হঠাৎ পাওয়া সুখ পর্ব-১

0
2712

#হঠাৎ_পাওয়া_সুখ
শারমিন মিশু

(১ম পর্ব)

প্রায় ৪৫ মিনিট ধরে লাবন্যর বাসার সামনে দাঁড়িয়ে ওর জন্য অপেক্ষা করছি। কিন্তু মেয়েটার আসার কোন খবরই নাই। প্রায় দুই সপ্তাহ আগে বজ্জাত মেয়েটা আমার এনাটমির নোট নিয়ে গেছে এখনো দেওয়ার কোন খবর নাই। কোন কমনসেন্স বলতে এই মেয়েটার নাই।যত্তসব!!!

এতক্ষণ ধরে কথা বলছি নিজের নামটাই তো বলা হয়নি এখনো।
আমি ডাঃ মারজুক শাহরিয়ার। মেডিকেলে পড়ছি। এখন থেকেই সবার কাছে নিজেকে ডাক্তার বলে পরিচয় দিই যদিও আমার পাশ করে বেরুতে আরো ৭মাস বাকী।
বাবা সরকারের উচ্চ পদস্থ এক কর্মকর্তা,, মা স্কুল শিক্ষিকা। আমরা দুই ভাই বোন । ছোট বোন মার্জিয়া পড়ছে আইন নিয়ে।
আমাদের দুই ভাই বোনের মাঝে অনেক বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। তবে তাই বলে আমাদের ঝগড়া কিন্তু কম হয়না। সারাদিন এটা সেটা নিয়ে লেগে থাকি।
বাবা মা দুজনে চাকরী করার কারণে আমাদের পিছনে তেমন সময় দিতে পারেনা। তারপরও যতটুকু সময় উনারা পায় আমাদেরকে দেওয়ার চেষ্টা করে যাতে আমরা কোনসময় তাদের প্রতি অভিযোগ না করতে পারি।
শয়তানি বাঁদরামি যাই করি বাবা মায়ের স্বপ্নপূরণে আমি এক পায়ে খাঁড়া। বাবার ইচ্ছা আমি বড় ডাক্তার হবো। গরিব মানুষদের সেবা করবো।
আমার বাবা সবসময় আমাকে ন্যায়নীতি শিক্ষা দিয়েছেন। কারো প্রতি কখনো খারাপ ব্যবহার করতে না করেছে। কারো সামনে নিজের অহংকার আর দাম্ভিকতা দেখাতে নিষেধ করেছে। সবসময় যতটা পারি অন্যের সাহায্য করতে বলেছে। বাবার শিখানো পথে আজ অবদি চলার চেষ্টা করেছি।

আর যার জন্য এতক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছি সে আমার বেস্টফ্রেন্ড আর ভালোবাসার মানুষও বলতে পারেন। অবশ্য ভালোবাসাটা একতরফা। ও আমাকে ভালোবাসে কিনা আমি জানিনা তবে আমি ওকে ভীষন ভালোবাসি।
জানিনা লাবণ্য আমার ভালোবাসা বুঝে কিনা? নাকি বুঝেও না বুঝার অভিনয় করে?

ওইতো পাগলীটা আসতেছে। আগে ওর সাথে বোঝাপড়াটা করি পরে অন্য কথা বলি।
লাবণ্য সামনে এসে নোটটা বাড়িয়ে দিয়ে বললো,, এই নে দোস্ত!

-থাপ্পড় দিয়ে তোর বত্রিশটা দাঁত ফেলে দিবো বেয়াদব! এই তোর পাঁচ মিনিট?
পুরো পঞ্চান্ন মিনিট পরে তুই আসছিস।

-আমার এখনো বত্রিশটা দাঁত উঠে নাই তো কি করে ফেলবি?
-আবার কথা বলছিস? রাগে আমার শরীর জ্বলতেছে। কি করছিলি এতক্ষণ?
-আরে বলিসনা বাসায় যাওয়ার পরে আপুর ফোন আসছিলো স্কটল্যান্ড থেকে। কথা বলতে বলতে তোর কথা ভুলেই গেছিলাম। কথা বলার পরে আমি খেতে বসলাম। খাওয়া শেষ হতেই তোর কথা মনে পড়লো।

-কিইইই! আমায় এখানে দাঁড় করিয়ে রেখে তুই খাবার খেয়েছিস?

