয়। তবুও আনোয়ারা বেগম তার নিজ স্থানে অনড়।

তিনি সবসময় বলেন,’ সেঁজুতি এ বাড়িতেই থাকবে, তিনি দেখাশোনা করবে। সেঁজুতির বাবার বাড়িতে এরজন্য গিয়ে থাকতে হবে না। এমনিতে বেড়াতে গেলে যাবে, তখন বারণ নেই কোনো। তাছাড়া সেঁজুতি গেলে সে নিজেও বাড়িতে একা হয়ে যাবে, এরজন্যই বেশি খারাপ লাগছে আনোয়ারা বেগমের। তার কথায় সবাই একটু মনমরা হলেও কিছু বলে না। সেঁজুতি শান্ত ভাবে আনোয়ারা বেগমের কথায় সম্মতি দেয়। আনোয়ারা বেগমও মহাখুশি। তবে দিন যত এগোচ্ছে সেঁজুতির বাবু ধীরে ধীরে বড় হচ্ছে। মাত্র চারমাস তার। সাওনের আনন্দ থাকলেও চিন্তায় থাকে সারাক্ষণ। তবে সবকিছু নিজের মধ্যেই রাখে, সেঁজুতিকে কিছু বুঝতে দেয় না। যতক্ষণ বাসায় থাকবে সে একা-একা সেঁজুতির পেটের উপরে মাথা দিয়ে বাবুর সাথে কথা বলবে। সাওনের এমন কাণ্ড দেখে হেসে দেয় সেঁজুতি।
অফিসে থাকলে মন থাকে সেঁজুতির কাছে। সময়মত খেয়েছে কি-না! বাবু কী করছে! সেঁজুতি কী করে! আগে রান্নাবান্না, কাজকর্ম নিয়ে ব্যস্ত থাকতো কিন্তু এখন তো এসবের ধারেকাছেও যেতে পারে না। কাজকর্ম হাসি করে দিয়ে যাবে এবং রান্না আনোয়ারা বেগম করেন। তার এক কথা সেঁজুতি শান্তভাবে বসে থাকবে, নতুন অতিথির খেয়াল রাখবে। আনোয়ারা বেগমের এমন আচরণে মাঝেমাঝে খুশিতে চোখ দুটো ছলছল করে উঠে সেঁজুতির। তখন আনোয়ারা বেগম মাথায় হাত বুলিয়ে বলবেন, ‘ আগের সবকিছু মনে রেখো না, মা! আমি আজ আছি, কাল নেই। তখন দয়া দাবি থাকলে শান্তি পাবো না, এমনিতেও পৃথিবীতে পাপের শেষ নেই।’

আনোয়ারা বেগমের এমন কথা শুনে চোখ দুটো ছলছল করে উঠে সেঁজুতির। কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বললো, ‘কে থাকে, কে চলে যায়, তার ঠিক নেই। দয়া করে এসব বলবেন না। আমি অনেক ভুল করেছি, বেয়াদবি করেছি আমার সবকিছুর দাবি ছাড়িয়ে নিচ্ছি।’

সেঁজুতির কথায় চুপ হয়ে যায় আনোয়ারা বেগম। কথার প্রসঙ্গ পাল্টিয়ে বললেন,” এখন বয়স হয়েছে তাই অতশত পারি না , হাতে গোটাকয়েক নকশিকাঁথা সেলাই করেছি। তাছাড়া বাকিগুলো সাওনকে কিনে আনতে বলেছি।”

আনোয়ারা বেগমের কথায় মৃদু হেসে সেঁজুতি বললো,” মা সেলাই করেছে আরও করবে। আপনি চিন্তা করবেন না। তাছাড়া এখনও অনেকদিন হাতে আছে।”

আনোয়ারা বেগম বললেন,” আশায় রাখবো না কিছু আমার দাদু ভাইয়ের জন্য। সবকিছু আগেই গুছিয়ে রাখবো।”

আনোয়ারা বেগমের কথা শুনে উৎসুকভাব সেঁজুতি তাকালে হেসে দেয় আনোয়ারা বেগম। সে মৃদু হেসে বলেন,” আমার মন বলছে দাদু ভাই হবে। ”

আনোয়ারা বেগমের কথা শুনে মৃদু হাসে। যখন সাওন বাড়িতে আসে তখন খুশিমনে সবকিছু বলে। সেঁজুতির কথা শুনে ওর গলা জড়িয়ে সাওন বলে, “সাঁঝেরবাতি খুশি হলে আমিও খুশি। এখন বলো, ঠিকঠাক ভাবে খেয়েছো? ”

সেঁজুতি বলল, “মা থাকতে না খেয়ে থাকবো কীভাবে! জোর করে খাইয়ে দিবে। ”

সাওন বলল, “শাশুড়ি বউয়ের মান-অভিমান ভাঙলো তবে? ”

সাওনের টাইয়ের নট খুলতে খুলতে সেঁজুতি বললো, “একশো থেকে দশ পার্সেন্টে আসছে।”

সাওন কপাল কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো, ” দশ পার্সেন্ট রয়েছে শুধু?”

