হঠাৎ পাওয়া সুখ পর্ব-১৪ ১৫

0
959

#হঠাৎ_পাওয়া_সুখ
(১৪তম ও ১৫ তম পর্ব)
লেখা- শারমিন মিশু

মারজুকের হঠাৎ মনে পড়লো নাবিলা সেদিন কথায় কথায় বলেছে ওর বৃষ্টি খুব ভালো লাগে। বৃষ্টি দেখলেই ওর নিজের ভিতরে চঞ্চলতাকে ও কোনভাবে আটকে রাখতে পারেনা। বৃষ্টিতে না ভিজতে পারলে ওর ভালো লগেনা। তাহলে নাবিলা…
ভাবতে ভাবতে মারজুক রুম ছেড়ে বেরিয়ে আসলো।
মারজুক যে বাসাটাতে থাকে এটা একটা দুই তলা বিশিষ্ট বাড়ি। বাড়িটা নতুন হয়েছে উপরের দিকে হয়তো আরো বাড়বে। প্রতি ফ্লোরে দুইটা করে ফ্লাট। নিচের তলার পুরোটা ছাত্রী হোস্টেল হিসাবে ভাড়া দেওয়া হয়েছে। তাদের ছাদে উঠা নিষেধ। আর উপরের তলার এক ফ্লাটে বাড়ির মালিক থাকে অপর ফ্লাটে মারজুকরা থাকে। বাড়ির মালিক মারজুককে বেশ পছন্দ করে। আর তাছাড়া মেডিসিন স্পেশালিষ্ট ডাক্তার মারজুক শাহরিয়ারকে এই খানে প্রায় অনেকেই চিনে। বাড়ীওয়ালারা এক সপ্তাহ ধরে দেশের বাহিরে আছে। তাই সুবিধা অসুবিধার জন্য মারজুকের কাছে ছাদের একটা চাবি দিয়ে গেছে।
মারজুক সিঁড়িঘরের চৌকাঠে পা রাখতেই দেখতে পেলো এক নারী অবয়ব দুই হাত প্রসারিত করে বৃষ্টিকে আলিঙ্গন করছে। মারজুকের রাগ চেপে গেছে এই মেয়েকে ইচ্ছামতো কয়েকটা বকা না দিলেই নয়। এই অসময়ের বৃষ্টির পানি অনেকটা বিষাক্ত হয়। গায়ে পড়তেই জ্বর এসে চেপে ধরে। আর তাছাড়া নাবিলার জন্য এই মুহুর্তে বৃষ্টিতে ভিজা মানে ওর জন্য বিরাট হুমকি। মেয়েটার কি কোন কমনসেন্স নাই? নিজের শরীরের প্রতিও তো একটু খেয়াল রাখা দরকার আছে।

মারজুক কিছু বলতে যাবে কিন্তু পরক্ষনে সিঁড়ি ঘরের লাইটের আবছা আলোয় নাবিলাকে হাতে বৃষ্টি নিয়ে ছুড়োছুড়ি করতে দেখে ও নিজেই হা হয়ে গেলো। এক অদ্ভুত ভালোলাগায় মারজুকের মন ছেয়ে গেলো। লাইটের আবছা আলোয় নাবিলাকে যে কেমন লাগছে তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। এতো মোহনীয় আকর্ষনীয় রমণীকে দেখে নিজেকে সামলানো বড় দায়। এই বৃষ্টিবিলাসীকে দেখতে যে কি অপরূপ লাগছে বলে বোঝানো যাবেনা। মারজুক যেন একটু সময়ের জন্য নাবিলাতে আটকে গেলো। এক অন্যরকম নেশা ধরে গেলো ওর চোখ আর মনের মধ্যে।

মারজুক বিড়বিড় করে বলতে লাগলো,

হে বৃষ্টিধারা, তুমি থেমোনা আজ
ঝরতে থাকো অঝর ধারায়
তোমার জলে আজ নিজেকে সিক্ত করছে
এক একবিংশ বৃষ্টি বিলাসী তরুণী
জানো তো কে সে?
সে আমার এই নিঃসঙ্গ ছন্নছাড়া জীবনের
হঠাৎ পাওয়া সুখ

কিছু একটা অদৃশ্য শক্তি যেনো মারজুককে নাবিলার দিকে টানছে। মারজুক আস্তে আস্তে নাবিলার দিকে এগিয়ে গেলো।