-সরিরে!!

-রাখ তোর সরি!! তোর সরির আমার দরকার নাই! আর যদি কোন সময় আমার থেকে নোট নিয়েছিস তো তোর খবর করে ছাড়বো আমি!

-শুন না!!!

-মেজাজ গরম করে বললাম,,,কি??

-আমি না নোটটা করতে পারিনি!! তুই আমার নোটগুলো করে দিতে পারবি?

-কিহ!! আল্লাহ এই মেয়ে বলে কি!!
দুই সপ্তাহ আমার নোটগুলো তোর কাছে রেখেছিস এখন বলছিস তুই নোট করতে পারিসনি?

-আরে বলিস না ফেরদৌস আর প্রিয়াঙ্কার হঠাৎ বৃষ্টি ছবিটা আজ এক সপ্তাহ ধরে দেখছি। যতবার দেখি ততই দেখতে ইচ্ছে করে। তুই দেখিস ভালো লাগবে!

-তোর ছবি তুই দেখ৷ আমার এসব ছবি টবি দেখার কোন ইচ্ছা নাই। আর আমি তোর নোট ও করে দিতে পারবোনা।

-প্লিজ দোস্ত!! তুই না আমার বেস্ট ফ্রেন্ড!

-এই একদম আমাকে গলানোর চেষ্টা করবি না!

-দে না এমন করছিস কেন!

-আচ্ছা যা করে দিবো। (শত হলেও নিজেরই তো ভালোবাসার মানুষ না করি কি করে?)

-এইতো এই না হলে আমার বন্ধু!!! আচ্ছা এখন যা কাল দেখা হবে।

-হুম এখন তো আপনার স্বার্থ উদ্ধার হয়ে গেছে এখন আমাকে আর দরকার নাই। নিজে তো দিব্যি খেয়ে এসেছে৷ আর আমি যে এতক্ষণ ক্ষিধেয় মরছি তার কোন খবর তো আপনার নেওয়ার দরকার নাই!

-কি বলছিস? তুই এখনো খাসনি?

-হুম রাস্তায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমি খেয়েছি তো। যত্তসব!!

-আহারে!!! বাসায় বাবা মা কেউ নেই নয়তো তোকে বাসায় গিয়ে খেতে বলতাম!

-তুই বললেও আমি যাবোনা৷ যা তো আমার সামনে থেকে।

-আমি কোথায় যাবো? এটা আমার বাসা! তুই যা!!

-রাগে গজগজ করতে করতে আমি হাটা ধরলাম। লাবন্য পিছন থেকে হা হা করে হাসতে লাগলো।
আমি বুঝিনা এই মেয়ে কি করে ডাক্তারী করবে? এতো খামখেয়ালি ও মানুষ হয়??
সারাদিন রাত ওর মাথায় ঘুরবে আজ কোন ছবি বেরিয়েছি! কোন নায়কটা দেখতে সুন্দর! কোন ছবিটা সুন্দর! কি করে যে পারে এসব?

দুদিন পরে আজিমের বাসায় গেলাম মন খারাপ করে। আজিম ও আমার অনেক ভালো বন্ধু। আমি যে লাবন্যকে পছন্দ করি এটা আজিম জানে আর আমার ছোট বোন মার্জিয়া জানে।

আজিম আমার মন খারাপ দেখে বললো,, কি রে ভাই মন খারাপ কেন?