সেঁজুতি বললো,” হ্যাঁ। জোর করে খাইয়ে মোটু বানিয়েছে, তাই দশ পার্সেন্ট আছে। ”

সাওন খানিকটা দূরে সরে বললো,” মা হয়ে তো বলতে পারে না! আসল কথা হল, আমার গুলুমুলু বউ পছন্দ।”

সাওনের কথা শুনে কটমট করে তাকায় সেঁজুতি। তারপরে বললো,” তাহলে এতদিন ভালো লাগেনি?”

সাওন থতমত খেয়ে বললো, “হ্যাঁ। সময়ের অভাবে বলতে পারিনি। ”

সেঁজুতি কটমট দৃষ্টি নিক্ষেপ করলে একগাল হেসে সাওন বললো,”আরে রাগছো কেন? আমার সাঁঝেরবাতিকে সবসময় ভালো লাগে। তাই বলার সময় পাইনি কারণ আমি তো মুগ্ধ নয়নে সবসময়ই তাকিয়ে থাকি। ”

সাওনের কথা শুনে মুখ ঘুরিয়ে হেসে দেয় সেঁজুতি।
সাওন এক মনে তাকিয়ে থাকে।

.

যেদিন আলট্রাসনোগ্রাফি করে জানতে পারে সেঁজুতির ছেলে হবে, সেদিন ঘরে এক অন্যরকম আনন্দ উৎসব বয়ে যায়। সাওন শুধু নিশ্চুপ হয়ে তাকিয়ে থাকতো সেঁজুতির দিকে। এইতো কিছুদিন আগেও যে সেঁজুতি যত দুষ্টি বুদ্ধি মাথায় নিয়ে ঘুরতো ; সে এখন ততই হিসেবি। সারাক্ষণ ছেলের জন্য কী করবে! স্বামী সংসার কীভাবে গোছাবে এসব নিয়ে চিন্তিত থাকে। এসব বেশ মনোযোগ দিয়ে দেখে সাওন। তবে যতটা হাসিখুশি থাকে সবার সামনে, মনে মনে ঠিক ততটাই শঙ্কায় থাকে। সবকিছু কি সত্যিই ভালো হচ্ছে! না-কি আবারও এলোমেলো হয়ে যাবে! এসব নিয়ে সাওন চিন্তিত থাকলেও সেঁজুতির দিকে তাকালে সব ভুলে যায়। ওর জামাই পাগলি সেঁজুতির মধ্যে আরেকটা ছোট অস্তিত্ব বড় হচ্ছে। এই ভালো লাগার মুহূর্তে মন খারাপ থাকবে কীভাবে, সাওনের! তার সব ভালো লাগা, খারাপ লাগার কারণ যে একজনকে ঘিরেই রয়েছে।

.

দুপুরের খাবারের পরে বিছানায় গা এলিয়ে দেয় সেঁজুতি। কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমের দেশে পাড়ি জমায়। সাওনের হাফ টাইম থাকায় তাড়াতাড়ি বাসায় আসে। বাসায় এসে সেঁজুতিকে ঘুমে দেখে জাগায়নি। ফ্রেশ হয়ে খাবার খাওয়ার পরে ওর পাশ ঘেঁষে বসলো সাওন। কিছুক্ষণ সেঁজুতির দিকে তাকিয়ে রইল, তারপরে ওর বাবুর সাথে একা-একা কথা বললো। সেঁজুতি ঘুমে এতই বিভোর, যার জন্য কিছু টেরই পায়নি৷ কতক্ষণ হল সাওন এসেছে অথচ সেঁজুতির ঘুম ভাঙছে না, সাওন নিজেও উঠায়নি। সেঁজুতির মাথার কাছে বসে মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত সাওন। কিছুক্ষণ পরেই অনুভব করলো মাথার পিছন থেকে কেউ চুল মুঠো করে টানছে। সাওন সে হাতের উপর হাত ছুঁয়ে পাশ ফিরে তাকিয়ে দেখে সেঁজুতি মিটমিট করে হাসছে৷ ভ্রু কুঁচকে সাওন বললো,”ছেলেকে টাক বাবা ডাকার সুযোগ করে দিবে?”