নাবিলা পিছন ঘুরতেই একজন মানুষকে ওর দিকে এগিয়ে আসতে দেখে ওখানে বরফের মতো জমে গেলো। এ মুহুর্তে তো ছাদে কারো আসার কথা নয় এটা পুরোপুরি নিশ্চিত হয়ে ও ছাদে এসেছে। অসময়ে বৃষ্টি দেখে লোভ সামলাতে পারেনি তাই ছাদে ছুটে এসেছে।
ভয়ে নাবিলার দম আটকে আসছে। নাবিলা কি করবে চিৎকার দিবে নাকি?
নাকি চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকবে? ভাবতে ভাবতে মানব অবয়বটা আরো সামনে এগিয়ে এলো। নাবিলা মুখ খুলতে নিলেই মারজুক এসে ওর মুখে হাত দিয়ে দিলো। নাবিলা এতক্ষণ অন্ধকারে চিনতে না পারলে এখন ভালো করে চিনেছে যে এটা মারজুক। কিন্তু মারজুকের চোখের দিকে তাকিয়ে নাবিলার বুকের ভিতর কেমন যেন করে উঠলো। মারজুকের স্পর্শে নাবিলা চোখ বন্ধ করে ঝড়ের পাখির মত কেঁপে উঠলো। অচেনা এক মধুর শিহরণ যেন বিদ্যুৎ খেলে গেলো ওর শরীরের সমস্ত রক্ত কণীকায়। ঝর্ণার মতো শব্দ করে বেজে উঠলো আনন্দ লহরী। হৃদয় তানপুরায় বেজে উঠলো মিলনের সুর । মারজুক নাবিলাকে ঘুরিয়ে দিয়ে হাতে থাকা গাঁদা ফুলের মালাটা নাবিলার মাথায় পেঁছিয়ে দিলো।
মারজুকের চোখে আজ অন্যরকম নেশা দেখতে পাচ্ছে নাবিলা। কিছুক্ষণের মাঝে দুজন দুজনাতে আবদ্ধ হয়ে গেলো। মারজুক ফট করে নাবিলাকে কোলে তুলে নিলো।
সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এসে কোনরকমে রুমের দরজা আটকে দিলো।
ডাক্তার বলেছে প্রথম তিনমাস একটি সাবধানে থাকতে৷ কিন্তু আজ না চাইতেও ওরা একে অন্যকে কাছে আসা থেকে আটকাতে পারে নি। আর তাছাড়া এটা পৃথিবীর অমোঘ নিয়ম যে দুটো নারী পুরুষ কখনো একান্তে নির্জনে একত্রিত হলে চুপচাপ হয়ে থাকতে পারেনা। সেখানে ওরা তো স্বামী স্ত্রী। সেই অধিকার ওদের পুরোপুরি আছে।
তারপরে এক অন্যরকম নেশায় দুজন দুজনাতে বিভোর হয়ে গেছে।

ফজরের আগে মারজুকের মৃদু ধাক্বানিতে নাবিলার ঘুম ছুটে গেলো। নাবিলা চোখ মেলে মারজুককে ওর মুখের উপর উপুড় হয়ে চেয়ে থাকতে দেখতে পেয়ে সাথে সাথে চোখ দুটো আবার বন্ধ করে নিলো। লজ্জায় মারজুকের দিকে তাকাতে পারছেনা। কাল হঠাৎ কি যে হয়ে গেলো! ওদের তো এরকম আরো ফিজিক্যাল রিলেশান হয়েছে। কিন্তু কালকের ব্যাপারটা পিরোপুরি আলাদা।
নাবিলা লজ্জায় নিজেকে মারজুকের দিকে তাকাতে পারছেনা। উফ!! কি করে যে মুখোমুখি হবে?
উনি সরে যাচ্ছেনা কেন?

মারজুক ঠোঁটে হাসির রেখা ফুটিয়ে বললো,, এতো লজ্জা কিসের বলোতো?

-আরে আমরা আমরাইতো!মনে হয় যেনো এবারেই প্রথম!
-উফ! আপনি থামবেন?
-আমি আবার কি করলাম? তুমি নিজেই তো!
-আপনি চুপ করুন না।
-আমার কিন্তু কোন দোষ নেই!
-নাবিলা চেখ বড়বড় করে বললো,, মানে?
-মানে আবার কি? কাল রাতে আমি ইচ্ছে করে কিছু করিনি। তুমি ডেকেছো তাই আমি গিয়েছি।
-আমি আপনাকে ডেকেছি? আমি? এই আপনাকে কে বলেছে তখন ছাদে যেতে?
-কাল আপনি যে চিন্তায় ফেলেছিলেন আমাকে ভয়ে আমার কলিজা শুকিয়ে গিয়েছিলো। ফোন দিয়ে আপনাকে পাইনি বাসায় এসে পাইনি। কতটা টেনশন হয়েছে বুঝতে পারছেন?
-সরি আমি আসলে বৃষ্টি দেখে লোভ সামলাতে পারিনি।
-এখন যদি জ্বর আসে তখন কি হবে বুঝতে পারছো?
তারপর মুখে দুষ্টু হাসি হেসে বললো,, অবশ্য যা হয়েছে তাতে কিন্তু আমার অনেকটা লাভ হয়েছে।
-আপনার কি লজ্জা শরম বলতে কিছু নেই?
-এতে লজ্জার কি আছে? আমরা স্বামী স্ত্রী কথা বলছি!
-আপনাকে না আমি..
-আমাকে যা করার পরে করবেন ম্যাডাম। আগে গিয়ে তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে আসুন। নামাজ পড়বো একসাথে।