– কিছুনা!!
-আবারো বিয়ে ভাঙতে হবে?
-কি করে বুঝলি?
-তোর কিছুনা শুনেই বুঝতে পেরেছি!!
-হুমরে!! ছেলে নাকি ইন্জিনিয়ার ওদের সবার পছন্দ। প্লিজ তুই কিছু একটা কর! তুই ছাড়া আর কার উপর আমি বিশ্বাস করবো বল?
-আচ্ছা বলতো এভাবে আর কত বিয়ে ভাঙবি? এই নিয়ে লাবন্যর ২০টা বিয়ের সম্বন্ধ তুই ভেঙ্গেছিস!!
লাবন্যর বাবা জানতে পারলে তোর হাত পা ভেঙে হাতে ধরিয়ে দিবে। আর লাবন্য জানলে তো আর কোন কথাই নাই!
-কি করবো বল এছাড়া আর কোন উপায় নাই!
-তুই এতো টেনশন না করে লাবন্যকে বলে দিচ্ছিস না কেনো?
-ভয় হয় যদি ফিরিয়ে দেয়!!
আমি ওকে এখনো বুঝতে পারিনা!!
তাছাড়া এখনো পাশ করে বেরুতে পারিনি। বাবার উপরে আমি এখনো নির্ভরশীল অন্য কাউকে কি করে আনবো?
লাবন্যর পরিবার তো পারলে এখনি ওকে বিয়ে দিয়ে দেয়।
-তুই আঙ্কেল আন্টিকে বলে অন্তত!!
-না রে সম্ভব না। বাবা মা হয়তো না করবেনা। কিন্তু এই মুহূর্তে এসব বিয়ের চিন্তা মাথায় আনলে আমার পড়ালেখার অনেক ক্ষতি হয়ে যাবে। বাবা মায়ের স্বপ্ন আমি ভাঙতে পারবোনা।
-কি আর করার আবারো আরেকটা ছেলের লাবন্যকে বিয়ে করার স্বপ্ব ভাঙতে হবে! ব্যাপার না তোর জন্য আমি সব পারবো!!

অবশেষে আজিমের বানানো গল্পে বিশ্বাস করে এই ছেলেটাও লাবন্যকে বিয়ের আশা বাদ দিলো।

পরদিন লাবন্য মন খারাপ করে এসে বসলো। আমরা দুইবন্ধু ওর দিকে তাকিয়ে মিটি মিটি হাসছিলাম।
কিছুক্ষণ পর আজিম বললো,, কিরে কি হলো লাবন্য? মন খারাপ কেন?
-লাবন্য বললো,,, আর বলিস না দোস্ত! জানিনা কার কোন ক্ষতি করেছি!
কার বাড়া ভাতে ছাই দিয়েছি আমি?

-আমি কোন মতে হাসি চেপে বললাম,, কেন কি হয়েছে?
-আচ্ছা তোরা বলতো আজ পর্যন্ত আমি কোন ছেলের সাথে ভালোবাসায় জড়ায়ছি কিনা?
-না তো!!
-আর কোন হারামি বারবার আমার বিয়ের জন্য সম্বন্ধ আসলেই আমার নামে ওদের কাছে বলে যে,, আমি নাকি কোন ছেলেকে ভালোবাসি। আর ছেলে নাকি ওদের আরো কি কি হুমকি দিয়েছে। এই নিয়ে কতগুলো বিয়ে ভাঙলো। ওই হারামিটারে যদি আমি পাইতাম!!! ওর বাপের নাম ভুলিয়ে দিতাম!!
-আমরা হাসি চেপে রাখতে না পেরে শব্দ করে হেসে উঠলাম।
-লাবন্য অবাক হয়ে বললো,, তোরা হাসছিস কেন?
তারপর সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,,, এই কাজটা তোরা করছিস না তো আবার?
-আমি বললাম,, ছি!! লাবন্য!! তুই আমাদেরকে এই চিনেছিস?
আমরা তোর বন্ধু আমরা এমন কাজ কি করে করতে পারি?
-হুম তা ও ঠিক তোরা আমার বন্ধু তোরা এমন কাজ কি করে করবি?
-আজিম বললো,, তুই আমাদের সন্দেহ করে কাজটা একদম ঠিক করিসনি লাবন্য?
-আরে আমি তো এমনি জিজ্ঞেস করলাম। তোরা এতটা গুরুতর ভাবে কেন নিচ্ছিস?
আচ্ছা আমাদের ব্যাচের কোন ছেলের কাজ নয়তো?
-হতেও পারে!!
-কে করতে পারে বলতো? রাতুল নয়তো?
ওই তো সবসময় আমার পিছন পিছন ঘুরে!
-কে জানি হতেও পারে! তুই গিয়ে জিজ্ঞেস করনা!!
– রাতুল যদি হয়ে থাকে তবে ওর একদিন কি আমার একদিন আজ বলে রেগে মেগে লাবন্য উঠে গেলো।

ও চলে যেতেই আমরা দুই বন্ধু অট্টহাসিতে ফেটে পড়লাম।
সেদিন বাসায় এসেও আমি ক্ষণে ক্ষণে হাসতে লাগলাম লাবন্যর কথা মনে করে । খেতে বসেই লাবন্যর সেই রাগি চেহারাটা মনে পড়তেই হাসি বেরিয়ে আসলো। আর তার সাথে ভাত গলায় আটকে কাশতে কাশতে আমার অবস্থা খারাপ।