সেঁজুতি বললো,” হুম। ছেলের মায়ের খোঁজ-খবর না নিয়ে মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত থাকলে এমন হবেই।”

সাওন কিছুটা ঝুঁকে বললো,”আচ্ছা। ছেলের মা যে ঘুমে বিভোর ছিল! অন্যকিছুতে খেয়াল ছিল না তার, সে বেলায় কিছু হবে না?”

সেঁজুতি মৃদু হেসে বললো,” ছেলের মা যা কিছু করবে তাতে তার সাতখুন মাফ।”

সাওন কপাল কুঁচকে বললো,”আচ্ছা, তার সাতখুন মাফ হবে তখনই যখন সে সময়মত খাবার খাবে ; নিজের যত্ন করবে।”

সেঁজুতি বলল,” মা থাকতে এসবের নড়চড় হয় না। তাছাড়া জামাই পাগলি কি শুধু শুধুই হয়েছি? সে নিজেই যত্ন নিচ্ছে। তাহলে সবকিছু এলোমেলো হবে কীভাবে!”

সেঁজুতির কথা শুনে মৃদু হাসে সাওন।

.

সেঁজুতির ডেলিভারি ডেট নিকটে। আনোয়ারা বেগমকে অনেক বুঝিয়ে শুনিয়ে সেঁজুতিকে নিয়ে যায় ওর পরিবার। একমাত্র মেয়ে, এমন সময়ে তাদের বাড়িতেই রাখতে চায় সবাই। তাছাড়া সেখানে যত্ন বেশি হবে, এখানে আনোয়ারা বেগম নিজেই বয়স্ক তাই এতকিছু সামলাবে কীভাবে! আনোয়ারা বেগমের মুখ ভার ভার থাকলেও পরবর্তীতে বেশ খুশি হন তিনি৷ বেশ কিছুদিন দুই মেয়ের বাড়িতে থেকে সেঁজুতির বাড়িতে যান। একাকিত্ব কাটবে এবং ছেলে বউ, নাতির খেয়াল রাখা হবে। সবকিছু মিলিয়ে বেশ খুশি দুই পরিবার।

সাওন এক সপ্তাহের জন্য ছুটি নিয়েছে৷ কোনো ভাবেই এমন সময়ে সেঁজুতির থেকে দূরে যাবে না। যখন সেঁজুতির লেবার পেইন উঠে তখন সাওনের চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পরে। সবার সামনে জড়িয়ে ধরে সেঁজুতিকে বলেছিল,‘ কিছু হবে না ওর, মনে সাহস রাখতে হবে। ’
সেঁজুতি তখন চোখের কোণে পানি নিয়ে নিশ্চুপ হয়ে সাওনের দিকে তাকিয়েছিল। ওর সব থেকে বড় ভরসাই যে সাওন ছিল।

সেঁজুতির অবস্থা বেশি ভালো নয়। যখন ওটি তে নেওয়া হবে তার আগে সাওনের হাত, ওর দুই হাতের মুঠোয় করে নিশ্চুপ হয়ে তাকিয়েছিল। সাওন শুধু ভরসা দিয়েছে,’ কিছু হবে না। আমি আছি তো!’
তখন কেন জানি সাওনের কথাটি শুনে কষ্টের মধ্যেও মৃদু হেসে দেয় সেঁজুতি। তখন সাওনের হৃদস্পন্দন বন্ধ হওয়ার উপক্রম হলেও মুখে হাসির রেখা টেনে সেঁজুতির হাতে চুমু খেলো। এই দেখাই যে শেষ দেখা হবে বুঝতে পারলে কখনোই সেঁজুতিকে একা ছাড়তো না সাওন। সবসময় আগলে রাখতো নিজের কাছে।

সবকিছু নিমিষেই স্তব্ধ হয়ে গেল। চারিপাশে প্রিয়জন দের কান্নার আওয়াজ স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে, সাথে নতুন অতিথির কান্নার আওয়াজ স্পষ্ট ভেসে আসছে। সাওন নিশ্চুপ হয়ে শুধু তাকিয়ে আছে। কাঁদা তো দূরের কথা, চোখের কোণে পানির দেখাও মিলছে না। শুধু ঘুমন্ত সেঁজুতির মুখমণ্ডলের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে অজুহাত দেখাচ্ছে, যেমনটা আগে সেঁজুতি দেখাতো। সেঁজুতির মা ও আনোয়ারা বেগম বেহুশ হয়ে আছে। সেঁজুতি জুড়ে যে অস্তিত্ব ছিল, সে অস্তিত্বকে সেঁজুতির ভাবি কোলে নিয়ে বসে আছে। নিশ্চুপ সে নিজেও।