সেদিন বিকালে সত্যি সত্যি পুরো শরীর কাঁপিয়ে নাবিলার জ্বর এলো। সন্ধ্যায় মারজুক এসে দেখলো নাবিলা জ্বরের ঘোরে আবোল তাবোল বকছে।
মারজুকের নিজেরও একটু একটু জ্বর ভাব লাগছিলো। কিন্তু বাসায় এসে নাবিলার অবস্থা দেখে তো ওর বেহাল দশা । মারজুক যে বাসায় এসেছে নাবিলার সেদিকে কোন হুঁশ নেই। জ্বর মেপে ১০৪° দেখে মারজুক আরো অস্থির হয়ে উঠলো। নিচে গিয়ে ফার্মেসী থেকে জ্বরের কিছু ঔষধ নিয়ে আসলো।
কোন রকমে নাবিলাকে টেনে তুলে অল্প একটু খাইয়ে দিয়ে ঔষধ খাইয়ে দিয়েছে। নাবিলার মাথায় জলপট্টি দিতে দিতে কখন যে ওর মাথার পাশে ঘুমিয়ে পড়েছে নিজেও জানেনা।
নাবিলা জ্বরের ঘোরে পানি পানি করছিলো তাতে মারজুকের ঘুম ছুটে গেলো। উঠে গিয়ে পানি দিলো। কোনরকমে রাতটা পার করলো।

ফজরের নামাজ পড়ে মারজুক নাবিলার পাশে বসে কিছুক্ষণ কোরআন তেলাওয়াত করে বিছানায় মাথা এলিয়ে দিলো। প্রচন্ড মাথা ধরে আছে। মারজুক কি করবে ভেবে পাচ্ছেনা। এখন নাবিলার পাশে কারো থাকার দরকার। মার্জিয়াকেও ফোন করতে পারছেনা। বাবা জানলে খুব হুলস্থূল কান্ড বেঁধে যাবে। ওখানে কিছু না জানানোটাই ভালো।

একটা কাজের মেয়ে খু্জে দেয়ার জন্য অনেক কে বলেছে কিন্তু এখনো কোন খবর দিতে পারেনি।
মারজুক নাস্তা বানিয়ে নিয়ে রুমে আসলো। নাবিলাকে ধরে উঠে বসাতেই নাবিলা জ্বরের ঘোরে গড়গড় করে বমি করে মারজুকের পুরো শার্টসহ বিছানা ভাসিয়ে দিলো।
মারজুক কোনরকমে নাবিলাকে ধরে বাথরুমে নিয়ে পরিস্কার করে মাথায় পানি দিয়ে রুমে এনে সোফাতে বসিয়ে বিছানার চাদর পাল্টে নাবিলাকে আবার শুইয়ে দিলো।
তারপর নিজে গিয়ে চেন্জ করে এসে নাবিলাকে কোনমতে অর্ধেক রুটি খাইয়ে ঔষধ খাইয়ে শুইয়ে দিলো।
মারজুক নিজে বেশ হাঁফিয়ে উঠেছে। কি করবে না করবে কিছুই মাথায় আসছেনা। সারারাত এক প্রকার না ঘুমিয়ে কাটিয়েছে। চোখগুলো কেমন জ্বালা করছে।
এভাবে নাবিলাকে বাসায় ধরে রেখেও বা কি করবে। আন্দাজে ঔষধ খাওয়ালেও তো হবেনা। ওর শরীরের অবস্থা বিবেচনা করে মেডিসিন দিতে হবে। সোহানা ম্যাডামকে জানাতে উনি বললো হসপিটালে নিয়ে যেতে। হসপিটালে নিলেও তো কারো একজনের নাবিলার পাশে থাকা দরকার।