আবার রাতে পড়তে বসেও আমার হাসি যেনো থামছেই না। মার্জিয়া কখন জানি আমার পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে বুঝতে পারিনি।
আচমকা ওর কথা শুনে আমি চমকে উঠলাম। পিছন ফিরে তাকাতেও আবারো বলে উঠলো।
ভাইয়া তোকে কি কোন জ্বিনে আছর করেছে নাকি?
-মানে কি? আমাকে কেন জ্বিনে ধরবে?
-না তুই বাসায় আসার পর থেকে দেখছি হাসছিস ব্যাপার কি বলতো?
-কি ব্যাপার কিছুনা!
-তোকে তো আমি ভালো করে চিনি! বিনা কারণে হাসার মত ছেলে তুই না।
-আরে না কি হবে?
-লাবন্য আপুর কোন ক্ষতি করেছিস নাকি?
-আমার হাসির শব্দ এবার প্রবল আকারে বেজে উঠলো।
-তুই আবারো আপুর বিয়ে ভেঙ্গেছিস?
-কি করবো বল আর তো কোন উপায় নাই।
-ভাইয়া তুই কিন্তু এটা ঠিক করছিস না।এভাবে কতদিন তুই উনার বিয়ে আটকাবি?
একসময় হয়তো ঠিকই বিয়ে করে চলে যাবে তোকে ছেড়ে। তখন কি করবি?
-এবার আমার হাসি বিষাদে রূপ নিলো। সত্যি তো এভাবে কতদিন আমি ওর বিয়ে আটকাবো?
-মার্জিয়া বললো,,, ভাইয়া তুই কেন এত চিন্তা করছিস বলতো? তুই আপুকে বলে দে ভাইয়া!! পরে যা হবার হবে!
-বলে দিবো?
-হুম
-যদি না করে দেয়!!
-না করে দিলে দিবে! তারপরও তো একটা চিন্তা থেকে তোর মুক্তি হবে!
তোর কষ্টগুলো আমার সহ্য হয়না ভাইয়া?
-আমার খুব ভয় লাগছে রে!
-এভাবে ভয় নিয়ে চুপ থেকে থেকে একদিন সব হারাবি মনে রাখিস!! বলে মার্জিয়া চলে গেলো।
প্রায় একসপ্তাহ আমি দিনরাত এক করে ভেবেছি। এভাবে আর লাবন্যকে নিয়ে মনের মধ্যে চিন্তা বয়ে বেড়ানো সম্ভব না!
যা হয় হবে! অন্তত ওর মনের কথাটাও তো জানতে পারবো।

লাবন্যকে দেখলাম অনুর সাথে দাঁড়িয়ে কথা বলছে। আজিমকে দিয়ে ওকে ডেকে আনলাম। আমার বুকের ভিতর ধুকপুক ধুকপুক আওয়াজ হতে লাগলো। কি হয়!! কি হয়!! একটা ভয় কাজ করছে। বুকের ভিতর ভয় জড়তা আর অজানা এক আনন্দের অনুভূতির সৃষ্টি হলো

লাবন্য এসেই কর্কস কন্ঠে বলে উঠলো,, কিরে কি জন্য ডাকছিলি?
কি এমন কথা আছে তোর যে আজিম কে দিয়ে আমাকে ডেকে আনতে হলো?

আমার শরীরের ঘাম ছুটে গেছে। গলায় কেউ হাত চেপে ধরেছে কথা বেরুচ্ছে না। প্রচন্ড পানির পিপাসা পেয়েছে। বুকের ভিতর থেকে গলা পর্যন্ত শুকিয়ে কাট হয়ে গেছে! মনে হয় কতদিন ধরে আমি পানি না খেয়ে আছি!!
লাবন্যকে বললাম,, তোর কাছে পানি হবে? অনেক তৃষ্ণা পেয়েছে!!

লাবণ্য চোখ বড় বড় তাকিয়ে ব্যাগ থেকে পানির বোতল নিয়ে আমার দিকে বাড়িয়ে ধরলো………

চলবে…….
ইনশাআল্লাহ …

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here