সাওনের অবস্থা দেখে এমন কেউ নেই, যার চোখের কোণ দিয়ে পানি ঝড়েনি। তবুও সাওন কাঁদেনি তখন।

যখন সেঁজুতিকে গোসল করাবে তখন সাওন মানতে রাজি নয় , ওর সেঁজুতি ওর কাছে আর ফিরবে না। সেঁজুতির ভাই তখন সাওনকে জড়িয়ে ধরে বলে,”ভাইরে! ও ফিরবে না আমাদের কাছে। “কথাটি বলেই তিনি হাউমাউ করে কেঁদে দেয়। সাওন পাথরের মতো নিশ্চুপ হয়ে তাকিয়ে থাকে।
জানাজায় এত মানুষের ভিড়ে আরেকজনের চাপা কান্না শুনতে পায় না কেউ। অভ্র! নিজেকে নিজে একজন ভাগ্যবান ব্যক্তি হিসেবে জানে এবং মানে। যে কি-না প্রেমিকার বিয়েতে হাসিমুখে এসেছিল এবং আজকে তাকে বিদায় দিতেও এত মানুষের ভিড়ে এসেছে। তবে একনজর দেখার সৌভাগ্য হয়নি। শুধু এবারেও শেষ বিদায় জানাতে এসেছে।

সেই চঞ্চল, হাসিখুশি সেঁজুতি এভাবে সবাইকে কাঁদিয়ে চলে যাবে কেউ মানতে পারছে না। সাওনের দুইবোন বেশ চুপ হয়ে যায়, এই মানুষটির সাথে কতরকম ব্যবহার করেছে অথচ আর কখনো কথাই বলতে পারবে না। তাছাড়া, এতটুকু দুধের বাচ্চা মা ছেড়ে থাকবে কীভাবে! সাওনের ছেলেকে কোলে নেওয়ার পরে চোখ দিয়ে টলমল করে পানি ঝড়ে যায় বোনের।
আনোয়ারা বেগম নিশ্চুপ হয়ে আছেন। হারিয়ে যাওয়া দিনগুলোই হয়তো ভালো ছিল। এভাবে পুড়তে হতো না।

.

আকাশে মস্ত বড় চাঁদ উঠেছে। চারিদিকে জোনাকিপোকার আলো ছড়িয়ে আছে। জানালার পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে রাতের আকাশ উপভোগ করছে সাওন। চাঁদের আশেপাশে ছোট-বড় তারার মেলা। সেখান থেকে একটা বড় তারা বারবার উঁকি দিচ্ছে সাওনের জানালায়। ছোট সময়ে যখন গল্প শুনতো তখন জানতো এই ছোট তারা গুলোর মাঝেই প্রিয়জনেরা থাকে। হয়তো সব থেকে উজ্জ্বল তারাই সেঁজুতি ছিল৷ সেদিন সাওন কাঁদেনি, আজ চোখের কোণ বেয়ে পানি ঝড়ছে। যে সেঁজুতি কখনও চন্দ্র বিলাস করতো না, সারাক্ষণ আজগুবি কথা মাথায় নিয়ে ঘুরতো আজ সেই সেঁজুতি নিজেই সে দেশে আছে। কখনো সাওনের বুকে মুখ লুকিয়ে বলবে না, ছোট বেলায় ঈদের সময়ে চাঁদ দেখতে পারেনি তাই আবেগের জন্য আজ কাঁদতে ইচ্ছে করছে। এটা ভেবেই সাওনের চোখের কোণ দিয়ে নিশ্চুপ হয়ে পানি ঝড়ে।