এই একদিনে মারজুক হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারছে একটা মেয়ে যতটা ধৈর্যশীল হতে পারে একটা ছেলের পক্ষে তা কখনোই সম্ভব না। মেয়েরা সারাদিন ধরে বাসার কাজ করলে কখনো বিরক্তি প্রকাশ করেনা। সারারাত জেগে প্রিয়জনের সেবা করে ও এরা সারাদিন অনায়াসে ঘরের কাজ করেও সেই মানুষটার সেবা করতে পারে। এদের মাঝে সব কষ্ট ক্লান্তি সয়ে যাবার একটা ক্ষমতা সৃষ্টিকর্তা দিয়ে দিয়েছে যা পুরুষের নেই।

এমন সময় নাবিলার ফোনটা বেজে উঠলো। মারজুক ফোনে চোখ বুলিয়ে দেখলো ওর শশুরের নাম্বার থেকে ফোন। মারজুক ফোন ধরেই সালাম দিতে ওপাশ থেকে রাফিউল ইসলাম সালামের জবাব দিয়ে বললো,, কি ব্যাপার বাবা আজ তোমার ডিউটি নেই?
-না মানে..আসলে নাবিলা একটু অসুস্থ তো তাই ছুটি নিয়েছি আজ।
-সে কি কি হলো নাবিলার? আমাদের জানাওনি কেনো?
-অনেক জ্বর ! কথাও বলতে পারছেনা।
-নিশ্চয় বৃষ্টিতে ভিজেছে?
-জী।
-ডাক্তার এত করে বলেছে ওকে বৃষ্টিতে না ভিজতে কিন্তু এই মেয়ে কারো কথা শুনার নয়। এখন ঔষধ খাইয়েছো?
-জী আব্বা। তবে আমার মনে হয় হসপিটালে ভর্তি করানো লাগবে।
-তো দেরি করছো কেন?
-নিয়ে যাবো সন্ধ্যায় ৷ তবে ওর পাশে তো একজন কারো থাকা লাগবে কি করবো বুঝতে পারছিনা।
-এটা নিয়ে চিন্তা করছো কেন? আমি আর তোমার শাশুড়ি এখনি আসছি।
-মারজুক যেনো অনেকটা হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। আস্তে করে বললো,,আচ্ছা ঠিক আছে আমি এখন রাখছি।

নাবিলার বাবা মা আসার পরে নাবিলাকে হসপিটালে নিয়ে গেলো….

চলবে……..

#হঠাৎ_পাওয়া_সুখ
১৫তম পর্ব
লেখা – শারমিন মিশু

এক সপ্তাহ পরে নাবিলা অনেকটা সুস্থ হলো। নাবিলা সুস্থ হতেই ওর মা চলে গেছে। বাড়িতে ওর বাবা একা মানুষ। অসুস্থ মানুষ কি রান্না করে কি খায় তাই ভেবে নাবিলা নিজেই ওর মাকে পাঠিয়ে দিয়েছে। মারজুক নিজে গিয়ে উনাকে দিয়ে এসেছে।

এই এক সপ্তাহের জ্বরে শরীর ভীষন আকারের দুর্বল হয়ে গেছে। পুরো মুখ তিতা হয়ে আছে। কোন কিছু খেতে ও পারছেনা মুখের ভিতরে ঘা হয়ে গেছে। তবে সোহানা ম্যাডাম বারবার করে মারজুক কে বলেছে নাবিলার খেয়াল রাখতে। প্রতিমাসে এনে চেকাপ করাতে হবে। আর তাছাড়া সকাল সন্ধ্যা নিয়মিত টাইম করে হাটতে হবে। যদিও এখনকার ডাক্তাররা রুগী পেলে তাকে না পারতেও বেড রেস্টে ধরিয়ে দেয়। তবে এসময়ে শুয়ে বসে থাকলেই আরো বেশি ক্ষতি হয়। যেহেতু মারজুক নিজেই একজন ডাক্তার সেহেতু ও অবশ্য এসব ব্যাপারে অবহেলা করবেনা।
নাবিলার গ্যাস্টিকের সমস্যা বেশি। সেই জন্য প্রতিদিন সকালে কুসুম গরম পানিতে ইসপা গুলের ভূষি গুলিয়ে নয়তো আমলকি বা অর্থকি শুকিয়ে সেগুলো গুঁড়ো করে রাতে পানিতে ভিজিয়ে সকালে খেতে বলেছে। নিয়মিত আয়রন ক্যালসিয়ামের ট্যাবলেট গুলো দুবেলা করে খেতে বলেছে।

মারজুকের এই টেককেয়ার গুলো নাবিলার ভিতর থেকে ছুঁয়ে যাচ্ছে। মনে মনে বলে আসলে আমি তার এতো ভালোবাসা আর টেককেয়ার পাওয়ার যোগ্য?
আমার জন্য সে নিজের পরিবার ছেড়েছে কেন? কিসের টানে?
সেদিন মারজুককে এ প্রশ্নটা করতে মারজুক জবাব দিলো জানিনা কেন করেছি? কেন তোমায় নিজের সাথে জড়িয়েছি? কেন তোমায় হৃদয়ের অন্তঃস্থলে জায়গা দিয়েছি?
শুধু জানি সেদিন এক পলক তোমায় দেখে আমার মনে হয়েছে, আমার জীবনের এতগুলো বসন্তের মাঝে হৃদয়ের যে অতৃপ্ত বাসনা ছিলো সেগুলোকে পূর্ণতা দিতে তুমি আমার জীবনের #হঠাৎ_পাওয়া_সুখ হয়ে এসেছো।

মার্জিয়া আজ আবার আয়ানকে ডাক্তার দেখাতে এসে নাবিলাকে এসে দেখে গেছে। দুপুরের পর খেয়ে ও আবার চলে গেছে৷ নাবিলাকে খুব সাবধানতা অবলম্বন করতে বলেছে। আর তাছাড়া আর কয়েকটা মাস গেলে মার্জিয়া এসে নাবিলার কাছে থাকবে বলে গেছে।
কিন্তু সারাদিনের পরে সেই একলা ঘরে একঘেয়েমি ভরা শূন্যতা এসে মনের মধ্যে ভর করে। মারজুকের বইয়ের তাকে মেডিকেলের বইয়ে ভর্তি। কাশেম বিন আবু বকরের কয়েকটা উপন্যাস রয়েছে। অবশ্য সে সবগুলো নাবিলার পছন্দের। নাবিলা বাবার বাড়ি থেকে আসার সময় নিজের অনেকগুলো বই নিয়ে এসেছে। বইগুলো আছে বলে নাবিলার কিছুটা সময় কাটে। না হলে তো আরো বেশি একাকী লাগতো। এই যান্ত্রিকতার শহরে কারো সাথে যে একটু বসে কথা বলবে সেরকম কোন উপায় নাই। এ ব্যস্ততার শহরে সবাই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত কারো সাথে কথা বলার একটুখানি সুযোগ কারো নেই। নাবিলা ভাবছে আমার জীবনটা কি কখনো এমন হওয়ার কথা ছিলো? কত স্বপ্ন কত আকাঙ্খা ছিলো মনের মধ্যে বিয়ের পরের জীবনের জন্য। বাবা মাকে ছেড়ে আসলেও শশুর শাশুড়ীর ভালোবাসায় নিজেকে জড়িয়ে সেই ব্যথা গুছাবে। ঘরবর্তী শুধু ভালোবাসা বিরাজ করবে৷ কিন্তু সব একনিমিষে শেষ হয়ে গেলো!
আর আজ আমাকে বিয়ে করতে গিয়ে আরেকটা মানুষকে সবকিছু ছাড়তে হলো। নাবিলার মাঝে মাঝে মনে হয় উপরওয়ালা শুধু আমাকে মানুষের কষ্টের কারণ হতেই সৃষ্টি করেছে। আমার দ্বারা কারো কোন ভালো হতে পারেনা। পরক্ষনেই মনে হয় এই পৃথিবীতে সৃষ্টিকর্তা অনর্থক কিছুই বানান না। সবকিছু বানানোর পিছনে তার কোন না কোন উদ্দেশ্য আছে। এই যে এই মানুষটা আমাকে আমার সবকিছু জানার পরও আমাকে এতো এতো ভালোবাসা দিচ্ছে হয়তো এই জন্য আমাকে সৃষ্টি করার স্বার্থকতা।

আজ দুপুরে খাবার খেতে এসে মারজুক বলে গেলো বিকালে রেডি হয়ে থাকতে ডাঃ ইসহাকের বাড়ীতে দাওয়াত আছে আজ রাতে।
-নাবিলা বললো, দাওয়াত তো রাতে বিকালে কেন বের হবো?
-তোমাকে নিয়ে তো কোথাও বেরোনো হয়নি এতদিন তাই ভাবছি একটু বৈকালিক ভ্রমণ করবো আর একটু কেনাকাটা এই আর কি!