তুমি ঠিকই বংশের আলো জ্বালিয়ে, আমার জীবনের আলো নিভিয়ে গেলে। এমন সন্ধ্যা প্রদীপের আলোর সাথে কখনোই পরিচিত হতে চাইনি আমি। আমি যে ভীষণ কাঙাল। তুমি তো হারিয়ে যাওনি, আমার জীবনের আলো হারিয়েছ৷ সেদিন বলেছিলে, সেঁজুতি না থাকলে তার সাওন থাকবে না। সেদিন যদি এই কথাটির সত্যতা জানতাম, আমি সত্যিই চলে যেতাম। খুব দূরে চলে যেতাম। তাহলে এই মুহূর্তের সাথে পরিচয় হতো না। কীভাবে পারলে তুমি! তুমি কথা রাখতে পারোনি। একটুও পারোনি। শুধু মিথ্যা বলেছিলে। তুমি বলেছিলে, তোমার আগে আমাকে নিয়ে যাওয়ার প্রার্থনা করেছো। কিছুই তো হল না, এই দেখো আমি বেঁচে আছি। মরেও বেঁচে আছি। না-কি তোমার প্রার্থনা আল্লাহ কবুল করেছে! এই যে দেখো আমায়! আমি নিঃশ্বাস নিতে পারছি না। হ্যাঁ, সেঁজুতি ছাড়া সাওন বেঁচে নেই । সত্যিই সাওন নেই। বেঁচে থেকেও নেই। সে সেঁজুতির পথ চেয়ে বসে আছে, কখন সে পথের হদিস মিলবে। অথচ সে পথের দেখা এখনও মিলেনি। আজ আট বছর হতে চললো কিন্তু তোমার সাথে দেখা হয়নি এখনো৷
রাতের আকাশের দিকে তাকিয়ে কথাগুলো বলছে আর চোখের কোণ দিয়ে পানি মুছতে লাগলো সাওন।

হঠাৎ রুমের আলো জ্বলে উঠে। পিছনে তাকিয়ে দেখে আনোয়ারা বেগম দাঁড়িয়ে আছেন। সাওন নিশ্চুপ হয়ে তাকালে আনোয়ারা বেগম কাঁদোকাঁদো স্বরে বলেন,”বাবারে! আমার নাতির কথা ভাবিস একটু। সারাক্ষণ এমন হয়ে থাকলে, এমন কথাবার্তা বললে ওর যে কোথাও যাওয়ার থাকবে না।”

আনোয়ারা বেগমের কথায় নিশ্চুপ হয়ে যায় সাওন। আনোয়ারা বেগম নিজেও নিশ্চুপ হয়ে আছেন। তার পিছুপিছু একজন চোখ ডলতে ডলতে আসলো সাওনের সামনে। টি-শার্ট উল্টো পরে, চোখে ঘুম নিয়ে সাওনের সামনে এসে দাঁড়ায়।
হাই তুলতে তুলতে বললো,”আব্বু চলো। আমরা আম্মুকে বাসায় নিয়ে আসি। তখন কাঁদবে না তুমি আর আমিও আম্মুর সাথে থাকবো। ”

ছেলের মুখ থেকে এমন কথা শুনে ঝাঁপটে ধরে সাওন। সোহান হাসতে হাসতে বলে,”দাদু ভাই! দেখো, আব্বু বুড়ো হয়ে যাচ্ছে। আমার মতো মাথাভর্তি চুল নেই, এটা মানলাম। কিন্তু আব্বুর কালো চুলের মাঝেমাঝে সাদা চুল দেখা যাচ্ছে। আব্বু বুড়ো হয়ে গেছে।”

ছেলের কথা শুনে হেসে দেয় সাওন। সোহানের টি-শার্ট নজরে আসলে শব্দ করে হেসে দেয়। উল্টো টি-শার্ট পরে ঘুরছে। তখন সাওন ছেলেকে জড়িয়ে ধরে বললো,”তোমার মতো উল্টো শার্ট পরে আমি ঘুরি না। ”

সোহান বললো,”তুমি সত্যি সত্যিই বুড়ো হয়েছো কি-না পরীক্ষা করলাম তাই উল্টো টি-শার্ট পরেছি। পরীক্ষা করে দেখলাম তোমার নজরে এসব আসে কি-না!”

এতটুকু ছেলের মুখে এমন কথা শুনে কপাল কুঁচকে তাকায় সাওন। সোহান নিজের মুখ চেপে না হেসে, সাওনের মুখ চেপে শব্দ করে হেসে দিলো। সাওন নিজেও ছেলের এমন কাণ্ডকারখানায় হাসলো।
সাওন, সেঁজুতির ভালোবাসার চিহ্নকে বুকে আগলে রাখলো। যার জন্য এতবড় ত্যাগ করতে হয়েছে।
জানালায় উঁকি দিয়ে আকাশের এত তারার ভিড়ে একটা উজ্জ্বল নক্ষত্র হাসছে। এ হাসি দেখেনি কেউ, শুধুই অনুভব ছিল।

#সমাপ্ত

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here