-নাবিলা বললো,, আমি এই অবস্থায় বাহিরে বের হবোনা।
-আরে আমরা তো একটা কাজে যাচ্ছি। তাই ভাবলাম বেরুচ্ছি যখন এককাজে দুই কাজ সেরে ফেলি। সবসময় তো তোমাকে নিয়ে বের হতে পারবোনা।
-তারপরেও..
-কোন কথা নয় যা বলছি তাই করো

নাবিলা আর মারজুক পাশাপাশি হাটছে রমনা পার্কের ভিতর দিয়ে। বিকালের এই শান্ত পরিবেশ মৃদু বাতাস শরীর মন প্রান জুড়িয়ে যাচ্ছে। অবশ্য সাথে যদি প্রিয় মানুষ থাকে তবে তো আর কথায় নাই। মনে হয় যেনো সময়টা এখানেই থমকে যাক। তবে আশপাশের নোংরা পরিস্থিতি দেখলে শরীর কেমন ঘৃন ঘৃন করে উঠে। ঢাকা শহরের আজকাল এমন অবস্থা কোথাও যে একটু নিরিবিলি সময় কাটাবো সেই জায়গাটি আর নেই। প্রতিটি জায়গায় জোড়ায় জোড়ায় যুবক যুবতী একেবারে অন্তরঙ্গ হয়ে বসে আছে। অবশ্য এদের মধ্যে বিবাহিত কিছু যুগল ও আছে। তবে তা হাতে গোনা। মাঝে মাঝে মনেহয় এই ছেলেমেয়ে গুলোর কি মা বাবা নাই নাকি?

নাবিলা এসব ভাবতে ভাবতে মারজুকের হাত চেপে ধরে বললো, আমার না এখানে ভালো লাগছেনা। চারপাশে কি বিশ্রী অবস্থা! চলুন আমরা চলে যায়।
-কি করবো বলো! এজন্যই আজকাল কোথাও আর বেরোই না। এগুলো দেখলেই নিজের কাছে খারাপ লাগে। সকালের দিকে পরিবেশ একটু ভালো থাকে। কি আর করবো নিজেদের মতো নিজেদের চলতে হবে। আচ্ছা চলো আমাদের তো আরো কাজ আছে।

কিছু কেনাকাটা সেরে ডাঃ ইসহাকের বাসায় গেলো ওরা।
নাবিলা ভিতরের রুমে চলে যেতে এক তরুণী এসে হাসিমুখে নাবিলাকে সালাম দিয়ে জড়িয়ে ধরলো। নাবিলা বুঝলো ইনিই ইসহাক স্যারের বউ।
কুশলাদি বিনিময় শেষে সোমা নাবিলাকে বললো, অবশেষে তোমার সাথে আমার দেখা হলো নাবিলা। এতদিন তোমার কথা শুনতে শুনতে তোমাকে একবার দেখার জন্য আমার মন কেমন উতলা হয়ে ছিলো বলার মতো না।
-ভাবি আপনি আমার কথা শুনেছেন?
-হুম ইসহাক তো আমাকে তোমার সব কথা বলেছে।
-সব বলেছে মানে?
-ভয় পেয়োনা। আমি জানি তুমি কতটা সৎ ছিলে। মারজুক ভাইয়ের বাবা মা বুঝলোনা উনারা কি এক দামি জিনিসকে অগ্রাহ্য করছে! একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে দেখো। আল্লাহর উপর ভরসা হারিয়োনা। আল্লাহ ভালো মানুষকে তার প্রতিদান ঠিক দিবে। একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে।

দুটো ছোট ছোট মেয়ে দৌড়ে এসে নাবিলা সালাম দিলো। নাবিলা সালামের জবাব দিয়ে ওদের কাছে টেনে নিলো। কি মিষ্টি চেহারা ওদের। একজনের বয়স বোধহয় আট আরেক জনের ছয় হবে। অথচ কি সুন্দর করে দুজনে কথা বলছে। নাবিলা অবাক হয়ে গেলো যখন দেখলো এত ছোট মেয়ে অথচ ওরা দুজনে বাসায়ও মাথায় হিজাব পরে আছে।
-কৌতুহল দমন করতে না পেরে নাবিলা বললো,, ভাবি ওরা কি সবসময় এমন হিজাব পরে থাকে?
-হুম সবসময় পরে থাকে। ওর বাবাই ছোটবেলা থেকে এমনভাবে গড়ে তুলেছে। ওর বাবার কড়া নির্দেশ।
আমিই মাঝে মাঝে বলতাম, ইসহাক এরা তো এখনো ছোট মানুষ বড় হলে ঠিক হয়ে যাবে।
ও বলে কতজন এভাবে ভবিষ্যতে ঠিক হয়েছে বলতে পারো৷ শতে তে হয়তো একজন পারে নিজেকে বদলাতে।
শুনো সোমা, একটা প্রবাদ আছে বাংলায়-
কাঁচায় না নোয়ালে বাঁশ
পাকলে করে ঠাশ ঠাশ।
সূচনায় ভুল করলে তা শোধরাবার কোন সুযোগ ফিরে আসেনা।
শুরু থেকেই সূচনা করতে হয়। এদের এখন থেকে যদি আল্লাহর কুরআন ও রাসূলের সুন্নাহ দিতে পারি তাহলে হয়তো আর আমাদের এদের নিয়ে ভাবতে হবেনা । এখন হয়তো আমাদের একটু কষ্ট হবে ওদের লাইনে আনতে। পরে দেখবে আমাদের আর বলতে হবেনা ওরা নিজেরাই নিজেদের মত বেড়ে উঠবে।
কিন্তু আজ যদি আমরা স্নেহ বাৎসল্যের কারণে আমাদের সন্তানদের প্রতি এতটাই দুর্বল হয়ে যাই যে, শরীয়তের লঙ্গনগুলো আমরা হালকাভাবে নিই অথবা সংশোধনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব না করি তাহলে একদিন ওরা সত্যি বিগড়ে যাবে।
হাদীসে আছে,
প্রতিটি মানবশিশু ইসলাম বা ফিতরাতের উপর জন্মগ্রহন করে। পরে তার মা বাবাই তাকে ইহুদি বা খ্রিষ্টান কিংবা অগ্নিপূজক হিসাবে গড়ে তুলে।
(বুখারী ও মুসলিম)

আজ যদি আমাদের সন্তানরা আমাদের ভুলের জন্য বিপথে চলে যায় তাহলে কাল কেয়ামতের মাঠে তারা আমাদের বিরুদ্ধে আল্লাহর কাছে নালিশ দিবে।

পবিত্র কোরআনের সূরা হা-মীম সাজদার ২৯নং আয়াতে আছে কেয়ামতের দিন এরা বলবে,
‘হে আমাদের প্রতিপালক! যেসব জ্বীন ও মানুষ আমাদেরকে পথভ্রষ্ট করেছিলো তাদেরকে দেখিয়ে দিন, আমরা তাদেরকে পদদলিত করবো, যাতে তারা সর্বাধিক অপদস্থের অন্তর্ভুক্ত হয়’।

জেনেশুনে কেন নিজেদের ক্ষতি করবো? ভবিষ্যতে নিজেদের ভুলের জন্য যাতে আফসোস করতে না হয়, তাই যা করার এখনি করতে হবে।

-নাবিলা ভাবে কি সুন্দর একটা ইসলামিক অনুশাসনে চলা পরিবার। অথচ আমাদের দেশের আধুনিক মা বাবারা তাদের সন্তানদেরকে কোন জামাটায় কত সুন্দর মানাবে, কিভাবে টপস জিনসে তাকে ফিট লাগবে ওইসব দেখে, কিভাবে চুল খুলে রাখলে তার প্রতি মানুষ তাকাবে সেইটা নিয়ে ভাবে। কখনো ভাবেনা এতে তারা নিজেদের কতবড় ক্ষতি করছে!

নাবিলাদের পরিচিত এক মহিলার তিন মেয়ে। বড় মেয়ে এস এস সি দিবে, মেঝো টা জে এস সি আর ছোটটা ক্লাস টুতে পড়ে। উনারা স্বামী স্ত্রী মেয়েদের শখ করে সবসময় টপস জিনস পড়ায় শার্ট পড়ায়। সেদিন সেই ভদ্রমহিলা হেসে হেসে বলছিলো, রাস্তা দিয়ে যখন উনি মেয়েদের নিয়ে হেঁটে আসছিলেন তখন কয়েকটা ছেলে নাকি শুনিয়ে শুনিয়ে বলছিলো,, এজন্যই তো বলি বাজারে আমাদের শার্টের এত দাম কেন?
অবাক লাগলো এই মহিলার নির্লিপ্ততা দেখে, উনার মেয়েদের প্রকাশ্য অপমান করা হয়েছে অথচ এই মহিলা কেমন নির্দিধায় হেসে হেসে সেই কথার ব্যাখ্যা করছে। আল্লাহ জানে এইসব মানুষের কি হবে সেই কেয়ামতের দিনে! ভাবতে গিয়ে নাবিলার শরীর শিউরে উঠলো।

-সোমা নাবিলাকে বললো, ভাবি আজ দুনিয়ার হালচাল খারাপ এ পরিস্থিতিতে একটা বাচ্চাকে মানুষের মতো মানুষ করে তোলা সত্যি অনেক কষ্টকর৷ তারপরও আমাদের চেষ্টা করতে তো দোষ নেই। আমরা চেষ্টা করবো সফল না হলে তা আমাদের ব্যর্থতা মেনে নিবো।

আর একটা কথা ভাবি,
আপনি কিন্তু এখন বেশি বেশি করে করে আল্লাহর কাছে দোয়া করবেন যাতে আপনার সন্তানটা নেককা্র হয়ে দুনিয়াতে আসে। এ সময়টার ইবাদত আল্লাহর দরবারে খুব দ্রুত কবুল হয়। আর এতে সাওয়াব ও বেশি।

সবসময় এই দোয়াটা পড়বেন,

(রাব্বী হাবলী মিল্ লাদুনকা যুররিয়্যাতান্ ত্বাইয়্যিবাতাহ, ইন্না-কা সামী’উদ্ দু’আ—ই)
(হে প্রভু! আমাকে তুমি তোমার নিকট হতে সৎ বংশধর দান কর। নিশ্চয়ই তুমি প্রার্থনা কবুলকারী)

-আচ্ছা ভাবি আমার জন্য কি এখন এমন কোন ইবাদত নির্দিষ্ট আছে যেটা করতে হবে।
-এমন কোন আমল নির্দিষ্ট নেই। তবে তুমি বেশি বেশি করে কোরআন তেলাওয়াত করবে, দোয়া, জিকির, তাসবিহ, তাহলীল পাঠ করবে এবং বেশি বেশি নেকীর কাজ করবে।

-কোন কোন সূরা এসময় আমি বেশি পড়বো?

-আসলে সেরকম তো নির্দিষ্ট কোন সূরা নেই। তবে তুমি চাইলে সূরা আলে ইমরান, সূরা ইউসুফ, সূরা মারইয়াম, সূরা লোকমান, সূরা মুহাম্মদ ও সূরা ইবরাহীম পড়তে পারো।

-জাযাকাল্লাহু খায়রান। কতো কিছু জানার আছে আপনার কাছ থেকে। আপনার সাথক দেখা হয়ে নিজেকে খুব সৌভাগ্য হচ্ছে।

-বিনময়ে সোমা একটা মুচকি হাসি দিলো।

নাবিলা ভাবলো আসলে আমরা হাজারো মানুষের সাথে না মিশে বেকার সময় না কাটিয়ে যদি এরকম একজন মানুষের সাথে একঘন্টা কথা বলি তাহলে কতইনা উত্তম। এদের কাছ থেকে কত কি শিখার আছে। ইসহাক স্যার এতবড় একজন ডাক্তার অথচ তার বাসার পরিবেশটা ও কত সাধারণ!

খাওয়া দাওয়া শেষে রাত দশটার দিকে ওরা বাসায় ফিরে আসলো। মারজুকের বাসা আর ডাঃ ইসহাকের বাসা প্রায় কাছাকাছি। বাসা থেকে রাস্তায় বেরিয়ে মারজুক রিকশা ডাকতে নিলেই নাবিলা থামিয়ে দিয়ে বললো, রিকশা ডাকবেন না। এইটুকু রাস্তা চলুন হেটে যাই।
-মারজুক হেসে বললো,, বাব্বাহ্ এই রাতের বেলা হেটে হেটে প্রেম করার ইচ্ছে হলো নাকি?
-আজাইরা কথা বলবেন না।
-সত্য কথা তো কারো শুনতে ভালো লাগেনা।
-আচ্ছা ঠিকআছে আমার প্রেম করার ইচ্ছে হইছে। এবার খুশি তো?
-বাব্বাহ গোমড়ামুখোর মুখ দিয়ে কথা ফুটলো তাহলে।
-আপনি সব সময় আমায় গোমড়ামুখো বলেন কেন? আমি তো সবসময় কথা বলি!
-তুমি সবসময় কথা বলো? তাহলে বোধহয় আমি দেখিনা।
-নাবিলা মারজুককে আস্তে করে ধাক্বা দিয়ে সরিয়ে দিলো, আপনি সবসময় এমন করেন।
-বাব্বাহ নিজের বউয়ের সাথে একটু মজা করবো না তো কার সাথে করবো বলে হাসতে হাসতে মারজুক রাস্তার মাঝ দিয়ে হাটতে লাগলো
-হয়েছে এত কথা বলতে হবে না। দ্রুত হাঁটুন রাত বাড়ছে বলে নাবিলা মারজুককে রাস্তার মাঝখান থেকে টেনে এনে মারজুকের আঙুলের ফাঁকে আঙুল ঢুকিয়ে হাটা ধরলো………..
চলবে………..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here